সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
একলা

বহুদিন পর সমুকা আসছেন শুনে তাপসের খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু তিনি এলে তাঁকে দেখে সে একটু সংশয়ে পড়ল।

তাপস সমুকার বাড়িতে ভাড়াটে কাম কেয়ারটেকার। সমুকা অর্থাৎ সমরেশ হালদার বহুদিনের আমেরিকাবাসী, বছরে-দু'বছরে হয়তো একবার দেশে আসেন। এমন মানুষেরা সাধারণত সল্ট লেক বা নিউ টাউনে একটা বড় ফ্ল্যাট করে নেন। কিন্তু সমুকা উত্তরপাড়ার এই বাড়িতে ছোটবেলা, কলেজবেলা কাটিয়েছেন। বিদেশে থিতু হয়েও তিনি এর টান কাটাতে পারেননি। প্রচুর টাকা ঢেলে বাড়িটার সংস্কার করিয়ে নিয়েছেন। দেশে ফিরলে এখানেই ওঠেন, তারপর ঘুরেফিরে সবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সারেন। সমুকা বাবা-মা'র একমাত্র সন্তান। তাঁদের মৃত্যুর পর কয়েক বছর বাড়িটা অরক্ষিতই পড়ে ছিল। দেখভালের অভাবে বাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখে সমুকার বন্ধু রঞ্জন কাকু বলেছিলেন, "সমু, তোর তো টাকার অভাব নেই। তুই একজন কেয়ারটেকার রাখ।"
"সে একজন কেয়ারটেকার কাম ভাড়াটে রাখাই যায়। কিন্তু লোকটার তো বিশ্বাসী হওয়া চাই।"
"সেটা আমার ওপর ছেড়ে দে।"
রঞ্জন কাকুর ভরসা পেয়ে সমুকা তাঁর কাছে চাবি রেখে আমেরিকা ফিরে গিয়েছিলেন। আর রঞ্জন কাকু একটু খোঁজখবর করে জোগাড় করেছিলেন তাপসকে। তাপস কাছাকাছি একটা হাসপাতালে প্যাথলজি বিভাগে কাজ করে, সেই সূত্রে রঞ্জন কাকুর সঙ্গে তার আলাপ। হাসপাতালে অনলস ও সৎ কর্মী হিসেবে তাপসের খুব সুনাম। তবে সে উলুবেড়িয়ার থেকে আসে। ট্রেন-বাস বদলে এতটা পথ আসতে মাঝে মাঝে দেরি হয়ে যায়। তাই সে কাছাকাছি অল্প ভাড়ায় বা পেয়িং গেস্টে থাকার জায়গা খুঁজছিল। খবর পেয়ে রঞ্জন কাকু তাকে সমুকার বাড়ির দেখভালের প্রস্তাবটা দিলেন।
আমেরিকাবাসীর বাড়ি শুনে তাপস প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু রঞ্জন কাকু হোয়াটসঅ্যাপে সমুকার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার পর তার ভয় দূর হল। "ওসব স্যার-ফ্যার ছাড়, আমাকে সমুকা বলবি।" উনিই বলেছিলেন।
"কিন্তু এত বড় বাড়ি, আমাকে কত দিতে হবে?" ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করেছিল তাপস।
"দিবি কী রে, আমিই বরং তোকে দেব। তুই বাড়িঘর মাঝে মাঝে একটু সাফ-সুতরো করে রাখবি, গ্যাজেটগুলোর দিকে একটু নজর রাখবি। তার জন্য কত খরচ আমাকে জানাবি, আমি মানি ট্রান্সফার করে দেব।"
তাপস ভয়ে ভয়ে বলেছিল, "আর তোমরা যখন আসবে আমি নয় ক'দিন উলুবেড়িয়া চলে যাব।"
"পাগল নাকি! তুই না থাকলে আমরা তো আতান্তরে পড়ে যাব। বাড়ির কিছু সমস্যা হলে, গাড়ি ভাড়া করতে হলে, ডাক্তার-বদ্যির দরকার হলে –"
"সে তুমি ভেবো না সমুকা, আমি সব করে দেব।"
"আর এতবড় বাড়ি, থাকার সমস্যা কী? একতলায় তুই থাকবি। আমাদের সব জিনিসপত্র দোতলায়, আমরা ওখানেই থাকব।"

এভাবে ব্যাপারটা ঠিক হওয়ার পরও তাপসের যেটুকু সংশয় ছিল, ক'মাস পরে সমুকা এলে সেটুকুও দূর হয়ে গেল। মানুষটা দিলখোলা। বিদ্যেবুদ্ধির জাহাজ, তবু যে কোনও মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে তাকে মুহূর্তে আপন করে নেন। "বা:, তুই তো বাড়িটার ভোল পাল্টে দিয়েছিস!" তাপসের পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন।
কাকিমা অতটা খোলামেলা না হলেও হেসে তাপসকে বলেছিলেন, "কেয়ারটেকারের কথা শুনে আমি কিন্তু প্রথমে একটু আপত্তি করেছিলাম। জোয়ান ছেলে, হয়তো বন্ধুবান্ধব এনে আড্ডা মেরে ঘরদোর নোংরা করে রাখবে। কিন্তু ও বলল, রঞ্জন আমার বহুদিনের বন্ধু। ও যাকে বাছবে, আমি চোখ বুঁজে তার ওপর ভরসা করতে পারি। তা, আমি তোমাকে দেখে এখন বুঝছি রঞ্জনদা যোগ্য লোককেই এনেছেন।"
তাপস একটু কুঁকড়ে গিয়ে বলেছিল, "কাকিমা, এখানে আমি আছি আর রঞ্জন কাকু মাঝে মাঝে দেখাশোনা করতে আসেন। তাছাড়া আর কেউ –"
"আসবে না কেন? তুই ভাড়াটে, তোর আত্মীয়বন্ধুদের আনা তোর হক। তবে কাকিমা যা বলছিল, বেশি লোক জড়ো হয়ে পার্টিফার্টি বা হৈহুল্লোড় করলে, আমাদের ওখানেও তো দেখেছি, ঘরবাড়ি আবর্জনায় ভরে যায়। তাই –"
"না সমুকা, তেমন কিছু আমি হতে দেব না।" তাপস দৃঢ়ভাবে বলেছিল।
সমুকার মেয়ে পিয়ালির অবশ্য প্রথম প্রথম একটু উন্নাসিক ভাব ছিল। আমেরিকায় জন্মেছে আর বড় হয়েছে, ওখানেই কলেজে যাচ্ছে। বাংলা ও তার মানুষজন সম্বন্ধে তাই তার এক সহজাত সংশয়। কিন্তু একটা ব্যাপারের পর সেই দেওয়ালটুকু ভেঙে গেল।
একদিন সকালে কাকিমা তাপসের কাছে এসে কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, "মেয়েটার কাল রাত থেকে জ্বর এসেছে। প্যারাসিটামলে ক'ঘণ্টা কমার পর জ্বর ফিরে আসছে। একটা গাড়ি ডেকে দেবে, তাপস? ওকে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।"
"দরকার হলে সে ব্যবস্থা করা যাবে।" তাপস একটু দ্বিধা করে বলল, " কিন্তু একটা কথা বলি। তার আগে বোনকে আমাদের হাসপাতালে একবার নিয়ে আসবেন? একজন ডাক্তার আছেন, খুব ভালো। উনি একবার দেখুন, দরকার হলে উনিই কলকাতা পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই ভালো।" কাকিমার সংশয় আর পিয়ালীর আপত্তি উপেক্ষা করে সমুকা সবাইকে তাপসের হাসপাতালে টেনে নিয়ে গেলেন।
ডাক্তারটির নাম সম্পৎকুমার, কিন্তু ঝরঝরে বাংলা বলেন। সব শুনে ও রোগীকে দেখে তিনি বললেন, "বিদেশ থেকে এলে সাধারণত পেটের সমস্যা বেশি হয়। আপনারা সেসব সাবধানতা নিয়েছেন তো?"
"হ্যাঁ। ফুটোনো জল বা ব্র‍্যান্ডেড কম্পানির বটলড ওয়াটার খাই। কাঁচা খাবার, স্যালাড এড়িয়ে চলি আর –"
"ওতেই হবে। তাহলে সম্ভবত পিয়ালির সমস্যাটা পেটের নয়। আপনারা যেখান থেকে আসছেন সেখানকার আর্দ্রতা এখানকার থেকে অনেক কম। তাই ওর একটা 'হিউমিডিটি শক' হয়েছে। এটা নিজের থেকেই সেরে যাবে। তদ্দিন কোনও কড়া ওষুধের দরকার নেই। প্যারাসিটামল ছাড়া আমি একটা ওষুধ দিচ্ছি আর কিছু ব্যবস্থাপত্র। মেনে চলুক, ও দু'দিনে ঠিক হয়ে যাবে।"
গেলও তাই। কাকিমা এসে তাপসের হাত দুটো চেপে ধরেছিলেন। পিয়ালী একটু দূরে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। তাপস একটু হেসে বলেছিল, "তাহলে মফস্বলের ডাক্তারের ওষুধেও অসুখ সারে?"
সমুকা বলেছিলেন, "সত্যিই তোর এই সম্পৎকুমার – আর কী পরিস্কার বাংলা বলেন!"
"উনি ছোটবেলার থেকেই কলকাতাবাসী। এখান থেকেই এমবিবিএস করেছেন। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন, তারপর ইংল্যান্ডে গিয়ে এমডি করে শেষে ওখানেই এক হাসপাতালে চাকরি নিয়েছেন।"
"সে কী, তাহলে উনি এখানে?" পিয়ালী অবাক।
"সেটাই তো মজার। ইদানীং উনি আট মাস ইংল্যান্ডে আর চার মাস পশ্চিমবঙ্গে থাকছেন। এই চার মাস কোনও ছোটখাটো হাসপাতালে কাজ করেন নামমাত্র সম্মানমূল্যে।"
"কিন্তু কেন?"
"উনি বলেন, ভারতে এত সংখ্যায় এত বিচিত্র রোগী যে এখানে চিকিৎসা না করলে একজন ডাক্তারের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু উনি যা বলেন না তা হচ্ছে উনি বাংলা ও তার মানুষকে খুব ভালোবাসেন।"
"কিন্তু তুমি তো আগে বলোনি –"
"যে উনি বিলেত ফেরত? আমি দেখছিলাম, খাঁটি ভারতীয় ডাক্তারদের ওপর তোমাদের ভরসা কতটুকু। জানি, বাইরের থেকে তোমরা পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্বন্ধে ভয়ানক অনেক কিছু শোনো। সেগুলো পুরো মিথ্যে নয়। কিন্তু পাশাপাশি অনেক নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীও রয়েছেন, যাদের জন্য মানুষ এখনও অন্তত কিছুটা সুচিকিৎসা পায়।"

সমুকা সাধারণত বছরে একবার দেশে আসতেন। তবে কাকিমা সব সময়ে সঙ্গে থাকতেন না। তাঁর চাকরির যা ধরণ তাতে লম্বা ছুটি নেওয়া সহজ নয়। আর পিয়ালী তো কলেজে উঠে পড়াশোনা নিয়ে এত ব্যস্ত যে এদিকে আর আসতেই পারল না। সমুকা অবশ্য আসেন আর সময় পেলেই তাপসের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করেন।
"পারলে একবার ঘুরে যা।" সমুকা বলেছিলেন, "ভিসা আর টিকিট করে চলে আয়, তারপরের দায়িত্ব আমার। একটা অন্যরকমের দেশ। পারলে সবারই একবার দেখে যাওয়া উচিত। তোর দৃষ্টিভঙ্গীই হয়তো বদলে যাবে।"
"হ্যাঁ কাকু, কূপমণ্ডুক হয়ে থাকা অর্থহীন। তুমি যখন আছ, একটু সুবিধে হলে নিশ্চয়ই যাব। আচ্ছা, তোমাদের ওখান থেকে গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়ন কত দূরে?"
"কাছেই। অতল গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়নের ভয়াল সৌন্দর্যের পৃথিবীতে তুলনা নেই। তবে গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়ন, ইয়েলোস্টোন পার্ক, নায়াগারার মতো বিশালদের বাদ দিলেও ওখানে অনেক ছোটখাটো দর্শনীয় আছে, যাদের খ্যাতি বিশ্বজোড়া নয় কিন্তু তারা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। আজকাল আমি ঘুরেফিরে সেইসব জায়গায়ই যাই।"
তারপর যখনই সময় হয়েছে, সমুকা বর্ণনা করেছেন ওরকম কিছু দর্শনীয়ের কথা, যা ইন্টারনেটের হেডলাইন নয়। উনি আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে থাকেন বলে সেখানকার কথাই তাঁর বর্ণনায় বেশি চলে আসে। যেমন ফিনিক্স থেকে গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়ন যাওয়ার পথের কিছু দূরের এক বিশাল উল্কা গহ্বর 'ব্যারিংগার ক্রেটার', যা বর্তমান যুগে দৃশ্যমান সবচেয়ে বড় উল্কা গহ্বর। প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর আগে তিন লক্ষ টনের এক উল্কা এখানে আছড়ে পড়ে প্রাণী জগতে মহা বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছিল। তারপর আছে সান ফ্রান্সিসকোর কাছে প্রশান্ত মহাসাগর উপকূল বরাবর দৃষ্টিনন্দন 'হাফ মুন বে'। এই অঞ্চলে আছে অজস্র সুন্দর ছোটবড় 'বীচ', যেখানে প্রায় সারা বছর দর্শনার্থীর ভিড়। আমেরিকার অধিকাংশ এলাকাই হয় খুব ঠাণ্ডা নয় খুব গরম। এই 'হাফ মুন বে' এলাকায় কিন্তু সারা বছর কমনীয় তাপমাত্রা। গরম নেই, মাঝে মাঝে একটু ঠাণ্ডা পড়ে। তাই এখানে অধিকাংশ বাড়িতে এসি বা ফ্যান অনুপস্থিত, শুধু কেউ কেউ রুম হিটিংয়ের ব্যবস্থা রাখেন।
তবে সমুকার নাকি সবচেয়ে মন কেড়েছে অ্যারিজোনার 'ওয়াইল্ড ওয়েস্ট' বলে পরিচিত যুগের জোড়া শহর প্রেসকট আর জেরোম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকায় নেমে পড়েছিল দলে দলে শ্বেত ভাগ্যান্বেষী বা 'প্রসপেক্টর'। তাদের লক্ষ্য ছিল অনাবিস্কৃত ভূখণ্ডে কোথায় সোনা, রুপো, তামা প্রভৃতি দামি ধাতু আছে তা আবিস্কার করা। তখন প্রায়ই নিয়ম ছিল 'Finder is the taker', যে পায় খনি ও খনিজ তার। অবশ্যই সে শ্বেত ইউরোপীয় হলে তবেই। এভাবে কতজন রাতারাতি মহাধনী হয়ে গেছে। আবার এই দখলদারি নিয়ে চলেছে নিজেদের মধ্যে আর স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মরণপণ লড়াই। এই নৈরাজ্যে স্থানীয় শাসকদের বাহুবলই ছিল আইন। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যখন স্টিম ইঞ্জিনের রেলগাড়ি সবে চালু হচ্ছে আর পেট্রলের গাড়ি দূর স্বপ্ন, তখন মূল যান ছিল ঘোড়া। এইসব ঘোড়ার চালক আর তত্ত্বাবধায়কদের বলা হত 'কাউবয়'। বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বুকে প্রায় বন্য ঘোড়াদের পোষ মানানো এই মানুষগুলি হয়ে উঠত বেপরোয়া জঙ্গী। এই 'ওয়াইল্ড ওয়েস্ট' আর 'কাউবয়' নিয়ে তাই অজস্র হলিউড মুভি তৈরি হয়েছে। তার এক বড় অংশের শ্যুটিং হয়েছে এই প্রেসকটে। প্রেসকটের কাছে ছিল রুপোর খনি আর জেরোমের কাছে তামার। তাদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই দুই শহর। তারপর ধীরে ধীরে খনিজ ফুরোল, সঙ্গে সঙ্গে ফুরোল এই দুই শহরের রমরমা। প্রেসকট এখন শৈলশহর হিসেবে টিঁকে রয়েছে। আর পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত প্রায় জনশূন্য জেরোম টিঁকে রয়েছে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। দুই শহরেই নানা মিউজিয়াম অতীতের স্মৃতি তুলে ধরে। প্রেসকটের আরেক ট্রাডিশন হচ্ছে 'রোডিও' অর্থাৎ কাউবয়দের ঘোড়ার পিঠে নানা কসরত দেখাবার ও ছুটন্ত ঘোড়া ল্যাসো ছুঁড়ে ধরার প্রতিযোগিতা।
তাপস মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত। শেষে সমুকা বলতেন, "এখন সেই অরাজকতা আর নেই। কিন্তু ঐ দুরন্ত অতীতের জের হিসেবে আমেরিকান রক্তে লড়াকু মনোভাব আর নির্দ্বিধায় এগিয়ে যাওয়ার ট্র‍্যাডিশনটা ঢুকে গেছে। এটা না থাকলে বিশ্বজয়ী হওয়া যায় না।"
তারপর উজ্জ্বল চোখে বলতেন, "আমাদেরও অমন মরণজয়ী সাহসে ভর করে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই আমরা আবার বিশ্বের সেরা দেশগুলির সমকক্ষ হব। বুঝেছ বালক?"
তাপস ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাত।

তারপর আবার ক'বছর কেটেছে। সমুকার কোম্পানির এখন খুব নাম। আর শোনা যায়, সমুকা খুব দায়িত্বপূর্ণ কাজে যুক্ত। তাঁর যেমন সুনাম তেমন ব্যস্ততা। ক'বছর ভারতে আসতে পারেননি। তাপসকে হোয়াটসঅ্যাপ কলও তেমন করে উঠতে পারেন না। কিন্তু তিনি শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাপস কোনও মেরামতির বিল পাঠালে সেটা তক্ষুণি মিটিয়ে দেন।
তাপসও অবশ্য এখন দেখ-না-দেখ বিল পাঠায় না। ছোটখাটো কিছু খরচ নিজেই দিয়ে দেয়। হলই বা নামকাওয়াস্তের কেয়ারটেকার, দিনের পর দিন এমন সুন্দর একটা বাড়িতে একেবারে বিনিপয়সায় থাকতে তার অস্বস্তি হয়।
সমুকা বলেছিলেন ২০২০তে আসবেন। কিন্তু তখন হঠাৎ বিশ্বজুড়ে কোভিড অতিমারী শুরু হল। ট্রেন, বাস, প্লেন সব বন্ধ। যখন সেসব খুলল, তখনও নিতান্ত দরকার ছাড়া কেউ ভয়ে যাতায়াত করে না। তার ওপর সমুকার আই-টি কোম্পানির অতিমারীর সময় কাজ অনেক বেড়ে গেল। তিনি ঘরে বসেই দিনরাত কাজ করেন। কবে যে আবার ভারতে আসতে পারবেন ঠিক নেই।
তাপসদের হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসা হত। অজস্র রোগী, কিছু দুঃখজনক মৃত্যু। তার মধ্যেই সাহসে ভর করে কাজ করে গেছে তাপস। তারও বার দুই কোভিড হয়েছে, তবে রোগ খুব জোরালো থাবা বসাতে পারেনি।
আমেরিকায় কোভিডে অজস্র মানুষের মৃত্যু হলেও সমুকারা সবাই সুস্থ আছেন জেনে সে নিশ্চিন্ত হয়েছে।

তারপর সময়ের নিয়মে অতিমারীর প্রকোপ শিথিল হয়েছে। যাতায়াত আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে খবরে বা ব্যক্তিগত সূত্রে সে জানতে পারল, আমেরিকার অর্থনীতি একটু টালমাটাল। অনেকের চাকরি চলে যাচ্ছে। তাপসের অনেক কমবয়সি আত্মীয়বন্ধু আমেরিকায় থাকে। তাদের কারও চাকরি নেই, চিন্তায় আছে এবার ভিসাও চলে যাবে বলে। অন্যরাও উদ্বিগ্ন অফিসে অনেকে ছাঁটাই হয়েছে, এবার হয়তো তার পালা। যেসব নামি কোম্পানিতে কেউ একবার ঢুকলে ভাবে প্রায় আজীবন কাজ করবে, সেসব জায়গার থেকেও মন্দার জন্য কর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে।
সমুকা অবশ্য এ নিয়ে কিছু বলেননি। তাপসও জিগ্যেস করেনি। অত উঁচু জায়গায় যিনি পৌঁছে গেছেন, তিনি তো নিশ্চয়ই এসব ঝড়ঝাপটার ঊর্ধ্বে।
এমন সময় তাপস সমুকার মেসেজ পেল, তিনি ক'দিন পর কলকাতা আসছেন। একটা বিশেষ কাজে এবার হয়তো একটু বেশিদিন থাকতে হবে। তবে তাপস যেন ব্যস্ত না হয়। উনি উত্তরপাড়ায় অল্পদিনই থাকবেন, তখনও বেশি কিছুর দরকার হবে না।
তাই কী হয়! তাপস খুশিমনেই তাই মালিকের আসার আগে বাড়িঘর তকতকে ঝকঝকে করে রাখল। আর তার গাড়ির জন্য স্থানীয় কার রেন্টালে বলে রাখল। তারপর উত্তেজনা বুকে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন সমুকা আসেন।

সমুকা নির্দিষ্ট দিনে এলেন। তবে প্লেন দেরি করায় একটু বেশি রাতে বাড়ি পৌঁছোলেন। তাপস জেগেই ছিল, তাকে দেখে যথারীতি "হে-ল্লো" বলে হ্যান্ডশেক করলেন। তারপর বললেন, "অনেকক্ষণ তোকে জাগিয়ে রেখেছি। যা, এবার শুয়ে পড়।"
"আমি একটু দেরিতেই শুই। তাছাড়া, আজ তুমি আমার সঙ্গেই কোনওমতে দুটি খাবে। এত রাতে আর কিছু করতে পারিনি। কাল থেকে বাজার, রান্নার লোক সব ব্যবস্থা করে দেব।"
"সে কী রে, তুই আমার জন্য এখনও না খেয়ে বসে আছিস!" সমুকার চোখ যেন ছলছল করে উঠল, "তুই আমায় খুব ভালোবাসিস, না রে?"
"কে জানে! তবে আমি তোমাকে কাকা বললেও নিজের বাবা-জ্যাঠার মতোই শ্রদ্ধা করি। যাও, স্নান করে সাফসুতরো হয়ে আসো।"
খেতে বসে সমুকা অনেক গল্প করলেন। তাপস জিগ্যেস করল, "তোমরা সবাই ভালো আছ? তুমি, কাকিমা, পিয়ালী?"
"হ্যাঁ রে, হ্যাঁ। সব ঠিক আছে।" সমুকা যেন একটু বেশি জোর দিয়েই বলে উঠলেন।
কিন্তু তাপসের কেন যেন মনে হল, সব ঠিক নেই। আর উনি একটু অন্যমনস্ক, সবসময় কী ভেবে চলেছেন। কে জানে, হয়তো এমন কাজ নিয়ে এসেছেন যা খুব ভজকট।

পরদিন রাতে সমুকা বললেন, "আমি কাল কলকাতা যাব। কাজকর্ম সেরে ফিরতে অন্তত দু'সপ্তাহ লাগবে মনে হচ্ছে।"
"তুষারের ফোন নম্বর তো তোমার কাছে আছে। আমি ওকে বলে রেখেছি, যখন দরকার হয় গাড়ি চেয়ে নিও।" তাপস বলল।
পরদিন সকালে সমুকা বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় তাপস বলল, "ফেরার আগে তুষারকে জানিও। ও তুমি যেখানে থাকবে সেখান থেকে তোমায় নিয়ে আসবে।"
"শিওর।" বলে সমুকা গাড়িতে উঠলেন।

তারপর দিন ছয়েক কেটেছে। সমুকা সাধারণত এদিক-ওদিক গেলে তাপসকে নিয়মিত মেসেজ দেন। কখনও হয়তো ফোনও করেন। এবার কিন্তু তিনি একদম চুপ। হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজে ভীষণ ব্যস্ত।
ইতিমধ্যে তাপসও ডিউটির পর এক খুশির ব্যস্ততায় মেতে রয়েছে। অনেক চেষ্টার পর সে পাড়ার শিশু ও কিশোরদের নিয়ে একটা বিচিত্রানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। এক সন্ধেয় স্থানীয় এক স্কুল প্রাঙ্গণে এই অনুষ্ঠান হবে। টিভির প্রোগ্রাম আর ছোটদের টিউশন-কোচিংয়ের দাপটে এ ধরণের অনুষ্ঠান তো আজকাল প্রায় হারিয়েই গেছে। তাপস আর তার বন্ধু মানবেন্দ্র পাড়ার বড়দের ও ছোটদের সঙ্গে অনেক কথা বলে শেষে সম্মতি আদায় করেছে। এই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারীরা টিভি ও সিনেমার অনুষ্ঠানের নকল না করে যথাসাধ্য নিজেদের তৈরি প্রোগ্রাম পেশ করবে। তার জন্য কয়েকজন নাটক ও ছড়া লিখছে। তাপস আর মানবেন্দ্র শুধু কলম চালিয়ে সেগুলো একটু শুদ্ধ করে দিচ্ছে।
রোজ সন্ধেয় অনুষ্ঠানের রিহার্সাল চলে মানবেন্দ্রর বাড়িতে। ব্যাপারটা বেশ জমে উঠেছে। আর তিন-চারদিন বাকি, এই ক'দিন টেনে রিহার্সাল দিতে পারলেই সব দাঁড়িয়ে যাবে। এমন সময় মানবেন্দ্র একদিন এসে ম্লান মুখে বলল, "একটা ঝামেলা হচ্ছে রে। কাল সন্ধেয় আমাদের বাড়িতে বাবার কয়েকজন অফিস কলিগ আসছেন। তাই রিহার্সাল করা যাবে না।"
"সে কী রে, চারদিনের একদিন চলে গেলে কী করে ওদের সব শেখাব? সব ছকটাই তো বানচাল হয়ে যাবে।"
মানবেন্দ্র একটু দ্বিধা করে বলল, "তোর বাড়িতে হয় না? একটা তো দিন।"
"না, না।" তাপস প্রবল আপত্তি জানাল, "আমি সমুকাকে কথা দিয়েছি কোনও জমায়েত এখানে হবে না। আর উনি এখন শহরে আছেন। বাড়িঘর নোংরা হলে –"
"নোংরা হবে না। রিহার্সালের পরই আমি বাচ্চা ব্রিগেডকে লাগিয়ে দেব, পনেরো মিনিটে বাড়ি পয় পরিস্কার হয়ে যাবে। আর তুই তো বলছিস তোর কাকা এখন দিন কতক আসবে না।"
অনেক দ্বিধার পর তাপস শেষ অবধি রাজি হল।

পরদিন রিহার্সাল খুব জমে উঠেছে। কিছু আবৃত্তি, নাচের পর একটা হাসির নাটিকার তালিম চলছে, তাপস পাশে বসে প্রম্পট করছে। এমন সময় দরজার বেল বাজল। এই অসময়ে কে? তাপস তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিল। সামনে দাঁড়িয়ে সমুকা, তার মুখে ক্লান্তি আর বিষণ্ণতার ছাপ।
তাপসের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সমুকা ভেতরে ঢুকলেন। এক মুহূর্তের জন্য যেন তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। তারপর তিনি তাপসের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন।
"আগামী শনিবার ছোটদের নিয়ে একটা ফাংশন করছি, তার রিহার্সাল। বিশ্বাস করো, শুধু আজকের দিনটার জন্য। তুমি আসবে জানতাম না, নইলে – আমি এক্ষুণি সব বন্ধ করে দিচ্ছি।" তাপস আমতা আমতা করে বলল।
"না।" সমুকা হাত নেড়ে বললেন, "যা করছিস কর। সব শেষ হলে আমার সঙ্গে দেখা করিস।"
"সমুকা, তোমার স্যুটকেসটা দাও।" তাপসের বাড়ানো হাত উপেক্ষা করে সমুকা দৃঢ় পায়ে মালপত্র নিয়ে ওপরে চলে গেলেন।

ভয়ে ভয়েই তাপস বাকি রিহার্সালটা শেষ করল। সমুকা নিশ্চয়ই তাকে খুব বকবেন, হয়তো বাড়ি ছেড়ে দিতে বলবেন। না বললেও সে নিজে থেকেই চলে যাবে। আরেকটা জায়গা ঠিক জুটিয়ে নেবে। কিন্তু সে কথার খেলাপ করে একজন দেবতুল্য মানুষের বিশ্বাস হারিয়েছে এটা ভেবে তার মন গ্লানিতে ভরে যাচ্ছিল।
রিহার্সাল, সাফাই চুকলে তাপস ভয়ে ভয়ে সমুকার সঙ্গে দেখা করল। তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, "বোস। তোর সঙ্গে কথা আছে।"
"কিন্তু সমুকা, খেয়ে নিয়ে বললে হত না? তুমি আগে জানাওনি। তবু আমি নিজের জন্য যে তরকারি, মাছ করেছি তাতে দুজনের বেশ হয়ে যাবে।"
"ব্যস্ত হোস না, আমি খেয়ে এসেছি।"
"তুমি তুষারকে গাড়ির কথাও বলোনি। এখানে তো উবর আসে না, এলে কীভাবে?"
"সে একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছি। ওসব না ভেবে একটু স্থির হয়ে বোস। তোকে অনেক কিছু বলব যা এখন না বললে হয়তো আর বলা হবে না। কে জানে, হয়তো কাউকেই বলা হবে না।"
তাঁর স্বরে কী যেন ছিল, তাপসের বুক কেঁপে উঠল। সমুকা শুরু করলেন।

"নিশ্চয়ই জানিস, গত ক'বছর আমেরিকার অর্থনীতি এক অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোভিড যেমন অনেকের প্রাণ নিয়েছে, তেমন দেশের অর্থনীতিতেও আঘাত হেনেছে। এই বছরে তার একটা প্রভাব, অনেক কোম্পানি লোকসংখ্যা কমাচ্ছে, অর্থাৎ ছাঁটাই। এই ছাঁটাইয়ের কোপ শুধু ছোট ছোট কোম্পানির নিচুতলার লোকেদের ওপর পড়েছে, তা নয়। নামি কোম্পানি, যার কর্মীরা চার্চ বা সরকারকে নয়, কোম্পানিকেই তাদের ভগবান বলে মানত, তাদেরও নিচু থেকে উঁচুতলার কর্মীরা পাচ্ছে সংক্ষিপ্ত নোটিশ, "তোমার চাকরির আর দরকার নেই।" এই নোটিশ যেমন অলস, অকর্মণ্যরা পাচ্ছে, তেমন পাচ্ছে সেই সব মানুষগুলোও যারা বছরের পর বছর খেটে কোম্পানির ভিত আর সুনাম তৈরি করেছে। অতীতের কোনও দাম নেই। এই মুহূর্তে যদি কোম্পানির তোমাকে দিয়ে কোনও কাজ না হয় তবে তুমি এখন এসো, পরে দেখা যাবে।"
সমু ভয়ে ভয়ে বলল, "সমুকা, তোমার কি চাকরি গেছে?"
বিষণ্ণ হেসে সমুকা বললেন, "ঠিক তা নয়। ব্যাপারটা ডিককে নিয়ে। ডিক পদমর্যাদায় আমার জুনিয়র কিন্তু বয়সে বড়। যারা বহু বছরের শ্রম ও মেধা দিয়ে কোম্পানির ভিত গড়ে তুলেছে, ও তাদের একজন।
সম্প্রতিও ডিক আমার সঙ্গে কাজ করছিল। মাসখানেক আগে ওর নেতৃত্বে এমন একটা প্রজেক্টের সফল সমাপ্তি হয়েছে, যা শুধু কোম্পানির পক্ষে নয়, দেশের পক্ষেও অতি গুরুত্বপূর্ণ। তারপর সঙ্গে সঙ্গে ও কোনও প্রজেক্ট হাতে নিতে পারেনি। দু-তিনটে প্রজেক্টের কোনটা বেশি সম্ভাবনাময়, ভাবছিল। সেই নিয়ে আমার সঙ্গেও কথা হচ্ছিল। হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাপারটার ফয়সালা করে নিত।
এক শুক্রবার বিকেল ছ'টা অবধিও ফোনে আমার সঙ্গে ওর ভবিষ্যতের কাজের কথা হয়েছে। আমি মজা করেই বলেছি, "তুমি তো অপরিহার্য। কিন্তু এখন কোম্পানিতে যা চলছে, এত প্ল্যান করার পর কালই আমাকে বসিয়ে না দেয়।"
ডিক হেসে বলেছিল, "নিতান্ত আহাম্মক না হলে কোনও কোম্পানি সমু হালদারকে ছাড়বে না।" তারপর আর দু-এক কথা বলে আমরা ফোনালাপ শেষ করেছিলাম।
তার আধ ঘণ্টা পর আমি ই-মেইল পেলাম, ডিকের চাকরি চলে গেছে।"

একলা

"ই-স! বুড়ো বয়সে, কী অপমান!" তাপস বলে উঠল, "কী দরকার ছিল? কিছুদিন বাদে হয়তো এমনিতেই রিটায়ার করত।"
"ঠিক ধরেছিস", সমুকার চোখ জ্বলে উঠল, "অপমান! আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দারা চাকরি গেলে জীবন কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে গেলেও খেতে পায় না তা নয়। বেকারদের জন্য সরকারি সাহায্য আছে আর কোম্পানিও ছাঁটাই করলে বেশ কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান লোকটার কাছে এত বছর ছিল ঈশ্বর, সে তাকে বলতে গেলে আধঘণ্টার নোটিশে ছুঁড়ে ফেলে দেবে এটা সহ্য করা কঠিন। আর এই বরখাস্ত চিঠিটা এসেছে সম্ভবত এক 'রোবট' প্রোগ্রামের কাছ থেকে, যে ডিকের গত কয়েক মাসের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে দেখেছে সে তিন সপ্তাহ বেঞ্চে বসা কিন্তু তার কাছে ডিক আজীবন কোম্পানির আর দেশের জন্য কী কী করেছে তার ডেটা নেই!
অবিচারটা সহ্য হল না। কোম্পানির উচ্চস্তরে প্রতিবাদ জানিয়ে সিদ্ধান্তটা ফিরিয়ে নেবার জন্য অনুরোধ করলাম। যখন কোনও জবাব পেলাম না, 'দুত্তোর!' বলে লম্বা ছুটি নিয়ে ভারতে চলে এলাম।"

" কিন্তু এই অবস্থায় – কোম্পানি তোমাকে বলেনি ছুটি না নিতে?"
"বলেনি আবার! কিন্তু সমরেশ হালদার কেয়ার করে না, এই চাকরি গেলেও এখনও এনি ডে পাঁচটা জুটিয়ে নিতে পারে। তবে সেদিন রাতে বসে আমি ডিকের কথা ভাবছিলাম। এই আঘাতটা পেয়ে তার মনের কী অবস্থা? কিন্তু সেটা জানার কোনও সুযোগ পেলাম না। সে আমার ফোন তুলছে না। হয়তো ভাবছে তার এই লে-অফের পেছনে আমারও হাত আছে।
তখনই আরেকটা কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম। এই যে আমেরিকার লড়ে সফলতা ছিনিয়ে নেওয়ার সংস্কৃতি, তা একদিকে দেশটিকে অতি উন্নত করে তুলেছে। কিন্তু অন্য দিকে এই আধুনিক সভ্যতা মানুষকে করে তুলেছে একলা। বন্ধু, পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, সবাই হয়ে উঠেছে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আঘাতের সময় সাহায্য করা দূরে থাক, সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতোও কেউ থাকে না।"
"ডিকের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে –"
"ওদেশের প্রথা মোতাবেক ছেলেমেয়েরা আঠেরো বছর হয়ে গেলেই যে যার পথ দেখে, নইলে ভারী লজ্জা। বাবা-মা'কে যাতে একেবারে ভুলে না যায়, তাই আছে ফাদার্স ডে, মাদার্স ডে। আর ডিকের দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে এখনও ডিভোর্স হয়নি, তবে তারা বেশি সময় একসঙ্গে থাকে না। হয়তো দুঃখ ভুলতে লোকটা একলা বাড়িতে বসে মদ খাচ্ছে।"
"তারপর তুমি দেশে এলে এখানকার চাকরির খোঁজে?"
"ঠিক তা নয় রে। হঠাৎ আমার মনে হল, ব্যক্তিভিত্তিক আমেরিকান সমাজ সুখের সন্ধানে সমস্ত সামাজিক সংগঠন ভেঙে দিয়ে আসলে আমাদের আরও দুখি করে তুলছে। গোটা উন্নত পাশ্চাত্যেই মোটামুটি এই ছবি। এই দেশগুলির তাই বর্তমান আছে, ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু এই সংগঠনগুলি কিছুটা হলেও টিঁকে আছে প্রাচ্যে। এখানে এখনও মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তারা দল বেঁধে আড্ডা দেয়, গান করে, খেলে। মনে পড়ল, আমেরিকা আসার আগে আমি এই পাড়ায় 'জাগরণী' ক্লাবের হয়ে খেলে তাদের স্থানীয় প্রতিযোগিতার সেমি ফাইনাল অবধি পৌঁছে দিয়ে গেছি। তখনও 'বাংলা ব্যান্ড' আসেনি। কিন্তু আমাদের একটা গানের ট্রুপ ছিল, যার গান আমরাই লিখতাম, কম্পোজ করতাম আর স্টেজে গাইতাম। তাই ভবিষ্যত যদি থাকে তা আমাদের মতো প্রাচ্যের দেশগুলির।
তাই আমি প্ল্যান করলাম কিছুদিন ভারতে এসে আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে দেখাশোনা করব। সেই পুরনো দিনের মতো আড্ডা, গান, হাসিতামাশায় কিছুদিন মন হাল্কা করব। আমার যা ডলার আছে তাতে এদেশে আমি কিছু না করেও বাকি জীবন আয়েশে কাটাতে পারি। কিন্তু আমার ইচ্ছে আমি নতুন ধরণের একটা কোম্পানি গড়ে তুলব এদেশের ছেলেমেয়েদের নিয়ে। তাদের টিম ওয়ার্কের মাহাত্ম্য শেখাব। 'প্রসেস'এর বাঁধন ছিঁড়ে স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখাত।"
"তারপর?'
"আমি চূড়ান্ত হতাশ হলাম। আমাদের মতো মানুষদের সচ্ছ্বলতা বেড়েছে। আমাদের ছেলেমেয়েদের সাফল্যের পেছনে ছোটার লড়াকু মনোভাব এসেছে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে এই জুয়েল ছেলেমেয়েগুলো বড্ড একা হয়ে পড়ছে। তারা পরীক্ষা ছাড়া কোনওদিকে তাকায় না। নিজেকে ছাড়া আর কাউকে চেনে না। পাড়া, ক্লাবের ছোটখাটো স্থানীয় খেলাধূলা, জলসা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তার জায়গা নিচ্ছে ভিডিও গেম আর টিভি প্রোগ্রামের অক্ষম নকল। যে পাশ্চাত্য থেকে ধাক্কা খেয়ে শান্তির খোঁজে আমি দেশে এসেছি, তারা তাকেই অনুকরণের আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
আমার স্বপ্নে আমি যে দেশকে কল্পনা করতাম তা হারিয়ে গেছে।"
"তুমি – আগে বোঝনি?"
"এতটা নয়। আসলে প্রফেশনাল হলেও সাধারণ জীবন সম্বন্ধে আমি মানুষটা বড় অজ্ঞ। তাই ধাক্কাটা বড় লাগল।"
"তুমি – আবার ফিরে যাবে?"
বিষণ্ণ হেসে সমুকা বললেন, " হয়তো।" তারপর হঠাৎ তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, "কিন্তু আজ এখানে এসে আবার বুকে একটু বল পেয়েছি তোর এই রিহার্সাল দেখে আর শুনে। হয়তো, হয়তো আমার স্বপ্নের সবটাই হারিয়ে যায়নি।"
তারপর তাপসের পিঠে হাত রেখে তিনি অস্ফুটস্বরে বললেন, "প্লীজ, এটুকু ছাড়িস না।"

"সমুকা, তুমি সত্যিই খেয়ে এসেছ?"
"হ্যাঁ, রে। যা, এবার তুই খেয়ে নে।"
"যাচ্ছি। আর তুমিও তাহলে এবার শুয়ে পড়ো, তোমাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। আর হ্যাঁ, শোনো, তোমার স্বপ্ন কিন্তু পুরো হারিয়ে যায়নি। এদেশে বা বিদেশে কোনায় কোনায় তার টুকরোগুলি অবাধ্য বাচ্চার তেজে বেঁচে রয়েছে। তোমার মতো মেধার মানুষ তা ঠিক খুঁজে নিতে পারবে।"
"বলছিস?" সমুকা উত্তেজিত হয়ে উঠে বসলেন।
"হ্যাঁ। আর আবার যখন কোথাও যাবে আমাকে জানিও।"
"হ্যাঁ রে, হ্যাঁ। গুড নাইট।"

কিন্তু পরদিন সকালে উঠে তাপস দেখল সমুকা নেই। ভোর না হতেই কোথাও চলে গেছেন। তুষারকে ফোন করে জানল, তার থেকে গাড়ি নেননি।
তারপর তাঁর আর কোনও খবর নেই। মেসেজ দিয়ে রিপ্লাই পেল না। দু'দিন একটু চিন্তায় থাকার পর হঠাৎ একদিন সকালে আমেরিকা থেকে কাকিমার ফোন, "হ্যালো তাপস, সমু আছে? একটু দেবে? ওর ফোনটা বোধহয় সুইচড-অফ।"
"কাকু তো দু'দিন আগে হঠাৎ চলে গেছে, কিছু বলে যায়নি।"
কাকিমার প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থা। বললেন, "কী যে মুস্কিলে পড়লাম! ও কিছুফিন আগে কাউকে কিছু না বলে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। পৌঁছোবার পর ফোন করলে ধরেনি। শুধু মেসেজ দিয়েছে আমি কলকাতায় আছি, ভালো আছি। খুব ব্যস্ত আছি, পরে কথা হবে। কিন্তু সেই 'পরে' আর কখনও আসেনি। এখন সেলও সুইচড-অফ।"
"বেরোবার আগে তোমাকে কিছু বলেনি?"
"আমরা তো ছিলাম না। আমাকে এখন কাজের সূত্রে বেশিরভাগ দিন সিয়েটলে থাকতে হয় আর পিয়ালী ওর ইউনিভার্সিটি হস্টেলে। একাই ছিল। অফিসে কীসব রাগারাগি করে চাকরি ছেড়ে চলে এসেছে। তারপর নাকি ওদের কোম্পানির সফটওয়্যার সিস্টেম কারা হ্যাক করে বহুদিনের কাজ লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। সেই কাজগুলি পুনরুদ্ধার করতে পারত শুধু সমু আর তার বহুদিনের বন্ধু ডিক। সম্প্রতি কোম্পানি ডিককে লে-অফ করায় সে কোম্পানির ফিরে আসার অফার ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই সমুকে ওরা পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু পাচ্ছে না।"
"আচ্ছা, আমি দেখছি। কোনও খোঁজ পেলে অবশ্যই জানাব।" ফোনটা ছেড়ে তাপস কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।

না, সমুকাকে তারপর আর কেউ খুঁজে পায়নি। উদভ্রান্ত কাকিমা ভারতে এসে অনেক চেষ্টায়ও কোনও খোঁজ পায়নি। শেষ অবধি তাপসের কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছে, "মানুষটা বড় অভিমানী ছিল রে। তার বুকে অনেক আশা ছিল। সেগুলো ঘা খেয়ে যাওয়ায় খুব ভেঙে পড়েছিল। তখন আমরা কেউ তার পাশে ছিলাম না। তাই একটু শান্তি খুঁজতে তার জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিল।"
"কিন্তু যে দেশকে সে ছেড়ে গিয়েছিল, তাকে তো আর পায়নি। সব যে বদলে গেছে।" তাপস বলেছিল।
"হয়তো সেটা সহ্য করতে না পেরে নিজেকে সরিয়ে দিয়েছে।" কাকিমা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।
তাকে সান্ত্বনা দিয়ে তাপস বলেছিল, "তা নয়, কাকিমা। সমুকা অত সহজে হার মানার মানুষ নয়।"
"বলছিস?" কাকিমা যেন আবার কিছুটা ভরসা বুকে ফিরে গিয়েছিলেন।

প্রায় এক বছর কেটে গেছে। সমুকা এখনও ফিরে আসেননি। কিন্তু তাপস জানে, তিনি পৃথিবীর কোনও অংশে আশার টুকরোগুলি জড়ো করে তাঁর স্বপ্নের রূপায়নে ব্যস্ত, একদিন বিস্ফোরণ হয়ে জেগে উঠবেন।
আর তাপসও সমুকার শেষ অনুরোধটুকু ধরে রেখেছে, "এটুকু ছাড়িস না।" তাই আজ প্রায়ই সন্ধ্যাবেলায় কচিকাঁচাদের কলরবে সমুদার বাড়ির একতলা মুখর হয়ে ওঠে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা