সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
যদি শুরু হয় পারমাণবিক যুদ্ধ

মানুষের জীবন অমূল্য। অনেক মানুষ আছেন যাঁরা এই মুহূর্তে কোনও মানুষের প্রাণ বাঁচাতে আপ্রাণ লড়াই করছেন। যেমন ডাক্তার, দমকলকর্মী বা উদ্ধারকারীর দল। কেউ বা নানা ল্যাবরেটরিতে প্রাণপাত করছেন মারাত্মক রোগের ওষুধ আবিষ্কার করে অনেক মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টায়। যেমনটা করেছিলেন আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং, যিনি জনস্বার্থে তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার পেনিসিলিনের পেটেন্টও নেননি।

আবার অনেকে এখনই এই অমূল্য প্রাণ ধ্বংস করার খেলায় নানা প্রাণঘাতী অস্ত্র তৈরি করা ও সেগুলোকে উন্নত করার চেষ্টায় মত্ত। এইসব অস্ত্রের মধ্যে আছে প্রচলিত বোমা, বন্দুক, আবার আছে একসাথে গাদাগাদা মানুষকে খুন করার নানা মারণাস্ত্র বা Weapons of Mass Destruction. এদের মধ্যে আছে জীবাণু অস্ত্র, রাসায়নিক অস্ত্র আর সবার ওপরে, পারমাণবিক অস্ত্র। শেষেরটা নিয়েই এই লেখা।

পারমাণবিক অস্ত্র মোটামুটি দুই ধরণের। প্রথমটা 'ফিশন' বা 'অ্যাটম' বোম, যেখানে ভারী তেজস্ক্রিয় পরমাণুর বিভাজন বা 'ফিশন' ব্যবহার হয়। দ্বিতীয়টা 'ফিউশন' বা 'হাইড্রোজেন' বোম, যাতে ব্যবহার হয় একের বেশি হালকা হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম পরমাণুর সংযোজন বা 'ফিউশন'। ফিশন ও ফিউশনে অল্প পরিমাণ বস্তু 'ধ্বংস' হয়ে শক্তির রূপ নেয়। আইনস্টাইন দেখিয়েছেন, এই শক্তি অমিত। মাত্র এক গ্রাম পদার্থ 'পুড়িয়ে' পাওয়া শক্তি গোটা কলকাতার কয়েক ঘণ্টার বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পারে। অবশ্য যদি এই শক্তি একটু একটু করে বেরিয়ে আসে, যেমন হয় পারমাণবিক চুল্লিতে। কিন্তু পারমাণবিক বোমায় এই অমিত শক্তি এক ঝটকায় বেরিয়ে আসে আর শক্তিতে রূপান্তরিত পদার্থের পরিমাণও এক গ্রামের যথেষ্ট বেশিই থাকে। এই নির্গত শক্তির দমকা মুহূর্তে ডেকে আনে ধ্বংস। কতটা, সে কথায় এবার আসছি।

হাইড্রোজেন বোমের তুলনায় অ্যাটম বোম কম বিধ্বংসী। জনবহুল জায়গায় এখন অবধি মাত্র দু'বার অ্যাটম বোম ফেলা হয়েছে – ১৯৪৫ সালে জাপানে, প্রথমে হিরোশিমায় ও তারপর নাগাসাকিতে। বোম দু'টি ফেলেছিল আমেরিকা। পারমাণবিক অস্ত্রের শক্তি মাপা হয় তা বিস্ফোরণ ক্ষমতায় কতটা ডিনামাইটের মূল উপাদান ট্রাই নাইট্রো টলুইনের সমতুল্য, তাই দিয়ে। হিরোশিমার বোমা 'লিটল বয়'এর শক্তি ছিল প্রায় ১৫ কিলোটন আর নাগাসাকির বোমা 'ফ্যাট ম্যান' ছিল প্রায় ২০ কিলোটনের। এই দুই বিস্ফোরণে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়। আরও অনেক লক্ষ মানুষ ঝলসে, গলে বিকলাঙ্গ হয়ে যায়। বহু দশক ধরে বাতাস বয়ে বেড়ায় তেজস্ক্রিয়তার অভিশাপ। পরবর্তী প্রজন্মও রেহাই পায়নি তেজস্ক্রিয়তা সৃষ্ট জন্মবিকৃতির থেকে।

তারপর পারমাণবিক অস্ত্রের প্রচুর বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। হাইড্রোজেন বোম আরও অনেক শক্তিশালী। বিভিন্ন দেশ তাদের পারমাণবিক প্রকল্পগুলি গোপন রাখে। তবে অনুমান, অদ্যাবধি তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমের শক্তি ৫০ মেগাটন অর্থাৎ 'ফ্যাট ম্যান'এর প্রায় ২৫,০০ গুণ! কপাল ভালো, আর কোনও বোমের পরীক্ষা জনবহুল জায়গায় হয়নি।

যদি শুরু হয় পারমাণবিক যুদ্ধ
বিভিন্ন দূরত্বে একটি ২০ কিলোটন পরমাণু অস্ত্রের ধ্বংসলীলা

পারমাণবিক অস্ত্র অনেক কারণেই প্রাণঘাতী। প্রথমত, বিস্ফোরণকেন্দ্রে দেখা দেয় অত্যন্ত বেশি তাপমাত্রা, যা সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা দু'কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসের সমান হতে পারে। অতিতপ্ত বিস্ফোরণকেন্দ্রের গ্যাস ও অন্যান্য বস্তুকণা তক্ষুণি তীব্র দীপ্তিতে জ্বলে ওঠে। এই উত্তাপ দ্রুত চারদিকে ছড়ায়, ফলে ছড়ায় আগুনের  দীপ্তি। এভাবে মুহূর্তে তৈরি হয় এক বিশাল 'অগ্নিগোলক' বা 'ফায়ারবল', যার মাপ কয়েকশো মিটার থেকে কয়েক কিলোমিটার হতে পারে। এই ঘটনা যদি কোনও উন্নত শহর বা কলকারখানায় ভরা এলাকায় হয়, তবে এই তপ্ত অগ্নিগোলক শহরের জ্বালানি তেলের ভাণ্ডার ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থকে জ্বালিয়ে আরও ব্যাপক এক আগুনের জাল তৈরি করতে পারে। একে বলে অগ্নিঝড় বা 'ফায়ারস্টর্ম'। এলাকাটি যত উন্নত ও জনবহুল, অগ্নিঝড়ও তত ব্যাপক। এই অগ্নিঝড়ে নির্গত শক্তি মূল বোমে নির্গত শক্তির বহুগুণ। এই অমিত তাপে সবকিছু পুড়ে তৈরি হয় কার্বনের অজস্র সূক্ষ্ণ কণিকা। সেগুলো ওপরে উঠতে উঠতে জমে বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় স্তর স্ট্যাটোস্ফীয়ারে (যা অক্ষাংশ অনুযায়ী মাটি থেকে ৭-২০ কিলোমিটার উঁচুতে), ও বছরের পর বছর সেখানে ভেসে বেড়ায়। এর ফলে প্রথমত সূর্যের আলো বাধা পেয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাতাসের যে ওজোন স্তর আমাদের সূর্যের বিপজ্জনক অতিবেগুনী রশ্মির থেকে বাঁচায়, এই দূষণের ফলে তা ভেঙে ও ফুটো হয়ে পৃথিবীর মানুষকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। কতটা, সেই প্রশ্নে পরে আসছি।

যদি শুরু হয় পারমাণবিক যুদ্ধ
পারমাণবিক বিস্ফোরণে নির্গত বিভিন্ন ধরণের শক্তি

পারমাণবিক অস্ত্রের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রভাব, অতিতপ্ত বায়ু কেন্দ্রস্থল থেকে তিরবেগে বাইরে ছুটে আসার ফলে ঘটে মহা বিস্ফোরণ। এই প্রবল চাপে ছুটে আসা বাতাস মহাঝঞ্ঝার বেগে ছুটে গিয়ে আশেপাশের সবকিছু ধুলিসাৎ করে দেয়। এই ধ্বংসস্থলের ব্যাসার্ধও কয়েকশো ফুট থেকে কয়েক কিলোমিটার হতে পারে।
তৃতীয়ত, অতি উত্তপ্ত বায়ুকণার উজ্জ্বল বিকিরণ চোখ ধাঁধানো আলোর সৃষ্টি করে। এই আলো চোখে পড়লে সাময়িক অন্ধত্ব, ক্ষেত্রবিশেষে স্থায়ী অন্ধত্বও হতে পারে।
আর এক মহা বিপদ হচ্ছে তেজস্ক্রিয়তা। আশ্চর্যের বিষয়, তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হয় বেশি শক্তিমান 'ফিউশন' বোম থেকে নয়, কম শক্তিমান 'ফিশন' বোম থেকে। কিন্তু 'ফিউশন' সৃষ্টি করতে লাগে অতি উচ্চ তাপমাত্রা, যা কেবল 'ফিশন' বোম ফাটিয়েই পাওয়া যায়। অর্থাৎ ফিশন বোম দিয়ে ফিউশন বোম 'ডিটোনেট' করা হয়। তাই ফিউশন বোম থেকে না হলেও তার 'ডিটোনেটর' থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়, যা কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে প্রাণঘাতী হতে পারে। আরও অনেক, অনেক কিলোমিটার জুড়ে থাকে তার মারাত্মক প্রভাব, যা বছরের পর বছর, এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দীও যায় না।

*****

একটি বড়সড় ফিউশন বোম জনবহুল জায়গায় পড়লে যে ক্ষতি হবে, তা ভাবাও যায় না। .এখন পারমাণবিক শক্তিমান প্রত্যেক দেশেরই ফিউশন বোম আছে। তাই কেউ পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করলে আক্রান্ত দেশ বা তার পরমাণু শক্তিধর মিত্রের প্রত্যাঘাতে আক্রমণকারীও পাল্টা ধ্বংস হবে। আর এভাবে কয়েকটি মহা সাইজের বোম পড়লে শুধু দেশ দু'টি কেন, গোটা পৃথিবীই মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। এই ভয়েই হয়তো পারমাণবিক অস্ত্র হিরোশিমা-নাগাসাকির পর আর যুদ্ধে ব্যবহার হয়নি। একে বলে পারমাণবিক প্রতিষেধক বা 'নিউক্লিয়ার ডিটারেন্ট'।

কোন দেশের কত পরিমাণ অস্থ্র আছে

কিন্তু এতে যাদের প্রচলিত অস্ত্রবল কম, তারা পারমাণবিক ছত্রছায়ায় থেকেও নিশ্চিন্ত হল না। পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেও তা তো আত্মহত্যার ইচ্ছে না থাকলে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তাহলে বেশি ট্যাঙ্ক, কামান, ডুবোজাহাজের অধিকারী প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে বাঁচার কী উপায়? এই সমস্যার সমাধানে বেরলো 'খুদে' পারমাণবিক অস্ত্র। তাকে 'কৌশলগত' বা 'ট্যাকটিকাল' অস্ত্র বা ক্ষেত্রবিশেষে 'নিউট্রন বোম'ও বলা হয়। এই সীমিত শক্তির পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে সামরিক বা বেসামরিক অনেক মানুষকে মুহূর্তে মেরে ফেলা যায়। কিন্তু এর ধ্বংসক্ষমতা সীমিত হওয়ায় তাতে (আশা করা যায়!) হয়তো পৃথিবী ধ্বংস হবে না। তাই 'দুর্বল' দেশকে যদি 'শক্তিশালী' দেশ আক্রমণ করে তবে তারা এই বোম দিয়ে আগ্রাসী শত্রুসৈন্যদের ধ্বংস করতে পারে।

লক্ষ্যণীয়, প্রত্যেক দেশই নিজের সামরিক বাহিনীকে বলে 'ডিফেন্স' বা 'প্রতিরক্ষা বাহিনী'। তাহলে আক্রমণটা করে কারা আর যুদ্ধই বা শুরু হয় কীভাবে? 'অন্যের' জন্য?

আপাতদৃষ্টিতে এই 'খুদে' অস্ত্র  এই স্বস্তি দেয় যে পারমাণবিক যুদ্ধ হঠাৎ লেগে গেলেও তার ক্ষয়ক্ষতি সীমিত হবে। কিন্তু তা নয়। কেউ এই অস্ত্র একবার ব্যবহার করলেও হাজার হাজার মৃত্যু ঘটবে, তার 'বদলা' প্রতিপক্ষও একইভাবে নেবে। এভাবে বাড়তে বাড়তে কখন 'বড়' অস্ত্র নেমে আসবে, বলা শক্ত। বরং এই 'ছোট' অস্ত্রের বাড়তি বিপদও আছে। বড় অস্ত্র সাধারণত কেন্দ্রীয়ভাবে গোপনে রাখা থাকে। শান্তির সময় অস্ত্রগুলি যে মিসাইল দিয়ে ছোঁড়া হয় তার থেকে আলাদা করে রাখা হয়। সেগুলোর নিয়ন্ত্রণও করেন অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা, যেমন সেনাপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান। তাই 'নিউক্লিয়ার ট্রিগার' যখন তখন কারও টিপে দেওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু 'ছোট' পারমাণবিক অস্ত্র এমনকি ছোট সাঁজোয়া গাড়িতেও যুদ্ধক্ষেত্রে বয়ে নেওয়া যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে সেগুলো মিসাইলের সাথে লাগানোই থাকে আর তার নিয়ন্ত্রণ থাকে নিচু স্তরের অফিসারদের হাতে, যারা পরিস্থিতি বিচারে ভুল হলে ওগুলো চালিয়ে দিতে পারে। এছাড়া সন্ত্রাসবাদী বা জঙ্গীদের হাতেও এই অস্ত্র চলে যেতে পারে।

এত প্রশ্ন এখন হঠাৎ কেন আসছে? আসছে এইজন্য যে সম্প্রতি পুলওয়ামায় ৪৪ জন সি-আর-পি-এফ জওয়ান সন্ত্রাসবাদীদের নৃশংস আক্রমণে নিহত হওয়ার পর দুই পরমাণু অস্ত্রে বলীয়ান দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। উত্তেজনা সাময়িকভাবে কমেছে। কিন্তু ভবিষ্যত অনিশ্চিতই রয়ে গেছে।

ব্যাপারটা শুধু উপমহাদেশে নয়, গোটা বিশ্বেই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ  দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশের পরস্পরের এলাকায় বিমান আক্রমণ বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথম। এমনকি অমিত শক্তিধর আমেরিকাও ছোট্ট দেশ উত্তর কোরিয়াকে সামরিক আক্রমণ না করে সংযত থেকেছে, কারণটা ওদের পারমাণবিক অস্ত্র। এখন ভারত-পাকিস্তান দুই দেশ থেকেই হুঙ্কার ও পাল্টা হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিও। দুই দেশের অজস্র দেশপ্রেমীও তাতে পরোয়া করেন না বলে দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। না করুন, তার আগে অন্তত সবার সুনির্দিষ্টভাবে জানা দরকার এমনকি সীমিত পারমাণবিক যুদ্ধেও দুই দেশ ও পৃথিবীর কতটা ক্ষতি হতে পারে। সন্দেহ হয়, অনেকেই এসব বিশদে জানেন না। যেমন পোখরানে আমাদের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর অনেক 'দেশপ্রেমী' পোখরানের বালি সারা দেশে ছড়াতে চেয়েছিল, আমাদের শৌর্য প্রচারের জন্য। তাদের বোধহয় জানা ছিল না, ঐ তেজস্ক্রিয় বালির থেকে কী বিপদ হতে পারে। স্বভাবতই সরকার তাদের বিরত করেছেন।

যা বলছিলাম। ভারত-পাকিস্তান দু'জনেরই শতাধিক পারমাণবিক অস্ত্র আছে, যার মধ্যে আছে ছোট 'ট্যাকটিকাল' অস্ত্র আবার বড় হাইড্রোজেন বোম। যদি তার থেকে দুই পক্ষ গোটা পঞ্চাশ করেও ব্যবহার করে যেগুলির গড় শক্তি স্রেফ আদ্যিকালের হিরোশিমা বোমের মতো ১৫ কিলোটন, তবে তার প্রত্যক্ষ প্রভাবে এক সপ্তাহের মধ্যে আনুমানিক দু'কোটি লোকের মৃত্যু হবে, যা সন্ত্রাসবাদী হানায় এক দশকে নিহতের সংখ্যার প্রায় দু'হাজার গুণ!

কোন বোমের কত শক্তি

আর এই বোমগুলোর কিছুটাও যদি পড়ে কলকারখানা ভরা শহর এলাকায়, তবে তাতে যে অগ্নিঝড় তৈরি হবে তাতে বাতাসে ছড়াবে ৫০ লক্ষ টন ধোঁয়া। ফলে জনবহুল এলাকার ওজোন স্তর ২০ থেকে ৫০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে বিপজ্জনক অতিবেগুনি রশ্মিকে দরজা খুলে দেবে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা-শস্য, এমনকি সমুদ্রের তলার প্ল্যাঙ্কটন, যা সমুদ্রের খাদ্যচক্রের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই অবস্থা স্বাভাবিক হতে লাগবে প্রায় দু'দশক। এই বিপুল পরিমাণ ছাই সারা পৃথিবীর আকাশে ছড়িয়ে সূর্যের আলো আড়াল করে পৃথিবীর তাপমাত্রা নামিয়ে আনবে দেড় থেকে আড়াই ডিগ্রি অবধি। এর ফলে শীতকাল হবে দীর্ঘতর। বৃষ্টিপাত কমে যাবে ১০% মতো। ফলনের সময় যাবে কমে, কানাডার মতো শীতল এলাকায় হয়তো ফলনই হবে না। সব মিলিয়ে বিশ্ব জুড়েই দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ, যাতে অন্তত কুড়ি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খাদ্যাভাব ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে দেখা দেবে নানা মানবিক সমস্যা, যুদ্ধবিগ্রহ, গৃহযুদ্ধ। এটাও বছর দশেক চলবে। অর্থাৎ স্থানীয় ও সীমিত পারমাণবিক যুদ্ধও গোটা বিশ্বের পরিবেশকেই বিপন্ন করে তুলবে।

এমনকি যদি মাত্র একটি ১৫ কিলোটন অস্ত্রও শিল্পসমৃদ্ধ এলাকায় ব্যবহার হয়, তার ফলে লক্ষাধিক টন ধোঁয়া বাতাসে উড়বে আর তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ শিকার হবেন কয়েক কোটি মানুষ।

যদি শুরু হয় পারমাণবিক যুদ্ধ

যা বলছিলাম – এই সব জেনেও যদি আমরা মনে করি যুদ্ধ, এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধ একটা দারুণ ব্যাপার, শুধু কাপুরুষরাই শান্তির কথা বলে, তাহলে ভালো। তবে যদি কেউ মনে করেন 'জোশ' দেখাবার একমাত্র ক্ষেত্র যুদ্ধ তাহলে বলি – এখন মানব সভ্যতার সামনে আরও এমন অনেক সমস্যা আছে, যার সমাধান কঠিন ও বিপদসঙ্কুল। পরিবেশ দিন দিন কিছু মানুষের লোভের দূষণে বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। তার বিরুদ্ধে যাঁরা দাঁড়াচ্ছেন তাঁদের মৃত্যুভয় ও অন্যান্য প্রতিকূলতার মধ্যে একটু একটু করে পথ কেটে এগোতে হচ্ছে। অনেক মানুষের জীবনেই জীবনযাত্রার ন্যূনতম উপকরণও নেই। তাঁরা সেগুলো চাইতে গেলেই বিপদে পড়ছেন। সন্ত্রাসবাদ অবশ্যই একটি বড় সমস্যা। কিন্তু আমাদের দেশে আরও অনেক অদৃশ্য সন্ত্রাস আছে। যেমন, গড়ে প্রতিদিন কয়েকশো শিশু পেটের রোগে মারা যায় – যার মূল কারণ হচ্ছে জীবাণুমুক্ত পানীয় জলের অভাব। অনেক গ্রামের মহিলারা মাইলের পর মাইল হেঁটে মাথায় কলসিতে করে জল নিয়ে আসেন। গ্রীষ্মকালে তাও জোটে না। সবার জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের এই যুদ্ধ লড়ার জন্যও দরকার অনেক সৈনিক – যদিও তাঁরা হয়তো প্রচারের আলোয় আসবেন না বা ফেসবুকে তেমন 'লাইক' পাবেন না।

সারা পৃথিবীতে সামরিক খাতে খরচ প্রায় ১১২ লক্ষ কোটি টাকা, ভারতের মোট বাজেটের চারগুণ। এই টাকার এক ভগ্নাংশ দিয়ে কোটি কোটি শিশুকে সুষ্ঠূ শিক্ষা, স্বাস্থ্যের পরিষেবায় আনা যায়, কোটি কোটি মানুষকে টেনে আনা যায় দারিদ্রসীমার ওপরে। তার জন্য দরকার যুদ্ধের বদলে শান্তির আবহাওয়া জোরদার করা। কিন্তু তা হতে চায় না। লক্ষ্যণীয়, প্রত্যেক দেশই নিজের সামরিক বাহিনীকে বলে 'ডিফেন্স' বা 'প্রতিরক্ষা বাহিনী'। তাহলে আক্রমণটা করে কারা আর যুদ্ধই বা শুরু হয় কীভাবে? 'অন্যের' জন্য?

সুখের বিষয়, 'ভীরু' অপবাদের ও নানা বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়েও বিভিন্ন দেশে অনেক মানুষ বলছেন – আমরা সন্ত্রাসবাদ যেমন চাই না, তেমন চাই না যুদ্ধ। আর একদম চাই না বিশ্বঘাতী পারমাণবিক যুদ্ধ। বলছেন, মানুষের চিন্তাভাবনা ও কার্যকলাপ পরিচালিত হোক দুর্গত ও অভাবিদের সেবায়, তাদের আরও দুর্গত ও অভাবি করে তোলায় নয়। এই মানুষগুলি আজ সংখ্যায় কম। কিন্তু তারা আমার-তোমার সবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। আশা রাখা যাক আগামী দিনে এই চিন্তার অঙ্কুরগুলিই ফুলফল ফোটাবে।


ছবিঃ উইকিপিডিয়া, পিক্সাবে
গ্রাফিক্সঃ মহাশ্বেতা রায়, অনিরুদ্ধ সেন

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা