সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

['ইচ্ছামতী'-র সম্পাদিকা মহাশ্বেতা রায়ের সঙ্গে কথোপকথন।]


নমস্কার মহাশ্বেতা রায়। আমরা ‘উজান’ পত্রিকা এবারে ‘শিশু কিশোর সাহিত্য’ নিয়ে কাজে নেমেছি। আর সবই থাকবে অথচ নতুন শতকের নতুন প্রকাশ-মাধ্যম আন্তর্জালে শিশু কিশোর সাহিত্যের স্বরূপ সম্পর্কে কিছু থাকবে না—এ কেমন হয়? তখনই আপনার কথা মনে পড়ল। আমাদের অসম বা পূর্বোত্তর থেকে আন্তর্জালে শিশু কিশোরদের কোনও পত্রিকা নেই। তা যদিও আমাদের কাগজের বিস্তার এখন সারাভারতেই তবু অধিকাংশ পাঠক তো অসম তথা পূর্বোত্তরেরই। তাই আমাদের কাগজের মধ্যে দিয়ে এই নতুন মাধ্যমের সংবাদটি এখানে এসে পৌঁছাক-- এমন বাসনা থেকেই আপনার দুয়ারে এসে টোকা দেওয়া। আমাদের আশা, আপনি আমাদের খালি হাতে ফেরাচ্ছেন না। আমরা আপনার ‘ইচ্ছামতী ’-কে ঠিক ২০০৮ থেকে না হলেও প্রায় শুরু থেকেই দেখে আসছি।
কিছু তার পড়েছি, কিছু পড়িনি। আন্তর্জালের বাইরে অনেকেই পড়েন নি। আপনাদের কোনও ছাপা সংস্করণ আছে বলেও আমাদের কাছে খবর নেই। তাঁদের কাছে ইচ্ছামতী ’র বার্তা পৌঁছাক সঙ্গে আরও যদি কিছু আন্তর্জাল কাগজ আছে—তাদেরও। সেই লক্ষ্যে আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন রাখছি।

১। আপনাকে কী বলে ডাকব, চাঁদের বুড়ি? যেমন ‘ইচ্ছামতী’তে লেখা আছে? না মহাশ্বেতা রায়। যে নামে বাংলা আন্তর্জাল সাহিত্যের পাঠক লেখকেরা আপনাকে চেনেন?

- নমস্কার। আন্তর্জালে বাংলা ভাষায় শিশু-কিশোর সাহিত্য চর্চার প্রয়াস এবং ছোটদের ওয়েব পত্রিকা ইচ্ছামতীকে (www.ichchhamoti.in) নিয়ে এই কথোপকথনের সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রথমেই ‘উজান’ পত্রিকাকে ধন্যবাদ জানাই। সঙ্গে পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই উৎসবের মরসুমের শুভেচ্ছা।
আমি দুটি নামেই সমান স্বচ্ছন্দ। যদিও ইচ্ছামতীর পুরনো বন্ধুরাই আমাকে ‘চাঁদের বুড়ি’ নামে বেশি ডাকেন। তবে সদ্য চাঁদে ভারতের অভিযান সফল হওয়ার পরে, ‘চাঁদের বুড়ি’ আর কতদিন ছোটদের কাছে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বা ‘কল্পনার যোগ্য’ থাকবে সে নিয়ে মাঝে মধ্যে ভাবছি বই কি।

২। সাধারণ ভাবে এই ‘শিশু কিশোর সাহিত্য’ নিয়ে আপনার আগ্রহের কারণটি কী? ইচ্ছামতীর আগে সলতে পাকানোর কাহিনিটি বলবেন?

- অবশ্যই। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে যখন প্রথাগত পড়াশোনা শেষ করছি, সেই সময়ে ইন্টারনেট সবে এই দেশে সাধারণের হাতের নাগালে এসে পৌঁছাচ্ছে। কম্পিউটার নিয়ে কাজ করার নানা ধরণের সফটওয়্যার/ কোড/ ল্যাঙ্গোয়েজ নিয়ে কাজের পাশে পাশে জনপ্রিয় এবং প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছিল মাল্টিমিডিয়া ডেভেলপমেন্ট এবং ওয়েবসাইট ডিজাইন করার কাজ। আমি মাল্টিমিডিয়া ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করি। ‘মাল্টিমিডিয়া’ বা ‘বহুমাধ্যম’-এর মধ্যে পড়ে ছবি, ভাষা, শব্দ, ভিডিও, অ্যানিমেশন ইত্যাদি। তার সঙ্গে থাকে একটা প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যারের সঙ্গে কম্যুনিকেট/ সংযোগ করার সুযোগ। সব মিলিয়ে একজন ব্যবহারকারী সেই প্রোগ্রাম/সফটওয়্যার মারফত নিজের প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করতে পারে বা বিনোদন লাভ করতে পারে। প্রথমে একজন মাল্টিমিডিয়া ট্রেনার/প্রশিক্ষক হিসেবে এবং পরে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের জন্য বিভিন্ন ধরনের মাল্টিমিডিয়া সিডি-রম তৈরির কাজ করার সময়ে আমি অনুভব করি এই টেকনোলজি কতটা ভালোভাবে ছোটদের (এবং বড়দেরও) পড়াশোনা বা খেলাচ্ছলে জ্ঞান আহরণের পথে কাজে লাগতে পারে। এই সমস্ত কিছুর সহযোগে যে ছোট-বড় সবার জন্য অতি উন্নতমানের কন্টেন্ট তৈরি করা যায়, সে তো আজকের দিনে দারুণভাবে প্রমাণিত।

আমাদের দেশে, বিশেষত বাংলা ভাষায় যে সমস্ত পাঠ্যপুস্তক ছাপা হত, অন্তত আমাদের বড় হয়ে ওঠার বয়সে, সেগুলি সেই অর্থে একেবারেই আকর্ষণীয় ছিল না। বিশেষ ভাবে ইতিহাস, ভূগোল বা বিজ্ঞানের, এমন কি বাংলা সাহিত্যের বইগুলি আরও বেশি ব্যাখ্যামূলক ছবিতে ভরা থাকলে ছাত্রী/ পাঠক হিসেবে আমি খুশি হতাম। উৎকৃষ্ট মানের রঙিন বই ছাপার খরচা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, সেটা আমরা সবাই জানি। তাই আমার মনে হয়েছিল, পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি, নানা বিষয়ে তথ্য যদি সহজে এবং আকর্ষণীয়ভাবে এই ডিজিটাল মাধ্যমের মারফত ছোটদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে মন্দ কী!

তাই বলা যেতে পারে, সলতেটা অনেকদিন ধরেই পাকছিল, কিন্তু যথাযথ সহজলভ্য প্রযুক্তির অপেক্ষায় ছিল, যেটা আমার/ আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় আরও কিছুদিন পরে।

৩। শুরুর দিনগুলোর কথা কিছু বলুন। যখন ভারতে আন্তর্জালে বাংলা ভাষাতে লেখা পড়া বিশেষ ছিল না তখন এমন ভাবনা আপনার বা আপনাদের মধ্যে এল কী করে?

- ২০০৮ সালের শুরুর দিকে কোনো এক সময়ে ডঃ মেহেদি হাসান খান নির্মিত ‘অভ্র’ ইউনিকোড কীবোর্ড সফটওয়্যারটির সঙ্গে পরিচিত হই। সেই প্রথম আমি একটা ওয়েবপেজে সহজে, কোনো নির্দিষ্ট কীবোর্ড লেআউট না জেনেও, বাংলা টাইপ করতে পারি। ‘অভ্র’ আসার আগে যে কয়টি হাতেগোনা ওয়েবসাইটে বাংলা পড়া যেত, সেগুলি নিজস্ব কোডিং করে বাংলা অক্ষর ডিস্‌প্লে করত। কিংবা প্রিন্টিং-এর কাজ হয় এমন সফটওয়্যার-এ বাংলা লিখে ছবি হিসেবে সেভ করে সেইসব ছবি ব্যবহার করা হত।

আমি পেশাগতভাবে একজন ওয়েব ডিজাইনার। তাই ওয়েবপেজ বা ওয়েবসাইট নির্মাণ সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল। ইংরেজি ভাষায় ছোটদের জন্য তৈরি দারুণ ভালো সব ওয়েবসাইট এবং মাল্টিমিডিয়া সিডি দেখে আরও বেশি মনে হয়েছিল যে বাংলা ভাষাতেও এমনটা হওয়া দরকার।

ঠিক এই সময়েই এক প্রবাসী ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় যিনি নিজের লেখা দিয়ে ছোটদের জন্য বাংলা ওয়েবসাইট তৈরি করতে চাইছিলেন, মূলতঃ প্রবাসী বাঙালিদের জন্য। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে, তিনি যে পরিমাণ কাজ চাইছিলেন, সেই অনুপাতে পারিশ্রমিক দিতে রাজি ছিলেন না। তাই সেই কাজটা আর হয়নি।
এইখানে বলে রাখা দরকার যে, ওয়েব যেহেতু অপেক্ষাকৃত এক নতুন মাধ্যম, তাই আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে, কোনো কাজের জন্য একটা ওয়েবসাইট-এর প্রয়োজনীয়তা বা সঠিকভাবে ওয়েব ডিজাইন বা ডেভেলপমেন্টে কী পরিমাণ পরিশ্রম যেতে পারে সেই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা বেশিরভাগ মানুষেরই ছিল না। এখনও হয়ত নেই।
যাইহোক, এই অভিজ্ঞতার পরে আমার মনে হয় যে যদি প্রায় বিনা পারিশ্রমিকেই এমন একটা কাজ করানোর কথা কেউ ভাবতে পারেন, তাহলে আমি নিজেই সেই কাজটা করি না কেন? পরমুখাপেক্ষী না হয়ে নিজে যেটুকু জানি সেই জ্ঞানের সাহায্যেই যদি একটা এমন ওয়েবসাইট বানিয়ে ফেলা যায়, তাহলে কেমন হয়? বাঙালির পত্রিকা প্রকাশের উৎসাহ তো সর্বজনবিদিত, তাই না? তাই আমার বন্ধু কল্লোল লাহিড়ীর সঙ্গে বাংলা ভাষায় ছোটদের জন্য একটা ওয়েব পত্রিকা করার কথা ভাবি। ঠিক হল যে আমরা নিজেরা কিছু কিছু বিভাগে লিখব। বন্ধুদের থেকে নানা বিষয়ে লেখা চাওয়া হবে। ছোটদের পত্রিকায় রঙিন ছবি থাকা জরুরী। আনাড়ি হাতে সেই ছবি আঁকার দায়িত্ব আমি নিলাম। খুব বড় কিছু করব, বা বিশাল কোনো লক্ষ্যপূরণ করব, এমন কিছু ভাবিনি। বরং এটাই ভেবেছিলাম, যতদিন ইচ্ছে হবে বা সময় পাব, ততদিন পত্রিকা চলবে, আর সময় বা ইচ্ছে না থাকলে বন্ধ করে দেব। কিন্তু শুরুটা করতে হবে। আর এইভাবেই ২০০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হল ইচ্ছামতীর প্রথম সংখ্যা। সৌভাগ্যক্রমে, তৃতীয় সংখ্যা থেকেই আমাদের কাছে নতুন লেখকদের লেখা আসতে থাকে। শুধুমাত্র নিজেদের বা বন্ধুদের কলমের ওপর নির্ভর করতে হয় না। নতুন নতুন ধারার লেখা আসায় শুরু হয়ে যায় নতুন নতুন বিভাগও।

৪। ২০১৩ পর্যন্ত তো ‘ইচ্ছামতী ’ ত্রৈমাসিক ছিল। পিডিএফ আকারে নামিয়েও পড়া যেত। কিন্তু তখন তো নেট খরচাও প্রচুর ছিল। হাতে হাতে স্মার্ট মোবাইলও ছিল না যাতে আন্তর্জাল সংযোগ নেওয়া চলে। ডেক্সটপ বা ল্যাপটপ ভরসা। পাঠক কেমন মিলত? লেখকরাও কি টাইপ করে লেখা দিতেন?

- অনেকগুলি প্রশ্ন এক সঙ্গে… একে একে উত্তর দিই।

(১) সংখ্যাগুলির পিডিএফ আমরা বানাতে শুরু করি প্রথম থেকে নয়, অনেক পরে। বলা ভালো ২০১৩ সালের কাছাকাছি, যখন পাঠকদের মধ্যে থেকে পিডিএফ এর দাবী আসে। তাও, শেষ তিনটি সংখ্যার পিডিএফ আর বানানো হয়ে ওঠেনি, শুধুমাত্র সময়ের অভাবে।

(২) ২০০৮ সালে হাতে হাতে স্মার্ট ফোন ছিল না, ঠিক। ইন্টারনেট খরচ বেশ বেশি ছিল, এটাও ঠিক। ডেস্কটপ বা ল্যাপটপই ভরসা ছিল, এটাও ঠিক। তাই প্রথম সংখ্যা থেকেই অগুন্তি পাঠক ছিলেন, এমন কথা হলফ করে বলা যায় না। বরং বেশ কিছু লেখক লেখা দেওয়ার আগে জানতে চাইতেন কতজন পাঠক! তবে ক্রমে ক্রমে পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে। শুরুর দিকের ইচ্ছামতীর বেশিরভাগ পাঠক সাবালক। শিশু-কিশোর সাহিত্যের প্রতি তাঁদের অনুরাগ, কিংবা বাড়ির ছোটদের জন্য অনলাইনে বাংলা গল্প-কবিতা খোঁজার ইচ্ছে তাঁদেরকে ইচ্ছামতীর কাছে ফিরিয়ে আনে। সেটা হয়ত বেশিরভাগ ওয়েব বা মুদ্রিত পত্রিকার ক্ষেত্রেই সত্যি। বড়রা নিজেরা না পড়লে কেমনভাবে জানবেন পত্রিকাটি ছোটদের উপযোগী কি না?

প্রথম কয়েক বছর আমরা আলাদা করে গুগ্‌ল্‌ ব্লগস্পটের একটা ব্লগে বিভিন্ন সংখ্যার আপডেট দিতাম, যাতে সেখানে পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। সেখানে বরাবর খুব সদর্থক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এমন অনেককে জানি যাঁরা ইচ্ছামতীর কথা জেনে নিজের পরিচিত ছোটদের জানিয়েছেন এই পত্রিকার কথা। ইমেইল এসেছে প্রবাসী অভিভাবকদের থেকে — জানিয়েছেন ইচ্ছামতী তাঁদেরকে তাঁদের ছোটবেলার ‘সন্দেশ’ বা ‘আনন্দমেলা’-র স্বাদ ফিরিয়ে দিয়েছে; সন্তানকে বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করাতে তাঁরা ইচ্ছামতীর সাহায্য নেবেন। ইচ্ছামতীর আইডল এই ক্লাসিক পত্রিকাগুলির সঙ্গে তুলনীয় কাজ সত্যি করতে পেরেছি কি না জানিনা। কিন্তু এমন প্রতিক্রিয়া পেতে ভালো লাগত, একথা অনস্বীকার্য।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, গল্পের বই /পত্র-পত্রিকা পড়ার অভ্যাসটা শুরু করানোর দায়িত্ব অভিভাবকদের। যেমন করে সন্তানকে রোজ দাঁত মাজা বা স্নান করার অভ্যাস করান তাঁরা তেমনভাবেই গল্পের বই পড়ার বা সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত থাকার অভ্যাস করানো উচিত। এবং চাইলে যে তাঁরা সেটা পারেন, তার প্রমাণ পেয়েছি ২০২০ তে প্রথম লকডাউন চলাকালীন। সেই সময়ে ইচ্ছামতীতে প্রতিমাসে ছোটদের জন্য এক গুচ্ছ ছবির মাধ্যমে গল্প লেখার রসদ দেওয়া হত। দেশের এবং প্রবাসের কত ছেলেমেয়ে যে গল্প লিখে বা ছবি এঁকে পাঠিয়েছে! সেইসময়ে বাবা-মায়েরা বাড়িতে ছিলেন, স্কুল বন্ধ ছিল, নিয়মবদ্ধ রুটিনের বাইরে গিয়ে এমন সব কাজে দু-পক্ষেরই উৎসাহ ছিল।

(৩) লেখকদের টাইপ করে দেওয়ার ব্যাপারে বলি, বেশিরভাগই ইউনিকোডে টাইপ করে দিতেন। কিন্তু এমন অনেক লেখক ছিলেন যাঁরা বহুদিন অবধি ইউনিকোডে অভ্যস্ত হন নি। তাঁরা পিডিএফ পাঠাতেন। অনেকেই হাতে লেখা কাগজ স্ক্যান করে পাঠাতেন। বহু লেখাই নিজেকে টাইপ করে নিতে হয়েছে। বেশ কয়েকবার নিজের বন্ধুদের অনুরোধ করে সময় বার করিয়ে টাইপ করিয়ে নিতে হয়েছে। তাঁরা ইচ্ছামতীকে ভালোবেসে কাজটা করে দিয়েছেন। তবে গত কয়েকবছরে, বিশেষত স্মার্টফোন এসে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষ ইউনিকোডে বাংলা লিখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পরে অবশ্য আর এই দায়িত্বটা নিইনি। ইউনিকোডেই লেখা নিয়েছি।

৫। ‘ইচ্ছামতী ’র সাইটে লেখা আছে “ ২০১৩ এর নভেম্বর-ডিসেম্বর এ কোন নতুন লেখাই প্রায় প্রকাশিত হয়নি। চাঁদের বুড়ি বড়ই ঝড় ঝাপ্টার মধ্যে দিয়ে গেছে সেই সময়ে। তার চরকা-চশমা-রামধনুরং গুলিসুতো সবই গেছিলে ঝড়ে ভেঙে, হাওয়ায় উড়ে, জলে ভেসে... সেইসব গুছিয়ে এনে আবার কাজে কর্মে মন লাগাতে একটু সময় লাগল। “—কী হয়েছিল চাঁদের বুড়ির –জানা যাবে?

- ব্যক্তিগত বিপর্যয়। ২০১৩-এর নভেম্বরে ১৫ দিনের ব্যবধানে আমার ঠাকুমা এবং তার পরে আমার বড়মামা মারা যান। ঠাকুমার যথেষ্ট বয়স হয়েছিল এবং সেই প্রস্থানের মানসিক প্রস্তুতি ছিল। বড়মামারটা ছিল না। তিনি অকৃতদার ছিলেন। বন্ধ বাড়িতে আকস্মিক একা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। পুলিশ-দমকল ডেকে দরজা ভেঙে তাঁর প্রাণহীন দেহ বের করতে হয়; তারপরে থানা- পোস্টমর্টেম ইত্যাদি। এই পুরো ঘটনার অভিঘাতে বহুদিন মন দিয়ে কোনো কাজ করতে পারিনি। নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেকটা সময় লেগে গেছিল।

এদিকে ২০১৩ সালের পুজোর সময় থেকেই স্থির করি যে ইচ্ছামতীকে আর মুদ্রিত পত্রিকার মত ‘সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশ করব না। সমসাময়িক দেশি-বিদেশি ওয়েবপত্রিকার ধাঁচে নিয়মিত কিছু কিছু কন্টেন্ট আপলোড করব। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম প্রতি মাসেই নতুন কন্টেন্ট যাবে। কিন্তু এমন ঘোষণা করা পরের দুই মাসেই সেই কথা রাখতে না পেরে নিজেরই খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল ইচ্ছামতীর পাঠকদের জানানো উচিত কেন সময়মত নতুন লেখা প্রকাশ করতে পারিনি।

৬। এর পরেই লেখা আছে “এইরকম আর কোনদিন হবে না, -সেরকম কোন কঠিন প্রতিজ্ঞা সে করছে না, তবে যেন এরকম না হয়, সেটা বজায় রাখার চেষ্টা করবে আপ্রাণ।“—তা এরকম আর কখনও হয়েছিল? কীরকম?

- হয়েছে। ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ — পরপর তিন বছর পুজোর ঠিক আগে আগে, নিজে কিংবা পরিবারের কেউ না কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে ইচ্ছামতীর ‘পুজোস্পেশ্যাল’ দেরীতে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছি। কম্পিউটারের সামনে বসার বদলে বিছানায় বা হাসপাতালে দিন কেটেছে। ঘটনাচক্রে, এইসব বছরগুলিতে ইচ্ছামতীর ‘পুজোস্পেশ্যাল’ যথেষ্ট হৃষ্টপুষ্ট আকারের হত। তাই কাজ শেষ করতে সময়ও অনেক বেশি লাগত। এমনও হয়েছে যে পুজোর পাঁচদিন ধরে, এক বেলা করে কাজ করে আমি একটু একটু করে কন্টেন্ট আপলোড করেছি। কিংবা কোনো এক বছরে, শেষ অবধি ‘পুজোস্পেশ্যাল’ প্রকাশ পেয়েছে কালীপুজোর সময়ে।

৭। ২০১৩ থেকে আর ‘কাগজ’টি ত্রৈমাসিক রইল না। বলা চলে ‘মুহূর্তিক’ হয়ে গেল। ছাপা কাগজের নিয়ম কেন আন্তর্জালেও থাকবে—এর সংশোধন হবে না—এই কথাগুলো বেশ সুন্দর গুছিয়ে বলা আছে। কিন্তু এত কাজ সামাল দেন কী করে? সে আমরা জানি—আপনি একা করেন না। সঙ্গে আরও আছেন—ছবি একে দেন বিষ্টু মিস্তিরি। তিনি কে? তাঁকে কীভাবে দলে পেলেন? দাড়িদা-টিই বা কে? ধূপছায়া বুঝলাম সম্পাদনা সহযোগী। তাঁর নামটিই কী? এই চারজনেই কি ‘ইচ্ছামতী পরিবার’ ?

- আবার অনেকগুলি প্রশ্ন একসঙ্গে। একে একে উত্তর দিই।

- ইচ্ছামতীর ওয়েবসাইটে ‘ইচ্ছামতী পরিবার’ পাতায় তো ‘পরিবার’ বলতে কী বুঝি সেটা বিশদে লিখেইছি। সেটাই এখানে আরেকবার লিখি - ‘গত পনেরো বছরে নিজেদের লেখায়, ছবিতে ফটোগ্রাফে ইচ্ছামতীকে সাজিয়ে তুলেছেন যাঁরা, আমাদের সেই সমস্ত লেখক-শিল্পী-ফটোগ্রাফার বন্ধুরা ইচ্ছামতী পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইচ্ছামতী পুরনো- নতুন সব বন্ধুকে মনে রেখেছে এবং যিনি একবারের জন্যেও ইচ্ছামতীকে লেখা কিংবা ছবি বা ফটোগ্রাফ দিয়েছেন, তাঁকে আমরা সবসময়ে আমাদের পরিবারের অংশ মনে করি এবং করব। ইচ্ছামতী পরিবারের সদস্যদের নামের তালিকা তাই সর্বদাই ক্রমবর্ধমান।’

নিজেদের সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী কেউ কেউ ইচ্ছামতীর কাজকর্মের সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য যুক্ত থেকেছেন। আবার যখন তাঁদের অন্যদিকে কাজ বেড়েছে, স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা সময় দিতে পারেন নি। ইচ্ছামতীর প্রথম কয়েক বছরে কল্লোল লাহিড়ী আমাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। মাঝে আরেকজন সক্রিয় সহযোগী ছিলেন দেব কুমার বেরা, যিনি ‘নিধু সর্দার’ ছদ্মনামে ছোটদের জন্য গল্প লেখেন।

গত পনেরো বছরে বিভিন্ন সময়ে, ইচ্ছামতীতে অলংকরণ শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় চল্লিশ জন শিল্পী। এঁদের মধ্যে স্কুল এবং কলেজের ছাত্রছাত্রী যেমন আছে, তেমনই রয়েছেন পেশাদার এবং অপেশাদার শিল্পীরা। এই সমস্ত শিল্পীরা ইচ্ছামতী পরিবারের বেজায় গুরুত্বপূর্ণ রঙিন অংশ। আজকের ইচ্ছামতীর পরিচিতিতে এঁদের অবদান অনেকখানি।

- ‘বিষ্টু মিস্তিরি’ যাঁর ছদ্মনাম, তিনি একেবারেই ছবি আঁকেন না। তিনি পেশায় ওয়েব ডেভেলপার এবং আমার সহকর্মী। তাঁর নাম রজত নারায়ণ। ইচ্ছামতীর মত একটা বিশাল ওয়েবসাইটকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে সর্বদা ঠিকঠাকভাবে সচল রাখার জন্য আমি তাঁর ওপর ভরসা করি।

- ‘দাড়িদা’ আমার ভাই কৌস্তুভ রায়। ইচ্ছামতীর লোগো, রঙের স্কিম, ওয়েবসাইটের ব্যাকগ্রাউন্ড ইমেজ — এই সমস্ত কিছুর পেছনে তাঁর মাথা। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হলে তিনি ইচ্ছামতীর জন্য দুর্দান্ত সব ছবিও এঁকে দিয়েছেন। সে সবই অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগের কথা।

- ধূপছায়ার পুরো নাম ধূপছায়া মজুমদার। তিনি নিজগুণে একজন বলিষ্ঠ লেখিকা। ছোটদের এবং বড়দের জন্য সমানতালে গল্প এবং নিবন্ধ/ প্রবন্ধ লিখতে সিদ্ধহস্ত। ২০১৮ সাল থেকে ইচ্ছামতীর সম্পাদনা সহযোগী হিসাবে নিজের সুযোগ সুবিধামত কাজ করেছেন।


৮। ইচ্ছামতীতে দেখলাম ‘চাঁদের বুড়ির চরকা চিঠি’, ‘ছড়া-কবিতা’, ‘গল্প-স্বল্প’, ‘রূপকথা’ থেকে শুরু করে ‘মজার পাতা’ পর্যন্ত প্রায় সাতাশটি বিভাগ আছে। চারজনে এত সামাল দেন কী করে? তার উপরে দাড়িদা তো ‘গেছোদাদা’র মতো যাকে ‘’ প্রয়োজনের সময়ে বেশিরভাগই খুঁজে পাওয়া যায়না’?

- ‘দাড়িদা’ ২০১৬ সালের পর থেকে সরাসরি ইচ্ছামতীর কোনো কাজে যুক্ত থাকতে পারেন নি। তবে সময়-সুযোগমত ছবি আঁকা ছাড়া বা কিছু পরামর্শ দেওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো দায়িত্ব সেই অর্থে ছিল না। ইচ্ছামতীকে ‘মূহূর্তিক’ করার ভাবনাটা তিনিই প্রথম আমাদের যুগিয়েছিলেন এবং জোর দিয়েছিলেন। ‘বিষ্টু মিস্তিরি’-র মাতৃভাষা হিন্দি। তিনি বাংলা লিখতে-পড়তে পারলেও, সম্পাদনা সংক্রান্ত কোনো কাজই তাঁর এক্তিয়ারে নয়। তবে মাঝেমধ্যে জরুরী পরিস্থিতিতে কন্টেন্ট আপলোড করার প্রাথমিক কাজগুলি করে দিয়েছেন। ধূপছায়া নিজস্ব লেখালিখির ফাঁকে যতটা সম্ভব আর যেখানে সম্ভব সম্পাদনা সংক্রান্ত বিবিধ কাজে সাহায্য করেন।

ইচ্ছামতীর সমস্ত অলংকরণ শিল্পীদের কথা এখানে আরেকবার উল্লেখ করতেই হয়, কারণ কাজ সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে চাঁদের বুড়ি তাঁদের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। আজকের ইচ্ছামতীর জনপ্রিয়তায় তাঁদের প্রত্যেকের অবদান রয়েছে। কাহিনির প্রয়োজন এবং সম্পাদকের চাহিদা বুঝে সময়মত ছবি এঁকে পাঠিয়েছেন তাঁরা।

এর বাইরে যত কাজ বাকি থেকে গেল, সেসবের দায়িত্ব আমি একাই সামলাই। লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ, বিষয় এবং লেখা নির্বাচন, সেগুলির সঙ্গে ছবি আঁকার জন্য শিল্পী নির্বাচন, লেখা সম্পাদনা এবং প্রতিটা লেখাকে ছবি সহ সাজিয়ে-গুছিয়ে সঠিকভাবে ওয়েবসাইটে আপলোড করা — সবই আমি নিজে করি। প্রয়োজনে রং-তুলি নিয়ে ছবি আঁকা বা গ্রাফিক ডিজাইন করা, ‘চাঁদের বুড়ির চরকা-চিঠি’ (সম্পাদকীয়) সহ ইচ্ছামতীর কিছু কিছু বিভাগে নিয়মিত লেখা এবং সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট ও আমার কাজের মধ্যে পড়ে।

এই আগের অনুচ্ছেদে এতকিছুর সঙ্গে ‘আমি’ ব্যবহার করে মনে হচ্ছে ‘নিজের ঢাক নিজে পেটাচ্ছি’। ছোটবেলায় এমন করতে বারণ করা হত। কিন্তু ইচ্ছামতী একটি অবাণিজ্যিক উদ্যোগ; আমি লেখক বা শিল্পীদের কোনো সাম্মানিক দিতে পারি না। তাঁরা স্বেচ্ছায় ইচ্ছামতীকে লেখা বা ছবি দেন। এই পরিস্থিতিতে বাকি এত বিবিধ ধরনের কাজ কাউকে দিয়েই বিনা পারিশ্রমিকে করানো সম্ভব বা সঠিক নয়। তাই বেশিরভাগ কাজ আমাকে নিজেকেই করে নিতে হয়।

৯। ছোটোদের জন্যে লেখকের সংখ্যা কী বাড়ছে না কমছে? প্রশ্নটি এর জন্যেও করলাম কেন না—আমাদের পূর্বোত্তরে তো লিখে কোনও আয়ও হয় না পুরস্কারও জোটে না। ফলে ছোটদের জন্যে তো আলাদা করে লেখক সেরকম প্রায় বিরল। বড়োদের লেখকেরাও সহজে এই দিকে পা ফেলেন না। টেনিদা, ঘনাদা, কাকাবাবু, প্রফেসর শঙ্কু বা ফেলুদার মতো চরিত্র স্রষ্টা আমাদের নেই বললেই চলে। আর বর্তমান কাগজটি করতে গিয়ে দেখছি, বড়দের লেখকদের দিয়েই অনভ্যস্ত হাতে লেখাতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপনাদের অভিজ্ঞতা কী?

- আপনার প্রশ্নটা পড়ে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। ২০২১ সালে দ্বিতীয় লকডাউন চলাকালীন এক সন্ধ্যায় আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ফোনে গল্প করছিলাম। তাঁর বছর ছয়েকের ভাইঝি সেই সময়ে এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে তিনি কার সঙ্গে গল্প করছেন। ফোন ধরে রেখেই আমার বন্ধু তাকে বলেন – “ওই যে তোমাকে ইচ্ছামতী থেকে গল্প পড়ে শোনাই, সেই ইচ্ছামতীর চাঁদের বুড়ির সঙ্গে গল্প করছি।” এর পরে আমি ফোনের এপাশ থেকে শুনতে পেলাম ছোট্ট মেয়েটি অবাক গলায় বলছে, “সে তো মরে গেছে!” খানিক হতভম্ব হয়ে এবং তারপর প্রবল হাসির মধ্যে দিয়ে আমরা বুঝতে পারলাম যে, যেহেতু এই শিশুটি মূলত এমন সমস্ত লেখক-লেখিকার গল্প বা কবিতা শুনেই বড় হচ্ছে যাঁরা আজ প্রয়াত — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সুখলতা রাও, পুন্যলতা চক্রবর্তী, যোগীন্দ্রনাথ সরকার — তাই সে ধরেই নিয়েছে চাঁদের বুড়িও তেমনই কেউ!

ছোট্ট মেয়েটির গল্প বলতে গিয়ে আমি যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম, তাঁরা যে সময়ে সক্রিয় ছিলেন তার পরে মোটামুটি একটা গোটা শতাব্দীর বেশি কেটে গেছে। তবুও তাঁদের লেখা বইগুলি আজও বাংলা শিশু সাহিত্যের ক্লাসিক উদাহরণ। আবার আপনি যে সমস্ত চরিত্রদের কথা আপনার প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন, তারা আজ থেকে অন্তত পঞ্চাশ বা আরও বেশি বছর আগে সৃষ্ট চরিত্র। তাদের সমসময় এবং পরেও বাংলা সাহিত্যে একাধিক নতুন গোয়েন্দা, বিজ্ঞানী, অনুসন্ধানী বা অভিযাত্রী চরিত্র নির্মিত হয়েছে। প্রতি বছর এই সমস্ত চরিত্রদের নিত্যনতুন অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তারপরে সংকলন হিসেবেও প্রকাশ পায়। নতুন চরিত্রগুলির জনপ্রিয়তা বা পরিচিতি বা নিজস্ব ফ্যান ক্লাব নেই এমন কথাও হলফ করে কেউ বলতে পারবে না। এছাড়াও, কোনো নির্দিষ্ট চরিত্র ছাড়াও, সামাজিক গল্প, ভূতের বা হাসির গল্প , রূপকথা বা কল্পবিজ্ঞান লেখাতেও খামতি নেই; অনুবাদ এবং লোককথা-অতিকথার পুনর্লিখনও হচ্ছে। সব মিলিয়ে, পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষায় এই মূহুর্তে শিশু-কিশোরদের জন্য বিবিধ ধারায় যথেষ্ট পরিমাণে লেখালিখি হচ্ছে। বরং এটা বলা যেতে পারে যে, সঠিক প্রচারের অভাবে ভালো বইয়ের খবর যথেষ্ট পরিমাণে উৎসাহী পাঠকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।

উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্য চর্চা বিষয়ে আমার ধারণা খুবই সীমিত। তাই এই বিষয়ে কোনো বিশদ মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত কিশোর-কিশোরীদের জন্য পত্রিকা ‘কিশোর বার্তা’-র সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আসাম থেকে অধ্যাপক সুশান্ত কর, প্রখ্যাত অসমিয়া শিশুসাহিত্যিক হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের লেখা ছোটদের নাটক ইচ্ছামতীকে অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন। এছাড়া ‘একপর্ণিকা’ নামের শিশু-কিশোরদের জন্য ওয়েব পত্রিকাটিও ত্রিপুরা থেকেই প্রকাশিত হয়।

বাংলা ভাষায় এই মূহুর্তে বহু লেখক-লেখিকা ছোটদের জন্য নিয়মিত কলম ধরছেন । প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ কলমের পাশাপাশি অনেক নতুন জোরদার কলমও চলছে। শুধুমাত্র মুদ্রিত পত্রপত্রিকাই নয়, নিয়মিত নতুন কন্টেন্ট এর খোঁজে থাকা একাধিক ওয়েব পত্রিকা এই নতুন কলমদের হাত পাকানোর জায়গা করে দিচ্ছে। বরিষ্ঠ থেকে তরুণদের মধ্যে — জয়া মিত্র, অনিতা অগ্নিহোত্রী, শিশির বিশ্বাস, অচিন্ত্য সুরাল, রতনতনু ঘাটী, শিবশংকর ভট্টাচার্য, অনিরুদ্ধ সেন, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, শুক্তি রায়, যশোধরা রায়চৌধুরী, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, সৈকত মুখোপাধ্যায়, অনন্যা দাস, ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়, তৃষ্ণা বসাক, জয়া চৌধুরী, দীপান্বিতা রায়, চুমকি চট্টোপাধ্যায়, তাপস মৌলিক, হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত, জয়দীপ চক্রবর্তী, তরুণ কুমার সরখেল, মৃগাংক ভট্টাচার্য, শাশ্বতী চন্দ, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, অদিতি ভট্টাচার্য, দ্বৈতা গোস্বামী, সুস্মিতা কুন্ডু, ধূপছায়া মজুমদার — এক দীর্ঘ তালিকার থেকে তুলে নেওয়া কয়েকটি মাত্র নাম, যাঁরা এই সময়ে বাংলা ভাষায় নানা বয়সী শিশু-কিশোরদের জন্য নানা স্বাদের গল্প-উপন্যাস-ছড়া-কবিতা-রূপকথা-অনুবাদ গল্প উপহার দিচ্ছেন। উল্লেখ করা বাকি থেকে গেল যে নামগুলি, সেই তালিকা অনেক বেশি দীর্ঘ। শিশু-কিশোরদের উপযোগী শুধুমাত্র নিবন্ধ বা প্রবন্ধ লেখাতেই মনোনিবেশ করেছেন, এমন লেখকের সংখ্যাও প্রচুর।

লিখে আয় বা পুরস্কার পাওয়া যদি লেখকদের প্রধান চিন্তা হত, তাহলে বোধহয় ইচ্ছামতী বা এমন অন্যান্য ছোটদের এবং বড়দের অবাণিজ্যিক পত্রিকাগুলি চলতই না। সত্যি কথা বলতে গেলে, যত দিন যাচ্ছে, বাংলা ভাষায় সাময়িক এবং পূজাবার্ষিকী পত্রিকার সংখ্যা তত বাড়ছে, এবং তাদের মধ্যে ছোটদের জন্য পূজাবার্ষিকীও অনেক রয়েছে। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন ওয়েব পত্রিকা। ফেসবুকে রয়েছে অসংখ্য সাহিত্যচর্চার গ্রুপ। এই সমস্ত পত্রিকা এবং অনলাইন গ্রুপে লিখছেন বহু মানুষ। তবে হ্যাঁ, শুধুমাত্র ছোটদের জন্যই লিখছেন, এমন সাহিত্যিকের সংখ্যা এই মূহুর্তে বিরল। বেশিরভাগই বড়দের জন্য লেখার পাশাপাশি ছোটদের পত্রপত্রিকাতেও লেখেন। সেই লেখা হয়ত একটা নির্দিষ্ট সময়কালে বড়দের জন্য লেখার তুলনায় সংখ্যায় কম হয়। অনেক সময়েই দেখেছি, যাঁরা নিয়মিত বড়দের জন্য লেখেন, তাঁরা অনেকেই ছোটদের জন্য লিখতে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। আবার অনেকেই প্রথমবার ছোটদের জন্য লেখার পরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন এবং আরও লিখতে থাকেন।

আজ থেকে মোটামুটি ৩৫-৪০ বছর আগে, আমাদের বাল্যকালে, সামাজিক জীবনে ইন্টারনেট ছিল না, টেলেভিশন চলত নির্দিষ্ট সময়ে, একটি বা দুটি চ্যানেল। তাই আমাদের ছোটবেলায়, খেলাধুলো বা অভ্যাসমত নাচ-গান-আঁকার ক্লাস বাদ দিলে, বই পড়াই ছিল একমাত্র ব্যক্তিগত বিনোদন। আজকের দিনে, একটি শিশু জন্মে থেকে চোখের সামনে টেলেভিশনে বা মোবাইলে চব্বিশ ঘন্টা চলতে থাকা কার্টুন চ্যানেল দেখতে অভ্যস্ত। একটু বড় যারা, তারা আন্তর্জাতিক অডিও-ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট — জাপানি অ্যানিমে বা কোরিয়ান ড্রামা বা কে-পপ গান নিয়ে যত উৎসাহী, বই পড়তে তত নয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে যারা, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ বই পড়লেও হয়ত ‘peer pressure’-এ / বন্ধুদের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে ইংরেজি বই পড়তে বেশি উৎসাহী। এই সমস্ত বাচ্চাদের সর্বক্ষণ হাতের মুঠোয় থাকা রঙিন দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমের ঘোর কাটিয়ে সাদা-কালো বা আংশিক রঙিন বাংলা বইয়ের দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনার কাজটা অনেকাংশেই অভিভাবকদের দায়িত্ব এবং হয়ত স্কুলগুলিরও দায়িত্ব থেকে যায়।

আমার অভিজ্ঞতায়, আমরা সার্বিকভাবে ছোটদের জন্য বই বা পত্রিকা নিয়ে যতটা আলোকপাত করা উচিত ততটা করি না, বরং বলা যায় বেশ কম করি। বাংলা ভাষায় প্রতি বছর ছোটদের জন্য বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে বিভিন্ন লেখক-লেখিকার যত বই প্রকাশিত হয়, সহজে সবক’টির হদিশ পাওয়া মুশকিল। আজকের দিনে, যাঁদের ক্রয়ক্ষমতা আছে, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ আগেই বই সম্পর্কে খোঁজ নেন ইন্টারনেটে। সেক্ষেত্রে, ইংরেজি ভাষার একটা বই সম্পর্কে যত ধরনের তথ্য পাওয়া যায়, একই মানের বাংলা ভাষার বই সম্পর্কে সেইরকম তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। শুধুমাত্র ছোটদের জন্য বই প্রকাশ করেন, এমন প্রকাশকের সংখ্যা হাতে গোনা। ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট’ বা ‘শিশু সাহিত্য সংসদ’ থেকে নানা বয়সী শিশু-কিশোরদের জন্য যত বই পাওয়া যায়, সেগুলির বেশিরভাগের খবর বছরে একবার বইমেলা ছাড়া পাওয়া দুষ্কর। এদের ওয়েবসাইটগুলিও যথেষ্ট আপডেট করা থাকে না। এছাড়া, আজকাল প্রকাশনার ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি হয়েছে ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’। এই পদ্ধতিতে দেখা যাচ্ছে যে অনেক সময়েই একটা বই প্রকাশ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আর বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না, বা পুনর্মুদ্রিত হচ্ছে না। এটাও এক ধরনের ক্ষতি।

আজকের ব্যস্ত জীবনে, অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত মানুষের আলাদা করে কয়েকটা ছোটদের বইয়ের খোঁজ করার জন্য কলেজ স্ট্রীটে ( কলকাতার ক্ষেত্রে) না যেতে চাওয়ার একাধিক কারণ থাকতে পারে। তবে কোভিড লকডাউন চলাকালীন, কলকাতার বেশিরভাগ প্রকাশক হোয়াটস্যাপ মারফত অর্ডার নিয়ে বই বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া শুরু করায়, এখন সঠিক হদিশ থাকলে বাড়িতে বসেও বই পাওয়া সম্ভব।

আজকের দিনে, বইয়ের সঠিক প্রোমোশন জরুরী। জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর প্রোমোশন আসলে হয় নিজের পরিচিত বৃত্তটুকুর মধ্যেই। সোশ্যাল মিডিয়াকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে গেলে যে পরিমাণ সময়, শ্রম এবং অর্থ ব্যয় করা প্রয়োজন, সেটা স্বাভাবিকভাবেই সবাই করে উঠতে পারেন না। তাই ছোটদের জন্য লেখা নতুন এবং পুরনো বই সম্পর্কে ছোট-বড় সবাইকে অবহিত করার জন্য আলাদা করে ছোটদের বই নিয়ে বইমেলা, বা রাজ্য জুড়ে শুধুমাত্র ছোটদের বইয়ের বিপণী বা লাইব্রেরি, বা বিদেশের ধাঁচে পাড়ায় পাড়ায় বিনামূল্যে পড়ার বইঘর — এমন ধরনের ভাবনা ভাবা প্রয়োজন। ইন্টারনেট প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে পুরনো বইয়ের অনলাইন ওপেন আর্কাইভ আর নতুন বইয়ের ডেটাবেস থাকা উচিত। গত কয়েক বছরে মুদ্রন এবং ওয়েব টেকনোলজিতে প্রভূত উন্নতি এবং পরিবর্তনের ফলে এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে একটা বইয়ের মুদ্রিত সংস্করণের থেকে ডিজিটাল সংস্করণের দাম অনেক কম রাখা সম্ভব। তাই ছোটদের বিভিন্ন বইয়ের মুদ্রিত সংস্করণের পাশাপাশি যদি ডিজিটাল সংস্করণ রাখা সম্ভব হয় তাহলে হয়ত প্রবাসী অভিভাবকেরাও এই সমস্ত সংস্করণ কিনতে আগ্রহী হতে পারেন।

ইচ্ছামতীতে একেবারে প্রথম সংখ্যা থেকেই আমরা বই নিয়ে আলোচনার আলাদা একটা বিভাগ রেখেছিলাম – ‘বইপোকার দপ্তর’। এই বিভাগে আমরা চেষ্টা করেছি ছোটদের ভালো বইয়ের হদিশ দিতে।

এই ধরনের কাজগুলি একবার করার মত বা একক উদ্যোগে করার মত কাজ নয়। বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যকে নতুন করে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হলে, দীর্ঘ সময় ধরে, লেখক-শিল্পী-প্রকাশক-পাঠকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরী। সঙ্গে প্রয়োজন সরকারি এবং বেসরকারি সহযোগিতা।

১০। আমাদের পূর্বোত্তরে ছোটোদের লেখক কমে যাবার আরও একটি কারণ ছোটোরা বাংলা পড়তে পারছে কম। শিক্ষা ব্যবস্থাতেও এত পরিবর্তন আসছে যে যাদের কাগজ কিনে পড়বার সামর্থ্য আছে তাঁদের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলা ভাষাটাই আর লিখতে পড়তে পারছে না। পারছে তারাই যাদের সেরকম কাগজ বা বই কিনে পড়বার সামর্থ্য নেই। শিক্ষা ব্যবস্থার এই পরিবর্তন তো সারা দেশেই এক। এমন অবস্থাতে আপনাদের অভিজ্ঞতা কেমন? পাঠক কারা? ছোটোরাই কি বেশি বেশি পড়ছেন, না ছোটোদের জন্যে লেখা বড়রাই পড়ছেন?

- আমার অভিজ্ঞতা বলে, বড়রা পড়েন এবং তাঁরা ছোটদের পড়ান বা পড়ানোর চেষ্টা করেন। বড়রা না পড়লে ছোটদের তাঁরা জানাবেন কী করে যে বাংলা ভাষায় একটি বিশেষ বই/ পত্রিকা / ওয়েব পত্রিকা আছে?


আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারতে বাংলা শুধুমাত্র দুটি রাজ্যের ভাষা, যা হয়ত আরও কিছু রাজ্যে কমবেশি ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের কথাই যদি ধরি, এখানে ছেলেমেয়েদের স্কুলে দুটি বা তিনটি ভাষা পড়তে হয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হলে বাংলা ভাষা আলাদা করে গুরুত্ব পায় না। তার মধ্যে, গত কয়েক দশকে, বিভিন্ন কারণে ( আমি বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না), পাঠ্য বিষয় হিসেবে বাংলা ভাষা গুরুত্বহীন বা কেরিয়ার তৈরির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অপ্রয়োজনীয় — এমন ভাবনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে শহরে এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া ছেলেমেয়ে এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে। কিন্তু বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়া ছেলেমেয়েরা তো এখনও বাংলাতেই পড়ছে। তাই গল্পের বই বা ওয়েব পত্রিকা পড়ার ক্ষেত্রে তাদের বেশিরভাগের প্রথম পছন্দ বাংলা বই হবে এটাই স্বাভাবিক।


এই অবস্থাত বিপরীত ছবিও দেখেছি। দিল্লীতে বেড়ে উঠছে এমন এক ছোট্ট ছেলেকে তার অভিভাবকেরা ইচ্ছামতীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরে, সে নিজের ঠাকুমাকে বলেছে — তোমার যেমন নিজের একটা ম্যাগাজিন আছে, ইচ্ছামতী তেমন আমার নিজের ম্যাগাজিন। আবার কলকাতা শহরের নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে গল্প লেখার ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখেছি অংশগ্রহণকারী ছেলেমেয়েরা দিব্যি বাংলায় গুছিয়ে গল্প লিখছে।


অতীতে মুম্বই, দিল্লি এবং গুজরাতের বিভিন্ন বয়সী প্রবাসী বাঙালি ছেলেমেয়েরা নিজেদের আনাড়ি হাতে লেখা গল্প এবং অনুবাদ পাঠিয়েছে ইচ্ছামতীকে। সম্প্রতি সদ্য প্রবাসী হওয়া এক মেয়েকে বাংলায় লেখা পাঠাতে উৎসাহিত করেছেন তার মা। আবার আর এক মা জানতে চেয়েছেন ইচ্ছামতীর মুদ্রিত সংস্করণ পাওয়া যায় কি না, কারণ তিনি তাঁর গল্প পড়তে আগ্রহী ছোট্ট মেয়ের হাতে মোবাইল বা ট্যাব দিতে চান না।


তাই, শুধুমাত্র পরিচিত বৃত্তের কয়েকটি ছেলেমেয়েকে দেখে বাংলা ভাষা বা বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের বর্তমান বা ভবিষ্যত বিষয়ে কোনো রায় বা মতামত দেওয়া ঠিক হবে না। পাঠক নেই তাই লেখক নেই — এমন সরল সমীকরণের বদলে বোধহয় ভাবার দরকার যে, পাঠকের প্রয়োজন বা পছন্দমত বিষয়বস্তু, সহজ ভাষায়, সরস ভাবে যোগান দেওয়া যাচ্ছে কি না।


ওয়েব পত্রিকা দেখতে হলে ইন্টারনেট সংযোগ এবং টাকার কথা আসে, এটা ঠিক। ছাপা গল্পের বই কি সবসময়ে সেই তুলনায় সহজলভ্য? সে তো নয়। বরং একটা বইয়ের দামে কয়েকদিনের ইন্টারনেট সংযোগ হয়ে যেতে পারে, যেখানে একটা না, একাধিক পত্রিকা রয়েছে, যেগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিনামূল্যে পড়া যায়। তাই কোনো নাবালক যদি সত্যিই চায়, তাহলে বই কিনে বা যোগাড় করে হোক, বা ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে হোক, সে গেম খেলা বা অপ্রয়োজনীয় রিল্‌স্‌ দেখার বদলে সাহিত্যপাঠে সময় দিতে পারে। এমনটা হবে কি না, সেটা তার এবং তার অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত।


ওয়েবসাইট বা ওয়েব পত্রিকা এক অপেক্ষাকৃত নতুন মাধ্যম। যেকোনো অন্যান্য নতুন মাধ্যমের মতই, এটিকে বুঝতে এবং ব্যবহার করতে মানুষের কিছুটা সময় লেগেছে। অতিমারির দুটি বছরে, সমাজের সমস্ত স্তরে এবং সমস্ত কাজেকর্মে এই বুঝতে পারা এবং ব্যবহার করার পরিমাণ এক লাফে কয়েকশো গুণ বেড়ে গেছে। গত দুই -তিন বছরে, অতিমারি আক্রান্ত সময় পেরিয়ে খেয়াল করছি ইচ্ছামতীর পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে স্কুল বা কলেজের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। তারা বাংলায় লিখে আমাদের হোয়াটস্যাপ নম্বরে মেসেজ পাঠায় নিজের পাঠ্য বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর চেয়ে। আন্দাজ করতে পারি, বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করে, এমন আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের এমন সমস্ত চাহিদা থাকলেও, যোগান যথেষ্ট নেই। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় সাহায্য করার জন্য নানাধরনের মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের জন্য, যতদূর জানি একটাই অ্যাপ আছে , যেখানে পেইড সাবস্ক্রিপশন নিতে হয়। এমন সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে পড়াশোনায় সাহায্য করার ইচ্ছে থাকলেও, ইচ্ছামতীর এই মূহুর্তে সেইরকম পরিকাঠামো নেই।

১১। ‘ইচ্ছামতী ’ ছাড়া আর কারা কারা ভারতে বাংলাদেশে আন্তর্জালে ছোটোদের জন্যে সাহিত্য পত্রিকা করছেন—কিছু জানাতে পারেন?


- আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ‘পরবাস’ ওয়েব পত্রিকাতেই প্রথম ছোটদের জন্য আলাদা করে একটি বিভাগ শুরু হয়। এই পত্রিকাটি প্রথম বাংলা ওয়েব পত্রিকাগুলির মধ্যে একটি। ভারতে ইচ্ছামতী ছাড়াও শুধুমাত্র শিশু-কিশোরদের জন্য অন্যান্য ওয়েব পত্রিকাগুলি হল ‘জয়ঢাক’, ‘ম্যাজিক ল্যাম্প’, ‘একপর্ণিকা’, ‘জ্বলদর্চি’। মূলত বড়দের জন্য কন্টেন্ট থাকলেও, ‘কল্পবিশ্ব’ কাজ করে শুধুই কল্পবিজ্ঞান নিয়ে। এছাড়াও মাঝে আরও কয়েকটি ওয়েব পত্রিকা শুধুমাত্র ছোটদের জন্য কাজ শুরু করেছিল — ‘দিয়ালা’, ‘ক্রমশ কিশলয়’, ‘হযবরল’, ‘ঘোড়াড্ডিম’ — যেগুলি আপাতত আর প্রকাশিত হয় না বলেই জানি।


বাংলাদেশে আলাদা করে শুধুমাত্র ছোটদের জন্য ওয়েব পত্রিকা আছে কয়েকটি। যেটা লক্ষণীয়, সেখানকার বেশিরভাগ নিউজ পোর্টালগুলিকে একটি করে ছোটদের বিভাগ থাকে। সেখানে শুধু বড়রা নয়, ছোটরাও নিয়মিত সক্রিয়ভাবে লেখা এবং সম্পাদনার কাজে অংশগ্রহণ করে।


এখানে বলে রাখি, আজকের পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তর-পূর্বের কিছু রাজ্যের তুলনায়, বাংলাদেশে বাংলাভাষার গুরুত্ব, স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। ইচ্ছামতীতে ছোটদের বিভাগে/ ছোটদের লেখা কিন্তু আগে এসেছে বাংলাদেশ থেকে। বাংলা ওয়েব পত্রিকা বা কম্যুনিটি ব্লগ নিয়ে সেখানকার মানুষ অনেক আগে থেকে কাজ করছেন। আজ থেকে দশ-বারো বছর আগেই বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীরা নিজের ইমেইল আইডি থেকে লেখা পাঠাত। ভারতীয় ছেলেমেয়েরা নিজেদের লেখা পাঠাতে শুরু করেছে অনেক পরে।

১২। এইবারে কি ‘খাজাঞ্চির খাতা’র কথা পাড়তে পারি? আয় কিছু আছে গুগোল মনিটাইজেশন বা তেমন কোনও উৎস থেকে? ব্যয়ভার কী করে সামাল দেন?


- ২০১৩ সালের ৮ জুন, কলকাতার EZCCপ্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় ‘বেঙ্গল ওয়েব ফেয়ার’। সেখানে বিভিন্ন বাংলা ওয়েবসাইট অংশগ্রহণ করেছিল। তখনও সাধারণ মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন ছিল না, ওয়েব পত্রিকা সম্পর্কে বেশিরভাগেরই অস্পষ্ট ধারণা ছিল। সেই অনুষ্ঠানে আমরা ২০০৮-২০১৩ সালের জুন মাসের আগে অবধি প্রকাশিত ইচ্ছামতীর সমস্ত সংখ্যা সিডি-রম বন্দী করে নিয়ে গেছিলাম। সিডি-তে অন্তত ১৮টি সম্পূর্ণ সংখ্যা ছিল। দাম রাখা হয়েছিল ১০০/-। আশা ছিল উৎসাহী মানুষ সেইসব সিডি কিনবেন, বাড়ি নিয়ে গিয়ে কম্পিউটারে চালিয়ে দেখবেন। যাইহোক, সেই অনুষ্ঠানে আমাদের একটাই সিডি বিক্রি হয়েছিল— আমার এক দিদি কিনেছিলেন। গত পনেরো বছরে ইচ্ছামতীর উপার্জন বলতে ওই ১০০/-।


২০০৮ সালের প্রথম মাস থেকেই এই প্রশ্ন শুনে আসছি, এবং আজও শুনি। উত্তর তখনও যা ছিল, আজও তাই আছে। ইচ্ছামতী সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিক উদ্যোগ। ইচ্ছামতীর কোনো উপার্জন নেই। শুরুর দিকে ইচ্ছে থাকলেও গুগ্‌ল্‌ মনিটাইজেশনের সুযোগ নেওয়া যেত না, কারণ সেই সময়ে গুগ্‌ল্‌ বাংলা ওয়েবসাইটের জন্য এই ব্যবস্থা রাখেনি। বেশ কয়েক বছর পর থেকে, গুগ্‌ল্‌ ছাড়াও ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন রাখার আরও কিছু ব্যবস্থা/ উৎস হয়েছে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অন্যান্য বহু ওয়েবসাইট ভর্তি কন্টেন্ট-এর থেকে বেশি বিজ্ঞাপন দেখে একজন ইউজার হিসেবে আমি এত বিরক্ত থাকি, যে ইচ্ছামতীর ক্ষেত্রে আর সেই একই ধরনের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করার ইচ্ছা হয়নি। আর্থিক দিক থেকে দেখতে গেলে হয়ত এই সিদ্ধান্ত একেবারেই বেঠিক। কিন্তু ইচ্ছামতীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পেরে আমি খুশি।


তাই ওয়েবসাইটের ডোমেইন এবং হোস্টিং-এর দাম এবং পত্রিকা সংক্রান্ত অন্যান্য যা খরচা এতদিনে হয়েছে, সবের ব্যয়ভার নিজের পকেট থেকেই সামাল দিতে হয়।

১৩। পনেরো বছর তো হল। ত্রিশ পার করবে আশা করতে পারি?


- এই প্রশ্ন পড়ে একসঙ্গে অনেক কথা মনে হচ্ছে।


অচেনা পথে প্রথম হাঁটার অনেক অসুবিধা যেমন আছে, তেমন আবার নিত্যনতুন বিষয়ে প্রথম অভিজ্ঞতা লাভের রোমাঞ্চ এবং আনন্দও আছে। একবার এক প্রবীণ প্রিয় সাহিত্যিক মন্তব্য করেছিলেন — ওয়েব পত্রিকা কারা পড়ে বা আদৌ কেউ পড়ে কি না তিনি জানেন না; তিনি নিজে বোঝেন না তাই তাঁর এ নিয়ে উৎসাহ নেই; যেখান থেকে কোনো উপার্জন নেই, সেই কাজ বছরের পর বছর কেন করে যাচ্ছি — একাধিকবার জানতে চেয়েছেন বন্ধুরা। পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ নেই কেন, ফেসবুকে কেন সব গল্প কবিতা পোস্ট করছি না, করলে আর আলাদা করে ওয়েবসাইট খোলার কষ্ট করতে হয় না — এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি তিন-চার বছর আগে অবধিও। অন্যদিকে, কাজের প্রয়োজনে যোগাযোগ হয়েছে, এমন একাধিক বিদেশি বন্ধু এমন এক ওয়েব পত্রিকার কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছেন, “পাব্লিক ডোমেইনে দেশীয় ভাষায় ছোটদের উপযোগী লেখালিখি বিনামূল্যে প্রকাশ করছ — এটা তো তোমরা এক ধরণের কম্যুনিটি সার্ভিস দিচ্ছ।” এমন নানা প্রতিক্রিয়া পেরিয়ে, গত বছর এক তরুণী অধ্যাপিকা যোগাযোগ করে জানালেন তিনি বাংলা এবং অসমিয়া ভাষায় ওয়েব পত্রিকা এবং ওয়েবে সাহিত্যচর্চা নিয়ে পি এইচ ডি করছেন। কলকাতায় এসে এই বিষয় নিয়ে তিনি একাধিক সাহিত্যিক এবং ওয়েব পত্রিকার সম্পাদক সহ আমার সঙ্গেও কথা বলেন। সেদিন বেশ বিমিশ্র অনুভূতি হয়েছিল — ২০০৮ সালে ভাবিওনি এমন কোনো দিন আসতে পারে।


আপনি নিশ্চয় জানেন, গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপনের থীম হিসেবে, ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফ থেকে মাতৃভাষায় প্রাথমিক পড়াশোনা এবং তথ্য বিনিময়ের ওপর বারে বারে জোর দেওয়া হচ্ছে। মাতৃভাষায় কথোপকথন এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে হারিয়ে যেতে বসা স্থানীয় লোককথা, অতিকথা, শিল্প-সংস্কৃতি বিষয়ে তথ্যাবলী, আঞ্চলিক জ্ঞানভান্ডার। ইচ্ছামতীর দর্শন এই ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। ছোটদের জন্য লেখা একটা গল্প কিংবা নিবন্ধ — ছোট বা বড়, গ্রামের বা শহরের, ধনী বা দুঃস্থ — যেকোনো জায়গার যেকোনো বয়সী, যেকোনো সামাজিক স্তরের পাঠককে যদি কোনোরকমের নতুন, সদর্থক তথ্য বা ভাবনার যোগান দিতে পারে তাহলে সেইরকম একটা লেখাকে প্রকাশ করা আমি জরুরী মনে করি। সম্পাদক হিসেবে, আজকের ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকাকে আমি শুধুমাত্র ছোটদের জন্য একটা মনোরঞ্জক পত্রিকা হিসেবে দেখি না। ইচ্ছামতী ততটাই ছোটদের জন্য, যতটা বড়দের জন্য। তাই ইচ্ছামতীকে ‘সবুজ মনের রসদ’ বলে পরিচয় দিতে আমি উৎসাহী। নিতান্তই শখের কারণে যাত্রা শুরু করলেও, আজকের ইচ্ছামতী বাংলা ভাষার প্রতি এবং আমার সামগ্রিক প্রতিবেশের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা পূরণ করতে সাহায্য করছে।


এছাড়াও, আপনি যদি গুগ্‌ল্‌ বা ইয়াহু সার্চ-এ গিয়ে ‘ছোটদের ওয়েব পত্রিকা’ / ‘ছোটদের ওয়েব ম্যাগাজিন’ / ‘Bengali children’s web magazine’ — এমন সব ‘সার্চ কী ফ্রেজ’ দিয়ে খোঁজ করেন, তাহলে ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার নাম সার্চ রেজাল্টের প্রথম পাতাতেই দেখতে পাওয়া যাবে। অর্গানিক সার্চের প্রথম পাতায় আসা, বা একেবারেই প্রথমে নাম আসা — এটা কিন্তু একদিনে হয়নি। বেশ কয়েক বছর ধরে টানা সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন করার পরে এমন ফলাফল এসেছে। এবং এমন ফলাফল আনার জন্য আমি গুগ্‌ল্‌ বা ফেসবুক-কে টাকা দিইনি। পুরোটাই নিজে হাতে-কলমে করা। ইচ্ছামতী আজ যেখানে পৌঁছেছে, তার পেছনে রয়েছে গত দেড় দশকের পরিশ্রম।


ফেলে আসা বিভিন্ন সময়ে, ইচ্ছামতীকে নিয়ে নানা পরিকল্পনা করেছি। এত সামান্য পরিকাঠামো নিয়ে বেশিরভাগ পরিকল্পনাই সফল করা সম্ভব হয়নি। তবুও নানা ধরনের ভাবনা চিন্তা চলতেই থাকে। ২০১৬ সালে পুজোর সময়ে ইচ্ছামতীর নিজস্ব অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ লঞ্চ করা হয়। গুগ্‌ল্‌ প্লে স্টোর থেকে অ্যাপটি বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়। এই অ্যাপে ইচ্ছামতীর প্রথম সংখ্যা থেকে প্রকাশিত সমস্ত বিভাগের সমস্ত লেখা পড়তে পারা যায়।*


তবে, গত পনেরো বছরে ইচ্ছামতী যত বদলেছে, চাঁদের বুড়িও ততটাই বদলেছে— সেটা ভুললে চলবে না। পনেরো পেরোলাম বলেই ত্রিশও পেরোব, এমন স্বপ্ন দেখতে আপত্তি না থাকলেও, বাস্তবিক সুবিধা-অসুবিধাগুলির পরোয়া না করলেই নয়। শুধুমাত্র আবেগের ওপর নির্ভর করে একটা কাজ বছরের পর বছর করে যেতে গেলে, কাজটির সঙ্গে যুক্ত সকলেরই যথেষ্ট পরিমাণে ব্যয় করার মত সময়, মানসিক ইচ্ছে এবং শারীরিক ক্ষমতা থাকা জরুরী। আপাতত ধরে নিচ্ছি, সে সবই থাকবে। এমন হতে পারে যে কন্টেন্ট বা প্রকাশনার ধরন বদলাবে, কিন্তু ইচ্ছামতী পরিবারের যৌথ পরিশ্রমের ফসল ছোটদের ওয়েব পত্রিকা ইচ্ছামতী আছে এবং থাকবে।


আরও একবার, এই কথোপকথনের জন্য ‘উজান’ পত্রিকার সবাইকে ধন্যবাদ এবং নমস্কার জানাই।

*( ঠিক এই মূহুর্তে, গুগ্‌ল্‌ এর কিছু নীতি পরিবর্তনের কারণে অ্যাপটি প্লেস্টোর থেকে ডাউনলোড করা যাচ্ছে না। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই আবার অ্যাপটিকে দেখতে পাওয়া যাবে; আমরা কাজ করছি)

[ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে তিনসুকিয়া, আসাম থেকে প্রকাশিত 'উজান' সাহিত্য পত্রিকার উনবিংশ সংখ্যায় ( ১৪৩০/২০২৩)। এই সংখ্যার বিষয় ভাবনা 'শিশু-কিশোর সাহিত্য' ]

 

 

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা