সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
নলে

"এই যে তোরা গরমের ছুটি, শীতের ছুটি পড়লেই সবাই মিলে এখানে চলে আসিস, হইহই করে চিৎকার চেঁচামিচি করে এই এত বড়ো তিনতলা বাড়িটাকে মাথায় করিস, দুপুরে রাতে দক্ষিণের বড়ো পুকুর থেকে তোলা টাকটা মাছের গাদা, পেটি যত পারিস সাবাড় করিস – জানিস কি এসব কার করা?" ফুলদাদু আমাদের জিজ্ঞেস করলেন।

"কার আবার করা? তোমরাই করেছ, আবার কে করবে!" বললাম আমি।
"কিংবা তোমাদের বাবা কাকারা কেউ," পুটকি বলল বেশ বিজ্ঞ বিজ্ঞভাবে।
আমাদের ভাইবোনেদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো পুটকি, নামটাও ওই জন্যে, কিন্তু ওই সবচেয়ে গম্ভীর হয়ে খুব জ্ঞানীর মতো কথা বলে।

"ছি ছি ছি! তোদের কী হবে রে? যে বাড়িতে বসে এত ফুর্তি করছিস সেটা কার করা তাই জানলি না আবার তাচ্ছিল্য করে বলছিস 'কে আবার করবে, তোমরাই কেউ করেছ কিংবা তোমাদের বাবা কাকারা!' ছি ছি! কী দুরবস্থা তোদের! নিজেদের পূর্বপুরুষদের কথা, নিজেদের বংশের কথা কিছুই জানিস না, ছি ছি!" ফুলদাদু একেবারে ছিছিক্কার করে উঠলেন, বিরক্তও যে হননি তাও নয়।

"অত ছি ছি করছ কেন? তুমিই বলও না কে করেছিলেন এই বাড়ি? না বললে আমরা জানব কী করে?" গুড্ডু সামলানোর চেষ্টা করল।

ফুলদাদু রেগেমেগে উঠে চলে গেলে এমন সুন্দর সন্ধ্যেটা পুরো মাটি হবে। তাছাড়া ফুলদাদুর কথা বলার ধরণে বেশ একটা জমাটি গল্পের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে অল্প অল্প। এই সুযোগ ছাড়া যায় নাকি? তাছাড়া আর মাত্তর দুদিন আছি আমরা এখানে, তারপরেই বাড়ি ফেরা। আবার সেই স্কুল, পড়াশোনা, আঁকার ক্লাস, সাঁতারের ক্লাস, গিটারের ক্লাস – কত্ত কিছু। গল্প শোনার সময় কোথায় তখন? আর ফুলদাদু একবার রেগে গেলে আর কিচ্ছুটি নাও বলতে পারেন, তাই আমরাও গুড্ডুর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলে উঠলাম, "বলো না বলো না, না বললে জানব কী করে, বলো না।"

চারদিকে ছত্রি দেওয়া মেহগনি কাঠের উঁচু খাটটাতে বাবু হয়ে বেশ জমিয়ে বসে ফুলদাদু কাঁসার জামবাটিটা থেকে এক মুঠো মুড়ি তুলে মুখে পুরলেন আর ফুলকপির পকোড়া কামড়ালেন, চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ সেগুলো চিবোলেন, তারপর বললেন, "শোন তবে। এ বাড়ি করেছিলেন আমার ঠাকুরদা। একেবারেই তিনতলা বাড়ি করেছিলেন। ঈশ্বর নলিনাক্ষ মৈত্র। দূরদর্শী মানুষ ছিলেন। ভবিষ্যতের কথা ভেবেই একেবারে এই এত বড়ো বাড়ি করেছিলেন। আর করেছিলেন বলেই না তোরা সবাই একসঙ্গে থাকতে পারছিস আর এত হল্লা করছিস। অথচ ওঁর নামটাই জানিস না!"

ফুলদাদু এখনও যে আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট আছেন সেটা বেশ বোঝা গেল।

"দক্ষিণ দিকের ওই বাঁধানো ঘাটের পুকুরটাও তোমার ঠাকুরদাই কাটিয়েছিলেন? ওই যেটা থেকে রোজ মাছ ধরা হয়?" সোম জিজ্ঞেস করল।

"তোমার ঠাকুরদা বলছিস যে বড়ো! এ আবার কী অসভ্যতা! উনি তোদের অতি বৃদ্ধ পিতামহ হন না?" ফুলদাদু এবার সত্যি সত্যিই রেগে গেলেন। আজকে মনে হচ্ছে ওঁর মেজাজটা ঠিক সুবিধের নেই।

কিন্তু আমরাও নাছোড়, তাই ফুলদাদুর কথা শেষ হতে না হতেই সমস্বরে সবাই বলে উঠলাম, "সোমের কথা বাদ দাও, ও কিচ্ছু জানে না। তুমি বলো না আমাদের অতি বৃদ্ধ পিতামহ কী কী করলেন?"

সোম আমাদের দিকে কটমট করে তাকাল, কিন্তু আমরা পাত্তা দিলে তো!

ফুলদাদু মুড়ি, পকোড়া খেতে খেতে বললেন, "এ বাড়ি তৈরি করতে সে যুগেও কিছু কম খরচ হয়নি। কীরকম চক মেলানো দালান দেখেছিস? পঙ্খের কাজ করা দেওয়াল। খুব বড়ো বড়ো লোকেরাই এসব করত। দোতলা, তিনতলায় দক্ষিণদকে লম্বা টানা বারান্দা। দোতলার বারান্দায় থাকত ঠাকুরদার পোষা পাখিরা। কাকাতুয়া, ময়না, টিয়া – এসব। সকাল, সন্ধ্যে তারা ঠাকুরের নাম করত আর কত কী যে বলত! তিনতলার বারান্দায় থাকত সার সার ফুলের টব। বেলি, গন্ধরাজ আরো কত কী। খুব শৌখিন লোক ছিলেন কীনা। তবে এসব যে উনি করতে পারবেন তা কিন্তু কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। বরং বাড়ির লোকের মোটেই আশা ভরসা ছিল না ওঁর ওপরে। সে অনেক কথা বুঝলি।"

ফুলদাদু থামতেই আমরা আবার সবাই মিলে "বলো না বলো না" করে উঠলাম।

"সে এক্কেবারে গপ্পের মতো বুঝলি। শোন তবে। আমার ঠাকুরদা ছিলেন সাত ভাইবোনেদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো। ওঁর ঠাকুমার খুব আদরের। নলে বলতে ঠাকুমা অজ্ঞান ছিলেন," এইটুকু বলেই ফুলদাদু কীরকম যেন ছটফটিয়ে উঠে দু কানে হাত দিয়ে চোখ কপালে তুলে কীসব যেন বিড়বিড় করলেন।

আমরা অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।

ফুলদাদু সেটা বুঝে বললেন, "তোদের আর কী হবে! কিছুই জানিস না, বুঝিস না! উনি আমার ঠাকুদার হন না? এখন তোদের মতো এই গণ্ড মুখ্যুদের ওঁর কথা বলতে গেলে কয়েকবার তো ওঁর ওই ডাকনামটা বলতে হবে, যেটা বলে ওঁর গুরুজনেরা ওঁকে ডাকতেন, তাই আগে থেকে মাপ চেয়ে রাখলাম। এই সামান্য কথাটাও তোদের বুঝিয়ে বলতে হয়!"

আমরা সবাই খুব কাঁচুমাচু মুখ করে ঘাড় মাথা চুলকোলাম একটু, তারপর ক্ষীণ স্বরে বললাম, "তারপর কী হল?"

"ছোটো বলে ঠাকুমার খুব আদরের হলে হলে কী হবে," ফুলদাদু বলতে শুরু করলেন, "যেদিন ঠাকুরদা দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বললেন উনি আর পড়াশোনা করতে চান না,‌ মূর্তি গড়া শিখবেন, শুনে সবাই প্রথমটা হাঁ হয়ে গেল, তারপর রাগে অগ্নিশর্মা হল। ঠাকুরদা তখন সবে ইস্কুল ফাইনাল পাশ করেছেন, ওঁর বাবা কাকারা সবাই পড়াশোনায় ভালো, চাকরি বাকরি করেন। বড়ো ঠাকুরদা মানে ঠাকুরদার বড়ো দাদা তো ডাক্তার। এ হেন বাড়ির ছেলে বলে কীনা মূর্তি গড়বে! ঠাকুরদার বাবা তো ছড়ি নিয়ে তেড়ে এলেন, 'বামুনের বাড়ির ছেলে হয়ে তুই কীনা কুমোরের মতো মাটি দিয়ে মূর্তি গড়বি!'

ঠাকুরদা মুখ গোঁজ করে বললেন, 'মূর্তি কি শুধু মাটিরই হয় নাকি? পাথরের হয়, কত কিছুর হয়। সেসব বানানো যে সে কথা নয়, শিখতে হয়। আমিও শিখব।'

ঠাকুরদার বাবা তো বোধহয় ছড়ির দু এক ঘা লাগিয়েই দিতেন, ঠাকুমা সামলালেন, বললেন, 'করিস কী, করিস কী? আমি বুঝিয়ে বলব। নলে আমার খুব বুঝদার ছেলে। আমার কথা কক্ষণো অমান্যি করবে না।'

ঠাকুরদা কিন্তু শুনলেন না। ওঁর ঠাকুমা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি, বাবা বাছা করে বিস্তর বুঝিয়েছিলেন। এমন কী 'তুই চলে গেলে আমি কেঁদে কেঁদেই মরে যাব' একথাও বলেছিলেন কিন্তু ঠাকুরদাকে আটকানো গেল না। একদিন ভোরে সবাই দেখল ঠাকুরদা বাড়িতে নেই। ওঁর ঠাকুমার দেরাজের মধ্যে রাখা টাকাপয়সাও নেই। এমন কী পৈতের সময়ে পাওয়া সোনার বোতাম আর হীরে বসানো আংটিটাও নেই। ঠাকুমার দেরাজের ওপর রয়েছে একখানা চিঠি। তাতে লেখা – শিক্ষার প্রয়োজনে টাকাকয়টি লইলাম। উপার্জনক্ষম হইয়া অবশ্যই ফেরত দিব। ইতি শ্রী নলিনাক্ষ মৈত্র।

চিঠি পড়ে তো ঠাকুরদার বাবা একেবারে যাকে বলে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, 'ব্যাটা চুরি করতেও শিখেছে! একবার দেখা পাই, ওরই একদিন কী আমারই একদিন!'

এদিকে ঠাকুরদার মা আর ঠাকুমা তো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন। ভোরের প্রথম ট্রেনেই যে ঠাকুরদা চলে গেছেন সে তো সবাই বুঝতে পারলেন। তবে কলকাতায় গিয়ে কিন্তু ঠাকুরদা সত্যি সত্যিই অনেক কিছু শিখেছিলেন। আঁকা জোকা, মূর্তি গড়া – সব। কোথায়, কার কাছে শিখেছিলেন সে সব উনি কখনও খুলে বলেননি, তবে শিখেছিলেন। আর শিখেছিলেন যে তার প্রমাণ হল এই তিনতলা বাড়ি।"

"মূর্তি গড়া যে শিখেছিলেন তার প্রমাণ এই বাড়ি হবে কী করে?" আমি বলে উঠলাম আর বলেই বুঝলাম কী ভুল করেছি।

ফুলদাদু বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, "এখনকার ছেলেমেয়েদের এই দোষ। বড্ড অধৈর্য আর উলটোপালটা প্রশ্ন করে। আর যদি একটাও এরকম কথা বলেছিস তো আমি মুখে কুলুপ আঁটব – এই বলে দিলাম।"

আমি তো হাঁ হাঁ করে উঠলাম, "না না আর কক্ষণো কিচ্ছু বলব না।"

তখন ফুলদাদু আবার বলতে শুরু করলেন, "কলকাতায় এসে ঠাকুরদার শিক্ষা তো শুরু হল। তবে থাকা খাওয়ার খুব অসুবিধে হচ্ছিল। যতই হোক বাড়িতে দুধটা ঘিটা খেয়ে অভ্যেস। আবার এদিকে জেদ করে বাড়ি ছেড়ে এসেছেন, নিজে থেকে ফিরতেও পারছেন না, অন্তত কিছু রোজগারপাতি না করে। শেখা টেখা কিছু দূর হলেও তেমন কিছুই করতে পারছিলেন না। মোট কথা তখন ঠাকুরদার অবস্থা বিশেষ ভালো যাচ্ছিল না। এর মধ্যে একজনের কাছ থেকে একটা খবর পেলেন। বাগবাজারের রায়বাড়ির বুড়ি গিন্নিমা নাকি ভালো মূর্তি গড়তে পারে এমন একজনকে খুঁজছেন। ওঁর বাড়িতে থেকে কাজটা করতে হবে। ঠাকুরদা শুনে প্রথমটা একেবারে পাত্তা দেননি। ভালো মূর্তি গড়তে পারে এমন লোকের কি অভাব আছে এ শহরে? তাছাড়া রায়বাড়ির কাজ, পয়সাকড়ি মন্দ দেবে না, মেলা লোক গিয়ে জুটবে। কিন্তু যে খবরটা এনেছিল সে বলল কাজটা নাকি খুব গোপনীয়, যে করবে তাকে বেশ চালাক চতুর হতে হবে। এটা শুনে ঠাকুরদা ছটফটিয়ে উঠলেন, এ তো শুধু মূর্তি গড়া নয়, আরো কিছুর গন্ধ আছে মনে হচ্ছে। উনি বুড়ি গিন্নিমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়ে গেলেন, ঠিকানা ভালো করে বুঝে নিয়ে চলে গেলেন। একাই।

তখন সন্ধে হব হব। রায়বাড়িতে ঢুকে ঠাকুরদার চক্ষু চড়কগাছ। নিজেও কিছু গরীবের ছেলে ছিলেন না কিন্তু তা বলে এরকম বাড়ি, বাগান! যেমন বিশাল বাড়ি তেমনই বিশাল তার বাগান। পেছন দিকে গঙ্গায় যাবার বাঁধানো ঘাট অবধি আছে। বাগানে কতরকম গাছপালা আছে, ফোয়ারা আছে, পুকুর আছে, সে পুকুরে লাল নীল মাছ আছে! বাড়িরও কত বাহার! সেসব তোদের বলে কোনো লাভ নেই, ওসব তোরা বুঝবি না, দেখেছিস নাকি কোনো দিন! যাই হোক একজন চাকর এসে ঠাকুরদাকে বুড়ি গিন্নিমার কাছে নিয়ে গেল। একখানা ঘরে এই এত বড়ো একখানা পালঙ্কে বুড়ি গিন্নিমা তসরের কাপড় পরে বসে আছেন। পালঙ্ক কাকে বলে জানিস?"

আমরা সবাই ঘাড় নাড়লাম। ঘাড় নেড়েই হ্যাঁ বোঝালাম। কী দরকার বাবা মুখ খুলে, ফুলদাদু যদি আবার রেগে যান!

"ছাই জানিস! ও তোদের এখনকার মতো নীচু নীচু খাট নয়। এত উঁচু হত, ওর নীচে দশটা লোকও অনায়াসে ঢুকে থাকতে পারত। যাক গে, যা বলছিলাম। সেই পালঙ্কের ওপর বুড়ি গিন্নিমা বসে আছেন। বয়স অনেক, কিন্তু কী রূপ! অত বয়স কিন্তু চুল কুচকুচে কালো। কেউ যদি একটাও পাকা চুল বার করতে পারত বুড়ি গিন্নিমা তাকে সে যুগে গোটা দুটি টাকা দিতেন। বুড়ি গিন্নিমার অমন লক্ষ্মী প্রতিমার মতো রূপ দেখে ঠাকুরদার এত ভক্তি হল যে ঢিপ করে এক পেন্নাম ঠুকে ফেললেন।

বুড়ি গিন্নিমা বললেন, 'থাক থাক হয়েছে হয়েছে, বেঁচে থাকো, একশ বছর পরমায়ু হোক। নামধাম সব বলো দেখি।'

ঠাকুরদা সব বললেন। এমন কী বাড়ির অমতে যে কলকাতায় এসেছেন মূর্তি গড়া শিখতে সে কথাটা অবধি গোপন করলেন না। বুড়ি গিন্নিমার নাকি এমনই ক্ষমতা, ওঁর সামনে দাঁড়ালে একটাও মিথ্যে বলার বা কিছু গোপন করার যো নেই। শুনে বুড়ি গিন্নিমা বললেন, 'মা বাপের মনে দুঃখ দিয়ে বাড়ি থেকে এত দূরে চলে আসা! এ কী মতিভ্রম!'

ঠাকুরদা কিছু বলার আগেই আবার ফিক করে হেসে বললেন, 'অবশ্য তোমার মতিভ্রম না হলে আমার কাজ উদ্ধারই বা হয় কী করে?'

সে কথা শুনে ঠাকুরদা যেন কেমন হয়ে গেলেন, মুখ দিয়ে রা'টি বেরোল না।

বুড়ি গিন্নিমা এদিকে বলেই যাচ্ছেন, 'তোমাকে আমার বেশ লেগেছে। তোমাকে দিয়েই হবে। তোমার আগে আরো দুজন এসেছিল কিন্তু তাদের আমি ওই দেউড়ি থেকেই বিদেয় করেছি। এখন ভজা যখন এসে বলল আরেকজন এসেছে, শুনেই আমার মনে হল একে দিয়ে হবে। ঠিকই মনে হয়েছে। শোনো আজ আর বেশী কথাবার্তা হবে না। তবে একটি কথা ভালো করে শুনে রাখো। এ বাড়িতে আমার পুষ্যির সংখ্যা কিছু কম নয়, তারা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে, তুমি গরীব ছেলে, আমার জ্ঞাতি হও, পড়াশোনার জন্যে কলকাতায় এসেছ। একটা কলেজেও তোমাকে ভর্তি করে দিতে হবে। এরা সব খুব সেয়ানা। আসল কাজ কী সে আমি পরে বলব।'

পড়াশোনার নামেই ঠাকুরদার গায়ে জ্বর আসে। ওসব ওঁর কোনোকালে মোটে পোষায় না। কিন্তু বুড়ি গিন্নিমার কথায় না করতে পারলেন না। বুড়ি গিন্নিমার এরকমই অদ্ভুত ক্ষমতা। তাছাড়া আসল কাজ তো আর পড়াশোন নয়, আসল কাজ নিশ্চয়ই মূর্তি গড়া হবে, তাই ঠাকুরদা আর কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই রাজি হয়ে গেলেন আর বললেন, 'আমার জামাকাপড়, জিনিসপত্র নিয়ে আসি তাহলে?'

'যাও নিয়ে এসো,' বুড়ি গিন্নিমা বললেন, 'একা পারবে না কাউকে সঙ্গে দেব?'

ঠাকুরদার আর ক'টাই বা জিনিস? তাই উনি আর কাউকে সঙ্গে না নিয়ে একাই চলে গেলেন সেসব আনতে।

সে রাতে আর বুড়ি গিন্নিমার সঙ্গে দেখা হল না। তিনি দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেছেন। ভজা এসে ঠাকুরদার টিনের সুটকেস নিয়ে তিনতলার একটা ঘরে রেখে বলল, 'এই হল গিয়ে তোমার ঘর। মাঠান তাই বলেছেন। এখেনেই থাকবে, কাজকর্মও সব এখেনেই করবে।'

'কাজকর্মটা কী সেটা বলো। এখনও তো সেটাই জানতে পারলাম না,' বললেন ঠাকুরদা।

'সেসব মাঠান বলবেন'খন। আর শোনো ভুলেও এসব কথা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করবে না। খাবেদাবে, নিজের কাজ করবে আর মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে। মাঠান ছাড়া আর কারুর সামনে মুখটি খুলবে না – এই বলে দিলাম। পরে আবার বোলো না যেন, কই ভজা তো কিছু বলেনি' বলে ভজা চলে গেল আর ঠাকুরদা কীরকম যেন ঘাবড়ে গেলেন।

তবে ঘরখানা একেবারে ফার্স্ট কেলাস। তিনতলায় ওই একটিই ঘর। বেশ বড়ো, লাগোয়া বারান্দাও আছে। ঘর থেকেই গঙ্গা দেখা যায়। দরজা জানলা খুলে রাখলে হুহু করে গঙ্গার হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে যায়। রাতে খাওয়াদাওয়াটাও বেশ ভালো হল। একতলার লম্বা দালানে সারি বেঁধে সবাই খেতে বসে। ঠাকুরদা গুনে দেখলেন আঠাশটা পাত পড়েছে। তাছাড়া চাকরবাকরেরা আছে, দারোয়ানরা আছে, তারা পরে খাবে। বুড়ি গিন্নিমার খাবার দোতলায় ওঁর ঘরে যায়।"

ফুলদাদু থামলেন। দম নেওয়ার জন্যেই বোধহয়। ততক্ষণে ফুলদাদুর চাও এসে গেছে আর আমাদেরও সবার মুড়ি, পকোড়া খাওয়া শেষ।

চায়ে চুমুক দিয়ে ফুলদাদু আবার বলতে শুরু করলেন, "ঠাকুরদা রাতে বেশ আরাম করে ঘুমোচ্ছিলেন। এর আগে যেখানে থাকতেন ছারপোকার জ্বালায় দু মিনিট নিশ্চিন্তে শুতে পারতেন না। আর এখানে এত ভালো বিছানা, তার ওপর গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়া। ঘুমটা জব্বর হচ্ছিল এমন সময় দরজা ধাক্কাধাক্কিতে ভেঙে গেল। দরজা খুলে দেখলেন ভজা।

'এহ তোমার তো দেখি ঘুমই ভাঙে না!' ভজা বলল, 'মুখ হাত ধুয়ে দোতলায় এসো দিকিনি, মাঠান ডাকছেন। কথা আছে। নাও তাড়াতাড়ি করো।'

বুড়ি গিন্নিমার নাম শুনেই তো ঠাকুরদার ঘুম টুম এক্কেবারে উধাও হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে দোতলায় নেমে এলেন। ভজা ওঁকে বুড়ি গিন্নিমার ঘরে নিয়ে গেল। সে ঘর দেখে তো ঠাকুরদার চোখ কপালে। কেমন বাহারি সব সুন্দর সুন্দর আসবাব, দেওয়াল আলমারি ভর্তি কাঁচের পুতুল, তেমন সুন্দর পাথরের মেঝে। বুড়ি গিন্নিমা তখন রুপোর রেকাবি থেকে ফল মিষ্টি খাচ্ছিলেন। শ্বেত পাথরের গোল টেবিলের ওপর রুপোর গেলাসে সরবত রাখা, গন্ধরাজ লেবুর গন্ধ ভুরভুর করছে।

নলে

বুড়ি গিন্নিমা বললেন, 'এত ভোর ভোর ডাকার কারণ আছে। রাবণের গুষ্টির ঘুম এখনো ভাঙেনি, নিশ্চিন্তে কাজের কথা বলা যাবে। নইলে রক্ষে থাকত না। দেওয়ালেরও কান আছে জানবে। বোসো, বলছি সব। এ বাড়ির বাইরের বারান্দায় দুখানা পাথরের মূর্তি আছে দেখেছ? প্রদীপ হাতে মেয়ের মূর্তি? কত্তা বানিয়েছিলেন। ওঁর এক সাহেব বন্ধু ছিল, সেই এক মূর্তি বানানেওয়ালাকে জুটিয়ে এনেছিল, সেও সাহেবসুবো মানুষ। কত্তা তাকে দিয়েই তৈরি করিয়েছিলেন। ভালোই পয়সাকড়ি লেগেছিল তখন। মূর্তিদুটো খোলা জায়গায় থেকে থেকে কেমন হয়ে গেছে, জায়গায় জায়গায় শ্যাওলাও জমেছে, তাও ও দুটোর দাম বিস্তর। রাবণের গুষ্টির নজর এখন ওদিকে পড়েছে। আমি বেঁচে থাকতে হয়তো কিছু করতে সাহস করবে না কিন্তু আমি চোখ বুজলেই বা সেরকম অসুস্থ হলেই দেবে ও দুটোকে বেচে, বুঝলে?'

ঠাকুরদা কিছুই বুঝলেন না। এতে ওঁর কী করণীয়? উনি আমতা আমতা করে বললেন, "তা আপনিই ও দুটোর কিছু ব্যবস্থা করছেন না কেন? মূর্তির কদর বোঝে এরকম কাউকে বিক্রিও করে দিতে পারেন।'

'কী বললে? ক্ষেমংকরী দেবী বেঁচে থাকতে এ বাড়ির জিনিস বিক্রি হবে!' বুড়ি গিন্নিমা ফুঁসে উঠলেন একেবারে।

দেখে তো ঠাকুরদার হয়ে গেছে, কোনোরকম 'না মানে না মানে' করে যাচ্ছেন।

'শোনো, তোমরা একালের ছেলেছোকরা। তোমরা এসব বুঝবে না। আমি যদি এখন মূর্তিদুটো বিক্রি করে দিই বা কাউকে দিয়ে দিই তাহলে সবাই এই বুঝবে যে বাগবাজারের ক্ষেমংকরী দেবী নিজের বিষয় আশয় আর ঠিকঠাক সামলে রাখতে পারছেন না। আবার এ বাড়ির আশ্রিতদের বিদেয় করলেও বাড়ির সম্মান নষ্ট। অনেক দিক ভেবে কাজ করতে হয় বুঝলে? সোজা কথা হচ্ছে তোমাকে ওই মূর্তিদুটোর নকল বানাতে হবে বুঝেছ? একদম ওইরকম দেখতে। জায়গায় জায়গায় কালো কালো হয়ে যাওয়া, ছ্যাতলা পড়া। তারপর যা হবে না! ব্যাটারা যা জব্দ হবে ভেবেই আমার হাসি পাচ্ছে,' বুড়ি গিন্নিমার চোখে দুষ্টুমি ঝিলিক দিয়ে উঠল, 'তোমার যা যা জিনিসপত্র দরকার সরকারমশাইকে বলবে, ভজাকেও বলতে পারো, সব এসে যাবে। তুমি কী দিয়ে মূর্তি তৈরি করবে, কী করে করবে – সে তোমার ব্যাপার। আমার একদম ওইরকম দুটো মূর্তি চাই, এই হচ্ছে কথা। ওরে ভজা, সরকারমশাই এলেন কীনা দেখ, এলে এখানে পাঠিয়ে দে।'

এতক্ষণে ঠাকুরদা বুঝলেন কেন তাঁকে ডাকা হয়েছে আর ঠিক কী করতে হবে। ভজা ততক্ষণে সরকারমশাইকে নিয়ে এসেছে। ধুতি পাঞ্জাবি পরা শীর্ণ চেহারার এক ভদ্রলোক, চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হবে। দুহাত জোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, "পেন্নাম হই মাঠান।'

'সরকারমশাই এই ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কোনো একটা কলেজ টলেজে ভর্তি করে দিন। আর এর যা লাগবে সব এনে দেবেন,জানেনই তো সব,' বললেন বুড়ি গিন্নিমা। সরকারমশাই মাথা নেড়ে 'যে আজ্ঞে' বলে ঠাকুরদাকে বললেন, 'জলখাবার খেয়ে তৈরি থেকো, তোমাকে নিয়ে বেরোব।'

ঠাকুরদা সেদিনই ভর্তি হয়ে গেলেন। সরকারমশাই ওঁকে ভালো করে বোঝালেন যে দিনের বেলা কলেজে আসতে হবে, পড়াশোনা করতে হবে আর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মূর্তি তৈরি করতে হবে। মোট কথা এ খুবই গোপনীয় ব্যাপার।"

এই অবধি বলে ফুলদাদু হঠাৎ থেমে গেলেন, বললেন, "নাহ তোরা বড্ড বকাস। বকতে বকতে আমার মুখ ব্যথা করছে। আর বলতে পারছি না।"

আমরা সবাই চেঁচামিচি করে উঠলাম, "না না এ হবে না। এত দূর বলে শেষ করবে না তা কখনো হয় নাকি? বলো বলো।"

"আর কতটুকুই বা আছে? আরপর তোমার ঠা... মানে আমাদের অতি বৃদ্ধ পিতামহ মূর্তি তৈরি করলেন। এই তো? সেটুকু বলেই দাও না," বলল পুটকি।

"কতটুকুই বা আছে মানে? দু দুটো মূর্তি তৈরি করাকে কতটুকু বলছিস তুই! জানিস মূর্তি তৈরি করতে করতে কত কিছু হয়েছিল? বুড়ি গিন্নিমার আশ্রিতরা ঠাকুরদাকে কত সন্দেহ, কত বিরক্ত করত জানিস?" ফুলদাদু বললেন।

"তুমি না বললে জানব কী করে?"
"তিনতলার যে ঘরে ঠাকুরদা থাকতেন সেখানে সব সময় তালা দিয়ে রাখতে হত মানে যখন ঠাকুরদা ঘর থেকে বেরোতেন, সব জানলাও বন্ধ রাখতে হত। সে একতলায় খেতে গেলেও। একদিন খেয়ে ওপরে এসে আর তালা খুলতে পারছেন না, খেয়াল করে দেখলেন দরজার তালাটাই পালটে গেছে। ঠাকুরদার তো মাথায় হাত। তার মানে কি ওই তালা খুলে কেউ ঘরে ঢুকেছিল? কিন্তু তালা পালটালো কেন? এবার কী করবেন, কাকে বলবেন, বুড়ি গিন্নিমা যদি রেগে যান – এইসব সাত পাঁচ ভাবছেন এমন সময় সেখানে ভজা উদয় হল।

'মাঠান তোমাকে চালাকচতুর ভাবেন আর তুমি কীনা এই! যখন খেতে বসেছিলে তোমার ফতুয়ার পকেট থেকে চাবি তুলে নিয়ে সাবানে তার ছাপ তুলে রেখে আবার চাবি তোমার পকেটে রেখে দিল কিন্তু তুমি কিচ্ছুটি বুঝতে পারলে না! খেয়েই গেলে শুধু! বলি কাতলা মাছের ওরকম মুড়ো কোনোদিন খাওনি নাকি? যত্তসব! কী ভাগ্যি আমি দেখেছিলাম, তাই সঙ্গে সঙ্গে তালা পালটে দিলাম। এই নাও ধরো চাবি,' ভজা বেশ বকল ঠাকুরদাকে।

'কিন্তু ওই তালাটা তুমি খুললে কী করে? আর এত তাড়াতাড়ি তালা আবার পালটেও ফেললে!' ঠাকুরদা না বলে পারলেন না।

'মাঠানের জন্যে ভজা করতে পারে না হেন কাজ নেই। সাধে কি মাঠানের এই ভজা না হলে এক দণ্ডও চলে না? এখন এই কাজটি ভালোয় ভালোয় মিটুক আমি মা কালীর থানে পুজো দেব। যাও ঘরে ঢোকো আর কখনও এরকম বেখেয়াল হোয়ো না,' ভজা আরেকবার বকুনি দিয়ে চলে গেল।

তা সত্যি কথা ভজা আর সরকারমশাই ছাড়া বুড়ি গিন্নিমার একটুও চলে না। এই দুজনই শুধু ওঁকে মাঠান বলে, বাকি সবাই গিন্নিমা বলেই ডাকে।

আরেকবার কী হয়েছিল জানিস? সেদিন বুড়ি গিন্নিমা গেছেন কালীঘাটে পুজো দিতে, সঙ্গে ভজাও গেছে। নাহলে বাড়ি ছেড়ে ভজা এক পাও নড়ত না। ওর চোখ সবদিকে ঘুরত। ওপরে জল তোলা নেই দেখে ঠাকুরদা নীচের বাথরুমে গেছেন, একতলার পেছনের দিকে। ঢুকে আর বেরোতে পারেন না, বাইরে থেকে কে হুড়কো টেনে আটকে দিয়েছে। যতই চেঁচান, দরজা ধাক্কান, কেউ আসে না। আসবে কেন? ইচ্ছে করেই তো করেছে। ঘুপচি মতো একটা জানলা, সেটাও খোলে না, না খুলে খুলে আটকে গেছে, অনেক কাণ্ড করে সেটাকে খুলে ঠাকুরদা বাইরে তো এলেন কিন্তু হাত, পা, গা ছড়ে কেটে একসা। ঠাকুরদার খুব রাগ হল। ঠিক করলেন বুড়ি গিন্নিমা বাড়ি ফিরলেই বলে চলে যাবেন। বললেনও। শুনে বুড়ি গিন্নিমা আগে সরকারমশাইকে ডেকে ঠাকুরদার জন্যে ওষুধ আনতে বললেন, তারপর বললেন, 'তুমি তোমার ঘরে যাও। এরকম যাতে আর না হয় আমি দেখছি।'

কোথায় গেল ঠাকুরদার রাগ! বুড়ি গিন্নিমার সঙ্গে কথা বললেই সব উধাও হয়ে যায়। ওষু্ধ এল, যত্নেরও কোনো ত্রুটি হল না।

ভজা খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল, 'মাঠান সব ক'টাকে ধরে যা বকান বকছেন! সব ব্যাটা চুপ। আর কিচ্ছুটি করবে না। রোজ দুবেলা এমন মণ্ডা মিঠাই কোথায় জুটবে?' এরপর অবশ্য তেমন কিছু হয়নি। শুধু একবার ঠাকুরদার চটি লুকিয়ে রেখেছিল। কলেজে যাওয়ার সময় ঠাকুরদা আর চটি খুঁজে পাননা। এতে অবশ্য বিশেষ কিছুই হল না। বুড়ি গিন্নিমার হুকুমে ততক্ষণাৎ ঠাকুরদার জন্যে দুজোড়া চটি এল আর যারা থাকত ওই বাড়িতে তাদের সব্বার দু সপ্তাহ চটি জুতো পরা নিষিদ্ধ হল। এরপরও ওরা মাঝে মধ্যে ফাঁক ফোকর খুঁজত ঠাকুরদার ব্যাপারে জানার জন্যে, তিনতলার অত বড়ো ঘরে ঠাকুরদা কী করে জানার জন্যে, কিন্তু পারেনি। ঠাকুরদাও সাবধান হয়ে গেছিলেন। দেখতে দেখতে মূর্তি তৈরিও শেষ হল। কিন্তু ........." ফুলদাদু আবার থেমে গেলেন।

"কিন্তু? কিন্তু কী?" আমরা বলে উঠলাম।

"কিন্তু ঠাকুরদা কী দিয়ে মূর্তি তৈরি করেছিলেন, কত দিন লাগল, রাত জেগে জেগে কী করেই বা করলেন – এসব কথা কোনোদিন কিচ্ছু বলেননি। সবাই জিজ্ঞেস করত কিন্তু ঠাকুরদা কিচ্ছুটি বলেননি। বুড়ি গিন্নিমা নাকি সব গোপন রাখতে বলেছিলেন। এমন কী ঠাকুরদার বানানো মূর্তি কোথায় রাখা হল, আসল মূর্তিরই বা কী হল - তাও নয়। শুধু রাত গভীর হলে ভজা দুটো মুশকো জোয়ান লোককে সঙ্গে নিয়ে দরকারি জিনিসপত্র সব ঠাকুরদার ঘরে পৌঁছে দিত। সে লোকদুটোর নাকি তাগড়াই চেহারা ছিল, নিঃশব্দে কাজ করে চলে যেত, মুখ দিয়ে একটি শব্দও বার করত না। ঠাকুরদা একবার ভজাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এ লোকদুটো কোত্থেকে এল, বাড়িতে তো কখনো দেখেননি। ভজা কপাল টপাল কুঁচকে খুব বিরক্ত হয়ে বলেছিল, 'অত খপরে তোমার দরকার কী বাপু? তোমার কাজ তুমি করো, তাহলেই হল। এ হল ভজার লোক। বলিনি মাঠানের জন্যে ভজা করতে পারে না, হেন কাজ নেই,' বলে গজগজ করতে করতে চলে গেছিল। ঠাকুরদাও আর কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেননি আর বাড়ি ফিরে এসেও এ ছাড়া আর কোনো কথা কাউকে বলেনওনি। কথার খেলাপ হবে না? ওঁর ঠাকুমা বলতেন, 'নলের আমার অতি উচ্চ বিচার। কথা রাখতে জানে।'

মূর্তি তৈরি তো শেষ হল কিন্তু ঠাকুরদার পড়া তখনও শেষ হয়নি।

বুড়ি গিন্নিমা বললেন, 'যেমন আছ থাকো, পড়াটা শেষ করো।'

তাই হল। ঠাকুরদা খুশী মনেই রয়ে গেলেন। যত্ন আত্তির তো কোনো কমতি ছিল না। যেদিন ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হল তার পরের দিন বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে বুড়ি গিন্নিমার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন ঠাকুরদা। বুড়ি গিন্নিমা একখানা কাগজ ধরিয়ে দিলেন ঠাকুরদার হাতে। পড়ে দেখে তো ঠাকুরদা অবাক। একেবারে ক'বিঘে জমিই কিনে দিয়েছেন ঠাকুরদার নামে। সঙ্গে দিলেন একখানা সোনার লকেট, তাতে লেখা ঠাকুরদার ঠাকুমার নাম। বুড়ি গিন্নিমা সব কথাই জানতেন কীনা। ঠাকুরদা সেটিকে ট্যাঁকে গুঁজে সোজা বাড়ির পথ ধরলেন। মন বেশ খুশী খুশী। কত বছর পরে যাচ্ছেন বাড়িতে। এদিকে বাড়িতে তো সবাই ওঁর আশা ছেড়েই দিয়েছিল। এত দিন কোনো খোঁজ খবরই পাওয়া যায়নি। ওঁর ঠাকুমা কেঁদে কেঁদে বলতেন, 'আহা নলেটা আমার যেন একেবারে উবে গেল!'

সেই নলেকে এত বছর পরে ফিরে পেয়ে বাড়িতে তো উৎসব লেগে গেল। ঠাকুরদা প্রথমেই লকেটটা ঠাকুমাকে দিলেন। ঠাকুমার তো আনন্দ আর ধরে না। সবাইকে ডেকে ডেকে দেখান আর বলেন, 'দেখো নলে আমাকে নাম লেখা সোনার লকেট দিয়েছে।'

তবে ঠাকুরদা কিন্তু আর কোনোদিন বসে থাকেননি। বুড়ি গিন্নিমার জন্যে পড়াশোনা হয়েছিল। গ্রামের ইস্কুলের মাস্টারমশাই হয়ে গেলেন।

ঠাকুমা এ অঞ্চলের সব মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিলেন, 'সবাই বলত নলেটার পড়াশোনায় মাথা নেই। আজ দেখো নলে আমার কেমন মাস্টারমশাই হয়েছে!'

সেই বছর থেকে বাড়িতে খুব ঘটা করে সরস্বতী পুজো শুরু হল। ঠাকুরদাই মূর্তি গড়তেন। বছরে শুধু ওই একটি মূর্তিই গড়তেন, সারা জীবনে আর কোনো মূর্তি গড়েননি কখনো। কেন সে কথাও কেউ জানে না।

নলে

কয়েক মাস পড়ে বড়ো ঠাকুরদা ফল, মিষ্টি নিয়ে গেছিলেন বাগবাজারে বুড়ি গিন্নিমার সঙ্গে দেখা করতে। ওঁর জন্যেই তো ঠাকুরদার পড়াশোনাটা হল। গিয়ে দেখেন সে বাড়িতে মহা হট্টগোল তখন। বুড়ি গিন্নিমা আর নেই, মারা গেছেন। অন্য যারা থাকত তারা বাড়ির বাড়ির ভাগ নিয়ে গোলমাল করছে। অথচ বুড়ি গিন্নিমার ইচ্ছে ছিল ও বাড়িতে মেয়েদের ইস্কুল হোক। কিন্তু তারা হতে দিলে তো!

বড়ো ঠাকুরদা শুনলেন একজন বলছে, 'বারান্দার মূর্তিদুটো কবে পালটে গেল টেরটি পর্যন্ত পেলাম না। এ সেই ছোকরাটার কাজ, তিনতলায় থাকত আর ঘরের মধ্যে কী জানি কী করত! গিন্নিমার খুব পেয়ারের ছিল। নলিনাক্ষ না কী যেন বেশ নাম। ব্যাটাকে একবার পেলে হয়। যত বুদ্ধি ওই দিয়েছিল গিন্নিমাকে।'

শুনে বড়োঠাকুরদা আর দাঁড়ালেন না, চলে এলেন।

বুড়ি গিন্নিমা আর নেই – এ খবর শুনে ঠাকুরদা যা শোক পেয়েছিলেন সে আর কী বলব! তবে আসল মূর্তিগুলো নাকি কোন মিউজিয়ামে রাখা আছে, অনেক পরে ঠাকুরদা বলেছিলেন। এরপর আস্তে আস্তে বুড়ি গিন্নিমার দেওয়া জমি বিক্রি করে ঠাকুরদা ওই বড়ো পুকুর কাটালেন, তার ঘাট সুন্দর করে বাঁধালেন আর শ্বেত পাথরের ফলকের ওপর লেখালেন ঁক্ষেমংকরী দেবীর পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে। ও ফলক তো এখনও পুকুরপারে আছে, দেখিসনি? তারপর এই তিনতলা......"

ফুলদাদুর কথা শেষ হতে না হতেই আমরা একসঙ্গে বলে উঠলাম, "এই তিনতলা বাড়ি তৈরি করলেন।"

"এমনভাবে বলছিস যেন সব একেবারে চোখের সামনে হতে দেখেছিস! বল দেখি এ বাড়িতে ক'টা ঘর আছে?" ফুলদাদু জিজ্ঞেস করলেন।

হঠাৎ এ প্রশ্নের জন্যে আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ঘাড় টাড় চুলকে কর গুণে ঘরের হিসেব করতে লাগলাম।

"সারা দিন এত বার একতলা তিনতলা করছিস আর ক'টা ঘর আছে সেটা অবধি জানিস না! কী যে ছেলেমেয়ে তোরা! কী যে হবে তোদের!" চোখ মুখ কুঁচকে বললেন ফুলদাদু।


ছবিঃ অঙ্কুশ চক্রবর্তী

অদিতি সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কর্মসূত্রে আরব দুনিয়ায় বসবাসের অভিজ্ঞতাও আছে। বই পড়তে ভালোবাসেন। ভ্রমণ,ছবি তোলা,এম্ব্রয়ডারির পাশাপাশি লেখালিখিতেও সমান উৎসাহী। নানান ওয়েব ম্যাগাজিন ও পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা