সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
আশীরগড়ে এক রাত

এবারের গরমের ছুটিতে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হবে না শুনে টায়রার মন যতটা খারাপ হয়েছিল, হঠাৎ করে ইন্দোরে মেজদিভাইয়ের বাড়ি যাওয়া হবে শুনে ঠিক ততটাই আনন্দে তিরতিরিয়ে উঠল।

"কি রে? ইন্দোর যাওয়ার কথা শুনেই তো চোখ ঝিকিয়ে উঠেছে তোর", মায়ের গলা শুনে ট্র্যাভেলিং ব্যাগ গোছাতে গোছাতেই ছুটে এসে মাকে ধরে গোল করে দু'পাক ঘুরিয়ে দিল টায়রা। তারপর মায়ের গালে একটা চকাস করে চুমু খেয়েই বলল, "খুশি, ভীষণ খুশি"।

তিনদিন পরেই মা, ভাই আর কাকার সাথে মেজদিভাইয়ের বাড়ি পৌঁছে দেখে তার এক দূর সম্পর্কের শ্বশুরও সেখানে এসেছেন। তিনি আবার রিটায়ার্ড আর্মি মেজর। বাউন্ডুলে স্বভাবের মানুষটার নেশা হল একাই পাহাড়ে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো। টায়রার বেড়ানোর আগ্রহ দেখে তিনি ডিনারের পর মধ্যপ্রদেশের বিখ্যাত "আশীরগড় ফোর্ট"-এর গল্প শোনালেন। আর জানালেন যে তিনি পরদিনই যাচ্ছেন ওই দূর্গ দেখতে। টায়রারা চাইলে সঙ্গে যেতে পারে। শুনেই টায়রা তো একপায়ে খাড়া। পরদিন ভোরবেলা মেজর আঙ্কলের সাথে বেরিয়ে পাঁচ ঘন্টায় তারা পৌঁছে গেল বুরহানপুর।

রাস্তায় যেতে যেতে আঙ্কলের কাছ থেকে বাকী গল্পটাও শুনে ফেলল টায়রা। 'আশীরগড়' বা 'আসা আহির গড়' আসলে সম্রাট আসা আহীরের তৈরী। এই দূর্গের মধ্যে একটা শিবমন্দির আর একটা মসজিদ পাশাপাশি আছে। দূর্গের তিনটি অংশের মধ্যে প্রথম অংশের নামই প্রাধান্য পেয়েছে, বাকী দুটো 'কামারগড়' আর 'মলয়গড়'কে এখন কেউ চেনেও না। দূর্গটা বুরহানপুর শহর থেকে প্রায় কুড়ি কিমি. দূরে বলে সেদিন আর কেউ যেতে চাইল না। তাই টায়রা আঙ্কলের সাথে একাই চলল দূর্গ দেখতে।

সাতপুরা পর্বতশ্রেণীর উপর অবস্থিত এই দূর্গের প্রবেশপথে পা রাখতেই গা ছমছম করে উঠল টায়রার। একটা পেঁচা তার দিবানিদ্রা ভঙ্গ হওয়ায় বিরক্তিসহকারে উড়ে গেল ডানা ঝটপটিয়ে। সে আঙ্কলের শার্টের কোণটা চেপে ধরল, "এখানে কেউ থাকে না?"

হা হা করে হেসে উঠলেন আঙ্কল, "কেন রে? ভয় করছে নাকি?"
স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে টায়রা বলল, "মোটেও না। চলো কোনদিকে যাবে"।

প্রায় তিনতলার সমান উঁচু লোহার ভারী দরজা দিয়ে ঢুকেই বড় বড় চৌকো পাথর বসানো সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে দূর্গের মাথায়। দু'পাশে শ্যাওলা-সবুজ পাথরের দেওয়াল। একটা ভ্যাপসা গন্ধ এক মুহূর্তেই টায়রাকে যেন পৌঁছে দিল কয়েক শতাব্দী আগে। এই সিঁড়ি দিয়েই কোন এক সম্রাট হেঁটে যেতেন তার অন্দরমহলে। একটু এগিয়েই সিঁড়ি চলে গেছে দুদিকে। টায়রা কি যেন এক অজানা টানে এগিয়ে চলল বাঁদিকের সিঁড়ি ধরে। একটু এগিয়েই ভাঙা কেল্লার ধ্বংসাবশেষ। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে পাথুরে কেল্লার অংশ, আর তার চারপাশে সবুজের সমারোহ। বিভিন্ন ধরনের গাছ আর আগাছায় ভর্তি। ঝিঁঝিঁর আওয়াজে বাকী সব শব্দই চাপা পড়ে গেছে। কে যেন টায়রার কানের কাছে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। চমকে উঠে টায়রা পেছন ফিরে বলতে গেল, "ভয় দেখাচ্ছ কেন আঙ্কল?" কিন্তু একি, কেউ তো কোথাও নেই! তাহলে কি মনের ভুল? হাওয়ায় ওড়া চুল সামলাতে সামলাতে টায়রা খেয়াল করল সে একেবারে একা দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা কেল্লার মাঝখানে। সামনেই সেই শিবমন্দির আর মসজিদ পাশাপাশি। সেগুলোরও ভগ্নদশা। এদিকে সন্ধ্যে নেমে আসছে।

"আঙ্কল, আঙ্কল..." বেশ কয়েকবার ডেকেও টায়রা কোন সাড়া পেল না, তার ডাকটাই শুধু প্রতিধ্বনিত হতে থাকল ভাঙা পাথুরে দেওয়ালে।

এবারে সত্যিই ভয় পেয়ে টায়রা দ্রুত ফিরে এলো সেই সিঁড়ির কাছে, যেখান থেকে সে চলে এসেছিল বাগানের দিকে। কিন্তু কোথাও আঙ্কলের দেখা নেই। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে কেল্লার আনাচে কানাচে। পায়ের উপর দিয়ে একটা কোন জন্তু চলে গেল সড়সড় করে। আঁতকে উঠে কি করবে ভেবে না পেয়ে টায়রা আবার ছুটে চলল সেই শিবমন্দিরের দিকে। তার কাছে না আছে টর্চ, না আছে জল। এদিকে আঙ্কলেরও সাড়া পাচ্ছে না। সে বেশ বুঝল কোনরকমে রাতটুকু তাকে এখানেই কাটাতে হবে।

আশীরগড়ে এক রাত

আবছায়ার মধ্যেই শিবমন্দিরের ভেতরে ঢুকে শিবলিঙ্গ ঘেঁসে জড়োসড়ো হয়ে বসল টায়রা। মন্দিরের গায়ে কয়েক শতাব্দীর কালো ছোপ আর শ্যাওলা, আগাছাও আছে। কোথাও একটা রাতচরা পাখীর ডাক রাতের অন্ধকার চিরে বুকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। টায়রা মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল যাতে তাড়াতাড়ি সকাল হয়। জেগে থাকার অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়ল সে। আচমকাই পাথরের উপর খড়মের খটখট আওয়াজে ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠল টায়রা। প্রথমে সে ভাবল নিশ্চয় ভোর হয়ে গেছে আর আঙ্কল এসে মন্দিরে পুজো করছেন। কিন্তু খড়ম পেল কোথা থেকে! তাই সেও দেওয়ালের দিকে সরে গেল আঙ্কলকে চমকে দেবে বলে। কিন্তু নিজেই চমকে গেল…লিঙ্গের সামনে এসে বসলেন এক বৃদ্ধ। তার মাথার চুল কাঁধ ছাড়িয়ে নেমেছে, রবীন্দ্রনাথের মত একমুখ দাড়ি-গোঁফ, মোটা মোটা ভ্রু…সবই ধবধবে সাদা। কেঁপে ওঠা পাথরের প্রদীপ-শিখায় দেখা গেল মানুষটার দু'চোখ বন্ধ আর একটা অদ্ভুত "ওওওমমমম" আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। তাহলে কি ইনিই শিবলিঙ্গটা পরিষ্কার রাখেন! ভাবতে ভাবতেই টায়রা দেখল বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে লিঙ্গকে তিনবার প্রদক্ষিণ করলেন আর একটা কমন্ডলু থেকে লিঙ্গের মাথায় দুধ ঢালতে লাগলেন, সাথে মন্দ্রস্বরে শিবস্তোত্র। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল টায়রার, উনি কি টায়রাকে দেখতে পাচ্ছেন না? যত দেখছে টায়রার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠছে। শূন্যে হাত বাড়িয়ে একমুঠো টাটকা ফুল আর বেলপাতা নিয়ে অর্ঘ্য দিলেন। ম্যাজিক! পুজোশেষে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে সোজা বেরিয়ে গেলেন মন্দির থেকে। টায়রাও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল, কিন্তু বাইরে কাউকেই দেখতে পেল না।

দূর থেকে আঙ্কলকে আসতে দেখে ছুট্টে তার কাছে গিয়ে টায়রা এক নিশ্বাসে বলে ফেলল কি কি দেখেছে। আঙ্কল একটু চুপ করে থেকে বললেন, "আমিও এক গোপন কুঠুরীতে পড়ে গিয়েছিলাম, অনেক কষ্টে বেরনোর রাস্তা পেতে পেতেই ভোর হয়ে গেল। চল, গাড়িতে যেতে যেতে তোকে শিবপুজোর গল্পটা বলব"।

"তুই মহাভারতের অশ্বত্থামার গল্প শুনেছিস?"
টায়রা সঙ্গে সঙ্গে তার জ্ঞানের ঝুলি উজার করে দিল, "হ্যাঁঅ্যাঅ্যা, গুরু দ্রোণাচার্যের ছেলে"।
"ঠিক, স্থানীয় লোকেরা বিশ্বাস করে যে রোজ ভোররাত্রে সেই অশ্বত্থামা এখানে আসেন আর শিবপুজো করে যান"।
"যাহ্‌ তাই আবার হয় নাকি! তাহলে ওনার এখন বয়স কত?" বলেই হিহি করে হেসে ওঠে টায়রা।

আঙ্কল কিন্তু বলেই চলেন, "একবার শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, তাকে সমস্ত মানুষের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে বইতে হবে আর কলিযুগের শেষ পর্যন্ত একাই ঘুরতে হবে। তাকে থাকতে হবে সমাজের বাইরে, সবকিছু ছেড়ে, কারুর সাথে কথা পর্যন্ত না বলে। এক অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক দুরারোগ্য অসুখে তাকে ভুগতে হবে। এই বলে অশ্বত্থামার কপালের মণিটি খুলে নেন আর অশ্বত্থামা কুষ্ঠরোগগ্রস্ত হয়ে পড়েন"।

টায়রা যেন আবার তার ঘাড়ের কাছে একটা গরম নিঃশ্বাস অনুভব করল, অনেকটা দীর্ঘশ্বাসের মত। এদিকে আঙ্কল বলে চলেছেন, "লোকে বিশ্বাস করে যে বিষ্ণুর দশম অবতার কল্কির সাথে দেখা হলে তবেই মুক্তি পাবে অশ্বত্থামা। এরা এটাও বিশ্বাস করে যে গত পাঁচ হাজার বছর ধরে প্রতিদিন ভোরে তিনি এখানে এসে শিবপুজো করে যান। প্রতিদিন তাই মন্দিরে লিঙ্গকে পাওয়া যায় সদ্যস্নাতরূপে আর তার সামনে পড়ে থাকে একরাশ চন্দনমাখা ফুল"।

টায়রা একবার গাড়ির জানালা দিয়ে দূর্গের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল...সেই বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন দূর্গের মাথায়, তাকিয়ে আছেন এদিকেই, হাওয়ায় উড়ছে তার শ্বেতবস্ত্র আর উত্তরীয়। ঠিক সেই চেহারা, যা সে আজ ভোরবেলাই দেখেছে মন্দিরে। সে হাত তুলে ফিসফিসিয়ে বিদায় জানাল এই অমর আত্মাকে… "গুডবাই অশ্বত্থামা"।


ছবিঃ ঈশিতা চন্দ্র

জয়তী অধিকারী, কলকাতার বাসিন্দা, বেসরকারী চাকুরীরত। ভালবাসেন পাহাড়ের বুক বেয়ে সবুজ গন্ধে বুক ভরিয়ে নিতে,ভালবাসেন বই পড়তে আর গান শুনতে।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা