সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
বাদল জেঠুর ভাণ্ডার

বাবার ফোনে বাদল জেঠুর মৃত্যুর খবর পেয়ে মানস একটা বড় ধাক্কা খেল।
বাদল জেঠু তার ছেলেবেলার এক মধুর আর উজ্জ্বল স্মৃতি। উনি বাবার অনেকদিনের বন্ধু। তারপর জেঠু চাকরি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ায় সম্পর্কে একটু ছেদ পড়েছিল। কিন্তু জেঠু চাকরি ছেড়ে আবার দেশে ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছেন জেনে বাবাই গরজ করে তাদের বাড়ির পাশের খালি প্লটটার সন্ধান তাঁকে দিয়েছিলেন, তদ্বির-তদারক করে বাড়িটাও করিয়ে দিয়েছিলেন।

তারপর একদিন বাদল জেঠুরা মালপত্র সহ এসে গেলেন। জেঠু, জেঠিমা ও ওঁদের ছেলে অরুণদা পরদিনই এলেন মানসদের সঙ্গে দেখা করতে। এমন বুদ্ধিদীপ্ত, হাসিখুশি পরিবার সচরাচর দেখা যায় না। জেঠুকে দেখলে মনে হবে বাবার চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু দু'মিনিট কথা বলেই তিনি সহজাতভাবে জ্যেষ্ঠত্বের সম্ভ্রম আদায় করে নেন।

"এবার তোমরা একদিন চলে এসো।" বলেই তিনি মানসের দিকে ফিরে বলেছিলেন, "জুনিয়র, বিশেষ করে তোমাকে বলছি। তবে কী, কিছুদিন পরে এলেই তোমার খুশির সরঞ্জাম বেশি পাবে। আমার অনেক জিনিসপত্র পার্সেল করে পাঠিয়েছি, আসতে এই মাসখানেক সময় লাগবে।"

মানস মাসখানেক পরেই জেঠুর কাছে গিয়েছিল আর তারপর থেকে জেঠুর বাড়ি তার একটা স্থায়ী আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে তখন বোধহয় সিক্স বা সেভেনে। তার থেকে বছর দুয়েকের বড় জেঠুর ছেলে অরুণদা কলকাতায় এসে এক আইসিএসই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। বিদেশ থেকে এলেও তার ব্যবহারে কোনও হামবড়াই ছিল না। তবে সে পড়াশোনাতেই ডুবে থাকত। জেঠুর মেয়ে সীমাদি কলেজে পড়ত, তাই অস্ট্রেলিয়াতেই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু ছুটিছাটায় আসত আর মানসের সঙ্গে নানান মজার মজার গল্প করত।

তবে মানসের মূল আকর্ষণ ছিলেন জেঠু। আর তাঁর ভাণ্ডার, অর্থাৎ জ্ঞান আর বই এই দুয়ের সীমাহীন পুঁজি। এত বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান মানস খুব কম লোকের দেখেছে। আর বিষয়গুলি সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিতেও তাঁর জুড়ি ছিল না। পেশায় তিনি ছিলেন জীবাণুতত্ত্ববিদ। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা ও গবেষণা করে যশ ও অর্থ দুইই অর্জন করেছিলেন। এর সাথে তাঁর ছিল বাগান করার শখ। সেটা করতে গিয়ে তিনি গার্ডেনিং ছাড়াও কৃষিবিদ্যা সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে পড়েন। ততদিনে সারা পৃথিবীতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের মাটি ও মানুষের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে অর্গানিক ফার্মিং বা জৈব কৃষি একটি বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে উঠে আসতে শুরু করেছে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক চর্চা ও প্রয়োগ শুরু হয়েছে। বাদল জেঠুও ব্যাপারটায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নিজেও নানা গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন।

এই কাজ করতে করতে হঠাৎ তাঁর মনে হয়, অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে কৃষিপ্রধান দেশ ভারতে এই জৈব কৃষির প্রয়োজন বেশি। আর সে বিষয়ে দেশকে সাহায্য করার জন্য তাঁর দেশে ফেরা দরকার। যা ভাবা তাই কাজ। চাকরি ছেড়ে, তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফিরে এলেন ভারতে।

"ভুল করছ, বাদলদা।" বাবা নিষেধ করেছিলেন, "অষ্ট্রেলিয়ায় জমি অঢেল, মানুষ কম। কৃষি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগও বেশি। এদেশে একখণ্ড জমিতে অনেকের মালিকানা, নানা ঝঞ্ঝাট, পরীক্ষার উপযুক্ত পরিবেশই পাবে না।"

জেঠু মৃদু হেসে বলেছিলেন, "কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করতেই তো চ্যালেঞ্জ বেশি। বাবা আমার নাম বাদল রেখেছিল অগ্নিযুগের বিপ্লবী বাদল গুপ্তের নাম অনুসারে। দেখি, যদি দেশের জন্য অল্পস্বল্প কিছু করে অন্তত তাঁর নখের যোগ্য হতে পারি।"

সুতরাং জেঠু খোঁজখবর শুরু করলেন আর কয়েক বছরের মধ্যে রানাঘাটের কাছে চাকদায় কিছুটা কৃষিজমি কিনে তার পাশে বাড়ি করলেন। অরুণদা তদ্দিনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হস্টেলে চলে গেছে। জেঠু আর জেঠিমা তাঁদের চাকদার বাড়িতে চলে গেলেন। জেঠিমা ইংরেজির টিচার ছিলেন, আশেপাশের একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরি নিলেন।

তার অনেক আগেই অবশ্য মানসের জেঠুর ওপর গভীর শ্রদ্ধা জন্মেছে। জেঠুর কাছে অজস্র বই ছিল — শুধু জ্ঞানবিজ্ঞানের নয়, ছোট ও বড়দের জন্য নানা ধরণের মন কাড়া গল্প-উপন্যাস। তার অধিকাংশই ইংরেজিতে। তবে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র মানসের তাতে অসুবিধা হত না।

"জীবাণু নিয়ে গবেষণা করেছ, তোমার ভয় হত না?" মানস জিগ্যেস করত, "যদি কোনও মারাত্মক রোগে ধরত?"
"না না, আমরা সবরকম সতর্কতা নিয়েই কাজ করি।" জেঠু বলতেন, "আর জীবাণুমাত্রেই ক্ষতিকর নয়। অনেক জীবাণু আছে নির্দোষ আর অনেকগুলো উপকারী। যেমন, আমাদের পেটে অনেক জীবাণু থাকে, যারা হজমে সাহায্য করে। আবার অনেক জীবাণু বাতাস থেকে নাইট্রোজেন নিয়ে যৌগ তৈরি করে মাটিকে দেয়, যার থেকে গাছপালার পুষ্টি হয়।"
"এমন একটা জীবাণু আবিস্কার করে তুমি জৈব কৃষিতে প্রয়োগ করবে, তাই না?" মানস উত্তেজনায় চোখ বড় বড় করে বলেছিল।
জেঠু মৃদু হেসে বলেছিলেন, "দুর, পৃথিবী কি আমার জন্য বসে আছে? অনেকদিন ধরেই এসব লোকে জানে, নতুন নতুন গবেষণাও চলছে। আমি বড়জোর কাজটাতে সামান্য সংযোজন করতে পারব।"
"আচ্ছা, জৈব কৃষিতে কি বেশি ফসল ফলে?"
জেঠু সামান্য ভেবে বলেছিলেন, "ঠিক তা নয়।"
"তবে এ নিয়ে অত মাতামাতি কেন?"
"তোমাকে একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই।" জেঠু বলেছিলেন, "জানো তো, মাটির নিচে জল আছে, যা তুলে আমরা প্রয়োজন মেটাই। আগে জল কুয়ো খুঁড়ে বালতি দিয়ে মেহনত করে তোলা হত। তারপর টিউবওয়েলে হাতপাম্পের সাহায্যে কম পরিশ্রমে বেশি জল তোলা শুরু হল। সব শেষে, বৈদ্যুতিক পাম্পে শারীরিক পরিশ্রম ছাড়াই অঢেল জল তোলা সম্ভব হল।

এতে সুবিধে হল ঠিকই। কিন্তু এই জলভাণ্ডার তো অফুরন্ত নয়। মূলত বৃষ্টির জলে এই ভাণ্ডারের পুষ্টি। কিন্ত জল তোলা যত সহজ হচ্ছে, তত বাড়ছে জলের ব্যবহার। আর সাথে সাথে অপচয়। ফলে মাটির তলার থেকে আমরা যত জল তুলছি ততটা পূরন হচ্ছে না। জলতল দিন দিন নেমে যাচ্ছে, অনেক গভীর অবধি না গিয়ে জল পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুদিনের মধ্যে অনেক জায়গায় মাটির নিচে জলই পাওয়া যাবে না।
তেমন, মাটিতে আছে ফসল ফলানোর পুষ্টি উপাদান বা নিউট্রিয়েন্ট। কিন্তু তা আছে মাত্র কয়েক ফুট পুরু ওপরের মাটিতে, তার নিচের মাটি মূলত নিস্ফলা পাথর। আমরা যখন চাষ করি, তখন ফসলের সঙ্গে এই পুষ্টি উপাদান তুলে নিই। উন্নত পদ্ধতিতে বেশি ফসল ফলালে ঐ পাম্পের সাহায্যে জল তোলার মতো উপাদানগুলো আরও তাড়াতাড়ি নিঃশেষ হয়। তাতে একদিকে বাড়ে খাদ্যের অপচয়। অন্যদিকে মাটির পুষ্টিভাণ্ডার তাড়াতাড়ি শূন্য হয়। এই পুষ্টি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে আবার পূর্ণ হয়, কিন্তু তা খুব ধীরে ধীরে। তাই তাড়াতাড়ি খুব বেশি ফসল ফলাতে গেলে মাটি কিছুদিন পরই পুষ্টি উপাদান হারিয়ে হয়ে পড়ে নিস্ফলা।

জৈব কৃষি একদিকে এই পুষ্টি উপাদানের উদ্দাম বেগে ক্ষয় হওয়ায় কিছুটা লাগাম লাগাতে পারে। আবার মাটির পক্ষে উপকারী যেসব কীট ও জীবাণু, তাদের পুষ্টির জন্য উপযোগী হচ্ছে জৈব উপাদান, রাসায়নিক সার নয়। তাই জৈব সার মাটির পুষ্টিভাণ্ডারের ঘাটতি পূরণে বেশি সাহায্য করতে পারে আর এভাবে জমিকে বাঁচিয়ে রেখে দীর্ঘদিন ফসল দিতে পারে।

এছাড়া তো আছেই রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে সেগুলো মানুষের দেহে চলে আসার ভয়ঙ্কর সব কুফল, যা জৈব কৃষিতে নেই।"
"তাহলে বলছ আমাদের দেশে শুধু জৈব পদ্ধতিতেই চাষ করা উচিত?"
"দ্যাখো, সেটা তো ঠিক করবে দেশের মানুষ আর সরকার। আসলে, কোনও ব্যাপারের অনেকগুলো দিক থাকে। জৈব কৃষিতে ফলন কম, কিন্তু খরচ বেশি। তাই ফসলের দামও বেশি। আমাদের গরিব দেশের অনেক মানুষের অত দাম দেবার ক্ষমতা নেই। তাই হয়তো আপাতত জৈব আর রাসায়নিক পদ্ধতির একটা মাঝামাঝি আপসরফা করতে হবে। অর্থাৎ দুই পদ্ধতিই থাকবে। কিন্তু ক্রমে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব চাষ বাড়াতে হবে ও তার পদ্ধতি গবেষণার মাধ্যমে উন্নততর করতে হবে।"

মানস অবাক হয়ে শুনত। তার বয়ঃসন্ধির মনের ওপর কথাগুলি গভীর ছাপ ফেলত। হয়তো সেটা তার আই আই টিতে ভর্তির সময় 'এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ফুড' ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ।

"সে কী, মানসবাবু! তুমি আই আই টি জয়েন্ট ক্লিয়ার করে শেষে আমার কথায় প্ররোচিত হয়ে কৃষিপ্রযুক্তির লাইনে গেলে? তোমার সামনে তো কত সম্ভাবনার দ্বার খোলা ছিল।"
"না, ঠিক তা নয়।" মানস কিন্তু-কিন্তু করে বলেছিল, "আসলে আমি তো তত ভালো র‍্যাঙ্ক পাইনি। আর এ ব্যাপারে ইন্টারেস্টও ছিল। তাই —"

জেঠুর আর একটা কথা খুব মনে পড়ে, "সঙ্গীত আর সাহিত্য মানুষকে শান্তি দেয়। মানস বাবু, যে পেশাতেই যাও না কেন, পারলে এ দুয়ের চর্চা রেখো।"

পেশাদার জীবনে এসে কথাটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে মানস। জীবনে আনন্দের সাথে দুঃখও আসে। তুমি যতই ভালো হও না কেন, সাফল্যের পাশে কখনও ব্যর্থতাও আসে। তখন আবার উঠে দাঁড়াবার জন্য মানস আশ্রয় নেয় তার প্রিয় গান ও বইয়ের জগতে। আর অশান্ত মন অচিরেই শান্তি খুঁজে পায়।

বাদল জেঠু নিজে ভালো গাইতে পারতেন। তেমন ভালো বাজাতে পারত সীমাদি। জেঠুর ঘরে অজস্র বইয়ের পাশে একটা দামি পিয়ানো ছিল, সীমাদি যখন আসত প্রায়ই মানস শুনতে পেত সে সুরের ঝঙ্কার তুলছে। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, অনেক ধরণের গানই শুনতে ভালোবাসতেন জেঠু। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় গান সম্ভবত ছিল "সমুখে শান্তি পারাবার"। তাঁর অনুরোধে সীমাদি কতবার যে সেটা বাজিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
তাঁর বইয়ের বহুবিধ সংগ্রহের মধ্যে ছিল অজস্র কিশোরপাঠ্য গল্পের বই। আরব্য উপন্যাস তাঁর খুব প্রিয় ছিল। বলতেন, "আজকাল তো তোমরা টিভিতে নানা সিরিয়াল দ্যাখো। কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম আদি সিরিয়াল হচ্ছে এই আরব্য উপন্যাস। রাজকন্যা শাহরজাদি জানে বিয়ের রাত পোহালেই তার নিষ্ঠুর বাদশা বর তাকে কোতল করবে। তাই সে প্রতি রাতে একটা গল্পের কিছুটা বলে একটা ইন্টারেস্টিং জায়গায় থেমে যেত, যাতে পুরোটা শোনার আগ্রহে বাদশা তাকে আরও একদিন বাঁচিয়ে রাখে। যেমন তুমি যাতে পরদিন দ্যাখো তাই সিরিয়ালগুলোও প্রতিদিন একটা ইন্টারেস্টিং জায়গায় গল্প থামায়। এভাবে হাজার এপিসোডের পর বাদশা রাজকন্যাকে ভালোবেসে ফেলল, আর মারতে পারল না।"

মানসের আরব্য উপন্যাসের প্রিয় গল্পের মধ্যে স্বভাবতই ছিল আলাদিন আর আলিবাবা। "আচ্ছা, ঐ উড়ন্ত গালিচা, উড়ন্ত কাঠের ঘোড়া — এসব কি শুধু গল্প লেখকদের কল্পনা, নাকি সত্যিই আগেকার কালে অমন কিছু ছিল?" জিগ্যেস করত মানস।

"ইতিহাস বা পুরাতত্ত্বে তেমন কোনও নিদর্শন মেলে না। আসলে, মানুষ প্রায়ই তার ইচ্ছেকে কল্পকাহিনীতে লিখে রাখে। আজ যা কল্পনা, একদিন হয়তো সেটা বাস্তবের রূপ নেবে। যেমন ধরো জুল ভার্নের 'নটিলাস' ডুবোজাহাজের গল্প, যা সাবমেরিন আবিস্কারের আগেই লেখা। পরে সাবমেরিন আবিস্কার হয়েছে। তখন তিনি যা যা বলেছিলেন তার কিছু মিলেছে, আবার অনেকটাই মেলেনি। কিন্তু পৃথিবী পাল্টাতে হলে মানুষের কল্পনাকে উদ্দাম হতে হয়। তাই ছোটদের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করতে পড়ার বইয়ের পাশাপাশি ভালো গল্পের বই পড়তেও উৎসাহ দেওয়া দরকার।"
"আর আলিবাবার ঐ চিচিং ফাঁক?"
শুনে জেঠুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠত। "আজকের দিনে সেটাও অসম্ভব নয়।" বলে তিনি মানসকে টেনে নিয়ে যেতেন একটা কম্পিউটার ডিসপ্লের সামনে।
"এগুলো হচ্ছে শব্দের ছাপ। অর্থাৎ বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণের সময় বাতাসে যে তরঙ্গ তৈরি হয়, একটা মাইক্রোফোনের সাহায্যে রেকর্ড করা তার অনুরূপ বৈদ্যুতিক তরঙ্গ। এখানে এগুলো বিশ্লেষণ করে কী কথা বলা হচ্ছে সেটা ধরার চেষ্টা হচ্ছে। সেটা বুঝে কম্পিউটার কোনও নির্দিষ্ট কাজ করতে পারে। ধরো, 'চিচিং ফাঁক' কথাটা একটা মাইক্রোফোন ক্যাচ করে একটা কম্পিউটারে পাঠিয়ে দিল। কম্পিউটার আবার সিগনালটা থেকে ঐ কথাটা উদ্ধার করে আউটপুট সিগনাল পাঠাল একটা মোটরকে চালু করে একটা দরজা খুলবার জন্য। আজ না হলেও কাল এটা সম্ভব হবে।"

সেটা বেশ ক'বছর আগের কথা। মানস জানে, আজ এই সম্ভাবনা কতটা সত্যি হয়েছে। আজ টিভি রিমোটে চ্যানেলের নাম বলে সেই চ্যানেল অন করা যায়। 'অ্যালেক্সা'কে ভয়েস কম্যান্ড দিয়ে তো কত কাজই করানো যায়।
তবে সেদিন সে শুধু চোখ বড়বড় করে কম্পিউটারের ডিসপ্লেতে দেখেছিল খালি কথা নয়, গানও কেমন উঁচুনিচু সিগনাল গ্রাফ হয়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। জেঠু একটা ডিসপ্লে দেখিয়ে বলেছিলেন, "এটা কী বলো তো?"
মানস হার মানার পর জেঠু মৃদু হেসে কম্পিউটার কীবোর্ডে একটা কী টিপেছিলেন। সাথে সাথে বেজে উঠেছিল পিয়ানোর ঝঙ্কার, সীমাদির বাজানো 'সমুখে শান্তি পারাবার'।
"আমি আজকাল পাশাপাশি স্পীচ অ্যান্ড মিউজিক প্রসেসিং নিয়েও একটু-আধটু গবেষণা শুরু করেছি। দেশবিদেশে অনেক কাজ হয়েছে, আপাতত তার সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করছি।"
"কিন্তু বাজনার থেকে তুমি কী বিশ্লেষণ করবে?"
"তার মূল কম্পনাঙ্ক বা পিচ, উপসুর অর্থাৎ ওভারটোন ও হার্মনিক, প্রাবল্য অর্থাৎ লাউডনেস — এগুলোর সুরের সাথে সাথে ওঠানামা করার প্যাটার্ন। আপাতত তার থেকে সঙ্গীতের সৌন্দর্য কীসের ওপর নির্ভর করে, সেটা বোঝাই আমার গবেষণার উদ্দেশ্য।"

তারপর তো বাদল জেঠু তাঁর চাকদার সেই খামার বাড়িতে চলে গেলেন। মানস তখন আই আই টি খড়্গপুরের কৃষিপ্রযুক্তির ছাত্র। তবে সে ফাঁক পেলেই ছুটিছাটায় এসে বাদল জেঠুর কাছে ছুটত। কিছু খেতজমি। তাতে মূলত শাকসব্জি আর ফুলের চাষ করতেন জেঠু। "এগুলো আমার ল্যাবরেটরির অংশ। আমার পরীক্ষালব্ধ ছোট ছোট তত্ত্ব এখানেই প্রয়োগ করে দেখি।" তিনি বলতেন।

তাঁর আসল পরীক্ষাগার অবশ্য ছিল খেত আর বাড়ির লাগোয়া একটি লম্বা ঘর। তাতে নানা রকম যন্ত্রপাতি, যা কৃষিপ্রযুক্তি পড়ার সুবাদে মানসের অনেকটাই জানা। শুধু তার একপাশে একটা খুপরি ঘর, যা সব সময় বন্ধ থাকত।
"এখানে আমার গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলি রাখা থাকে।" জেঠু বলেছিলেন।

"তুমি কি সন্দেহ করছ কেউ সেগুলো হাতাতে পারে?"
"আরে না, না। আমার কী এমন কাজ, যার জন্য ফরেন এজেন্টরা ব্যস্ত হয়ে উঠবে!" জেঠু হো হো করে হেসে বলেছিলেন, "আসলে, এসব জায়গায় ছিঁচকে চোরের উৎপাত। না বুঝে আমার দরকারি কোনও জিনিস নিয়ে চম্পট দিতে পারে। তাছাড়া, আমি তো নানা জীবাণুর কালচারও করি। সেসব কোনও অশিক্ষিত লোক নিয়ে গেলে তার থেকে মানুষের না হোক, গাছপালার মধ্যে রোগ ছড়াতে পারে।"
"কিন্তু তাহলে এই হালকা তালার ওপর ভরসা করা কি উচিত হচ্ছে?"
একটু ভেবে জেঠু বললেন, "উঁহু, দেখছি আরও ভালো কী সুরক্ষার ব্যবস্থা করা যায়।"
পরে সেই খুপরি ঘরটাকে ঢেলে সাজিয়ে তিনি একটা শক্তপোক্ত স্ট্রংরুম বানিয়েছিলেন।
জেঠুর ল্যাবে একটা জিনিস দেখে অবশ্য একটু অবাক লাগত — তাঁর পিয়ানো। জিগ্যেস করায় মৃদু হেসে বলেছিলেন, "আমি স্পীচ আর মিউজিক অ্যানালিসিসের রিসার্চ ছাড়িনি। এই কম্পিউটারে বসেই সেটা করি। তাছাড়া, যখন ক্লান্ত লাগে একটু বাজাই। অবসাদ মুহূর্তে দূর হয়ে যায়।"

লোকাল ট্রেন কাঁচরাপাড়া ছাড়িয়েছে। কিছুক্ষণ পর চাকদা, তারপর টোটোয় আর আধঘণ্টার মধ্যে বাদল জেঠুর বাড়ি। মানস একবার জেঠিমার সাথে দেখা করতে আসতই। কিন্তু কিছুটা তাড়াহুড়ো করে ছুটি নিয়ে পঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে আসতে হল এইজন্য যে জেঠিমা বাবাকে বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন, মানস যেন পারলে একটু তাড়াতাড়ি আসে। জেঠু নাকি কীসব নির্দেশ রেখে গেছেন, যা অরুণদা আর সীমাদির সাথে তারও দেখা দরকার। সীমাদি মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অস্ট্রেলিয়ার থেকে চলে এসেছে। অরুণদা বেঙ্গালুরুতে চাকরি করে, সে জেঠুর অসুস্থতার খবর পেয়েই এসেছিল। সবার সঙ্গে দেখা হবে, শুধু আসল মানুষটা নেই।

জেঠিমা খুব শক্ত মনের মানুষ। ইতিমধ্যেই আঘাতটা সামলে নিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে মানস জানতে পারল, জেঠুর নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হয়েছে।
"ওঁর জীবনে একটিমাত্র নেশা ছিল — কর্মজীবনে ঢোকার পর খুব চুরুট খেতে শুরু করেছিলেন। বলতেন, ওটা ছাড়া আমার বুদ্ধি খোলে না। পরে অবশ্য পরীক্ষায় শ্বাসযন্ত্রের দুর্বলতা ধরা পড়ায় ডাক্তারের নির্দেশে প্রিয় নেশাটা ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু তারপরও মাঝেমাঝেই সর্দিকাশি, হাঁপানির সমস্যায় ভুগতেন। মানুষটার তো নিজের খেয়াল থাকত না, আমিই সামলেসুমলে রাখতাম যাতে ঠাণ্ডা না লেগে যায়। কিন্তু এবারের শীতে কী যে হয়ে গেল —"
"থাক জেঠিমা, আপনার কষ্ট হচ্ছে, পরে বলবেন।" মানস বাধা দিল।
"না বাবা, বলতে যে আমাকে হবেই। ওঁর শেষ আদেশ আমাকে মানতেই হবে। অরুণ, সীমা আর তুমি, তিনজনকেই তার জন্য দরকার। ওরা আগেই এসেছে, শুধু তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।"
"বেশ জেঠিমা, বলুন তাহলে।" বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা জরুরি আর রহস্যঘন।

জেঠিমা অবিচল থেকে যা যা বললেন তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে এইঃ

বাদল জেঠু ইদানীং কিছু নতুন গবেষণা শুরু করেছিলেন। তাঁর জমি সংলগ্ন ল্যাবরেটরিরও অনেক উন্নতিসাধন করেছিলেন। কাছেপিঠের কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তিনি কিছু যৌথ কার্যসূচি গ্রহণ করেছিলেন। সেই সূত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র ও একজন প্রফেসার এখানে প্রায়ই আসতেন। যৌথভাবে নানা ছোটখাটো কাজ এগোচ্ছিল, যার অনেকটা মানসও জানত। কিন্তু কয়েক মাস যাবৎ একটা ব্যাপারে জেঠু খুব উত্তেজিত ছিলেন। বলতেন, "এতদিন যা যা করেছি, তা খুদকুঁড়ো। কিন্তু এই প্রজেক্টটায় যদি সফল হই তবে একটা কাজের মতো কাজ হবে।" পাগলের মতো কাজ করছিলেন। বারবার কার সাথে যেন ফোনে এ নিয়ে কথা বলতেন। প্রায়ই নাওয়া খাওয়াও ভুলে যেতেন।

কিন্তু মৃত্যুর কিছুদিন আগে একদিন তিনি খুব হতাশ ভঙ্গীতে জেঠিমাকে বলেছিলেন, "যা ভেবেছিলাম, হল না। সব হিসেব গোলমাল হয়ে গেল। কিন্তু কেন এমন হল?"
খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু দু-একদিনের মধ্যেই আবার তিনি শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, "বাদল চৌধুরী অত সহজে হার মানে না। সব পথের বাধা অতিক্রম করে আবার আমি উঠে দাঁড়াব।"
কিন্তু সে সুযোগ আর জেঠু পাননি। এর কিছুদিনের মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জ্বর, সর্দিকাশি থেকে স্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় তাঁকে কল্যাণী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে অনেক চেনা ডাক্তার। কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞদেরও ডেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা বললেন, "শ্বাসযন্ত্র আগেই দুর্বল ছিল, তাই এই ধাক্কাটা সামলানো সহজ নয়। কী হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না।"
এই অবস্থায় জেঠু একদিন জেঠিমাকে কাছে ডেকে বললেন, "কতগুলো জরুরি কথা শুনে রাখো। আমার যদি কিছু হয় —"
জেঠিমা বাধা দিয়ে বলেছিলেন, "অমন ভাবছ কেন?"
ম্লান হেসে জেঠু বলেছিলেন, "আমি একজন যোদ্ধা, শেষ বিন্দু শক্তি দিয়ে লড়ে যাব। কিন্তু বাস্তবকে মেনে নিতে হবে, বুঝতে পারছি শরীর আমার বশে নেই। তাই এই কথা ক'টি আমাকে বলতেই হবে, বাধা না দিয়ে শোনো।"
তিনি তারপর সংক্ষেপে বলেছিলেন, তাঁর কিছু হলে যেন অরুণ, সীমা ও মানসকে একত্রে ডাকা হয়। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তিনি জেঠিমার নামে লিখে রেখেছেন, উইল তাঁর সলিসিটারের কাছে আছে। শুধু কিছু ব্যতিক্রম আছে, যা ঐ উইলেই লেখা আছে। এছাড়া তিনি বিশেষভাবে বলেছিলেন যে তাঁর ল্যাবরেটরিতে যেন বিদ্যুৎ সংযোগ অবিচ্ছিন্ন থাকে, অন্তত স্ট্রংরুমে। তারপর তিনি জেঠিমাকে মুখে মুখে একটা ছড়া বলে সেটা লিখে তাঁকে দেখাতে বলেন। দেখে সন্তুষ্ট হয়ে বলেন, "ওরা এলে তিনজনকেই এটা অবশ্যই দেখিও। এটা ভীষণ জরুরি।"
তার তিনদিন পরই তিনি মারা যান।

তাঁর ল্যাবরেটরিতে দু-একবার রাতে চুরির চেষ্টা হওয়ায় তিনি ইলেকট্রনিক সুরক্ষা আর সিকিউরিটি গার্ডের ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে বাড়তি সুরক্ষা ছিল এই ল্যাবের একপ্রান্তে ঐ স্ট্রংরুমের অংশের জন্য। সেখানে যে কী থাকত জেঠু ছাড়া কেউ জানে না। তবে কিছু যন্ত্র আছে যা বেশ পাওয়ার টানে। ল্যাবের মূল গেট কী করে খুলতে হয়, সিকিউরিটি গার্ডদের জানা। কিন্তু স্ট্রংরুমটি শুধু জেঠু খুলতে পারতেন। তাঁর মৃত্যুর পর অরুণদা, সীমাদির উপস্থিতিতে অনেক চেষ্টা করেও তার দরজা খোলার কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি। না আছে তার তালা, না কম্বিনেশন লক। এক ভাঙা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু ভীষণ শক্ত সেই দরজা, ভাঙা সহজ নয়। আর ভাঙতে গেলে ভেতরের যন্ত্রপাতিরও ক্ষতি হতে পারে। সলিসিটারের কাছে রাখা উইল থেকে জানা গেল, তিনি জেঠিমার হাতেই সবকিছু ছেড়ে গেছেন। জেঠিমা তাঁর বিবেচনামতো যা ইচ্ছে ছেলেমেয়েদের দেবেন। শুধু তাঁর ল্যাবরেটরির দায় কার ওপর বর্তাবে, সেটা তাঁর দেওয়া দু লাইনের ঐ নির্দেশের অর্থভেদ করতে পারলে জানা যাবে।
জেঠিমা এবার সেই দু লাইনের ছড়াটা ওদের দেখালেনঃ

"নরম কলে সঠিক স্বরে দুয়ার খোলার ডাক।
ইচ্ছে, তোমার রত্নগুহার দরজা চিচিং ফাঁক।"

"আমার কথা শেষ। এবার তোমরা এই হেঁয়ালির অর্থ ভাবো।" জেঠিমা থামলেন।
"তাহলে তো এখন সবাই মিলে ল্যাবরেটরিতে যেতে হয়।" মানস বলল।
"যেও, কিন্তু দুপুরের খাওয়ার পর।" জেঠিমার গলায় আদেশের সুর। অগত্যা!
খেতে বসে মানস বলল, "কিছু মনে করবেন না, জেঠিমা — আপনি বলেছিলেন জেঠুর কথা শুনে আপনি ছড়াটা লিখে নিয়েছিলেন। কিন্তু —"
"যে চিরকুটটা তোমাকে দেখালাম, ওটা অরুণের হাতে লেখা। চোখ বটে তোমার! আসলে, অরিজিনাল চিরকুটটা আমার কাছ থেকে কীভাবে যেন হারিয়ে যায়। আমার কথা শুনে অরুণ ওটা আবার লিখে দিল। মানে, ওর হাতের লেখা তো আমার চেয়ে ভালো, তাই —"
"আচ্ছা, এই দুই বারের শ্রুতিলিখনের ফলে —"
"একচুলও এধার-ওধার হয়নি। এটা ওঁর শেষ নির্দেশ, তার প্রতিটি অক্ষর আমার মনে আছে।"
"কিন্তু চিরকুটটা হারাল কীভাবে?"
"তাই তো ভাবছি। আমার পার্সেই রেখেছিলাম, কিন্তু পরে খুঁজে পেলাম না। এত বড় ভুল কীভাবে হল?"

তিনজন মিলে ল্যাবরেটরিতে গিয়ে দেখল নানা যন্ত্রপাতি, গবেষণার উপকরণ ছড়ানো। কিছু কাগজপত্রও আছে। অরুণ ও সীমার উপস্থিতিতে সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল মানস। তারপর বলল, "এগুলো সাধারণ হিসেবনিকেশ আর রিসার্চের কিছু সাধারণ বিবরণ সংক্রান্ত। কোনও খুঁটিনাটি নেই, যার থেকে তিনি শেষ অবধি কী করছিলেন জানা যায় অথবা সেই কাজ এগিয়ে নেওয়া যায়।"
"হয়তো কল্যাণী ইউনিভার্সিটির যাঁরা বাবার সহযোগিতা করছিলেন, তাঁদের কাছে ডিটেইলসগুলো আছে?" অরুণদা বলল।
"হতে পারে।" মানস বলল, "ওঁদের নম্বর আছে?"
"হ্যাঁ। বাবার মৃত্যুর পর সবাই এসে দেখা করে গিয়েছিলেন। দেখি।"
কিছুক্ষণ ফোনাফুনির পর তাঁদের সাথে যোগাযোগ হল। প্রফেসার দেবল বাগচি আর দুই স্টুডেন্ট অতনু বোস আর শুভ্রা বসাক — প্রত্যেকেই দু'দিন পর আসতে রাজি হলেন।
মানসও তাই বলল সেদিনের মতো কলকাতায় বাড়ি ফিরে ঐদিন সকাল সকাল চলে আসবে।
বেরিয়ে আসার আগে চোখে পড়ল, জেঠুর পিয়ানো। সেটা এই ল্যাবেই রাখা আছে। মনে পড়ল, জেঠু মিউজিক প্রসেসিং নিয়েও রিসার্চ করছিলেন। একটু তাকাতেই আরও চোখে পড়ল, তার ওপর রাখা একটা প্রায় জরাজীর্ণ খাতা।
"বাবার নোটেশনের খাতা।" সীমাদি ধরা গলায় বলল, "বাবা আমার পিয়ানোয় বাজানো রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে খুব ভালোবাসত। শুনতে শুনতে চোখ বুঁজে তন্ময় হয়ে যেত। কিন্তু আমি আবার ওয়েস্টার্ন মিউজিকে বেশি স্বচ্ছন্দ, তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাতে মাঝে মাঝে ভুল করে ফেলতাম। তাই বাবা তাঁর প্রিয় গানগুলি অনেক কষ্ট করে পিয়ানোয় বাজানোর জন্য নোটেশন করে ঐ খাতায় লিখে রাখতেন। প্রথমেই —"
"সমুখে শান্তি পারাবার।" আত্মগতভাবে উচ্চারণ করল মানস, "ঐ গানটা তিনি সবচেয়ে ভালোবাসতেন।"
মানস বেরিয়ে আসার সময় সীমাদি বলল, "ঐ হেঁয়ালিটা নিয়ে ভাবিস, ভাই।"
"আমি ভাবছি, তোমরাও ভাবো।"

নরম কল — সঠিক স্বর — রত্নগুহা —
ঘুমের মধ্যেও শব্দগুলো মানসের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এক সময় মনে হল, চিচিং ফাঁক আর রত্নগুহা তো আলিবাবার গল্পের। তার সঙ্গে জেঠুর কী সম্পর্ক? ইচ্ছে — সত্যিই জেঠুর ইচ্ছে ছিল এমন একটা যন্ত্র বানানোর, যার সামনে 'চিচিং ফাঁক' বললেই দরজা খুলে যাবে।
তাহলে কি জেঠুর স্ট্রংরুমের দরজা খোলার সঙ্কেত আছে এই দু লাইনের মধ্যে? মনে হতেই মানস মাঝরাতে বিছানার ওপর উঠে বসল। কিন্তু অনেক ভেবেও বাকি শব্দগুলোর কোনও মানে করতে পারল না।

দু'দিন পর তাড়াতাড়ি বেরিয়ে মানস সকাল সকালই চাকদায় বাদল জেঠুর বাড়ি পৌঁছে গেল। একটু পর কল্যাণী থেকে প্রফেসার দেবল তাঁর ছাত্র অতনু আর শুভ্রাকে নিয়ে উপস্থিত হলেন।
দেবল বাবু কিছু কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন। সেগুলো দেখিয়ে বললেন, "আমার কাছে এগুলোই আছে।"
মানস আগ্রহভরে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করল। তারপর একটু হতাশ হয়ে বলল, "এই অবধি তো আমিও জানি। কিন্তু জেঠু শুনলাম তারপরেও কী একটা রিসার্চ প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিলেন, যা নিয়ে উনি খুব আশাবাদী ছিলেন।"
"হ্যাঁ, একদিন স্যারকে ডেকে নিয়ে গেলেন এই বলে যে একটা নতুন জিনিস খুঁজে পেয়েছেন।" উত্তেজিতভাবে বলল শুভ্রা।
"ঠিক। কিন্তু তখনই কার যেন একটা ফোন এল। আর উনি গম্ভীর মুখে বললেন — সরি দেবল, একটা জরুরি ব্যাপার এসে গেছে। আমি আপনার সাথে কাল আলোচনা করব। পরদিন আমি ব্যস্ত ছিলাম। তারপর যেদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট হল, তার আগে তো উনি অসুস্থই হয়ে পড়লেন।" দুঃখিতভাবে বললেন দেবল।
"ভেরি স্যাড, তাহলে ওঁর শেষ কাজটা বোধহয় হারিয়েই গেল। আর এতদিন যা হয়েছে —"
"সেগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব তো আমাকেই নিতে হবে।"
"বেশ। শুধু যদি যে পেপার্সগুলো দেখালেন তার একটা করে ফোটোকপি আমাকে দেন —"
"অবশ্যই।"
অতনু এই সময় বলে উঠল, "বাদল স্যার কিন্তু কিছু কাগজপত্র তাঁর স্ট্রংরুমে রাখতেন। ওটা খোলা হয়েছে?"
"না, ওটা খোলার চাবিটা পাওয়া যাচ্ছে না। দেখি চেষ্টা করে। পেলে আপনাদের জানাব।"

ওঁরা চলে গেলে চারজন চিন্তিত মুখে বসে রইল। এক সময় মানস বলল, "তোমরা ধাঁধাটার সম্বন্ধে কিছু ভেবে পেলে?"
এ ওর মুখের দিকে চাইছে দেখে মানস বলল, "দ্বিতীয় লাইনটার থেকে আমার মনে হল, জেঠু এই ধাঁধায় বলে যেতে চাইছেন কীভাবে তাঁর স্ট্রংরুমের দরজা খোলা যায়। আর সেটা প্রথম লাইনটায় আছে। কিন্তু তারপর আর কিছু মাথায় ঢুকছে না।"
"ঠিক বলেছিস, এটা তো আমাদের মনে হয়নি।" বলল সীমাদি।
"কিন্তু কীভাবে স্ট্রংরুম খোলা যায়, সেটা তো বাবা মাকেই বলে যেতে পারতেন। এত হেঁয়ালির কী দরকার ছিল?" বলল অরুণদা।
"তোর বাবা একটু রহস্যপ্রিয় ছিল। তাছাড়া, যে তার ল্যাবরেটরির দায়িত্ব পাবে তার বুদ্ধিও সে একটু যাচাই করা দরকার মনে করেছিল।" বললেন জেঠিমা।
"আরও একটা কারণ ছিল।" মানস বলল, "জেঠু সম্ভবত কাউকে সন্দেহ করেছিলেন। সরাসরি স্ট্রংরুম খোলার কৌশল বলে গেলে সেটা জেনে সে-ই আগে সেখান থেকে কাজের জিনিসগুলি হাতাত। আর সেই চেষ্টাও হয়েছিল। জেঠিমার হাতের লেখা চিরকুটটা হারায়নি, চুরি গিয়েছিল।"
"কী সর্বনাশ, তাহলে তো সে খুব কাছের লোক।" সীমাদি বলল।
"কিন্তু মনে হয়, সেও ধাঁধার উত্তর বের করতে পারেনি। তাই স্ট্রংরুম এখনও বন্ধই রয়ে গেছে।"

সবার কপালে চিন্তার রেখা। মধ্যাহ্নভোজের পর ঠিক হল, কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর সবাই ল্যাবে যাবে। মানস রাতটা চাকদাতেই থেকে যাবে।
সন্ধ্যা নাগাদ সবাই ল্যাবে জড়ো হল। প্রথমে অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করল, ঘরে কোনও লুকোনো সুইচ আছে কিনা। মানসের কী মনে হল, সে খুব আশা নিয়ে আরও কী যেন খুঁজল, কিন্তু হতাশ হল।
"কী খুঁজছিস?" অরুণদা জিগ্যেস করল।
"একটা লুকোনো মাইক্রোফোন, যাতে চিচিং ফাঁক বললেই আলিবাবার রত্নগুহার দরজা খুলে যাবে। কিন্তু পেলাম না।"
সবার মুখে চিন্তার ছাপ। তখন মানস বলল, "জেঠু বলতেন, সাহিত্য আর সঙ্গীত মানুষকে শান্তি দেয়। আমরা কেউই তো তেমন গান গাইতে পারি না। কিন্তু পিয়ানোটা আছে, সীমাদি বাজায়ও ভালো। কিছুক্ষণ শুনলে সবার মনের ব্যথাবেদনা জুড়িয়ে একটা শান্তির প্রলেপ পড়বে। তারপর নয় আবার মানে খোঁজা যাবে।"
"তুই এত সুন্দর করে বললি।" অরুণদা বলল, "নে দিদি, একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজা। বাবা তোর হাতের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে খুব ভালোবাসত।"
সীমাদি ছলছল চোখে পিয়ানোর সামনে বসে বাজাতে শুরু করল। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। যখন বাজনা থামল, সবাই স্তব্ধ।
"খুব ভালো বাজিয়েছ, সীমাদি।" মানস বলল।
"দুর, কদ্দিন পর বাজালাম, দু-চার জায়গায় ভুল হয়ে গেছে।" সীমাদি লজ্জিত ভঙ্গীতে বলল।
"তা হলেও, তুই মূল ভাবটা ঠিকই ফুটিয়ে তুলেছিস। তোর বাবা শুনলে খুশি হত।" বললেন জেঠিমা।
তারপর একটু বিষণ্ণ স্বরে বললেন, "কিছুদিন আগে উনি পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন। তখন আমি কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলাম — পিয়ানো কথাটা কীসের থেকে এসেছে, জানো? ইটালিয়ান Piano e forte থেকে। তার মানে হচ্ছে, যে হার্প যন্ত্রে কোমল আর চড়া দুটো সুরই বাজানো যায়। পিয়ানো মানে হচ্ছে সফট বা কোমল আর ফর্ট মানে হচ্ছে চড়া। শুনে উনি বললেন — ইন্টারেস্টিং তো, পিয়ানো মানে সফট!" "পিয়ানো মানে সফট, আর জেঠু সেটা জানত! জেঠিমা, তুমি এতক্ষণ বলোনি!" মানস উত্তেজিতভাবে বলে উঠল।
"কেন, তাতে কী হয়েছে?" জেঠিমা অবাক।
"নরম কল মানে সফট ইনস্ট্রুমেন্ট, অর্থাৎ পিয়ানো।"
"তাই তো, সত্যিই তো। তাহলে —"
"নরম কলে সঠিক স্বরে দুয়ার খোলার ডাক — দুয়ার খোলার ডাক, দুয়ার খোলার ডাক —"
মানসের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সীমাদি বলল, "খোলো খোলো দ্বার, রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে। এটাও ছিল বাবার একটা প্রিয় গান।"
"তাহলে — চটপট পিয়ানোয় বসে যাও। দেখা যাক এবার কী হয়।"

ঘরে টান টান উত্তেজনা। সীমাদি ঘামছে। হাত মুছে বসে পিয়ানোয় ঝঙ্কার তুলল। সত্যি, হাত বটে সীমাদির। ঘর সঙ্গীতের মূর্ছনায় এক অচেনা আবেগে ভরে গেল। আর সবাই যেন কোনও আশ্চর্য কিছু ঘটবার প্রত্যাশায় স্থাণু হয়ে রইল।
গান সুন্দরভাবে শেষ হল, কিন্তু কিছু তো ঘটল না! সবার মুখে আশাভঙ্গের বেদনা। এমন সময় অরুণদা বলল, "দিদি, ফাটাফাটি বাজিয়েছিস। কিন্তু প্রথম দুটো লাইন — সুর না কাটলেও একটু যেন অন্য রকম শোনাল।"
সীমাদি লজ্জিতভাবে বলল, "চর্চা না থাকলে যা হয়। সব জায়গায় মূল সুরটা এক্স্যাক্ট মনে নেই।"
"তুই স্বরলিপির খাতাটা খোল। ওটা দেখে বাজা।" জেঠিমা আদেশের সুরে বললেন।
"হ্যাঁ সীমাদি — নরম কলে সঠিক স্বরে, মানে স্বরলিপি অনুসারে। আর একবার ট্রাই নাও।" বলল মানস।
"দেখি আছে কিনা।" সীমাদি খাতাটা সামনে নিয়ে বসল। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এক সময় তার মুখে খুশির আলো, "পেয়েছি।" তারপর সে আবার শুরু করল।
আর প্রথম লাইন দুয়েক বাজাবার পরই সেই মিরাকলটা ঘটল। একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ করে স্ট্রংরুমের দরজা খুলতে লাগল। সম্পূর্ণ খুলে তবে তা স্থির হল।

"দাঁড়াও, এক্ষুণি যেও না।"
জেঠিমার কথায় আগুয়ান ওরা তিনজন থমকে দাঁড়াল। তিনি আবার বললেন, "ঘরটা অনেক দিন খোলা হয়নি, আগে কিছুক্ষণ বাইরের হাওয়া ঢুকতে দাও। আর দরজা যাতে নিজে থেকে বন্ধ হয়ে না যায়, তার ব্যবস্থা করে ঢোকো।"
সেই অনুযায়ী ওরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা ভারী পাথর এনে দরজা বন্ধ হওয়ার পথ আটকাল। তারপর ঢুকতে যাবে, জেঠিমা আবার বাধা দিলেন।
"আগে পা দেবে মানস। উনিই ওকে সেই অধিকার দিয়ে গেছেন।"
"সে কী, আমরা তো সবাই মিলে ধাঁধাটার সমাধান করলাম।" মানস প্রতিবাদ করল।
"না। উনি তোমার হাতেই ওঁর গবেষণার উত্তরাধিকার তুলে দিতে চেয়েছেন। 'ইচ্ছে, তোমার রত্নগুহার দরজা চিচিং ফাঁক' — এখানে 'ইচ্ছে' শব্দটার অর্থ ওঁর ইচ্ছে নয়, তোমার নাম অর্থাৎ মানস। তোমাকেই উনি ওঁর গবেষণার যোগ্য উত্তরাধিকারী মনে করতেন।"
"নে, ঢোক।" অরুণদা সস্নেহে মানসের কাঁধে হাত রেখে বলল।

বাদল জেঠুর ভাণ্ডার

ভেতরে একটা বিশেষ ধরণের ফ্রিজ, আরও কিছু যন্ত্রপাতি। একদিকে একটা আলমারি। আর সামনে টেবিলে রাখা একটা চিঠি। জেঠুর লেখা।

"শরীর ভালো না, তাই সংক্ষেপে সারছি। আমার বয়স হয়েছে। যদি কিছু হয়ে যায়, তাই আমার গবেষণা যাতে থেমে না যায় তাই কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেবলের সঙ্গে যৌথভাবে কাজগুলো করার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা কৃষির ব্যাপারে অনেক ছোটখাটো উদ্ভাবন করেছি। যেমন, সহজলভ্য কিছু প্রাকৃতিক সার ব্যবহার করেই মাটিতে কেঁচো প্রভৃতি কীট যারা মাটির উর্বরতা বাড়ায় তাদের বৃদ্ধি করার পদ্ধতি।

তবে আমার নিজস্ব গবেষণা ছিল মাটির আশ্রয়ে থাকা জীবাণুদের নিয়ে। এই কাজ করতে করতে আমি একটি জীবাণুর এক মিউট্যান্ট আবিস্কার করি, যারা সংখ্যায় খুব কম কিন্তু অনেক বেশি উপকারী। ঠিকমতো কালচার করে সংখ্যা বাড়িয়ে মাটিতে ছেড়ে দিলে তারা ফসলের ক্ষতিকারক কীটদের নিয়ন্ত্রণ করে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার অবান্তর করে তুলবে। শেষ অবধি একটা কাজের কাজ করতে চলেছি ভেবে খুব আনন্দ হয়েছিল।
কিন্তু পরীক্ষা করতে গিয়ে একটা ধাক্কা খেলাম। অল্প কিছু স্যাম্পল নিয়ে ছোট একখণ্ড জমিতে প্রথম যে পরীক্ষা করলাম, তাতে সফলতা এল না। কিছুদিন মনমরা হয়ে রইলাম — এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে চৈতন্যের উদয় হল — অন্তর্ঘাত। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আমার স্লাইড নষ্ট করেছে!

তখন থেকে আমি খুব সাবধান হলাম। ব্যাকটেরিয়া কালচারের বাকি অংশ যত্ন করে স্ট্রংরুমের ডিপ ফ্রিজারে সুরক্ষিত করে ঘরের দরজায় এক বিশেষ লকিং সিস্টেম লাগালাম। সত্যি বলতে এই সিস্টেমটা আগেই তৈরি করে রেখেছিলাম, একরকম শখ হিসেবে। এবার সেটাকে কাজে লাগাবার সময় এল।

মানসের নিশ্চয়ই আলিবাবার গুহার দরজা খোলার 'চিচিং ফাঁক' মন্ত্র নিয়ে ওর সঙ্গে আমার আলোচনার কথা মনে আছে। আজকাল ভয়েস কম্যান্ড দিয়ে কোনও সিস্টেম অ্যাকটিভেট করা যায়। আমি নিজে মিউজিক প্রসেসিং নিয়েও কিছু গবেষণা করছিলাম। আমার লক্ষ্য ছিল কম্পিউটারকে কথা নয়, এক একটা বিশেষ সুর চিনিয়ে তাই দিয়ে বিভিন্ন সিস্টেম অ্যাকটিভেট করা। অনেকটা এগিয়েওছিলাম। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাকে কাজে লাগাবার মতো বিশ্বাসযোগ্য সিস্টেম এখনও তৈরি করে উঠতে পারিনি। তাই আমি নির্ভরযোগ্য একটা সিস্টেম বানালাম, যা ফেইল প্রুফ।

এই পিয়ানোর কীবোর্ডটা এখন কার্যত একটা কম্পিউটারের বাড়তি একটা কীবোর্ড। কীবোর্ডে এক একটা কী টিপলে যেমন এ, বি, সি, ওয়ান, টু প্রভৃতি অক্ষরের কোড কম্পিউটারে যায়, তেমন পিয়ানোর প্রতিটি কী টিপলে ঐ কম্পিউটার তাকে আলাদা এক একটা কোড হিসেবে চিনতে পারে। এবার কেউ যদি স্বরলিপি ধরে কোনও গান বা সুর বাজায়, তবে সেই কী-সিকোয়েন্সটা কম্পিউটার মেমরিতে জমা হবে। নির্দিষ্ট একটা সুরের জন্য আগে স্টোর করা সিকোয়েন্সের সাথে এই সিকোয়েন্সটা মিললে তবেই দরজা খোলার মোটর অ্যাকটিভেটেড হবে।

এই সময় আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। কীভাবে, ঠিক বুঝলাম না। সবরকম সাবধানতা নেওয়া সত্ত্বেও বুকে সংক্রমণ হল। তবে যখন বুঝলাম যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে, তখন মনে হল সব অরুণ, সীমা আর মানসকে জানিয়ে রাখা দরকার। হ্যাঁ, বিশেষ করে মানসকে, কারণ আমার ধারণা আমার অবর্তমানে সে-ই আমার অসমাপ্ত কাজকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে পারবে। আমার বিশ্বাস, আমার কথায় অনুপ্রাণিত হয়েই সে অনেক বেশি অর্থকরী পেশার হাতছানি উপেক্ষা করে কৃষিপ্রযুক্তির সাথে যুক্ত হয়ে রয়েছে।

দরজা খোলার সূত্রটা আমি স্পষ্ট করে ঊষাকে বলে যেতে পারিনি। কারণ আমার বিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতক কেউ খুব কাছাকাছি আছে। তাহলে সে তোমরা পৌঁছোবার আগেই দরজা খুলে মূল স্লাইডটা হাতাবে। তাই হেঁয়ালির আশ্রয়। তবে আমার প্রত্যয় ছিল, তোমরা মিলে এই হেঁয়ালির উত্তর বের করে দরজা খুলে ঠিক জায়গায় পৌঁছোতে পারবে।

আমার সমস্ত সম্পত্তি ঊষার নামে লিখে দিয়েছি। অরুণ, সীমা তোমরা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, তোমাদের কোনও অভাব নেই। তবু মা তোমাদের উপযুক্ত উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না। শুধু আমি এক কোটি টাকা মানসের জন্য বরাদ্দ করে যাচ্ছি, আমার কাজকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিতে যে গবেষণা করতে হবে তাতে খরচের জন্য। পাশের আলমারিতে সমস্ত ডকুমেন্ট রাখা আছে, যাতে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে কতটা কাজ আমি করেছি আর এরপরে সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য মানস কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।

আর হ্যাঁ, একবার দরজা খোলা হয়ে গেলে প্রত্যেকবার ঐ সুর বাজিয়ে তা খুলতে হবে না। পিয়ানোর কোনও সাদা কী টিপলে দরজা খুলবে আর কালো কী টিপলে বন্ধ হবে।
এই চিঠি তোমাদের হাতে পৌঁছনো মানে আমি আর নেই। ভালো থেকো। সবার ভালো হোক।"

কিছুক্ষণ থমথমে নীরবতা। তারপর অরুণদা এসে মানসের কাঁধে হাত রেখে বলল, "বাবা তোকে অনেক দায়িত্ব দিয়ে গেছে। এই ল্যাবরেটরির দেখাশোনা ও বিকাশের দায় এখন তোর। তবে তুই তো বাংলার বাইরে এক জায়গায় আছিস। তোর যদি অসুবিধা থাকে —"
"থাকলেও তা ম্যানেজ করব। এটা যে জেঠুর আদেশ। তবে তোমরা আগে ভেবে দেখো। জেঠু যাই বলুন, যদি তোমাদের আপত্তি থাকে —"
"আমাদের কারও আপত্তি নেই। বরং এই প্রচেষ্টায় আমরাও বাড়তি অর্থসাহায্য করতে রাজি আছি। এই কাজটা বাবার মানসপুত্র বলেই নয়। এই চেষ্টা সফল হলে ভারতের মানুষের বিরাট উপকার হবে। উপকার হবে পরিবেশের।" বলল সীমাদি।
"ঠিক আছে। এখন অনেক রাত। কাল সকালে মানসের সাথে আলোচনা করা যাবে কীভাবে ও এগোবে। প্রথমত, সেই গুরুত্বপূর্ণ স্লাইডটা কীভাবে সাবধানে নিয়ে যাবে।"
"আর দেবল বাবুদের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের এই ডেভেলপমেন্টের কথা বলতে হবে।" বলল মানস।

পরদিন সকালে মানস জানাল সে কয়েক দিনের মধ্যে স্লাইড ও ডকুমেন্টগুলি নিয়ে যাবার ব্যবস্থা বন্দোবস্ত করে আবার আসবে। দেবল বাবুকে ফোনে খবর দিতে তিনি উত্তেজিতভাবে বললেন, মানস যেদিন আসবে সেদিন তিনিও ছাত্রদের নিয়ে আসবেন। স্বচক্ষে তিনি জেঠুর সেই স্ট্রংরুম ও তার ব্যাপারস্যাপার দেখতে চান।
সীমাদি এই সময় বলল, "বাবা কী অন্তর্ঘাতের কথা বলেছিলেন —"
মানস উদাসভাবে বলল, "সে যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর ওসব খোঁজ করে কী লাভ?" তারপর সেদিনের খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে বলল, "জেঠিমা, এই খবরটা দেখেছ?"
একটা চাঞ্চল্যকর খুনের আসামি সেদিন ধরা পড়েছে, মৃতেরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। জেঠিমা দুঃখিতভাবে বললেন, "হ্যাঁ, দেখেছি। বুঝতে পারি না, কী করে মানুষের এমন প্রবৃত্তি হয় — আপনজনের শরীরে ছুরি চালাতে দ্বিধা হয় না।।"
"সবাই বলছে, এমন মানুষের ফাঁসি হওয়া উচিত।"
"না, না।" জেঠিমা তাড়াতাড়ি বললেন, "চোখের বদলে চোখ, এটা একটা সমাজের নীতি হওয়া উচিত না। অন্যায়কারীর উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার, কিন্তু মৃত্যু নয়। শাস্তির উদ্দেশ্য সংশোধন। মৃত্যুতে সে সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়।"
মানস কেন যেন জেঠিমাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল। তারপর সেদিনের মতো বিদায় নিল।

মানসের দিন সাতেক সময় লাগল ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত করতে। সে যেদিন ঠাণ্ডাযন্ত্রওয়ালা একটা বিশেষ ধরণের ভ্যান নিয়ে হাজির হল, দেখল দেবল বাবু তাঁর ছাত্রদের নিয়ে আগেই উপস্থিত। মানসকে দেখে তিনি উত্তেজিতভাবে বললেন, "বাদল বাবুর আবিস্কারের সেই স্লাইডটা একবার হাতে নিয়ে দেখতে পারি কি?"
"নিশ্চয়ই।" মানস ভেতরে গিয়ে একটা প্যাকেট দেবল বাবুর হাতে দিয়ে বলল, "এই নিন।"
সেটা নিয়ে দেখতে দেখতে প্রফেসারের চোখ উত্তেজনায় বিস্ফারিত হয়ে উঠল। হঠাৎ তিনি বিষম জোরে কাশতে লাগলেন।
"কী হল, অসুস্থ বোধ করছেন নাকি?" মানস উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।
"ন-না, এই একগ্লাস জল পেলে—"
মানস তাড়াতাড়ি জল আনতে ছুটল। একটু সময় লাগল তার। এসে দেখে, প্রফেসার অনেকটাই সুস্থ হয়েছেন। তবে জলটা খেলেন। তারপর মানসের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলোচনার পর বিদায় নিলেন।
"এসব জিনিস, চোখে দেখেও তৃপ্তি। যাক, যাঁর জিনিস তিনি তো এর বেশি কিছু করার অধিকার আমাদের দেননি। আপনি সফল হোন। বিরাট খবর শোনার অপেক্ষায় রইলাম।"

মানস লুধিয়ানা ফিরে এসেছে। জেঠুর কথামতো নির্দিষ্ট জীবাণুবিদের সাথে যোগাযোগ করে সে জেঠুর আরব্ধ কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। শিগগিরই ভালো খবরের আশা করছে।
সীমাদি অস্ট্রেলিয়া ফিরে গেছে। অরুণদা তার কাজের জায়গায় ফিরে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আবার মাসখানেকের ছুটি নিয়ে ফিরে এসেছে। চাকদার ব্যাপারগুলো ধীরে ধীরে গুটিয়ে সে জেঠিমাকে নিয়ে যাবে। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতির দেখভালের জন্য দুজনকে নিয়োগ করা হয়েছে। পরে মানস বুঝেশুনে আরও লোক নিয়োগ করে পরবর্তী কার্যসূচি চালু করবে।
মানস মাঝে মাঝেই ভিডিও কল করে সবার কুশল সংবাদ নেয়। দেবল বাবুর খবরও নেয়। একদিন শুনল, তিনি অসুস্থ। লম্বা ছুটি নিয়েছেন, কারও সাথে দেখা করেন না। কিন্তু কী রোগ কেউ জানে না, বললেন জেঠিমা।
"আমি জানি — এক দুরারোগ্য চর্মরোগ। হার্পিস গোছের, কিন্তু তার চেয়েও ছ্যাঁচড়া। এর চিকিৎসা ভারতে হয় না বললেই চলে। ভদ্রলোক দীর্ঘদিন যন্ত্রণাভোগ করবেন। স্টেরয়েড ব্যবহার করে সাময়িক রিলিফ পাবেন, কিন্তু রোগ ঘুরে ঘুরে আসবে।"
জেঠিমা অবাক, "তুমি কী করে জানলে?"
"কারণ, আমিই তো জেঠুর মিউট্যান্টের স্লাইড বলে ঐ রোগের জীবাণুর স্লাইডটা ওঁকে দেখতে দিয়েছিলাম।"
"কী সর্বনাশ — একটু হাতে নিয়েই —"
"না, একটু হাতে নিলে কিছু হত না। কিন্তু দুর্বুদ্ধি — উনি ছল করে আমায় দূরে পাঠিয়ে দিয়ে ওটা হাতসাফাই করে অন্য একটা যাহোক তাহোক স্লাইড ফেরত দিলেন। আমি জানতাম, উনি এই কুকাজটি করবেন। তাই ফাঁদ পেতেছিলাম। তারপর ঐ স্লাইড নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়েই ওঁর বিপত্তিটা হল।"
"তুমি কী করে জানলে যে উনি,—"
"কারণ, উনি আগেও একবার এই কুকাজ করেছেন। জেঠু ওঁকে তাঁর পরীক্ষা করার স্লাইডটা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করে দিয়েছিলেন। উনি সেটা বদলে জেঠুকে দিয়েছিলেন অন্য স্লাইড — আমার ধারণা, নিউমিনোকক্কাই জীবাণুর স্লাইড। উনি অনুমান করেছিলেন এবার ঐ স্লাইড ঘেঁটে জেঠু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হবেন আর তাঁর যেহেতু শ্বাসরোগ রয়েইছে তাই তিনি আর সেরে উঠবেন না। তখন জেঠুর আবিস্কারের পুরো স্বত্বভোগী হবেন তিনিই।
কিন্তু তিনি বিফল হলেন। কারণ, ঐ স্লাইডে শুধু ছোট পরীক্ষা করার মতো পরিমাণে জীবাণু ছিল। পরীক্ষার পর কালচার করে বাড়াবার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। তাই আরও জীবাণু পাবার আশায় দেবল বাবুকে জেঠুর স্ট্রংরুম খোলার অপেক্ষায় থাকতে হল। নিশ্চয়ই তিনি জেঠুর বলা সূত্রটা আপনাকে লিখে নিতে দেখেছিলেন। কিন্তু আপনার পার্স থেকে কাগজের টুকরোটা হাতিয়ে লাভ হয়নি, উনি সূত্রটার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারলেন না।"
"কী সর্বনাশ — লোকটা তাহলে জেনেশুনে ওঁকে —"
"হ্যাঁ, বলতে পারো উনি জেঠুকে খুন করেছেন। ওঁর চোখ দেখেই আমার মনে হয়েছিল, ওটা অপরাধীর চোখ। তারপর যখন স্লাইডটা হাতে নিয়ে উনি আমাকে ছল করে সরিয়ে দিলেন, তখন নিশ্চিত হলাম।
কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই, যাতে তাঁকে আইনের সাহায্যে শাস্তি দেওয়া যায়। তা বলে ওঁকে তো একেবারে ছেড়ে দেওয়া যায় না। তাই সেদিন তোমাকে জিগ্যেস করে নিলাম খুনির মৃত্যুদণ্ড তুমি পছন্দ করো কিনা। যখন জানলাম যে তোমার আর আমার মত একই, তখন —"
"ওকে অপেক্ষাকৃত লঘুদণ্ড দিলে, নইলে হয়তো স্লাইডে প্রাণঘাতী কোনও জীবাণু রাখার কথা ভাবতে? ভাগ্যিস কথাটা বলেছিলাম! কিন্তু তুমি কী করে জানলে যে ও স্লাইডটা স্টুডেন্টদের হাতে দেবে না?"
"তাহলে তো ওঁর অপরাধ ধরা পড়ে যেত। যাক, এখন নিজের পাপের জন্য তিলে তিলে যন্ত্রণা ভোগ করুন। এদিকে কিন্তু ভালো খবর আছে — আমরা এগোচ্ছি। শিগগিরই গর্ব করার মতো কিছু হবে।"

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা