সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
মিতুল আর জঙ্গুলেরা

মিতুলের আজ খুব মজা, বাবা আসবে। বাবা অনেক দূরে চাকরী করে, কতদিন পরে পরে আসে – একটুও ভালো লাগে না মিতুলের। আর মা’রও কি ভালো লাগে? খালি বলে – একা আমি আর কত দিক সামলাব! আর তুই যা দুষ্টু হচ্ছিস! তোকে সামলাতেই তো আমার দিন কেটে যায়। বাবা  এখানে থাকলে সে তোকে সামলাত, আমি সংসার সামলাতাম!

অবশ্য মিতুল খুব শান্ত হয়ে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু হয় কী– ওদের বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে অনেক গাছ। সেখানে পাখি আসে অনেক। সেই পাখিরা এসে ডাকলেই মিতুলের মন কেমন করে ওঠে, পাখিদের দেখতে ইচ্ছে করে। ও তখন বাইরে গিয়ে গাছের ফাঁকে পাখি দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু পাখিরাও এমন দুষ্টু, কিছুতেই দেখা দেবে না! তাদের খুঁজতে খুঁজতেই হয়তো এসে পড়ল স্কুলের সময়, কিংবা ওর স্নান করার সময়,কিংবা খাবার সময়। ওকে মা যখন হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় তখন দুষ্টু পাখীগুলো দিব্যি সামনে এসে দেখে আর টিকি টুয়া – কতরকম আওয়াজ করে! আবার দেখ কী বদমাস! মিতুল যখন গম ছড়িয়ে দেয়, ওর খাবার থেকে ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে রাখে তখন তো এসে দিব্যি খেয়ে নেয়! ও একটু কাছে থেকে দেখবে – তা হতে দেবে না! এ দিকে খাবার বেলায় বেশ আছে! মিতুল রোজ ভাবে দুষ্টু পাখিগুলোর সাথে আড়ি করে দেবে। একবার করেও দিয়েছিল – দু’দিন যায়ই নি পাখী দেখতে! তখন কিন্তু জানলার কাছে এসে বেশ টুই টাই শুরু করেছিল!

তারপরে তো আছে ভুলো! বিকেল হতে না হতেই এসে জানলার ধারে –ভৌ! খাবার দিলেও আবার ভৌ। তার মানে এবার মিতুলকে ওর সাথে খেলতে হবে। ওর সাথে খেলা মানেই তো মা’র রেগে যাওয়া! বলবে – রাস্তার কুকুর! ওর গায়ে কতরকম রোগের জীবাণু আছে! কিন্তু মিতুল কী করবে? ভুলো যে কিছুতেই ওর সাথে না খেলে যায় না।

তাও ভালো ওদের বাড়িতে কোনও মিনিপুষি নেই। তা হলে আর দেখতে হতো না! বেড়াল মিতুলের খুব ভালো লাগে, কিন্তু মা পুষতেই দেয় না!

বাবা আসা মানেই মজা! এবারও এসেই মিতুলকে কোলে তুলে নিল। মা খালি বলে – তুই বড়ো হয়েছিস না! কোলে উঠবি কেন? বাবা কিন্তু একবারও বলে না! কতক্ষণ ওকে কোলে নিয়ে ঘোরে! আর বাবার কোলে উঠতে যা মজা! এবারও কোলে নিয়ে খানিক ঘুরে ওকে কোলে নিয়েই বসল বাবা, “ মিতুল! একটা ভালো খবর আছে যে!”

“কী ভালো খবর বাবা?”

“তোমরা এবার আমার সাথে যাচ্ছ! আমরা এবার থেকে একসাথেই থাকব! আমি বড়ো কোয়ার্টার পেয়ে গেছি! হাঃ হাঃ হাঃ!”

কী ভালো লাগল মিতুলের শুনে। আনন্দে বাবাকে দশটা হামি দিয়ে দিল। মা বলল, “মিতুলের পড়াশুনার কী হবে?”

“হবে হবে হবে হবে! সব হবে সব হবে! ওখানে কি ভেবেছ স্কুল নেই? আমি সব ব্যবস্থা করেই এসেছি।  একটু দূরে, কিন্তু আমার তো গাড়ি থাকবে! কোনও অসুবিধা হবে না! আর মিতুল রাণী ওখানে যত খুশী পাখি দেখবে, গাছ দেখবে, জঙ্গল দেখবে!”

সত্যি সত্যিই বাবার সাথে লটবহর নিয়ে ওরা চলে এল বাবার কোয়ার্টারে। কী ভালো জায়গাটা। কত গাছ! আর এখানকার পাখিগুলো অত দুষ্টু না। প্রথম কয়েকদিন দেখা দিতে চায় নি ঠিক, কিন্তু তারপরে বেশ ভাব হয়ে গেল মিতুলের সঙ্গে। ওর সামনেই দিব্যি ঘুরে বেড়ায়, খুঁটে খুঁটে এটা ওটা খায়। তবে এখানে ভুলোকে তো আনা হয় নি। ওর কথা ভেবে মিতুলের মন খারাপ লাগে – বেচারি কার সাথে আর খেলবে?

একদিন মিতুল দিব্যি পাখি দেখতে দেখতে বসে বাদামভাজা খাচ্ছে। হঠাৎ দেখে একটা বেশ বড়ো পাখি এসেছে কোথা থেকে। পাখিটা একটা গাছের ডালে এসে বসে মিতুলের দিকে ঝুঁকে ডাক ছাড়ল – ক্যারর ক্যার! মিতুলের মনে হল বলছে – কে রে তুই! পাখিটা ঠিক মিতুলের মাথার উপরে, মিতুল মাথা তুলে ওর দিকে তাকিয়ে জিভ ভেঙচাল – কে রে তুই? জানিস না! আমি মিতুল! এখানে নতুন এলি নাকি?  পাখিটা আবার ডাকল – ক্যারর ক্যকেস!

মিতুল বুঝল ও বলছে – কোথায় থাকিস? আবার ভেঙচাল – কোথায় থাকিস? জানিস না কিছুই! কোথা থেকে এসেছিস তুই? আমি তো ওই কোয়ার্টারে থাকি। তুই কোথায় থাকিস?

“ক্যাচে ক্যাচে ক্যাচে!” মিতুন বুঝে ফেলল পাখিটা বলছে – গাছে, গাছে গাছে!

“গাছে ছাড়া পাখিরা আবার কোথায় থাকে? তা কোন গাছে থাকিস?”

“ক্যারর ক্যাটো! ক্যারর ক্যাটো!” মিতুন বুঝে ফেলল পাখিটা বলছে,“বাদাম খাবো! বাদাম খাবো!”

“বাদাম খাবি তো নেমে আয় না! আমার কি তোর মতো পাখা আছে যে ওখানে গিয়ে তোকে দিয়ে আসব?”

পাখিটা নামল তো নাই, টুপুস করে মিতুলের মাথার উপর থেকে যা কাণ্ড করল! মিতুল মাথা উঁচু করে দেখছিল আর পাখিদের এই বদমাইসির কথা ও ভালো করেই জানে বলে বেঁচে গেল এ যাত্রা! ও কোনওমতে সরে যাওয়াতে প্রায় ওর ফ্রক ঘেঁষে টুপুস করে মাটিতে পড়লো – এমা ছিঃ!

এবার কিন্তু মিতুল খুব রেগে গেল, পাখিটাও এমন দুষ্টু – নেমে এসে মিতুলের সামনে বসে ঘাড় কাত করে বলল – ক্যাটর ক্যারা, ক্যাটর ক্যারা। মানে কেমন মজা আর কী! এবার মিতুল হাতে একটা ঢিল নিল – দেখবি মজা? তোকে বাদাম খেতে ডাকলাম আর তুই – ছিঃ এত বড়ো হয়েছিস – জামাকাপড় তো পরিসই না! আবার সবার সামনে এইসব কম্ম করিস!

কিন্তু মারবে কী করে? পাখিটা মিতুলের সামনে লাফাতে লাফাতে চলেছে, মিতুল ওর দিকে টিপ করতে না করতেই ও আরেকদিকে সরে যায়। অবশ্য মিতুলের মারার ইচ্ছা মোটেই ছিল না, ও একটু ভয় দেখাতে চাইছিল পাখিটাকে। মা যেমন করে ওকে ভয় দেখায়,“মিতুল! তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, নইলে আমি কিন্তু খুব রেগে যাব!” কিন্তু ভয় পাওয়ার কোনও লক্ষণ পাখিটার নেই, দিব্যি ওর সামনে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে আবার কখনও প্রায় মাটি ঘেঁষে একটু উড়তে উড়তে চলেছে আর আওয়াজ করছে – ক্যাটর ক্যারা! এবার রাগ চলে গিয়ে বেশ মজা লাগছিল মিতুলের। পাখিটাকে তাড়া করতে করতে ও চলল। কোথায় যাচ্ছে তার আর হুঁশ রইল না ওর।

হঠাৎ মিতুল তো অবাক! এ আবার কী? খুদে খুদে কালোয় হলুদে চকড়াবকড়া – এনারা আবার কারা? না, বেড়াল তো না? কুকুরের বাচ্চা? এরকম কুকুরের রঙ হয় নাকি আবার? পাখিটার ডাক হঠাৎ থেমে গেছে। মিতুল দেখতে থাকে –কী মিষ্টি বাচ্চা দুটো! টলোমলো পায়ে হাঁটছে, তাও দেখ! একটা আরেকটাকে সুযোগ পেলেই ঠেলা দিচ্ছে। হঠাৎ একটা ফ্যাসফ্যাসানি কানে এলো মিতুলের – ইনি আবার কিনি? ওদের মা নাকি? তাইতো! দেখতে তো খানিকটা কুকুরের মতোই, কিন্তু কুকুর আবার এরকম ফ্যাস ফ্যাস করে নাকি? পাখিটা হঠাৎ কেন কে জানে ভীষণ জোরে চীৎকার করে উঠল আর ডানার ঝাপটা মেরে নেমে এল মিতুল আর জন্তুটার মাঝে। জন্তুটার দিকে তাকিয়ে কর্কশ ডাক ছাড়ল – ক্যারর কাট কাট! এ আর কে না বুঝতে পারে? পাখিটা জন্তুটাকে ভয় দেখাচ্ছে – চলে যা কাট! বাবাঃ! পাখিটার সাহস আছে তো! জন্তুটাও হঠাৎ অনেকটা বেড়ালের মতোই, কিন্তু বেড়ালের মতো না এরকম গলা করে ডাকল – উমম উও! বাচ্চাদুটো সব দুষ্টুমি ফেলে সোজা মায়ের কাছে, ওদের নাক দিয়ে এক ঠেলা দিয়ে জঙ্গলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিয়ে জন্তুটা চলল সামনে বাচ্চাদুটোকে রেখে।

পাখিটা কিন্তু ডাক থামাল না, এবার মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলল – ক্যারর ক্যাঁও! মানে বাড়িযাও! তা তো যাবই! বাড়ি যাব না তো কি তোর মতো গাছে থাকব নাকি? মিতুলের আবার মনে পড়ে যায় ও কী অপকম্ম করেছে। তোকে শাস্তি না দিয়ে যাব ভেবেছিস? আয় দেখি মজা দেখাই তোকে! পাখিটা কিন্তু একটু সরে গিয়ে আবার বলল – ক্যারর ক্যাঁও! আবার ঘাড় উঁচু করে মিতুলের পিছন দিকে কী যেন দেখতে লাগল আর একই কথা বলে যেতে লাগল। কী দেখছে রে ও? পিছন ফিরে তাকিয়েই মিতুল অবাক! এদের তো ও চেনে! হাতি! এরা আবার এলো কোত্থেকে? সবার সামনে যে হাতিটা তার দাঁতদুটো প্রায় মাটি ছুঁয়েছে, দলে আরও কত হাতি! ওরে বাবা!  কয়েকটা যে চুন্নু মুন্নুও আছে! কী মিষ্টি দেখতে! সামনের বড়ো হাতিটা মিতুলের সামনে এসে ফোঁস করে শব্দ করল, কানদুটো নাড়ল, ডেকে উঠল প্যাঁ করে। খিল খিল করে হেসে উঠল মিতুল। ওমা! হাতি আবার এই রকম ডাকে নাকি! প্যাঁ! যেন ভেঁপু বাজছে। ও মুখের সামনে হাত নিয়ে শব্দ করল– প্যাঁ! হাতিটা এবার খুদে কুতকুতে চোখদুটো মিটমিট করে আবার ডাকলো–প্যাঁ! ইতিমধ্যে একটা বাচ্চা হাতি এগিয়ে এসে –কী দুষ্টু দেখ! পিছন থেকে ওর ঘাড়ের কাছে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। মিতুল চমকে উঠে ফিরে তাকিয়ে তবে ওকে দেখতে পেল। মিতুলকে চমকে উঠতে দেখে ওর খুদে চোখদুটো মিটমিট করে আর শুঁড় কান নেড়ে ওর কী হাসি! মিতুল রেগে গেল – খুব ফাজিল হয়েছিস তো! আলাপ পরিচয় হল না, কিছু না, আগেই ঘাড়ের কাছে ফোঁশ! দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি! মিতুল সোজা ওর সামনের গোদা গোদা পা দুটো যেখান থেকে বার হয়েছে সেখানে হাত ঢুকিয়ে কাতুকুতু দিতে লাগল – দেখ এইবার মজা! কাতুকুতু খেয়ে হাতির বাচ্চাটার কী লাফানি! ফোঁশ ফোঁশ শব্দ করে আর লাফায়। মিতুলের তো ভয় হতে লাগল – ও ওর গোদা পা দিয়ে ওর পায়ে চেপটে না দেয়। কাতুকুতু থামিয়ে বকা দিল – ও রকম লাফাচ্ছিস কেন? আমার যদি লেগে যায়? পা তো না তোদের একেকটা শালের খুঁটি! আরেকটা হাতি এগিয়ে এল – বোধহয় ওই বাচ্চাটার মা, সে নিচু গলায় কী যেন বলল বাচ্চাটাকে – সেও লাফানি থামাল। মিতুল হার মানল না – দেখলি তো! আমিও মজা দেখাতে পারি। এখন আয় তো! আমি তোর পিঠে উঠি একটু! কিন্তু পিঠে উঠবে কী করে? বার দুই ঊঠতে গিয়ে পিছলে যেতেই বাচ্চা হাতিটা প্যাঁ করে উঠল। মিতুল এবার বড়ো হাতিটাকে ডাকল – ও হাতিদাদা, দাও না আমাকে একটু ওর পিঠে তুলে! বড়ো হাতিটাও একবার ছোট্ট করে প্যাঁ করে উঠে কান শুঁড় নেড়ে এগিয়ে এল। আর কী মজা দেখ, মিতুলকে একেবারে শুঁড়ে জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে বাচ্চা হাতিটার পিঠে ভালো করে বসিয়ে দিল। বাচ্চাটার মা পাশে এগিয়ে এল – মিতুল তো কোনওদিন হাতির পিঠে ওঠে নি, তাই একটু পিছলে পিছলে যাচ্ছিল। বাচ্চাটার মা আবার তাকে সোজা করে দিচ্ছিল। হঠাৎ মিতুলের চোখ পড়ল পাখিটা একটা গাছের একটু উঁচু ডালে বসে দেখছে ঘাড় কাত করে। মিতুল ওর দিকে তাকাতেই ও বলে উঠল – ক্যারররর ক্যাটেটে টো! মানে বেশ জমেছে তো!

আবার মিতুলের সব কথা মনে পড়ে গেল – পাখিটাকে শাস্তি দিতেই হবে। ও মনে মনে হিসাব করে নিল ও যদি হাতিদাদার পিঠে ওঠে তবে পাখিটাকে ধরতে পারবে। সাথে সাথে ও বায়না শুরু করল – ও হাতিদাদা, আমায় একটু তোমার পিঠে নাও না। ওই বদমাস পাখিটাকে আমি আজ ধরবই!

হাতিদাদাও কী ভালো! অমনি প্যাঁ করে এগিয়ে এসে মিতুলকে শুঁড়ে জড়িয়ে তুলে ধরল।

মিতুলের মা মিতুলকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হল, মিতুলের বাবাকে বলল – যাও না, মেয়েটা আবার কোথায় গেল দেখ তো একটু! বাবা দেরি না করে বার হলো মিতুলকে খুঁজতে। অবশ্য যাবে আর কোথায়? কাছাকাছিই আছে নিশ্চয়ই, কোথায় কোন পাখির কাণ্ডদেখছে সব ভুলে। কিন্তু খানিক এগিয়ে দেখে মিতুলের নাম ধরে ডেকেও যখন সাড়া পাওয়া গেল না তখন চিন্তায় পড়ল।এবার একটু দ্রুত পায়ে এগোতে লাগল মিতুলের বাবা,জঙ্গলে অনেকদিন থাকার সুবাদে জঙ্গলের মধ্যে কাউকে খোঁজার নিয়ম তার জানা আছে। মাটিতে চিহ্ন দেখে দেখে এগোতে লাগল মিতুলের বাবা। হ্যাঁ, এই তো! মিতুলের জুতোর ছাপ, এই পথেই গিয়েছে মিতুল। কিন্তু খানিক এগিয়েই চক্ষু চড়কগাছ! মাটিতে  খুদে খুদে – এতো চিতাবাঘের বাচ্চার পায়ের ছাপ! এবার ডাক থামিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে মিতুলের জুতোর ছাপ ধরে এগোতে লাগল মিতুলের বাবা। আশঙ্কায় বুকের ভিতরে ওলট পালট হচ্ছে তার।

খানিক এগিয়ে বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল তার! এ কী! এতো হাতির পায়ের ছাপ! একটা না, পুরো হাতির পাল! মিতুলের জুতোর ছাপ তো বটেই, বাদামের দুই একটা দানা দেখা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই মিতুলের হাত থেকে খসে পড়েছে। দ্রুত বেগে একটা জঙ্গলের মোড় ঘুড়তেই এক মুহুর্ত অবশ হয়ে গেলো ডাকাবুকো ফরেস্টার মণীশ চ্যাটার্জী! বিশাল একটা হাতির শুঁড়ে ঝুলছে তার মেয়ে মিতুল! এক মুহুর্ত পরেই আবার নিজেকে যেন ফিরে পেলো মণীশ – সে তো মিতুলের বাবা! মিতুলকে তার বাঁচাতেই হবে! ছুটে গিয়ে বড় দাঁতালটার পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ল মণীশ – ওকে ছেড়ে দাও! ও শিশু, কোনও দোষ করে নি! তোমাদের রাগ থাকে আমাকে মারো! ওকে ছেড়ে দাও! প্লীজ!

মিতুল আর জঙ্গুলেরা

হাতির দল বৃংহণে জঙ্গল কাঁপিয়ে তুলেছে। মিতুল বাবাকে দেখতে পেয়েছে, “বাবা, তুমি ও রকম করছ কেন? হাতিদাদা খুব ভালো! আমাকে পিঠে চড়াচ্ছে! ও হাতিদাদা! তোমরা রাগ দেখাচ্ছ কেন? এই তো আমার বাবা! আমি কতক্ষণ বাড়ির বাইরে, আমাকে খুঁজবে না? তোমার মেয়ে হারিয়ে গেলে তুমি খুঁজতে না?”

হাতিদাদা ততক্ষণে মিতুলকে ওর পিঠে তুলে নিয়েছে। কয়েক পা এগিয়ে সে দাঁড়াল মণীশের সামনে, এক পা তুলল, এবার নিশ্চয়ই পরের পা পড়বে মণীশের মাথায়। মণীশ তবু সরল না, ওর উপরে রাগ মিটিয়ে হাতিরা মিতুলকে ছেড়ে দিক!

কিন্তু পা ওর মাথায় নামল না। বরং শুঁড় এসে ওর বগলের নিচ থেকে ওকে পেঁচিয়ে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল। প্যাঁ করে ডাকল হাতি– দলকে কী নির্দেশ দিল। যুদ্ধংদেহী চেহারা কোমল হয়ে এল তাদের।

ওপর থেকে পাখিটা এবার একেবারে স্পষ্ট বলে উঠল – ভয় পেয়ো না! ভয় পেয়ো না!

মিতুল এবার খপ করে ধরে ফেলল ওকে – ভয় পেয়ো না! আয় তোকে আমি মজা দেখাচ্ছি!

পাখিটা কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার কোনও চেষ্টাই করল না, মিতুলের নরম গালে ওর ঠোঁটটা ঘষে দিল আলতো করে। মিতুল আবার রাগ দেখাল, কিন্তু রাগ ওর এতটুকু নেই। মা ওর উপরে রেগে গেলে ও মার গালে গাল ঘষে মার রাগ ভাঙায় না! পাখিটাও তাই করছে। তখন মা যেমন করে বলে ও তাই বলল – আবার সোহাগ দেখানো হচ্ছে! দাঁড়া! তোকে আজ মজা দেখাব!

মা যেমন ওকে বুকে চেপে ধরে আদর করে তেমনই পাখিটাকে বুকে চেপে ধরে আদর করতে লাগল মিতুল।

এরপরে আর কী? মিতুল বাড়ী ফিরল কিন্তু হাতিদাদার পিঠে চড়েই। বাড়ির খানিক দূরে সে ওকে নামিয়ে দিল। দলের একজন ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এল – শুঁড় দিয়ে মিতুলের হাতে গুঁজে দিল একটা বড়ো পাকা আম! আম মিতুল খুব ভালোবাসে, ওরা জানল কী করে? আর আম পেলই বা কোথায়! মিতুল ওর শুঁড়ে হাত বুলিয়ে বলল – পরে যখন আসবে আমরাও তোমাদের খাওয়াব! আসবে তো? আবার আমাকে ভুলে যাবে না তো?

বাইরের কেউ শুনতে না পায় এরকম নীচু স্বরে প্যাঁ করে উঠেছিল হাতিরা, পাখিটা বলে উঠেছিল –ক্যারর ক্যারর ক্যাটো! কে না জানে এর মানে আবার আসিব ফিরে – বাবা কত শুনিয়েছে এই কবিতাটা!  মা কিন্তু কিচ্ছু জানে নি, বাবা মিতুলকে বলে দিয়েছিল, “মাকে বলবি না মিতুল, মা তবে যদি ভয় পায়? তোকে নিয়ে কলকাতা ফিরে যেতে চায়?”

মিতুল মাকে বলেনি। কিন্তু একদিন যখন মিতুল গাবলু গুবলু হাতির বাচ্চাদের সাথে খেলা করছিল তখন মা দেখে ফেলে। তখন বড়ো হাতিরা একটু দূরে ছিল আর বাবা মিতুলের কাছেই ছিল বলে মা ভয় পায়নি, অবাক হয়ে বাবাকে বলেছিল, “কী গো? মিতুল এ কাদের সাথে খেলছে? হাতিদের সাথে?” বাবা একটু হেসে বলেছিল, “উহুঃ! ওর হাতি বন্ধুদের সাথে। এই জঙ্গলে সবাই এখন ওর বন্ধু।” সেই পাখিটা গাছের উপর থেকে বলে উঠেছিল – ক্যাট্টো ক্যাটে! মিতুলের মা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেছিলো, “ওটা আবার কে? কী বলছে ও?”

মিতুলের বাবা এখন ওর কথা বুঝতে পারে, সে বলেছিল, “ও বলছে বন্ধু বটে! ও একটা প্যারট। কোথা থেকে এল এখানে কে জানে? দেখছি – ওর একটা জুড়ি পাওয়া যায় কি না!”

মিতুল এখন অনেক বড়ো হয়েছে, ও কলেজে পড়ে। বাবা কিন্তু এখনও ওই কোয়ার্টারেই আছে। বলেছে – আমি যতদিন চাকরি করব এখানেই থাকব, এখানে আমার মিতুলের বন্ধুরা আছে না! মিতুল সপ্তাহের শেষে আসে, ওর ছোটো বন্ধুরা এখন তো অনেক বড়ো! তা আর হবে না? ও কি কম বড়ো নাকি? ও এখন ব্যথা পেলেও কাঁদে না। তবে কোনও চোরা শিকারি দাঁতের লোভে কোনও হাতি মেরেছে শুনলে বা কোনও হাতি রেলের ধাক্কায় মারা গেছে শুনলে ও কেঁদে ভাসায়।

 

ছবিঃ বৃষ্টি প্রামাণিক

কলকাতা উপকণ্ঠের বাগুইআটি-নিবাসী শংকর সেন পেশায় প্যাথলজি ল্যাবরেটরির টেকনিশিয়ান। তাঁর অন্যতম নেশা ভ্রমণ, বিশেষতঃ পাহাড়ে। তাঁর আর এক নেশা হচ্ছে কিছু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মেডিক্যাল ক্যাম্পের সুবাদে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে গিয়ে অভাবী মানুষদের কাছে সুলভে প্যাথলজি পরিষেবা পৌঁছে দেবার কাজে অংশ নেওয়া। এইসব অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি বই ও লিখেছেন। সময় পেলেই তিনি নতুন নতুন ভ্রমণকাহিনী বা গল্প লেখেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা