সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
অপার্থিব চাবুক

(১)

রমাকান্ত কেতুপুর গ্রামের এক পুরনো বাড়ির কেয়ারটেকার। বাড়ির মালিক মহেন্দ্র চৌধুরী অনেকদিন আগেই সপরিবারে শহরে গিয়ে থিতু হয়েছেন। তাঁর ছেলেমেয়েরাও দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই কারও এই বাড়ির ওপর বিশেষ আঠা নেই। চৌধুরীবাবু রমাকান্তকে বাড়ি দেখাশোনার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত। আসেন কালেভদ্রে, শহরে থেকেই খোঁজ নেন। তা, রমাকান্তের মতো বিশ্বাসী ও নির্লোভ লোক আজকাল দুর্লভ। ছোটোবেলা থেকে এই বাড়িতে আছে, এখন নিজের মতো করেই বাড়ির দেখাশোনা করে। রমাকান্ত বিয়ে করেছে, তাদের একটি মেয়েও হয়েছিল, কিন্তু – যাক গে, এখন সে ঝাড়া হাত-পা। বাড়ির লাগোয়া উর্বর জমিতে ফল আর সব্জি লাগিয়েছে, তার থেকে আয় মন্দ হয় না। "ও টাকাটা তুই-ই রাখিস", চৌধুরিবাবু ঢালাও অনুমতি দিয়েছেন। তার থেকেই রমাকান্তের সংসার একরকম চলে যায়। এ ছাড়া সে গ্রামের লোকের কিছু সারাই আর হাতের কাজ করে দিয়েও কিছু রোজগার করে। মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে চৌধুরিবাবুর বাড়িতে কিছু টাটকা ফল-সব্জি পৌঁছে দিয়ে আসে।

সেদিন রাতে রমাকান্তের ঘুম আসছিল না। বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ধু-ধু মাঠ আর অগুনতি তারায় ভরা আকাশের দিকে আনমনে চেয়ে ছিল। হঠাৎ রাতের অন্ধকার ভেদ করে আকাশ থেকে একটা আলোর গোলা পৃথিবীর দিকে ছুটে এল। দেখতে না দেখতে সেটা দূর মাঠের বুকে আছড়ে পড়ল, সাথে সাথে আগুন আর বিকট আওয়াজ। ভয়ে, বিস্ময়ে রমাকান্ত স্থির হয়ে গেল। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে দেখে আসে জিনিসটা কী, কিন্তু সাহসে কুলোল না।

সে রাতটা কোনওমতে বিছানায় ছটফট করতে করতে সে পরদিন সকালে যেদিকে জ্বলন্ত জিনিসটা পড়তে দেখেছিল, সেদিকে রওনা দিল। বিরাট মাঠের মধ্যে দিশা পাওয়া সহজ নয়। অনেক মেহনত করেই সে ওটার খোঁজ পেল। মাঠ ছাড়িয়ে কিছু ঝোপজঙ্গল, তার আড়ালে পড়েছে। সেখান থেকে তখনও অল্পসল্প ধোঁয়া উড়ছে। দূর থেকে তাই দেখেই রমাকান্ত হদিস পেল।

বাপ রে, মাটিতে অনেকটা গর্ত হয়ে গেঁথে গেছে জিনিসটা। দেখে প্রথমে মনে হয় এবরো-খেবরো পাথর। কিন্তু কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখল লোহার মতো শক্ত। ছুঁতে গিয়ে আর এক বিপত্তি – ওটা তখনও আগুনের মতো গরম, হাতে ছ্যাঁকা লেগে গেল। অবশ্য পাথরটার কিছু ভাঙা টুকরো এধার-ওধার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সেগুলো ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। কী ভেবে সে তার থেকে দুটো লম্বামতো টুকরো হাতে তুলে নিল। তারপর তার এই আশ্চর্য আবিস্কারকে কিছু লতাপাতা, গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে দিল, যাতে জঙ্গলের পথে চলতে চলতে কারও চট করে নজরে না পড়ে। অবশ্য এখানে লোক চলাচল তেমন নেই, তবুও! জিনিসটা একটু ঠাণ্ডা হোক, তারপর নয় আবার আসবে ভালো করে দেখতে। তার আগে কারও চোখে পড়লে সব মাটি।

হাতের পাথরখণ্ড দুটো দেখেও মনে হল, এগুলো আসলে লোহা। বিশে কামারের কাছে দিলে সে এ দিয়ে দুটো চমৎকার ডাণ্ডা বানিয়ে দেবে। গতরে খেটে খেটে রমাকান্তের শরীরটা পেশল। তার বুকের পাটাটাও খুব চওড়া, কোনও দুশমনকে চট করে ভয় পায় না। অবশ্য ফল চুরি করতে আসা বাচ্চাদের সে দুশমন মনে করে না। বরং তাদের ধরতে পারলে জ্ঞান দিয়ে হাতে কিছু ফলটল ধরিয়ে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ইদানীং কিছু সন্দেহজনক চেহারার লোক আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। কী তাদের মতলব বোঝা যায় না, শুধু চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায় ওরা লোক ভালো নয়। অমন লোকেদের মোকাবিলা খালি হাতে করা যায় না। সে পিস্তল-বোমা কখনও ধরেনি, ধরবেও না। কিন্তু একটা মজবুত ডাণ্ডা পেলেই একহাত লড়ে যাবে।

(২)

আইরিন পাগলের মতো ছুটছে। দমে পাচ্ছে না, তবু ছুটতেই হচ্ছে। কারণ তার পেছনে মৃত্যু তাড়া করেছে।

এমনটা হবে আইরিন ভাবেনি। সে আমেরিকায় থাকে, ছুটিতে কলকাতায় বাড়িতে এসেছিল। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল মেয়ে বিজ্ঞানী হবে। তাই নোবেলজয়ী বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইরিন কুরির নামে তার নাম রেখেছিল। মেয়ে অবশ্য বাবার ইচ্ছে পূরণ করার পথে অনেকটা এগিয়েছে। সে ফিজিক্সে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে এখন মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে এম-এস করছে।

ঘটনাটার শুরু আকস্মিকভাবে। একদিন পাড়ার স্টোরে কয়েকটা দরকারি জিনিস কিনতে গেছে, দেখে পাশে একটা বাচ্চা মেয়ে একটা লিস্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে। তার দিকে চোখ পড়তে আইরিন আঁতকে উঠল। মেয়েটির গায়ের এখানে-ওখানে অজস্র ক্ষতচিহ্ন। কতগুলো কাটা, কিছু যেন পোড়ার দাগ।

"তুই কে রে?"
"আমি টুলি, হু-ই বাড়িটায় কাজ করি।" মেয়েটি আঙুল দিয়ে একটা ঝাঁ-চকচক তেতলা বাড়ি দেখিয়ে দিল।
"তোর গায়ে এসব কীসের দাগ?"
"কিছু না, পড়ে গেছি।" টুলি হঠাৎ যেন ভয়ে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর জিনিসগুলি ব্যাগে পুরে বাড়ির দিকে ছুট দিল।
"পড়ে গেছে না ছাই!" আইরিন বলল, "ওগুলো ঠিক মারধর আর ছ্যাঁকা দেওয়ার দাগ।"

দোকানের মালিক ধীরু বাবু ফিসফিসিয়ে বললেন, "ও রাজু গোঁসাইয়ের কাজের মেয়ে। একটু পানের থেকে চুন খসলেই ওরা অত্যাচার করে। কিন্তু সে কথা বলবে সাহস আছে ঐ মেয়ের!"
"ওটুকু মেয়ের সাহস নাই থাকতে পারে। কিন্তু ওর বাবা-মা কিছু বলে না? আপনারা পাড়াপড়শিরা?"
"তুমি মা এখানে থাকো না, হালচাল জানো না।" ধীরু বাবু এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, "রাজু গোঁসাইয়ের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে যাবে কে? ও একজন লোকাল লীডার। ওর হাতে কত ক্যাডার।"
"বেশ কাকু – আপনাদের যখন এত ভয়, আমাকেই কিছু করতে হবে। দেখি ও কত বড়ো নেতা।"
ধীরু বাবু তবু বোঝাতে চেয়েছিলেন, "শোনো মা, ক'দিনের জন্য এসেছ, অশান্তিতে জড়িও না।"

শোনেনি আইরিন। শোনেনি, কারণ সে-ও দু-একজন নেতা-টেতাকে চেনে। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তার প্রাণের বন্ধু ছিল মধুছন্দা, তার বাবা হিমাংশু বাবু একজন বিধায়ক আর আজকালকার দিনেও এক ব্যতিক্রান্ত সৎ রাজনীতিবিদ। আইরিন তাঁর সাথেই দেখা করেছিল।

সব কথা শুনে হিমাংশু বাবু বলেছিলেন, "এইটুকু ব্যাপারে তোমাকে ছুটে আসতে হল দেখে খারাপ লাগছে। এটা তো স্থানীয় পুলিশেরই কাজ। আসলে কিছু ভুঁইফোঁড় 'নেতা' আমাদের পার্টির বদনাম করে দিচ্ছে। ঠিক আছে, ব্যাপারটা আমি দেখছি।"

"কিন্তু ঐ মেয়েটি যদি এর ফলে আশ্রয়হারা হয়?"

"সে ব্যবস্থাও করা যাবে।" হিমাংশু বাবু আশ্বাস দিয়েছিলেন। আর যে কথা, সেই কাজ। কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশ রাজু গোঁসাইয়ের বাড়িতে হানা দিয়ে টুলিকে উদ্ধার করল আর তার বয়ান অনুযায়ী রাজুর স্ত্রীকে গ্রেফতার করল। টুলির বাবা-মা তাকে নিতে রাজি নয় শুনে তাকে এক মহিলা সংগঠনের হাতে তুলে দেওয়া হল। টুলিকে চিনিয়ে দেবার জন্য আইরিনও তাদের সঙ্গে গিয়েছিল।

এ অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে যে কালসাপ বেরিয়ে পড়বে কে জানত! রাজুর বাড়িতে হানা দেওয়ার সময় পুলিশের চোখে পড়ে কিছু অস্ত্রশস্ত্র। একটু খোঁজ নিয়ে জানা যায় ওগুলো বেআইনি। আরও একটু খোঁজ নিতে স্পষ্ট হয়, এই রাজু এক ডাকাত দলের 'বস'। তার নেতৃত্বে ইদানীং বেশ কয়েকটা চুরি, ডাকাতি ও খুন হয়েছে। পুলিশকে আসতে দেখে রাজু বিপদ বুঝে পেছনের পাঁচিল টপকে পালায়, তাই তাকে ধরা যায়নি।

"একটা বিরাট উপকার করলে তুমি।" হিমাংশু বাবু আইরিনের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলছিলেন, "এই গ্যাংটা অনেক দিন ধরে পুলিশকে নাজেহাল করে তুলেছিল। এরা ভীষণ প্রযুক্তি সচেতন। কম্পিউটার, ইন্টারনেট থেকে আরম্ভ করে আধুনিক ইলেকট্রনিকস সব প্রয়োগ করে চুরি-ডাকাতির জন্য। ওদের লীডার রাজু বা রাজীব গোস্বামী একজন উচ্চশিক্ষিত ইঞ্জিনীয়ার। সে-ই সব কাণ্ডের মাথা। আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে, কিন্তু ধরা পড়বেই। অন্যগুলোকেও একে একে ধরা হবে। তবে –"
হিমাংশু বাবুর দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে শঙ্কিত হয়ে আইরিন জিজ্ঞেস করল, "তবে কী?"
"তবে তার আগে অবধি, একটু সাবধান থেকো। ওরা ডেঞ্জারাস লোক। এতটা হবে আগে জানলে আমি তোমাকে পুলিশের সাথে রাজুর বাড়ি যেতে দিতাম না। যাক, যা হবার হয়ে গিয়েছে। এখন সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি ছুটি ছোটো করে কাল-পরশুই আমেরিকা ফিরে যাও।"

বাড়ি ফিরে আইরিন ব্যাপারটা বাবা-মা'কে বলতে তারাও চিন্তিত হল। মা বলল, "আমাদের খুব খারাপ লাগবে, তবু বলছি – তুই ফিরেই যা। ক'দিনের জন্য এসে কী ঝামেলায় পড়লি, বল তো!"
"বললেই কি ফিরে যাওয়া যায়! সস্তার টিকিট কেটেছি, এখন ডেট চেঞ্জ করতে গেলে একগাদা গচ্চা।"

বাবা একটু ভেবেচিন্তে বললেন, "তার চেয়ে তুই বরং কিছুদিন এখান থেকে সরে যা। তোর মণি পিসির বাড়ি ক'দিন ঘুরে আয় না? তোকে কতদিন দেখেনি, খুব খুশি হবে। আমি নয় তোকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।"

মণি পিসির বাড়ি যাওয়ার প্রস্তাবে আইরিনও খুশি হল। ওখানে পিন্টু দাদা, মঞ্জরী আছে, তাদের সাথে এককালে ওর খুব ভাব ছিল। কিন্তু বাবার সাথে যাওয়ার প্রস্তাব সে নাকচ করে দিল।
"আমি কি আমেরিকা গিয়ে পিসির বাড়ি ভুলে গেছি নাকি? এখান থেকে ট্যাক্সি ধরে হাওড়া, সেখান থেকে লোকাল ধরে বাগনান ঠিক চলে যাব। তুমি বাড়ি না থাকলে মা'কে দেখবে কে?"
কিছুতেই মেয়ে রাজি হয় না দেখে বাবা অবশেষে মত দিল।

পরদিন দুপুর নাগাদ আইরিন একটা ট্যাক্সি ধরে হাওড়া রওনা দিল। বার বার সে রিয়ার ভিউ মিররে দেখে নিচ্ছিল কেউ ফলো করছে কিনা। নিশ্চিন্ত হয়ে শেষে টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে এল। লোকাল ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ শোনে দুটো কুড়ি-পঁচিশ বছরের ছেলে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। আইরিনের উদ্বিগ্ন মন, কিছু সন্দেহ করে সে কান খাড়া করল।

"বস বলছিল, মেয়েটা ট্যাক্সি চেপে হাওড়া স্টেশনে এসেছে। ভন্টু আর সুবল ব্যান্ডেল সেকশনটা দেখছে। এখন দেখা যাক এদিকে এসেছে কিনা। দাঁড়া, ফটোটা ভালো করে দেখে নিই।" বলে ওদের একজন স্মার্টফোনে কী যেন দেখতে লাগল।

আইরিনের বুক হিম। এরা ওকেই খুঁজছে নাকি? কী বোকা সে – হয়তো ট্যাক্সি ধরার সময় কেউ তার কথা শুনে সাকরেদদের এখানে মজুত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। বোধহয় হোয়াটসঅ্যাপে তার ফটোও পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার শুনল অন্য ছেলেটা বলছে, "পাকা মেয়ে, ইন্ডিয়ায় এসে আমেরিকা ঝাড়ছে! আমাদের হাতে একেবারে হেরিকেন ধরিয়ে দিয়েছে! আজ হাতে পাই, বাছাধনের আর আমেরিকা ফিরতে হবে না।"

প্রচণ্ড টেনশনের মধ্যেও আইরিন চেষ্টা করল মাথা ঠিক রাখতে। আলগোছে একটা চায়ের স্টলের আড়ালে গিয়ে ওড়না দিয়ে মুখ যথাসাধ্য আড়াল করে ভাবতে লাগল, এখন কী কর্তব্য! কারও কাছে সব বলে সাহায্য চাইবে? কিন্তু এরা সাংঘাতিক খুনে – একবার গুলি চালাতে আরম্ভ করলে আশেপাশের লোকজন সব ছেড়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। বেশ কিছুটা দূরে দুটো পুলিশকে দেখা যাচ্ছে, বন্দুক হাতে ঢুলছে। কিন্তু ওদের কাছে পৌঁছোবার সময় পাবে কি?

আইরিন ভাবছে আর আড়চোখে লোকদুটোর দিকে তাকাচ্ছে। এমন সময় যাত্রীদের মধ্যে উত্তেজনা – উল্টোদিক থেকে পাঁশকুড়া যাবার গাড়ি ঢুকছে। আগেভাগে উঠে ভালো সিট পাওয়ার জন্য সবাই রণং দেহি ভঙ্গীতে তৈরি হচ্ছে। এদিকে অন্যদিকের প্ল্যাটফর্মে যে এক্সপ্রেসটা দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা এই গাড়িটা ঢুকতেই লাইন ক্লিয়ার পেয়ে ভোঁ দিয়ে চলতে শুরু করেছে। যাত্রীরা জানালা দিয়ে স্টেশনে সী-অফ করতে আসা আত্মীয়-বন্ধুদের দিকে হাত নাড়ছে। আইরিনের মাথায় হঠাৎ একটা চিন্তার ঝলক – সে দৌড়ে গিয়ে চলন্ত গাড়িটার একটা খোলা দরজা দিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে পড়ল।

ভেতরে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে একটা সীটে বসে ভাবছে কাজটা ঠিক হল কিনা, এমন সময় ক্যাটারিংয়ের লোক এসে জিজ্ঞেস করল, "ডিনারে কী নেবেন?"
"কিছু না।" বলেই আইরিনের খেয়াল হল, তার কাছে টিকিট নেই। সে নয় চেকার এলে সব কথা বলে তার সাহায্য চাওয়া যাবে। দরকার হলে ফাইন দিয়ে দেবে। এক্সপ্রেস ট্রেন বাগনানে থামে না, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে! ঠিক আছে, সেখানেই নেমে যাবে।

এইসব ভাবছে, হঠাৎ দেখে সেই ছেলে দুটো হন্তদন্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে করিডোর দিয়ে চলেছে। "তুই ঠিক দেখেছিস, এই ট্রেনে উঠেছে?" একজন বলল।
"হ্যাঁ রে, এই কামরায় বা পাশেরটায়।"
"সেই মেয়েটাই?"
"মুখ ঠিক দেখতে পাইনি। কিন্তু লাস্ট টাইমে যেভাবে রানিংয়ে উঠে পড়ল, আমি শিওর কিছু সন্দেহ করে পালাচ্ছে। নইলে লোকাল ধরত – বস বলেছে ও বিশেষ মালপত্র নিয়ে বেরোয়নি।"
পাশের ভদ্রলোক কাগজ পড়ছেন। আইরিন পাশে রাখা তার একটা সাপ্লিমেন্ট দিয়ে মুখ ঢেকে পড়ার ভাণ করতে লাগল। ছেলে দুটো খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে গেল। আইরিন সেদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে দ্রুতপায়ে পেছনের দিকের একটা টয়লেটে ঢুকে পড়ল।

এক্সপ্রেস ট্রেনে পুলিশ থাকে। তাদের খোঁজার চেষ্টা করবে? নাকি ট্রেনটা প্রথম স্টপে থামলে নেমে সাহায্য চাইবে? ইতিমধ্যে ট্রেন স্পীড নিয়ে তিরবেগে ছুটে চলেছে। কে জানে, প্রথম কোথায় দাঁড়াবে।

হঠাৎ ট্রেনটা একটা হ্যাঁচকা মেরে স্পীড কমাতে লাগল। ধীরে ধীরে মন্থর হতে হতে এক সময় থেমেই গেল এক্সপ্রেস। স্টপ এল? আইরিন বেরিয়ে এসে দরজা দিয়ে উঁকি মারল – একটা ছোট্ট স্টেশন। এখানে দূরপাল্লার গাড়ি দাঁড়াবার কথা নয়, নিশ্চয়ই সিগন্যাল পায়নি। ইতিউতি চাইতে চাইতে দরজা খুলে সে উল্টোদিক দিয়ে নেমে লাইনে পা রাখল তারপর লাফিয়ে সেদিকের প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়ল।

কিছু দূরে একটা বাসরাস্তা, সম্ভবত হাইওয়ে। সেখান দিয়ে বাস, ট্রাক, কার ছুটছে। আইরিন দ্রুতপায়ে স্টেশনের রেলিংয়ের ফাঁক গলে একটা এবরো খেবরো মাটির রাস্তা ধরে ছুট দিল। একটু পরেই বড়োরাস্তায় পৌঁছে গেল। পেছনে তাকিয়ে অন্তত সেই মুহূর্তে কাউকে দেখতে পেল না। ইতিমধ্যে একটা গম্ভীর ভোঁ শুনে দেখে, এক্সপ্রেস আবার চলতে শুরু করেছে। হঠাৎ দেখে দু'জন লোক পড়ি কি মরি করে উল্টোদিক দিয়ে লাফিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে নামল। অতিকষ্টে টাল সামলে তারা প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়ল। দূর থেকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও আইরিনের সন্দেহ নেই – এরাই তারা!

যেখানে আইরিন দাঁড়িয়ে, তার একটু দূরে একটা বাস দাঁড়িয়ে। সেদিকে এগিয়ে সে কন্ডাক্টারকে জিগ্যেস করল, "এটা কি, মানে, ইয়ে যাবে?"

তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে কন্ডাক্টার তার পেশাদার ভঙ্গীতে হাঁক ছাড়ল, "হ্যাঁ, হ্যাঁ – খড়গপুর, মেদিনীপুর সব যাবে, জলদি উঠে পড়ুন।" আইরিন দ্বিধা না করে উঠে পড়ল। বাসটায় এই মুহূর্তে বসার জায়গা নেই। তবে তেমন ভিড়ও নেই। একটা সীট দেখিয়ে কন্ডাক্টার বলল, "ওখানে দাঁড়ান। একটু পর বসতে পাবেন।" তারপর কী ভেবে আবার বলল, "কিন্তু আপনি স্টেশনের দিক থেকে এলেন না? একটু পরই তো প্যাসেঞ্জার ছিল, আরামে যেতে পারতেন।"

"না, মানে ট্রেনটা দু'ঘণ্টা লেট বলে অ্যানাউন্স করল কিনা, তাই –" আইরিন আমতা আমতা করে উত্তর দিল। ইতিমধ্যে রাস্তা ফাঁকা পেয়ে বাস জোর ছুটেছে। খানিকক্ষণ পর সে বসার জায়গাও পেয়ে গেল। এতক্ষণে সে একটু স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলতে পারছে। লোক দুটোকে ঠিক পেছন থেকে ঝেড়ে ফেলা গেছে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? কিছুই তো চেনে না। এখান থেকে বাবাকে বা হিমাংশু কাকুকে ফোন করে সব জানিয়ে সাহায্য চাইবে? কিন্তু সে কোথায় আছে বলবে? চলন্ত বাসে সিগন্যালও তেমন ভালো আসছে না। তার চেয়ে ঐ খড়গপুর, মেদিনীপুর কোনও একটা শহর আসুক, তারপর যোগাযোগ করা যাবে। ভেবেচিন্তে আইরিন একটা মেদিনীপুরের টিকিট কাটল।

অনেক দৌড়ঝাঁপের পর একটু নিশ্চিন্তি পেয়ে আইরিনের চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল। হঠাৎ এক ঝটকায় উঠে দেখে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বাস হু-হু করে ছুটে চলেছে, অন্ধকারে বাইরের দৃশ্য আবছা হয়ে গেছে। তাকে ধড়মড়িয়ে উঠতে দেখে কন্ডাক্টার আশ্বাসের হাসি হেসে বলল, "বসুন, মেদিনীপুর দেরি আছে।"

হঠাৎ তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় সঙ্কেত দিল – ঘোর বিপদ! চমকে উঠে সে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। না, সেই ছেলে দুটি নেই। কিন্তু কয়েকটা সীট পেছনে দুজন গাট্টাগোট্টা লোক মনে হল আড়চোখে তাকে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কী যেন বলছে। ওদের দৃষ্টি ভালো নয়। অবশ্য ওরা সাধারণ বাজে লোকও হতে পারে। তবে তার সম্ভাবনা কম। আইরিন এবার এক ভয়াবহ বাস্তবকে স্বীকার করার জন্য তৈরি হল – এরাও একই দলের লোক। মোবাইলে খবর আর ফটো পাঠিয়ে তাদের এই বাসে তাকে ফলো করতে বলা হয়েছে। এখন হয়তো তারা অপেক্ষায় রয়েছে। ভিড় একটু কমলে আর কোনও সুবিধেমতো জায়গা এলে আঘাত হানবে।

হায় ভগবান – কত বড়ো এই গ্যাং! এদের বিরুদ্ধে সে একজন একা, অসহায় মেয়ে কী করে আত্মরক্ষা করবে? আইরিনের বুক ফেটে কান্না এল। আমেরিকায় কত চমকপ্রদ রিসার্চের কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে –আর কি এ জীবনে করা হবে!

ততক্ষণে বাস একটা ছোটোখাটো গ্রামগঞ্জ এলাকায় ঢুকেছে আর কন্ডাক্টার হাঁকছে, "কেতুগ্রাম, কেতুগ্রাম।" কেতুগ্রাম – হঠাৎ যেন আইরিনের মনে অতীত ফুঁড়ে ভেসে উঠল এক আবছা স্মৃতি। এ জায়গা তার চেনা! যেন সেই কত যুগ আগে এখানে এসেছিল। আর কে যেন তার মনের ভেতরে ক্রমাগত বলে চলেছে – এখানেই তোমার নিশ্চিন্ত আশ্রয়, ঝড়ের মধ্যে নিরাপদ বন্দর। আইরিন আড়চোখে পেছনে চেয়ে দেখল, লোকদুটো একটু অসতর্ক হয়ে ঢুলছে। সম্ভবত সে মেদিনীপুর নামবে শুনে নিশ্চিন্তে আছে। সেদিকে চোখ রেখে কন্ডাক্টারের বিস্মিত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আইরিন নেমে পড়ল। তারপর কাঁচা রাস্তা ধরে গ্রামের দিকে চলতে লাগল। একটু পর বাসস্ট্যান্ডের আলো মিলিয়ে গেল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। তাতে গা ঢাকা দিয়ে আইরিন ছুটতে শুরু করল। হঠাৎ টের পেল, সে একা নয়। পেছনে আরও পায়ের শব্দ, গলার আওয়াজ। নিস্তব্ধ পরিবেশে অনেক দূর থেকে শব্দ শোনা যায়। একটু পর শুনতে পেল একজন বলছে, "তাড়াতাড়ি চল, এখনও বেশি দূর যেতে পারেনি।"

"হ্যাঁ। যন্তরটা রেডি রাখিস।"

আইরিন গতি বাড়াল। কিন্তু সে একজন মেয়ে, এই দুজন জোয়ান পুরুষের সঙ্গে দৌড়ে কতক্ষণ পাল্লা দেবে? নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের সাথে যুঝবেই বা কীভাবে? শেষ চেষ্টা হিসেবে সে মূল রাস্তা ছেড়ে মাঠে নামল। তারপর কখনও আল, কখনও খেতের মধ্য দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। পেছনে মৃত্যু। কিন্তু কে যেন তাকে বলছে – হাল ছেড়ো না। আর একটু, তারপরই তোমার সামনে নিরাপদ আশ্রয়। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো আইরিন মাঠঘাট ভেঙে, এঁকেবেঁকে সেই অজানা লক্ষ্যের টানে ছুটে চলল।

(৩)

রমাকান্ত ভাবছে। কিন্তু ভেবে ভেবে হদ্দ হয়ে গেলেও ধরতে পারছে না, আকাশ থেকে পড়া ঐ অদ্ভুত জিনিসটা কী! আজ যা ঘটল তারপর সে আরও ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। লেখাপড়া বিশেষ করেনি, ব্যাপারটা আর তার বুদ্ধিতে কুলোচ্ছে না। কোনও এম-এস-সি, বি-এস-সি মাস্টারকে ধরতে হবে মনে হচ্ছে।

আজ সে বিশে কামারের কাছে ঐ আকাশ থেকে পড়া পাথরের টুকরো দুটো নিয়ে গিয়েছিল দুটো লাঠি বানাবার জন্য। "কোথায় পেলে? এমন লোহা তো আগে দেখিনি।" বিশে অবাক হয়ে বলেছিল।
"ওই, মাঠেঘাটে পড়ে ছিল আর কী। ভাবলাম, পড়েই যখন আছে –"
"তা তো বটেই।" বলে বিশে এবার একটা টুকরো আগুনে দিল। তারপরই তাড়াতাড়ি সেটাকে বের করে এনে বলল, "আরে, গলাব কী – এটা তো মাখনের মতো একটু গরমেই গলে গলে পড়ছে!"
"তাহলে কি ওটা লোহা নয়? সীসে নাকি?"
"আরে ধুর, সীসে তো রুপোর মতো সাদা। এটা লোহা বা ইস্টিল, তবে হয়তো একটু অন্য রকমের। আমার বাপের জম্মে এমনটা দেখিনি। এখন দাঁড়াও, দেখছি কী করা যায়।"

তা, বিশুর এলেম আছে বটে। অল্প আঁচে নরম করে করে ধৈর্য ধরে দিল শেষ অবধি দুটো ডাণ্ডা বানিয়ে। ডাণ্ডাদুটো লিকলিকে, কিন্তু শক্ত। ধরার সুবিধের জন্য একদিকে বসানো হয়েছে শক্ত কাঠের হাতল। হাতে নিয়েই বুঝল রমাকান্ত, ফাটাফাটি হয়েছে। আসুক না ওই বদ লোকগুলি, দেখিয়ে দেবে মজা!

বাড়ি এসে রমাকান্ত একটু আড়ালে গিয়ে একটা ডাণ্ডা হাওয়ায় ঘুরিয়ে কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্র্যাকটিস শুরু করল। আর শুরু করতে না করতেই তার চোখ কপালে – এ কি ডাণ্ডা, না চাবুক? ঘোরাতে শুরু করলেই লোহাটা রবারের মতো বেড়ে লম্বা হয়ে সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে – যেন একটা জীবন্ত প্রাণী, বিষাক্ত জিভে শিকারকে ছোবল দিতে যাচ্ছে। ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একবার ডাণ্ডাটা বেঁকে তার একটা দিক রমাকান্তর অন্য হাতে লেগে গেল আর সে আর্তনাদ করে উঠল – যেন গরম লোহায় তার হাতে ছ্যাঁকা লেগে গেল! তাকিয়ে দেখে, সত্যিই একটা লম্বা পোড়ার দাগ।

এ কি ডাণ্ডা, না চাবুক? আকাশ থেকে এই বিচিত্র চাবুক তাকে কে পাঠাল – ভগবান? যেই পাঠাক, রমাকান্ত তার প্রতি ওপর দিকে চেয়ে হাত জোড় করল। যেই হোক, তার একমাত্র উদ্দেশ্য এটা দিয়ে শয়তানদের দমন করা। রমাকান্ত জিনিসটা শক্ত হাতে চেপে ধরল – সেই অদেখা অস্তিত্বের উদ্দেশ্য সে পূরণ করবে।

ডাণ্ডা দুটো নিয়ে সে বেশ কিছুক্ষণ লড়াইয়ের মহড়া দিল। ধীরে ধীরে তার মনে হল, এই জিনিস হাতে নিয়ে সে অনায়াসে কোনও বদলোকের মহড়া নিতে পারবে। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মনে রমাকান্ত বৌকে ডেকে কিছু খেতে দিতে বলল। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। এই সময়টায় গ্রামে লোড শেডিং থাকে, তাই চারদিকে ঘন অন্ধকার। লণ্ঠনের আলোয় খাওয়া সেরে রমাকান্ত বারান্দায় বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, এমন সময় বাইরের দরজার কড়া সজোরে নড়ে উঠল।

"কে?"
"প্লীজ দরজা খুলুন, আমার খুব বিপদ।"

একটি মেয়ের গলা। কে? গলাটা তো চেনা লাগে না। যাবে? ব্যাপারটার মধ্যে কোনও ছলচাতুরি নেই তো? হয়তো এই ছুতোয় দরজা খুলিয়ে ভেতরে ঢুকবে বলে কোনও ডাকাত বা গুণ্ডার দল অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ওত পেতে আছে। কিন্তু তার আছেটাই বা কী যে তার লোভে বাড়িতে ডাকাত পড়বে? আর – হঠাৎ হাতের ডাণ্ডা, না না, চাবুকটার দিকে চোখ পড়তেই রমাকান্তের মনে আবার সাহস ফিরে এল। ওটা হাতে থাকলে সে কাউকে ডরায় না! বুক ঠুকে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

(৪)

দরজায় দাঁড়িয়ে একটি ফুটফুটে মেয়ে। হাঁফাচ্ছে আর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। "ওরা – ওরা আমার পেছনে ধেয়ে আসছে। ধরতে পারলে –"
রমাকান্ত চট করে বাইরে তাকাল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। এবার সে মেয়েটিকে ভেতরে টেনে এনে দরজাটা বন্ধ করে বলল, "তোমার কোনও ভয় নেই, মা। একটু জিরিয়ে নাও। তারপর বলো, তুমি কে আর কী তোমার বিপদ। গীতা, একটা আলো।"
রমাকান্তের স্ত্রী লণ্ঠনটা নিয়ে এল। তার আলোয় মেয়েটির মুখ দেখতে দেখতে রমাকান্ত ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবতে লাগল। তারপর অবাক বিস্ময়ে বলে উঠল, "তুমি রিঙ্কু দিদিমণি না?"
"রমা কাকা!" আইরিন অস্ফুটস্বরে বলে উঠল।
"চিনতে পেরেছ তাহলে!"
"তুমি বিশেষ বদলাওনি। কিন্তু আমরা যখন এই বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে যাই, তখন তো আমি খুব ছোটো। তুমি তাও চিনতে পারলে?"
"তাই কি পারি, দিদি? তোমাকে তো শেষ দেখেছি সেই দুই-আড়াই বছর বয়েসে। আসলে তোমার মুখে বৌদিদির মুখ যেন কেটে বসানো। তা বাবু, বৌদিদি, দাদাবাবু সব কেমন আছে? তুমি এখন কোত্থেকে এলে?"
"সবাই ভালো আছে। সময় পেলে সব বলব। কিন্তু এখন আগে আমার একটা ফোন করা দরকার। টাওয়ার পাব কি?"
"দ্যাখো। কখনও পাওয়া যায়, কখনও যায় না।"
আইরিন চট করে তার মোবাইল বের করে দেখল, সিগন্যাল দুর্বল হলেও আছে। চার্জও ফুরিয়ে এসেছে, বড়োজোর একটা কল করা যাবে। সে হিমাংশু বাবুকে ডায়াল করল।

সৌভাগ্যক্রমে লাইনটা লেগেও গেল।

চ্যাং, চ্যাং – বেজেই যাচ্ছে। তোলো কাকু, তোলো! শেষে বারোটা রিং হবার পর শোনা গেল গম্ভীর গলা, "হ্যাঁ আইরিন, বলো। তুমি এখন কোথায়? ঠিকঠাক আছ তো?"
"আমি এখন কেতুপুরে আমাদের আদি বাড়িটায় আর আমি মোটেই ঠিকঠাক নেই, খুব বিপদে।" আইরিন তাড়াতাড়ি সংক্ষেপে তার পরিস্থিতি কাকুকে জানাল। তারপর তার বাবার নাম আর ফোন নম্বর জানিয়ে বলল, "তুমি একটু বাবার কাছ থেকে আমাদের বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নিও। তারপর দ্যাখো যদি কিছু করতে পারো।"
"যদি নয়, আমি এক্ষুণি সব ব্যবস্থা করছি। ঠিকানা দিয়ে গ্রামে কিছু হয় না। কেতুগ্রামে মহীন চৌধুরীর বাড়ি বললে পুলিশ ঠিক চিনবে। তবে সব যোগাযোগের পর ফোর্স পৌঁছোতে তো ঘণ্টাখানেক লাগবে। ততক্ষণ যদি তুমি কোনও রকমে –"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আইরিন বলল, "হ্যাঁ, ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করব। দেখি!"

ফোনটা সেরে আইরিন সংক্ষেপে রমাকান্তকে তার বিপদের ব্যাপারটা বর্ণনা করল। রমাকান্ত চোখ বড়ো বড়ো করে শুনতে শুনতে বলল, "খুব বাঁচা বেঁচে গেছ, দিদিমণি। আর ভাগ্যিস তুমি এই বাড়িতেই এসে কড়া নাড়লে!"
"জানো কাকা, বাসে কেতুপুর শুনেই যেন মনে হল জায়গাটা আমার চেনা। তারপর নেমে যখন অন্ধকারে মাঠঘাট ভেঙে এগোচ্ছি, কীভাবে যেন কোন দিকে যেতে হবে ঠিক বুঝে যাচ্ছি। তখন খুব ছোটো ছিলাম, তাই স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু মনের গভীরে সেই মাঠেঘাটে চড়ে বেড়ানোর স্মৃতিগুলো ঠিক রয়ে গিয়েছে।"
"হ্যাঁ, আমার কাঁধে চড়ে তুমি কত বেড়িয়েছ।"
"ঠিক। আর জানো, আমার ভেতর থেকে কে যেন বলছিল – ওদিকে যাও, তবেই তোমার নিরাপদ আশ্রয় মিলবে।"
রমাকান্তের চোয়াল শক্ত হল। বলল, "তুমি ঠিকই বুঝেছ। এটাই তোমার নিরাপদ আশ্রয়।"
"কিন্তু রমাকাকা, আমরা দুজন নিরস্ত্র মানুষ ওই গুণ্ডাদুটোর সঙ্গে পারব কী করে? ওরা যে কোনও মুহূর্তে এসে হাজির হতে পারে। আমি পুলিশে খবর দিয়েছি। তারা আসবে, কিন্তু ঘণ্টাখানেক সময় তো লাগবে। ততক্ষণ ওদের ঠেকাবে কে?"
"আমরাই ওদের ঠেকাব আর আমরা একেবারে নিরস্ত্র নই।" বলে রমাকান্ত এবার সংক্ষেপে তার আশ্চর্য চাবুকের কাহিনি আইরিনকে শোনাল।
"তাজ্জব! কী ওটা?" আইরিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
"সেটা তো তুমিই বের করবে – কত পড়ালেখা করেছ তুমি। কিন্তু ওসব এখন নয়। এখন চটপট দেখে নাও যন্তরটা কী করে চালাতে হয়। তখন দেখো, মনে জোর আপনা আপনিই আসবে।"

তারপর কিছুক্ষণ অন্ধকারেই রমাকান্ত আইরিনকে ওই আশ্চর্য চাবুক চালানো ও নিয়ন্ত্রণ করার তালিম দিতে লাগল। মিনিট দশ-পনেরো বোধহয় হয়েছে, এমন সময় দরজার কড়া আবার নড়ে উঠল।

(৫)

"ওরা এসে গেছে।" ফিসফিসিয়ে বলল আইরিন।
"আসুক।" রমাকান্তের মুখচোখ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, "একদিন আমি চোখের সামনে আমার মেয়েকে খুন হতে দেখেছি। কিছু করতে পারিনি, হাত খালি ছিল দেখে। আজ আমার হাতে অস্তর আছে, দেখি আমার আর এক মেয়েকে কে ছিনিয়ে নেয়!"
"রমা কাকা – তোমার মেয়ে –"
"ওসব এখন নয়। চলো, আমরা তৈরি হই।" আইরিনকে টেনে নিয়ে রমাকান্ত অন্ধকারে ছায়ার মতো মিশে গেল। দরজায় তখন কড়া নাড়ার বদলে অধৈর্য ধাক্কা পড়তে শুরু করেছে।

দরজা খুলল রমাকান্তর বৌ গীতা। সাথে সাথে তাকে প্রায় ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়ল দুটো মুস্কো জোয়ান। "মেয়েটা কোথায়?" ধানাই পানাই না করে সোজা জিগ্যেস করল।

"কোন মেয়েটা? আমাদের তো কোনও মেয়ে নেই।" গীতা যেন আকাশ থেকে পড়ল।
"ন্যা-কা! নাও নাও ভালো কথায় বলছি, চটপট উত্তর দাও, নইলে –" একজন কুৎসিত হেসে পকেটে হাত দিয়ে বলল, "আমরা পষ্ট দেখেছি, মেয়েটা দৌড়োতে দৌড়োতে এদিকে এসেছে।"
"এদিকে এসেছে, কিন্তু এবাড়িতে ঢুকতে কি তোমরা দেখেছ?"
"নয়তো যাবে কোথায়? চারপাশ আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।"

গীতা কথাবার্তা বলে ওদের যথাসাধ্য দেরি করাবার চেষ্টা করতে লাগল। এক সময় গুণ্ডাদের একজন অধৈর্য হয়ে বলল, "নাঃ, এ মহিলা সোজা নয়। ভদ্দর ভাষায় এর সঙ্গে হবে না, যন্তর বের কর ভজা।"

গীতা সভয়ে দেখল, দুটো আগ্নেয়াস্ত্র তার দিকে তাক করা। "এর এক একটার ঘড়ায় বারোটা করে গুলি। আমি এক-দুই-তিন গুনব, তার মধ্যে যদি না বলিস –" বলে গুণ্ডাটা গুনতে শুরু করল, "এক – দুই –"

"বলছি, বলছি।" ভয়ে বিস্ফারিত নেত্রে গীতা কী যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগে অন্ধকারের মধ্যে দরজার দু'পাশ থেকে গুণ্ডা দুটোর দিকে ছুটে এল রমাকান্ত আর আইরিনের 'ভগবানের চাবুক'। "বাবা রে, জ্বলে গেল!" একজন চিৎকার করে উঠল।

অপার্থিব চাবুক

"উঃ, সাপে কাটল নাকি!" দ্বিতীয়জনের ভীত আর্তনাদ, "মনে হচ্ছে বিষের জ্বালায় জ্বলছি।" কিন্তু তাদের ভাবার সময় না দিয়েই সপাং করে আবার ছুটে গেল একজোড়া চাবুক। তারপর পর পর পড়তেই লাগল, পড়তেই লাগল। এক সময় গুণ্ডাদুটোর হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল। দু'দিক থেকে দুজোড়া তৎপর হাত তা সাথে সাথে তুলে নিয়ে আবার চাবুক হাঁকড়াতে লাগল। ক্ষতবিক্ষত গুণ্ডা দুটো পালাবার চেষ্টা করল, পারল না। এমন সময় লোড শেডিং শেষ হয়ে আলো জ্বলে উঠল আর ভুলুণ্ঠিত গুণ্ডাদুটো সভয়ে দেখল, ডাণ্ডা হাতে রুদ্রমূর্তিতে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ় আর এক তরুণী।

"আর ডাকাতি করবি? আমার পিছু নিবি?" ফুঁসতে ফুঁসতে বলছে আইরিন।
"আমার মেয়েকে খুন করবি? কর দেখি!" রমাকান্তর মুখ রাগে লাল, ভাঁটার মতো চোখদুটো জ্বলছে।
"গরম লোহার রড দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়েছে রে, আমাদের সারা গা পুড়ে গেছে।" একটা গুণ্ডা শরীরের দিকে চেয়ে কঁকিয়ে উঠল।
"তোদের মতো পাপীদের জন্য গরম, আমাদের জন্য ঠাণ্ডা। নে, দ্যাখ –" বলে রমাকান্ত তার চাবুকটা অবলীলাক্রমে হাত দিয়ে চেপে ধরল। গুণ্ডাদুটো অবাক হয়ে চেয়ে রইল।
তারপর হঠাৎ কী খেয়াল হতে "ঘাট হয়েছে, ছেড়ে দাও – আর খেলব না" বলে পড়ি কি মরি করে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে দৌড়োল।

"তুই খেলবি না, তোর বাবা খেলবে।" বলতে বলতে এক উর্দি পরা রাশভারি চেহারার ইনস্পেক্টার তাদের পথ আগলে দাঁড়ালেন। তার সাথে আরও জনা দশেক সশস্ত্র পুলিশ।

এর পরের ব্যাপারটা সংক্ষিপ্ত। গুণ্ডাদুটো জেলে গিয়ে জেরায় আরও অনেক নামই ফাঁস করে দিল। শুধু নেতা রাজুকে ধরা গেল না। সে কোথায় গা ঢাকা দিয়েছে চেলারাও জানে না।

সেদিন রাতেই ওদের কেতুপুরের বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসল। আইরিন রমা কাকুর বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর গীতা কাকিমার সঙ্গে শুয়ে তার ছেলেবেলার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন আবার পুলিশ পাহারাতেই বাড়ি ফিরে গেল। যাবার আগে রমা কাকু যেন কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই কান্না লুকোতে।

(৬)

"রমার মেয়ে মল্লিকার কেসটা খুব স্যাড।" বাবা বলছিল, "তোর চেয়ে একটু বড়ই হবে। দুরন্ত মেয়েটা পাড়ায় পাড়ায় মাঠে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। একদিন বোধহয় কোনও অ্যান্টি-সোশ্যালদের ডেরা ওর চোখে পড়ে গিয়েছিল। সাথে সাথে ওরা তাড়া করল। ভয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ও মুখ খোলার আগেই ওরা –"
আইরিনের চোখ ভেজা। বলল, "তবে রমা কাকা খুশি যে এবার তার আর এক মেয়েকে বাঁচাতে পেরেছে। কারণ, এবার তার হাতে ছিল 'ভগবানের চাবুক'।"
"তা হ্যাঁ, ওই কেসটা কী, বলতো – ওই অদ্ভুত ডাণ্ডা বা চাবুকটা? জিনিসটা তো বুঝলাম উল্কাপিণ্ডের অংশ। কিন্তু তার ঐ অদ্ভুত উপাদানটা কী? যা লোহার মতো শক্ত, কিন্তু মোমের মতো অল্পেই গলে যায়? যা জোরে নাড়াচাড়া করলে বেড়ে যায় আর গরম হয়ে ওঠে, আবার চট করে ঠাণ্ডা হয়ে যায়?"
"আমিও বুঝতে পারছি না, বাবা। ওঃ, দাদা তো কাল আসছে – এ ব্যাপারে ও নিশ্চয়ই আলোকপাত করতে পারবে।"

আইরিনের দাদা সত্যেন পরদিন সকালেই এসে গেল। সে এক স্টীল প্ল্যান্টের ইঞ্জিনীয়ার। দায়িত্বপূর্ণ পদ, চাইলেই এলাকা ছাড়তে পারে না। অনেক চেষ্টায় বোনের সঙ্গে দেখা করার জন্য ক'দিনের ছুটি পেয়েছে। তাকে অবশ্য হুজ্জুত-হাঙ্গামার ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। এসে সব শুনে তো সে থ!

যাই হোক, সত্যেন একটু আত্মস্থ হবার পর আইরিন তাকে ওই উল্কাপিণ্ডের থেকে পাওয়া বিচিত্র ধাতুর বিষয়ে বলল। একটা চাবুক সে নিয়ে এসেছে। ডেমো দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়েও দিল। অবাক চোখে দেখে সত্যেন বলল, "এটা বিশুদ্ধ একটা ধাতু নয়, মিশ্রধাতু বা অ্যালয়। তার কম্পোজিশন বের করলে হয়তো রহস্যটা বোঝা যাবে। আমাদের মেটালার্জিস্ট সৎপাল সিং খুব অভিজ্ঞ লোক। আমি তাঁর কাছে এটা থেকে একটা ছোট্ট টুকরো কেটে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কলকাতা থেকে রোজ আমাদের কোম্পানির কুরিয়ার যায়। আজই পাঠিয়ে দিচ্ছি, মিঃ সিং কাল পেয়ে যাবেন। দু-এক দিনের মধ্যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে।"

বিকেলের মধ্যেই কুরিয়ার বাড়ি থেকে পার্সেলটা নিয়ে গেল। এখন দিন দুয়েক রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। তারপর তৃতীয় দিন সকালে সত্যেন আইরিনকে ডেকে বলল, "মিঃ সিংয়ের মেল এসেছে। দেখতে পারিস।"

দাদা ঠিকই বুঝেছিল। জিনিসটা একটা অ্যালয়। তারমধ্যে রয়েছে লোহা, সীসা, টিন, নাইক্রোম আরও কিছু ধাতু। কিন্তু মিঃ সিংয়ের মনে হচ্ছে, এ ছাড়াও একটা অজানা ধাতু রয়েছে যা তিনি কখনও দেখেননি। লোহার সঙ্গে অল্পমাত্রায় অন্যান্য ধাতু মিশিয়ে স্টীল বা ইস্পাত তৈরি করা হয়। ওই উপাদানগুলির সামান্য হেরফেরে স্টীলের ধর্মের বিস্তর প্রভেদ হয়ে যায়। অ্যালনিকো স্টীল, টাংস্টেন স্টীল, কার্বন স্টীল, নাইক্রোম স্টীল এদের উপাদানের হেরফের সামান্যই, কিন্তু প্রত্যেকের ধর্ম আলাদা আলাদা।

অ্যালয়টির বিচিত্র ধর্মগুলির সম্বন্ধে মিঃ সিংও ধন্দে রয়েছেন। পরীক্ষা করে দেখেছেন, এর গলনাঙ্ক খুব কম, তাই সহজে গলে যায়। নমনীয়তা প্রায় রবারের মতো, তাই একটু জোর পড়লেই দৈর্ঘ্যে বা আয়তনে বাড়ে। আবার আপেক্ষিক তাপ বা স্পেসিফিক হিট ক্যাপাসিটি খুব কম, তাই চট করে ঠাণ্ডা বা গরম হয়ে যায়। অ্যালয়টির এই বিচিত্র ধর্মগুলির পেছনে কিছুটা কারণ নিশ্চয়ই তার উপাদানগুলির নির্বাচন ও কৌশলী সংমিশ্রণ। কিন্তু তাতেও সব কিছু ব্যাখ্যা করা যায় না। অবশ্য ধাতুবিদ্যা বা মেটালার্জিতে ধাতুর উপাদান যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ তৈরির প্রক্রিয়া বা প্রসেসিং। দিল্লির কুতব মিনারের পাশের লোহার অশোক স্তম্ভটি দেড় হাজার বছরের বেশি পুরনো, কিন্তু তাতে মরচে ধরেনি। আমরা ঐ লোহার উপাদান বের করতে পেরেছি। কিন্তু কী পদ্ধতিতে ওটা তৈরি করা হয়েছিল জানি না। তাই অশোক স্তম্ভের অনুকরণে মরচেহীন লোহা তৈরি করতে আমরা আজও পারি না।

তবু সব মিলিয়ে মিঃ সিং মনে করেন, এই বিচিত্র পদার্থের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তার অজানা ধাতুটির মধ্যে। আর তাই তাঁর ধারণা, এ রহস্যের চূড়ান্ত সমাধান করতে পারেন ধাতুবিদ নন, কোনও বিজ্ঞানী।

মুম্বইয়ের এক নামী গবেষণা সংস্থার সাথে আইরিনদের গ্রুপ যৌথ কাজকর্ম করছে। সেখানকার অ্যাটমিক ফিজিসিস্ট অতনু সান্যালের সঙ্গে আইরিনের ফোনে ও ই-মেইলে ভালো পরিচয় আছে। আইরিন তক্ষুণি অতনুকে ফোন করল। সেদিন বিকেলেই একটা আর্জেন্ট কুরিয়ার অতনুর লক্ষ্যে রওনা দিল।

(৭)

আবার প্রতীক্ষা। এবার আরও বেশি দিন। একটার পর একটা দিন কাটছে আর আইরিনের উত্তেজনা বাড়ছে। তার ফেরার দিনও এগিয়ে আসছে। কিন্তু অতনুর কোনও পাত্তা নেই। ই-মেইল পাঠালে উত্তর দেয় না, ফোন করলে তোলে না। শেষে সাতদিনের মাথায় এক সুপ্রভাতে অতনুর মেইল এল:

"কুরি জুনিয়র,
দুঃখিত, আপনার নিক্ষিপ্ত সমস্যাজালে লাট খেতে খেতে অ্যাদ্দিন জবাব দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। যাক, কিছু ইন্টারেস্টিং তথ্য শেষ অবধি খুঁড়ে বের করেছি। কাল সকালে সশরীরে হাজির হয়েই সেটা পেশ করব। বাড়ির ঠিকানাটা দয়া করে মেসেজ করবেন।
বশংবদ অতনু।"

অতনু ইয়ার্কি করে আইরিনকে কুরি জুনিয়র ডাকে। 'আপনি"টাও আর একটা গম্ভীর ইয়ার্কি – ওদের মধ্যে এখন তুমি ছেড়ে তুইও আকছার চলে। যাক, অতনুর সাথে প্রথম দেখা হবে জেনে আইরিন খুব খুশি। উত্তেজিতও বটে – সশরীরে যখন আবির্ভূত হচ্ছে, নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু বলার আছে।

পরদিন সকালে যথাসময়ে অতনু হাজির। প্রাথমিক আলাপ-পরিচয় ও প্রাতরাশের পর বিশেষ ভূমিকা না করেই ও কাজের কথায় এল।

"দ্যাখ আইরিন, তোকে আর অ্যাটমিক ফিজিক্সের ফান্ডা কী দেব? তাই একটু এগিয়েই শুরু করছি।"
"না না, গোড়ার থেকেই বল। বাবা আর দাদাও তো শুনছে।"
"যো হুকুম। তাহলে অ্যাটম বা পরমাণুর থেকে শুরু করি। অ্যাটম হচ্ছে মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা। তার কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে থাকে ধনবিদ্যুৎ কণা প্রোটন ও বিদ্যুৎহীন কণা নিউট্রন। নিউক্লিয়াসের বাইরে থাকে ঋণবিদ্যুৎ কণা ইলেকট্রন, যারা বিপরীতধর্মী বিদ্যুৎকণা প্রোটনের টানে নিউক্লিয়াসের চারদিকে পাক খায়।
এদিকে, নিউক্লিয়াসে সমধর্মী বিদ্যুৎকণা প্রোটনগুলি আবার এ ওকে দূরে ঠেলার চেষ্টা করছে। এই বলের বিরুদ্ধে তাদের নিউক্লিয়াসে ধরে রাখছে কে? নিশ্চয়ই একটা পাল্টা বল। ছোট্ট নিউক্লিয়াসে প্রোটনগুলিকে জোর করে ঠেসে রাখতে অনেক বল দরকার, তাই বিজ্ঞানীরা এর নাম দিলেন 'স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স'। এই বল সাধারণ পরমাণুর প্রোটনগুলিকে স্থিতি দেয়। কিন্তু পদার্থ যত ভারী হয়, প্রোটনের সংখ্যা তত বাড়তে থাকে আর বাড়তে থাকে তাদের বিকর্ষণ। একটা সময় 'স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স' আর নিউক্লিয়াসকে অটুট রাখতে পারে না। প্রোটন ও নিউট্রন কণা ছিটকে বেরিয়ে পরমাণু অপেক্ষাকৃত হালকা দুই পরমাণুতে ভেঙে যায়। এই পরমাণু বিভাজনকে বলে 'ফিশন' আর এই উপলক্ষে নির্গত কণা আর শক্তিই হচ্ছে তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিও অ্যাকটিভিটি। রেডিয়াম, ইউরেনিয়াম প্রভৃতি কিছু পদার্থের থেকে নিজে নিজেই একটু একটু করে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হয়। আবার নানা কৃত্রিম পদ্ধতিতে এই বিকিরণের বেগ বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া যায়। তাহলে একসঙ্গে প্রায় অফুরন্ত শক্তি নির্গত হবে। এটাই হচ্ছে অ্যাটম বোম বা ফিশন বোম। এমনিতেই তেজস্ক্রিয়তা মানুষের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। আর অ্যাটম বোমার ধ্বংসক্ষমতা তো অবর্ণনীয়। আদ্যিকালের দুটি অ্যাটম বোমায় হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, লাখ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। যারা বেঁচে ছিল তাদের অনেকেই হয়ে গিয়েছিল বিকৃতদেহ, জীবন্মৃত। এখনকার বোমা তো অনেক বেশি শক্তিশালী।
কিন্তু এই ভারি পদার্থের পরমাণু ভাঙার হারটা যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণও ধীরে ধীরে হয়। তখন এই বিকিরিত শক্তি দিয়ে প্রথমে তাপ ও তার সাহায্যে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। কিন্তু এখানেও আনুষঙ্গিক তেজস্ক্রিয় দূষণের সমস্যা থেকে যাচ্ছে।"

"হ্যাঁ, এসব তো বারো ক্লাসের টেক্সট।" আইরিন অধৈর্য হয়ে বলল, "এবার আমাদের গল্পে আয়।"
"এই আসছি।" একগাল হেসে অতনু আবার শুরু করল, "নিশ্চয়ই জানিস, পৃথিবীতে এখন অবধি মোটামুটি ১১৮টা মৌলিক পদার্থ বা মৌল পাওয়া গেছে। পরমাণুর ভার অনুযায়ী সাজালে ইউরেনিয়াম হচ্ছে ৯২তম আর এই অবধি মৌলগুলো প্রকৃতিতে মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর চেয়ে 'ভারী' পরমাণুগুলি প্রোটনসংখ্যা অত্যধিক হবার জন্য চটপট তেজস্ক্রিয় বিকিরণ করে ভেঙে শেষ হয়ে যায়। তাই এগুলো প্রকৃতিতে বিশেষ পাওয়া যায় না, কৃত্রিমভাবে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়।
এবার তোর ঐ লাঠি বা চাবুকের বৈশিষ্ট্যে আসছি। ঐ অ্যালয়টায় আমরা এমন এক নতুন মৌলের সন্ধান পেয়েছি, যা পৃথিবীতে নেই! কিন্তু ১ থেকে ১১৮ প্রোটনসংখ্যার সব মৌলই তো আবিস্কার হয়ে গেছে, তাহলে আমরা এই নতুন পদার্থটাকে কোথায় বসাব? একমাত্র সম্ভাবনা, ওটা তারও ওপরে অর্থাৎ ১১৯ বা তারও বেশি প্রোটনসংখ্যার মৌল!"

"কিন্তু সেটা তো ভীষণ তেজস্ক্রিয় ও অস্থায়ী হবে?" আইরিনের উত্তেজিত জিজ্ঞাসা।
"হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের এই পদার্থটা ভীষণ স্থিতিশীল। নিশ্চয়ই কোনও অজ্ঞাত কারণে স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স বেড়ে গিয়ে নিউক্লিয়াসকে ধরে রাখছে।" "ঐ মৌলের প্রোটনের সংখ্যা জানতে পারলি?"
"অনুমান করছি, ১২৫ বা আশেপাশে হবে। তবে নির্দিষ্ট জানতে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার, তার জন্য দরকারি সরঞ্জাম বা সাহস আমাদের নেই। সেটা তাই সার্ন প্রভৃতি উন্নত ল্যাবের জন্য রাখছি।"
"সরঞ্জামের অভাব বুঝলাম। কিন্তু সাহস – কেসটা কী?"
"সংক্ষেপেই বলি। আমরা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে ফিশনের হারকে নিয়ন্ত্রিত করে বিদ্যুৎ তৈরি করি। কিন্তু সেখানেও ধীরে ধীরে হলেও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হয়। কিন্তু আমাদের পরীক্ষায় এই বিচিত্র অ্যালয় থেকে কোনও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ধরা পড়েনি। তবে বাইরে থেকে শক্তি দিয়ে উদ্দীপ্ত করলে এই পদার্থের নিউক্লিয়াস আরও বেশি শক্তি তাপ হিসেবে ফিরিয়ে দেয় – যেমন কোনও জ্বালানিতে দেশলাই কাঠি ধরলে তা জ্বলতে শুরু ক'রে আরও বেশি তাপ ফিরিয়ে দেয়। ঐ লাঠি বা চাবুকটা জোরে ঘোরালে পদার্থের অণুগুলির গতিশক্তি পায়। এই শক্তিতে উদ্দীপ্ত নিউক্লিয়াস আরও অনেক বেশি শক্তি ফিরিয়ে দেয়। ফলে তাপ সৃষ্টি হয়ে অ্যালয়টা সোল্ডারের মতো নরম হয়ে যায়। তখন তুই তাকে যে কোনও আকৃতি দিতে পারিস। আবার তাপশক্তি দিলে আরও বেশি তাপ নিজের থেকে সৃষ্টি হয় দেখে অল্প তাপেই বস্তুটা গলেও যায়।"
"তার মানে এটা একটা অমিত শক্তিভাণ্ডার, যার থেকে তেজস্ক্রিয় দূষণ ছাড়াই ধীরে ধীরে শক্তি পাওয়া যায়! এটা কীভাবে সম্ভব জানতে পারলে তো আমরা দূষণহীন শক্তি পাওয়ার সমস্যাটার সমাধান করে ফেলব।"
"দুর্ভাগ্য, আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনেক পিছিয়ে। আমরা একটা গোটা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে নানা বাধার দেওয়াল খাড়া করে তেজস্ক্রিয়তাকে আটকে তাপশক্তিকে বাইরে নিয়ে আসছি। কিন্তু এখানে তেজস্ক্রিয়তাটা মূলত আটকে থাকছে পরমাণুর মধ্যে আর বড়োজোর অল্পস্বল্প ঐ সীসার অ্যালয়ের মধ্যে। এই 'মির‍্যাক্‌ল্‌'-এর পেছনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া কী, আমরা জানি না। তাই এটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উপাদানগুলোকে আলাদা করার কাজও খুব সাবধানে করতে হবে। কোনও জনহীন দ্বীপে বা নির্জন প্রান্তরে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে কাজটা সারতে হবে। কারণ একটু এদিক-ওদিক হলেই ঐ অমিত শক্তির দৈত্য বোতল থেকে বেরিয়ে এসে প্রলয় ঘটিয়ে দিতে পারে।"
"তার মানে বলতে চাস কোনও বুদ্ধিমান ও উন্নত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানসম্পন্ন 'এলিয়েন' এটা তৈরি করেছে?"
"দ্যাখ, প্রকৃতিও এক মহাবৈজ্ঞানিক। তার রসায়নাগারে বিচিত্র আণবিক গঠন ও পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে জড় ও জীব দুয়েরই উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে। তাই মহাবিশ্বের দূর কোনও পরিমণ্ডলে যেখানে চাপ, তাপ, অভিকর্ষ সব একেবারে আলাদা সেখানে এই পদার্থ নিজে নিজে তৈরি হলেও হতে পারে। তবে আমি বলব কোনও উন্নত বুদ্ধিমান জীব প্রকৃতির এজেন্ট হয়ে ব্যাপারটা ঘটিয়েছে, এমন সম্ভাবনাই বেশি।"
"কিন্তু সেই এলিয়েনরা কি এটা কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে? নইলে এটা এল কীভাবে?"
"উদ্দেশ্য নিয়ে পাঠালে অত বুদ্ধিমান জীব এটাকে কোনও মহাকাশযান থেকে আলতো করে নামিয়ে দিয়ে যেত। কিন্তু যেহেতু এটা অনিয়ন্ত্রিত উল্কা হিসেবে পড়েছে, তাই আমার অনুমান – স্রেফ অনুমান – এটা হয়তো ওদের কোনও মহাকাশযানের একটা 'ইঞ্জিন' অথবা তার ভগ্নাংশ। মহাশূন্যে এটা মহাকাশযানকে শক্তি জোগাত। কোনও দুর্ঘটনায় এই অংশটি ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর মহাশূন্যে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো কোনও ধূমকেতুর পাখনায় চড়ে সৌরমণ্ডলে হাজির হয় ও শেষে পৃথিবীর বুকে উল্কা হয়ে আছড়ে পড়ে।" "কিন্তু বাতাসের ঘর্ষণে জ্বলতে জ্বলতে মাটিতে প্রবল বেগে আছড়ে পড়েও –"
"এই শক্তিভাণ্ডারে কেন বিস্ফোরণ ঘটেনি? আমার ধারণা, মহাজাগতিক ধূলিকণার সংঘর্ষ থেকে একে রক্ষা করার জন্য শক্তপোক্ত কোনও ধাতব আবরণ ছিল। সেটাই পৃথিবীতে নামার সময় নিজে ক্ষয়ে গিয়েও মূল জিনিসটাকে রক্ষা করেছে।"

সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। অতনু থামতে আইরিন জিগ্যেস করল, "এখন তাহলে কী করতে চাস?"
"খুব সাবধানে, ধীরে ধীরে এগোতে চাই। আর সেইজন্য একটা কাজ প্রথমে করা দরকার। যে উল্কাপিণ্ডটা মাটিতে গেঁথে আছে, সেটা উদ্ধার করে সাবধানে কোনও ল্যাবে পাঠাতে হবে। জায়গাটার নাম কী যেন বলছিলি?"
"কেতুগ্রাম। সত্যি যাবি? চল, রমা কাকা খুব খুশি হবে।"

(৮)

ওরা দুজন অবশ্য 'একা একা' যেতে পারল না। আইরিন যদ্দিন আছে, সঙ্গে পুলিশ গার্ডও থাকবে। ডাকাত দলের অধিকাংশ চাঁই ধরা পড়েছে। তবে রাজু গোঁসাই এখনও গা ঢাকা দিয়ে। সে আবার দল তৈরি করে যে কোনও সময় পাল্টা আঘাত হানতে পারে।

রমাকান্ত ওদের দেখে ভীষণ খুশি। আপ্যায়ন পর্ব শেষ হলে আইরিন আসল কথাটা জিগ্যেস করল – অর্থাৎ ঐ উল্কাটা কোথায় পড়েছিল? সব শুনে রমাকান্ত ওদের অকুস্থলে নিয়ে চলল। মাঠ পেরিয়ে ঝোপজঙ্গলের মধ্যে ঢুকে ও একটা চিহ্ন দেখে একটা জায়গায় এসে পাতা, ডাল সরাতে লাগল। একটু পরই আত্মপ্রকাশ করল সেই বহু প্রতীক্ষিত গহ্বর ও উল্কাপিণ্ড।

পরম কৌতুহলে জায়গাটা দেখতে দেখতে অতনু বলল, "কতটা গর্ত হয়ে ঢুকে আছে দেখ। গোটা মডিউলটা বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সময় নিশ্চয়ই এর চেয়ে অনেক বড়ো ছিল। বাইরের আবরণ জ্বলেপুড়ে, ভেঙে হয়তো ভেতরকার কয়েক কেজি জিনিস ঐ গর্তে পড়ে আছে। কিন্তু সেটা মাটির অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে, খুঁড়ে বের করতে সময় লাগবে।"
"তবে দাদাবাবু তোমরা বরং কাল সকালে এস। আমি মাটি খোঁড়ার লোক ঠিক করে রাখব 'খন। আর এখন তো সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, সাপখোপ বেরোতে পারে।"
বলতে না বলতেই পেছনে জঙ্গলে সড়সড় শব্দ। আইরিন আর অতনু লাফ দিয়ে পেছিয়ে এল। রমাকান্ত একটু সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, "নাঃ, মনে হয় তেনারা নন। তবে কীসের শব্দ? কোনও জন্তুজানোয়ারের?"
যাই হোক, সেদিনের মতো ওরা রমাকান্তর সাথে ফিরে এল। রাতটা বেশ খাওয়া দাওয়া গল্পগুজবে কাটল।
পরদিন সকাল সকালই রমাকান্ত লোকজন নিয়ে এল। সবাই মিলে জঙ্গলে গেল। আগের দিন রমাকান্ত গর্তটা আবার ডালপালা দিয়ে ঢেকে এসেছিল। সেটা সরিয়েই কিন্তু তার চক্ষু চড়কগাছ।
"দ্যাখো দাদাবাবু, ওটা আর নেই!"

অতনু দৌড়ে এসে দেখে, সত্যিই তাই। চারপাশে গর্ত খোঁড়ার চিহ্ন। আশেপাশে মানুষের পায়ের ছাপ। স্পষ্টতই কেউ রাতে এসে জিনিসটা তুলে নিয়ে গেছে। এতক্ষণে ওরা বুঝল, কেউ কাল ওদের অনুসরণ করছিল। চলে আসার আগে ওরা তার সরে যাওয়ার আওয়াজই পেয়েছিল।

অতনুর মুখ ফ্যাকাশে। খালি বলছে, "খুব খারাপ হল, খুব খারাপ হল! যে নিয়েছে, সে বুঝবে না জিনিসটা কত বিপজ্জনক। ওটার মধ্যে অসীম শক্তি লুকিয়ে আছে। সেই দৈত্য যদি কোনও আনাড়ির ভুলে একবার ছাড়া পায় তবে প্রলয় ঘটিয়ে দেবে।"

আইরিনের প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। তার মধ্যেই সে মাথা ঠাণ্ডা করে হিমাংশু কাকুকে আর পুলিশকে খবরটা জানিয়ে বলে দিল যেন আপৎকালীন তৎপরতায় বের করার চেষ্টা করা হয় কে ওটা নিয়েছে। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় থানার থেকে খবর এল, খুব সকালে একজন অচেনা লোক একটা বড়োসড়ো স্যুটকেস নিয়ে কেতুগ্রাম বাস স্টপ থেকে কলকাতার বাস ধরেছে। আইরিন খবর পেয়েই দৌড়ে গেল। যে দেখেছে, তার কাছে ওই যাত্রীর বর্ণনা শুনে সে কী মনে করে পকেট থেকে একটা ফটো বের করে দেখাল। "আরে, এই তো!" লোকটা চেঁচিয়ে উঠল।

রাজু গোঁসাই! আইরিন মাথায় হাত দিয়ে বসল।

রমা কাকার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজন কলকাতা ফিরছে। দুজনেরই মুড অফ। এক সময় অতনু বলল, "কপাল! লোকটা নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নেবে বলে তোকে ফলো করছিল, শুধু পুলিশ গার্ডের জন্য এগোতে পারেনি। তারপর জঙ্গলে লুকিয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনে ওর মনে হয় এই উল্কাপিণ্ডটা দারুণ মূল্যবান জিনিস। বড়ো দাঁও মারার আশায় তাই রাতারাতি মাটি খুঁড়ে তুলে নিয়ে হাওয়া হয়েছে।"
"আমি শিওর নই। ইদানীং ওর সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে যা জেনেছি, লোকটা অসম্ভব প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান সচেতন। ওর 'সোর্স'ও অনেক। তাই ও যদি ব্যাপারটা মোটামুটি জেনে গিয়ে থাকে বা আঁচ করে থাকে তবে আমি আশ্চর্য হব না।"
"তাহলেই মঙ্গল। কারণ তবেই ও জিনিসটার সম্বন্ধে উপযুক্ত সতর্কতা নেবে।"
"এতেও আমার সন্দেহ আছে। লোকটা ডেয়ার-ডেভিল, জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে ভয় পায় না। সবার আগে কিছু বের করে নাম, যশ আর অর্থ করার মোহে ও বেপরোয়া ঝুঁকি নিতেই পারে।"
"তাহলে আমাদের অপেক্ষা করা আর প্রার্থনা করা ছাড়া কিছু করার নেই।"

বাড়ি ফিরতেই হিমাংশু কাকার ফোন, "চিন্তা কোরো না আইরিন, সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা অবধি কাজে নেমে পড়েছে। রাজুর স্বাভাবিক ফটো আর ছদ্মবেশে কেমন দেখতে হতে পারে তার ফটোও চারদিকে পাঠানো হচ্ছে। ট্রেন, বাস, প্লেন সব টার্মিনাসেই পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কদ্দিন আর গা ঢাকা দিয়ে থাকবে? কলকাতার বাইরে যেতে গেলেই ধরা পড়বে।"
"ট্রেন, বাস, প্লেন – কাকু, জলপথে পাহারা বসানো হয়নি?"
"জলপথ? ও-হো, এটা তো ওরা খেয়াল করেনি। দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি বলে দিচ্ছি।"
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হিমাংশু বাবু কল ব্যাক করলেন, "তুমি বোধহয় ঠিক ধরেছ, আইরিন। গঙ্গায় একটা অজানা স্পীডবোট কিছুক্ষণ আগে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। কাছে গিয়ে জলপুলিশের মনে হয় বড়োলোকের কিছু বয়ে যাওয়া ছেলে মদ খেয়ে হল্লা করছে, তাই তাদের ছেড়ে দেয়। এখন মনে হচ্ছে –"
"বোটটা নিশ্চয়ই উত্তর দিকে গেছে?"
"না। আশ্চর্যের ব্যাপার, ওটা দক্ষিণে চলেছে।"
"ওঃ, তার মানে সমুদ্র দিয়ে বাংলাদেশ বা মায়ানমারে! কাকু, ওটাকে কি ফলো করা হচ্ছে?"
"হ্যাঁ, তুমি মনে করিয়ে দেবার পর আমি আই-জিকে ফোন করেছিলাম। তিনি অবিলম্বে তেমনটাই করার নির্দেশ দিয়েছেন। গোটা পুলিশ ফোর্স এখন ওটার পেছনে। আশা করি কিছুক্ষণের মধ্যেই 'গুড নিউজ' দিতে পারব।"

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেও অবশ্য সুসংবাদ এল না। ওরা ততক্ষণে কলকাতায় বাড়ি পৌঁছে গেছে। শেষে বিকেল নাগাদ হিমাংশু বাবুর ফোন এল, "দুঃখিত আইরিন, আমরা বোটটাকে হারিয়ে ফেলেছি। অসম্ভব ধড়িবাজ ওরা, নানাভাবে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে শেষে সুন্দরবন অঞ্চলে এক খালের মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।"
"ওখানে নেমে খোঁজ করা যায় না?"
"সেটা বাস্তবে অসম্ভব। তোমার এলাকাটার সম্বন্ধে ধারণা নেই। ওখানে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শুধু নদীর খাড়ি, খাল আর জঙ্গল। সভ্য মানুষের পা সুন্দরবনের সেই খাসমহলে কমই পড়ে। সেখানে আছে নরখাদক বাঘ, কুমির আর তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু জলদস্যু। তারাই সেখানে রাজত্ব করে, আইনের হাত অত দূর পৌঁছোয় না। এলাকায় অনবরত গজিয়ে ওঠা আর তলিয়ে যাওয়া অজস্র ছোটোখাটো দ্বীপের মানচিত্রও কোনও অ্যাটলাসে নেই। এই ভূপ্রকৃতির মধ্য দিয়েই গেছে বাংলাদেশ বর্ডার। কিন্তু বাঘ, কুমির আর ডাকাতরা বর্ডার জানে না। সরি – রাজু তার ভাই-বেরদারদের নিরাপদ আশ্রয় থেকে না বেরোলে আমরা কিছু করতে পারব না।"

আইরিন আর অতনু মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। শেষে অতনু ফিসফিস করে বলল, "একটা ভয়ঙ্কর টাইম বোম পড়ে রইল জলজঙ্গলের মধ্যে। যেটুকু জিনিস রাজু নিয়ে গেছে, তাতে ওই ভারী ধাতুর পরিমাণ অবশ্য বাড়াবাড়ি বেশি নয়। তবু তার সবটা শক্তি বিস্ফোরণে বেরিয়ে এলে তা আণবিক বোমার মতো যদি নাও হয়, ডিনামাইট, আরডিএক্সকে অনায়াসে হার মানাবে। এখন ওপরওয়ালাই ভরসা।"

(৯)

কিছুদিন হল আইরিন মিশিগান ফিরে এসেছে। মনে নানা বিষাদমধুর স্মৃতি। তার দেওয়া বিচিত্র মিশ্রধাতুর টুকরোটা নিয়ে অতনু তার অনুসন্ধান এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আইরিন তার কাজে মন দেবার চেষ্টা করছে।
ইন্টারনেটে বাংলা কাগজে রোজ একবার চোখ বুলোনো তার অনেকদিনের অভ্যাস। একদিন সকালে ভেতরের পাতায় একটা খবর দেখে সে নড়েচড়ে বসল, "নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দু'দিন আগে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এক দ্বীপে এক বিরাট বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণের তীব্রতা এমন যে কম্পনে আর জলোচ্ছ্বাসে গোটা দ্বীপটিই তলিয়ে গেছে। সৌভাগ্যক্রমে, নতুন গজিয়ে ওঠা দ্বীপটিতে কোনও জনবসতি ছিল না। বিস্ফোরণের কারণ জানা যায়নি। এটি কি গোপনে কোনও পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা, নাকি এক বিশাল উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে সৃষ্ট সংঘাত, তাই নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। সরকারি সূত্রে অবশ্য খবরটি অস্বীকার করা হয়েছে।"
চোখ বুজে দৃশ্যটা কল্পনা করে আইরিন শিউরে উঠল। তার জীবনে রাজু নামে দুঃস্বপ্নের তাহলে এক ভয়ঙ্কর সমাপ্তিই হল।
নাকি হল না?


ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা