খেলাঘরখেলাঘর

মাসখানেক হল নীলরা এই পাহাড়ী শহর সুলতানপুরে এসেছে। আসলে নীলের বাবা এখানে বদলী হয়ে এসেছেন। বরাবর সে ফ্ল্যাটে থেকে এসেছে, কিন্তু এবার তার বাবা পাঁচিল ঘেরা একটা বাংলো টাইপের বাড়ি পেয়েছেন যার সামনে পেছনে বাগানও আছে। নীলের তো খুব ভালো লেগে গেছে জায়গাটা। একে তো এরকম বাগানওয়ালা বাড়ি, তারপর কি রকম উঁচু নীচু রাস্তা! এরকম পাহাড়ী শহরে সে প্রথম থাকছে। নীলের বাবার বদলীর চাকরী। এক জায়গায় বেশীদিন থাকতে পারেন না, কিন্তু এত ভালো নীলের কোনো জায়গা লাগে নি। নতুন স্কুলটাও কি সুন্দর। এর আগে যেখানে ছিল সেখানে নীলের অনেক বন্ধু ছিল, তাদের ছেড়ে আসতে নীলের খুব কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু এখানে এসে মন খারাপ অনেকটাই কেটে গেছে।

নতুন ক্লাস কিছুদিন শুরু হয়ে গরমের ছুটি পড়ে গেছে। হলিডে হোমওয়ার্ক আছে ঠিকই, কিন্তু খেলার সময়ও প্রচুর। নীল তো সময় পেলেই বাগানে ঘোরাঘুরি করে। নীলের মা মাঝে মাঝেই রাগারাগি করেন নীলের রোদ্দুরে ঘোরাঘুরি দেখে কিন্তু নীলকে আটকানো যায় না। নীল ওর সমবয়সী ছেলেমেয়েদের থেকে বেশ অন্যরকম। খেলার জন্যে যে সব সময় ওর বন্ধুবান্ধব লাগে তা নয়, ও নিজের মনে ঘন্টার পর ঘন্টা দিব্যি খেলতে পারে। আগে তো ফ্ল্যাটের একটা ছোট্ট ঘরকেই দিব্যি একটা রাজপ্রাসাদ কল্পনা করে নিয়ে নিজে রাজপুত্র হয়ে কত যে রাক্ষস রাক্ষসীকে মেরে রাজকন্যাকে উদ্ধার করেছে তার ঠিক নেই! আর এখন তো একটা বড়ো বাড়ি, তার সঙ্গে আবার বাগান।

সেদিন সকাল থেকে ভালো রোদ্দুর ছিল না। পড়াশোনা শেষ করে নীল একটা লাঠি হাতে বাগানে আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। লাঠিটা কখনো ওর তলোয়ার হয়, কখনো জাদুকরের জাদুছড়ি, এমন কি কখনো হনুমানের গদা, কখনো বা শুধু লাঠিই। সুলতানপুর থেকে সে যে তখন কোন রূপকথার রাজত্বে কি পরীদের জগতে বিরাজ করছে তা সেই জানে!

বাগানের সামনের দিকটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ফুলগাছ লাগানো। পেছনে সবজির বাগান আছে আর একপাশে লছমনপ্রসাদের ঘর। লছমন বাংলোর কেয়ারটেকার। সবজি বাগানের চারপাশটা অত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়, ঝোপঝাড় আছে কিছু। মা লছমনকে পরিষ্কার করতে বলেছেন। নীল সারাক্ষণ বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বলা যায় না যদি সাপখোপ থাকে।

নীল লাঠিটা দিয়ে ঝোপঝাড়গুল খোঁচাচ্ছিল। হঠাৎ লাঠিটা যেন নরম একটা কিছুতে লাগল। কি আছে ওখানে, নীল ভাবল। তারপর আবার খোঁচাল। এবার আর কিছু বুঝল না। সাপটাপ নয়তো বা পাখির ছানা? নীল আস্তে আস্তে ঝোপটা লাঠি দিয়ে নাড়তে লাগল। এই নাড়ানাড়ির ফলে ঝোপের ভেতর থেকে গড়িয়ে বেরিয়ে এল একটা ছোটো বল। ক্রিকেট খেলার বলের সাইজে।

নীল নীচু হয়ে বলটা কুড়োলো, কি সুন্দর বলটা। রঙটাও কি দারুণ, কমলা সবুজ মেশানো, কি উজ্জ্বল, বলটা যেন জ্বলজ্ব্ল করছে! মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগল নীল। কার বল এটা? বিরজুদের কি? বিরজু লছমনের ছোটো ছেলে, নীলেরই বয়সী প্রায়। কিন্তু ওরা তো এখন কেউ নেই এখানে, সবাই গ্রামের বাড়িতে গেছে ওদের মার সঙ্গে। তাই জিজ্ঞেস করারও কোনো উপায় নেই।

‘যাক গে, এখন তো আমার কাছে রেখে দিই, পরে বিরজু ফিরলে জিজ্ঞেস করব,’ ভাবল নীল।

আর ঠিক তক্ষুণি বলটা নীলের হাত থেকে পড়ে বার তিন চারেক বাউন্স খেয়ে কিছু দূরে গিয়ে থেমে গেল। নীলের খুব মজা লাগল। ও বলটা নিয়ে খেলায় মেতে গেল। বলটা এত ভালো বাউন্স করে, ঠিক যেন বোঝে নীল কি চাইছে! যতক্ষণ না মা স্নান করতে ডাকলেন নীল বল নিয়েই পড়ে রইল। মজার ব্যাপার বলটা যেন বেশীক্ষণ হাতে থাকতে চায় না, ছেড়ে দিলেই খুশী। একবার তো নীলের মনেই হল বলটা বোধহয় জ্যান্ত! কিন্তু এসব কথা ত আর কাউকে বলা যায় না, বিশেষ করে বড়োদের তো নয়ই, হেসেই উড়িয়ে দেবে। নীলও তাই বিশেষ কিছু বলল না, শুধু মাকে জানালো যে বাগানে ও একটা বল পেয়েছে।

‘বিরজুদের হবে। ওরা ফিরলে দিয়ে দিও,’ মা বললেন।

নীল মুখে কিছু বলল না, যদিও দিয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর নেই।

দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর নিয়ম মতো মার পাশে শুয়ে ঘুমোতে হল। বিকালবেলা মা ওকে নিয়ে কাছেপিঠে একটু ঘুরে এলেন। অন্যদিন নীলের বিকালবেলা ঘুরতে ভালোই লাগে কিন্তু আজ খালি মনে হচ্ছিল কখন বাড়ি ফিরে বলটা নিয়ে খেলবে।

সন্ধ্যেবেলা নীল পড়ার ঘরে ঢুকে তো অবাক! অন্ধকারে বলটার গা দিয়ে অদ্ভুত একটা নরম আলো বেরোচ্ছে। নীল তাড়াতাড়ি ঘরের আলো জ্বালাতেই বল আবার স্বাভাবিক! নীল বলটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগল। হঠাৎ মনে হল আরে বলটাতে তো চোখ, নাক, মুখ রয়েছে আর সে মুখ বেশ হাসি হাসি। ‘কেমন বল এটা? এর আবার চোখ মুখ আছে! কই আগে তো ছিল না! আবার আলোও বেরোয়!’ নিজের মনেই বলল নীল।

বলতে বলতেইই দেখল চোখ, মুখ কোথায়? কিচ্ছু নেই! তার জায়গায় যেন অন্য কিছু দেখা যাচ্ছে। ভালো করে দেখে বুঝল আইসক্রীম। বলের গায়ে আইস্ক্রীমের ছবি?

ঠিক তখনই নীল বাবার গলা শুনতে পেল, ‘নীল শিগগির আয়। দেখ তোর জন্যে কি এনেছি। বাটারস্কচ আইসক্রীম, তোর ফেভারীট। দেরী করলে কিন্তু গলে যাবে।’

বাটারস্কচের নাম শুনেই নীল বলটাকে টেবিলের ওপরে রেখে দুদ্দাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। যদি লক্ষ্য করত তাহলে দেখত বল আবার স্বাভাবিক, আইস্ক্রীমের ছবি আর নেই।

রাতে শুয়ে নীল ভাবল বলে কেন চোখ মুখ ছিল? আইস্ক্রীমের ছবিই বা ছিল কেন? কই শুতে যাবার আগে যখন দেখতে গেল তখন তো কিচ্ছু নেই, আলোও বেরোচ্ছে না। এসব ভাবতে ভাবতেই নীল তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

নীল এখন পড়াশোনা ছাড়া বল নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস বলটা জ্যান্ত। একদম বন্ধুর মতো ওর সঙ্গে খেলা করে। নীলের মা, বাবাও ওর এই বল প্রীতি লক্ষ্য করেছেন।

ওনারা হাসেন, বলেন, ‘বাড়িতে এত ভালো ভালো খেলনা রয়েছে। সেসব ছেড়ে দিয়ে একটা কুড়িয়ে পাওয়া বল নিয়ে মেতে রয়েছে। পাগলা ছেলে!’

একদিন খেলতে খেলতে নীল দেখল বলটার গায়ে যেন বিন্দু বিন্দু রক্ত দেখা যাচ্ছে, লাল টুকটুকে কয়েকটা ফোঁটা। নীল এবার ভয় পেয়ে গেল, ও হাত থেকে বলটা ফেলে দিয়ে এক ছুটে মার কাছে চলে গেল। দেখল মা ডাইনিং টেবিলে আপেল কাটছেন। নীল মার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এই সময় লছমন কি যেন একটা বলল আর মা তার উত্তর দেবার জন্যে মুখ তুললেন। কিছু বোঝার আগেই নীল মার ছুরি ধরা হাতে আলতো ধাক্কা মারল। মার হাত তো সরে গেল, কিন্তু নীলের আঙুল অল্প ছড়ে গেল।

‘নীল কি করছিলিস তুই? আপেল খাবি তো আমাকে বল, আমি দিচ্ছি। ওরকম করে কেউ নিতে যায়? দেখ তো কি হল? ভাগ্যিস বেশী কিছু হয় নি! জ্বালা করছে? চল ওষুধ লাগিয়ে দিই।’

নীল একটু চুপচাপ প্রকৃতির ছেলে, শুধু মাথা নাড়ল, বলতে পারল না, ‘মা, আরেকটু হলে ছুরিটা তোমার আঙুলের ওপর পড়ছিল।’

এই ঘটনার পরে নীলের মনে বিশ্বাস জন্মাল যে বলটা নিশ্চয়ই সব কিছু আগে থেকে জানতে পেরে যায় আর ওকে সাবধান করে দেয়। তাই একদিন দুপুরে মা যখন বললেন, ‘আজ ঘুম থেকে তাড়তাড়ি উঠে পড়বি নীল। বিকালে রামলীলার মাঠে মেলা দেখতে যাব। বড়ো মেলা হয় ওখানে,’ তখন নীল বলল, ‘না মা আজ যাবো না, আজ খুব বৃষ্টি হবে।’

ও যে সকালে বলের গায়ে বৃষ্টির ছবি দেখেছে!

‘ও বুঝেছি, লছমনের কাছ থেকে গতবারের গোমতী নদীর বন্যার কথা শুনেছিস তাই না? খুব বৃষ্টি হয়েছিল গতবার। কিন্তু এখনো বর্ষা পড়ে নি। এখন বৃষ্টি হবে না। তোর সব ক’টা ফেভারিট রাইড কিন্তু মেলায় এসেছে। নে এখন চটপট ঘুমিয়ে পড়।’

নীল আর কি করে। বিকালবেলায় গেল মার সঙ্গে মেলায়। কিন্তু দু একটা রাইড চড়ার পরই আকাশ কালো করে এল। সময় থাকতে মা নীলকে নিয়ে কাছাকাছি একটা বাড়ির বারান্দায় উঠেছিলেন তাই ওই অঝোর বর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পেলেন। কিন্তু এই হঠাৎ বৃষ্টি তাঁকে ভাবিয়ে তুলল।

‘তুই তো ঠিকই বলেছিলিস নীল। কিন্তু তুই জানলি কি করে?’

নীল আর কি বলে, বলটার কথা তো আর বলা যাবে না। তাই চুপ করেই রইল।

শুধু মনে মনে বলল, ‘ছোটোরাও যে বড়োদের কত হেল্প করতে পারে সেটা যে বড়োরা কবে বুঝবে!’

সন্ধ্যেবেলায় নীলের বাবা সব শুনেটুনে বললেন, ‘পাহাড়ি জায়গায় এরকম হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হয়। দেখো হয়তো লছমনের কাছে শুনেছে। মেলায় যাবার ইচ্ছে ছিল না, তাই খালি বৃষ্টি বৃষ্টি করছিল।’

গরমের ছুটিটা ভালোই কাটছিল নীলের। স্কুল খোলার আর আর মাত্র সপ্তাহ খানেক বাকী। একদিন দুপুরে নীলের কিছুতেই ঘুমোতে ইচ্ছে করছিল না। এদিকে মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। নীল পা টিপে টিপে খাট থেকে নেমে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বলটা নিয়ে খেলতে লাগল। হঠাৎ বলটা ওর হাত থেকে ছিটকে মেঝেতে গড়াতে গড়াতে সদর দরজার দিকে যেতে লাগল। নীল বলটাকে ধরতে গেল কিন্তু বলটার গড়ানোর স্পীড যেন অন্যদিনের থেকে অনেক বেশী। নীল ধরতেই পারছিল না। সদর দরজাটা অল্প ফাঁক ছিল, লছমন কি যেন কাজ করছিল বারান্দায়। তখন কাজ ফেলে কোথাও গেছিল, বোধহয় নিজের ঘরে। বলটা বারান্দা পেরিয়ে বাগানে নেমে, গেটের ফাঁক গলে রাস্তায় চলে গেল। নীলেরও যে কি হল কে জানে, ও বলের পেছনে ধাওয়া করল। এমনিতে কিন্তু ও মাকে না বলে একা একা কোথাও যায় না।

বল রাস্তা দিয়ে গড়াতে গড়াতে চলল, পেছন পেছন নীল। দুপুরবেলা রাস্তাঘাট ফাঁকা তাই নীলকে কেউ দেখতে পেল না। নাহলে এ অঞ্চলে সবাই নীলকে চেনে। এ গলি ও গলি উঁচু নীচু ঢেউ খেলানো রাস্তা দিয়ে গিয়ে বলটা থামল একটা ছোটো বাড়ির পেছন দিকে। বাড়িটা খুব দূরে বলে নীলের মনে হল না। বল থেমে গেছে, নীলও দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে শুনশান জায়গাটা। নীল ভাবছে, বলটা এখানে থামল কেন? কি আছে এখানে?

এদিক ওদিক তাকাতে দেখতে পেল একটা জানলার একটা পাল্লা খোলা। বাকী সব দরজা জানলা বন্ধ। বাড়িটাতে কেউ থাকে বলেও মনে হয় না। জানলাটার ঠিক তলায় একটা মাটির ঢিবি মতো ছিল। নীল তার ওপরে উঠে জানলা দিয়ে উঁকি মারল। দেখল একটা ঘরে প্লাস্টিক দিয়ে কি যেন একটা চাপা দেওয়া রয়েছে আর দুজন লোক ঘুমোচ্ছে। কেমন যেন লোকদুটো, নীলের কি রকম ভয় করল। ও তাড়াতাড়ি ঢিবি থেকে নেমে বলটা কুড়িয়ে দৌড় লাগাল। লছমনের সঙ্গে ও এদিক দিয়ে অনেকবার যাতায়াত করেছে, তাই বাড়ি ফিরে যেতে অসুবিধে হল না।

বাড়ি ঢুকে দেখল লছমন বাগানে কাজ করছে। ও চুপিসারে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আবার মার পাশে শুয়ে পড়ল। লছমন বুঝতেও পারল না।

ওর আওয়াজ পেয়ে মা চোখ না খুলেই ঘুম ঘুম গলায় বললে, ‘কি করছিস নীল? দুপুরবেলায় ঘুরে বেড়াস না।’

নীল শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল কি করবে। মাকে সব বলবে? বললে তো ভালো মত বকুনি কপালে আছে। ভাবতে ভাবতেই দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল, সন্ধ্যেও হয়ে গেল। বাবাও অফিস থেকে ফিরে এলেন।

এসে বললেন, ‘কি ব্যাপার, আজ নীলবাবু কার্টুন দেখছেন না যে? কি হয়েছে?’
‘কে জানে! আজ দুপুরে ঘুমোয়ও নি। সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে বেরিয়েছে,’ মা বললেন।
নীল তখনো ভাবছে কি বলবে। বললেও বলের কথাটা বলাটা কি ঠিক হবে? এমন সময় হঠাৎ বাবার কথা কানে এল।

বাবা মাকে বলছেন, ‘দেখো নীল যেন একা একা বাইরে না যায়। সুলতানপুরে কিছু বাজে লোক ঢুকেছে। পুলিশের সন্দেহ এরা টাকা জাল করে। খুবই বিপজ্জনক লোক।’
‘পুলিশ ধরছে না কেন?’
‘ধরার চেষ্টা চলছে। সারা শহরে অ্যালার্ট করা হয়েছে। কালও মাইক নিয়ে বলবে।’
এই পর্যন্ত শুনে নীল আর থাকতে পারল না, সোজা বাবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘টাকা জাল কি বাবা? কি করে করে?’
‘টাকা জাল মানে আমাদের টাকার নকল তৈরী করা। ওদের মেশিন থাকে যাতে নকল টাকা ছাপায়। অত্যন্ত অন্যায় এবং বেআইনি কাজ।’
নীল ঢোঁক গিলল। ওই লোকদুটো নয়তো? কি করছিল ওরা ওরকম একটা চারদিকে জঙ্গলওয়ালা বাড়িতে? এবার বোধহয় বাবা, মাকে সব বলতে হবে।

বাবা লক্ষ্য করেছেন নীলের ভাবান্তর, জিজ্ঞেস করলেন, ‘নীল কি হয়েছে?’
আরো দুবার ঢোঁক গিলে নীল কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি আজ দুপুরে একা একা বাইরে গেছিলাম।’
‘কি!’ মা, বাবা দুজনেই চমকে উঠলেন।
‘লছমন তো সামনে কাজ করছিল, ওও আটকাল না?’ মা খুব বিরক্ত।
‘লছমনচাচা তখন সামনে ছিল না, তাই আমি বেরোতে পেরেছিলাম।’
‘কোথায় গিয়েছিলে নীল? কেন গিয়েছিলে?’

সব বলল নীল, শুধু বলের কথা বাদ দিয়ে। বলল কিভাবে ঘুরতে ঘুরতে ওই বাড়িটার সামনে চলে গিয়েছিল, কি দেখেছে সব। এও বলল যে লছমনের সঙ্গে ওই রাস্তা দিয়ে ও আগেও গেছে। বাবা তক্ষুণি লছমনকে ডেকে বাড়িটার সঠিক জায়গাটা জেনে নিলেন, তারপর পুলিশে ফোন করলেন।

ওই বাড়িটাই ছিল টাকা জাল করার কারবারীদের আড্ডাখানা। পুলিশ বামাল সমেত সবাইকে গ্রেপ্তার করল। এদিকে এসন কাণ্ডের মধ্যে বলটা কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। নীল কত খুঁজল, লছমনকে দিয়ে পুরো বাগান তন্নতন্ন করে খোঁজাল কিন্তু বল পাওয়া গেল না। নীলের তো মন খুব খারাপ। সারাক্ষণ মুখ ভার। অবস্থা দেখে নীলের বাবা অনেকগুলো নানারকমের বল কিনে এনে দিলেন কিন্তু নীলের মুখে হাসি ফুটল না।

সন্ধ্যেবেলা কার্টুন দেখছিল নীল, মা এসে ডেকে নিয়ে গেলেন। পুলিশকাকুরা নাকি এসেছেন নীলের সঙ্গে দেখা করতে।
নীল এলে বাবা বললেন, ‘এই হচ্ছে আমাদের নীল। কিন্তু এখন ওর মন খুব খারাপ কারণ ওর একটা বল হারিয়ে গেছে।’
সবাই হেসে উঠলেন।
একজন পুলিশকাকু নীলকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘তুমি এত সাহসী ছেলে আর একটা বল হারিয়ে গেছে বলে মন খারাপ করছ? এই দেখো আমরা তোমার জন্যে কি এনেছ। এই বন্দুক, গাড়ি, ভিডিও গেম সব তোমার।’
নীল অল্প হেসে ‘থ্যাংক ইউ’ বলল বটে কিন্তু মন খারাপ গেল না।
মনে মনে বলল, ‘তোমরা তো জানোই না সব কিছু হয়েছে ওই বলটার জন্যে। ওকেই তো থ্যাংক ইউ বলা হল না।’

অদিতি সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কর্মসূত্রে আরব দুনিয়ায় বসবাসের অভিজ্ঞতাও আছে। বই পড়তে ভালোবাসেন। ভ্রমণ,ছবি তোলা,এম্ব্রয়ডারির পাশাপাশি লেখালিখিতেও সমান উৎসাহী। নানান ওয়েব ম্যাগাজিন ও পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়।