সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
হোলা

হোলার জন্ম দক্ষিণ বাংলার এক অখ্যাত গ্রামে। শৈশবে এক গরিব পরিবারের বদান্যতায় তার আশ্রয় জুটেছিল এক খোড়ো ঘরে, খাওয়াও মোটামুটি জুটে যেত। কিন্তু ছোট থেকেই তার জীবন দুর্বিষহ করে দিয়েছিল এক বিরাট হুলো বিড়াল। সে নিয়মিত ওকে বিনা কারণেই মারত, আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিত দেখা হলেই। হোলা ওর সাথে পেরে উঠত না, একটু আধটু প্রতিরোধ করলেও শেষ পর্যন্ত পালাতে হতো ওকে। কিন্তু সেই হুলো বিড়ালটা বোঝে নি হোলার মনে ওর প্রতি কত বিদ্বেষ জমা হচ্ছিল আর বোঝে নি সে ক্রমশঃ বুড়ো হচ্ছিল আর হোলা জোয়ান হচ্ছিল। একদিন হোলার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। নিজের শক্তির উপরে ভরসা রেখে নিখুঁত পরিকল্পনা করে সে যুদ্ধে নামল। ওর থেকে অনেক বড় বিড়ালটাকে খেলিয়ে খেলিয়ে খালের ধারে নিয়ে গেল আর ঘুরতে ঘুরতে তাকে একবার খালের পারে নিতে পারল। এবার এক সজোরে ধাক্কা – বুড়ো বিড়ালটা গিয়ে পড়ল খালের জলে। ফ্যাঁচ করে ধাক্কা সামলে সে জল থেকে উঠতে যেতেই আবার ধাক্কা, তারপরে আবার। এবার হুলোটা ভয় পেল, একটু দূরে গিয়ে হোলার হাত এড়িয়ে উঠতে গেল। কিন্তু হোলা নাছোড়বান্দা, তড়িৎগতিতে সেখানে হাজির হয়ে আবার এক ধাক্কা।

সেদিন ছিলো দুর্গাপূজার বিসর্জন, গ্রামের ধারে নদীতে বাইচ হয়। বাইচ আর বিসর্জন দেখতে গ্রামের সবাই নদীর ধারে। কাজেই বুড়ো হুলোটাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার কেউ ছিল না। পরের দিন বুড়ো বিড়ালটার দেহ জলে ভেসে উঠতে দেখে সবাই অবাক। সাক্ষী না থাকায় হোলা কোনও কেস খেল না।

ওহো, বলতে তো ভুলেই গিয়েছি! হোলাও তো এক হুলো বিড়াল! যাই হোক, এর পরে হোলা গ্রামের বিড়ালদের নেতা হয়ে গেল। খাড়া লেজের নিশান উড়িয়ে সে ঘুরে বেড়াত, অন্য হুলোরা ওকে দেখলেই সসম্মানে পথ ছেড়ে দিত।

হোলার বাড়ির মানুষ সদস্যেরা ওকে খুব পছন্দ করত আর ভালো শিক্ষা দিয়েছিল। তাই হোলা ছোটবেলা থেকেই খেটে খেতে শিখে গিয়েছিল। বাড়ির আনাচে কানাচে থেকে সে ইঁদুর দূর করে ছেড়েছিল, ফলে সে বাড়ির সম্পদের ভালো পাহারাদার হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এরপরে সে হানা দিল আশেপাশের বাড়ীতে, সেখান থেকেও ইঁদুরের বংশ লোপ করার দুর্জয় চেষ্টাতে মেতে উঠল। ফলে সেই বাড়ীগুলো থেকেও কিছু বদান্যতা সে পেয়ে যেত।

হোলা ছোটবেলা থেকে একটা দারুণ শিক্ষা পেয়েছিল – কোনও পাত্রে রাখা কিছু কখনওই তার খাবার হতে পারে না। তার বাড়ির লোকেরা তাকে খাবার দিত মাটিতে। আমিষ নিরামিষ নির্বিশেষে সে চেটেপুটে খেয়ে নিত। তবে সে বাড়িতে এসে 'হোয়া হোয়া' করে খাবার তখনই চাইত যখন সে নিজে কোনও খাবার আয় করতে পারত না। কাজেই বলা যায়, হোলা শ্রমজীবি ছিল। তবে হোলার শ্রমজীবি দক্ষতাতেও মাঝে মাঝে বিভ্রাট ঘটত। এক আধটা শীতের রাতে হোলা প্রায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরে তারস্বরে 'হোয়া, হোয়া' করে চেঁচাত। বাড়ির কেউ উঠে দেখত হোলার সারা গা ভেজা – মানে হোলা খালের ধারে বসে মাছ শিকার করতে গিয়ে ব্যর্থ ঝাঁপ দিয়েছে জলে, মাছ জোটে নি, শীতের রাতে ভেজা গায়ে থাকার থেকে পরিবারের লোকেদের থেকে সাহায্য চাওয়া যে ভালো তা হোলা দিব্যি বুঝত। তাই বাড়ির ছেলেটার দু-একটা মৃদু চড়চাপটা আর বকুনি সহ্য করত বিনা প্রতিবাদে। এর বিনিময়ে হোলা একটা শুকনো চট পেত, যাতে ও সারাটা ভিজে শরীর ভালো করে মুছে নিতে পারত, অন্তত একমুঠো ভাত পেত, শোবার আর গায়ে দেবার জন্য শুকনো চট পেত। এর বিনিময়ে হোলা কিন্তু মৃদু 'ম্যাও' ধ্বনি দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভুলত না। তবে খুব কম দিনই এ রকম হতো। সাধারণতঃ হোলা শিকার পেত আর রাতে বাড়ি ফিরে মৃদু 'ম্যাও, ম্যাও' ডেকে ওর বরাদ্দ চটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ত আরামে। শিকার পাওয়া আর জলে চুবানি – কোনওটাই না হলে ডাকটা একটু দীর্ঘস্থায়ী হতো আর বাড়ির কাউকে উঠে একমুঠো ভাত দিতেই হতো। হোলা মাটিতে দেওয়া ভাত এত সুনিপুণভাবে চেটে খেত যে পরের দিন সকালে তার কোনও চিহ্ন থাকত না।

হোলা

বাড়ির গিন্নি মাছ কাটতে কাটতে হয়তো ভাতের জ্বালটা দেখতে উঠে যেত, যাবার আগে হোলাকে মাছের পাত্রের কাছে বসিয়ে রেখে বলে যেত – হোলা, দেখিস! হোলা একেবারে ব্ল্যাক ক্যাটের দক্ষতাতে কাক তাড়াত, ভুলেও মুখ দিত না। তবে মাটিতে কিছু পড়ে থাকলে হোলা সেটাকে নিজের খাবার ভেবে তৎক্ষণাৎ আত্মসাৎ করে নিত। সেক্ষেত্রে তাকে বকেও কোনও লাভ হতো না।

হোলা আরেকটা পারিবারিক দায়িত্ব নিয়মিত পালন করত। বাড়ির ছেলেটা মাঝে মাঝেই রাতের বেলাতে খালে বিলে বা মাঠের মাঝখানের এজমালি পুকুরগুলোতে মাছ ধরতে যেত। হোলা বিনা বাক্যব্যয়ে তার সঙ্গ নিত – বাড়ির ছেলেটাকে সে এই রাতে একা ছাড়ে কী করে? ছেলেটাও খুশী হতো নিশুতি রাতে এক সাথি পেয়ে। বিশেষত ওর ধারণা ছিল মাছ ধরার সময়ে বিড়াল সাথে থাকলে কোনও ভুত-পেত্নীর উপদ্রব হয় না। হোলা পুরো সময়টাই থাকত – কখনও ওর সাথিকে ফেলে ফিরে আসত না, ছেলেটার নিজেকে সাহস দেবার জন্য অনর্থক বকবকানি শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ছোট্ট 'ম্যাও' করে তার মত জানাত, জালে মাছ পড়লে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে উৎসাহ দিত আর ছেলেটার ভুল করে বা ইচ্ছা করে ফেলে দেওয়া এক আধটা চুনো চিংড়ি পেয়েই সন্তুষ্ট থাকত। ওর জায়গাতে কোনও মানুষ সাথি নিলে নিশ্চয়ই এর থেকে অনেক বেশী দিতে হতো তাকে।

কিন্তু হঠাৎ হোলাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ল বাড়ির লোকেরা। এক দিন ঘরের এক নিভৃত কোণার থেকে পাওয়া গেল দু'টি হাঁসের পা। সাথে সাথে সবাই দুইয়ে দুইয়ে চার করে ফেলল – হোলা নিশ্চয়ই কোনও বাড়ির হাঁস মেরে এখানে এনে খেয়েছে। সবাই তটস্থ হয়ে রইল, কার সাথে এবার ঝগড়া বাঁধে কে জানে?কিন্তু ঝগড়া বাধল না, কোনও বাড়ির হাঁস গায়েব হয়েছে এ রকম কোনও খবরও পাওয়া গেল না।এর কয়েকদিন পরে একদিন দুপুরে ঘরের সেই কোণা থেকে ঝটাপটির শব্দ শুনে ছুটে গেল সবাই – নিশ্চয়ই আবার হাঁস ধরে এনেছে। 'এই হোলা! ছাড়, ছাড়!' হোলা ভীষণ অবাক হল এই নির্দেশ পেয়ে। ততক্ষণে তার মুখ থেকে হাঁসটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। হোলা তীব্র প্রতিবাদ জানাল, "ম্যা-ও-ও-ও!" ভালো করে দেখে এবার বাড়ির সবাই অবাক – এ তো পোষা হাঁস না, হাঁসপাখি, বুনো হাঁস! ওরা নিশ্চয়ই জলার কাছে বিশ্রাম করছিল, হোলা শিকার করে এনেছে।

সেদিন হোলার ভাগ্যে আর কাঁচা মাংস জোটে নি, রান্না করা মাংস ভাত দিয়ে মেখে পরম তৃপ্তিতে সে খাওয়া শেষ করে মৃদু আওয়াজে সন্তোষ জানিয়েছিল, "উম্মম্যাওও!"

ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

কলকাতা উপকণ্ঠের বাগুইআটি-নিবাসী শংকর সেন পেশায় প্যাথলজি ল্যাবরেটরির টেকনিশিয়ান। তাঁর অন্যতম নেশা ভ্রমণ, বিশেষতঃ পাহাড়ে। তাঁর আর এক নেশা হচ্ছে কিছু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মেডিক্যাল ক্যাম্পের সুবাদে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে গিয়ে অভাবী মানুষদের কাছে সুলভে প্যাথলজি পরিষেবা পৌঁছে দেবার কাজে অংশ নেওয়া। এইসব অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি বই ও লিখেছেন। সময় পেলেই তিনি নতুন নতুন ভ্রমণকাহিনী বা গল্প লেখেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা