সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
গল্পের মতো

দিনটা যখন পয়লা বৈশাখ, পয়লা বৈশাখের একটা দিনের গল্প বলি আজ। ছোটবেলায় মা মাসি দিদাদের কাছে অনেকবার শোনা একটা সত্যি ঘটনা, এক্কেবারে গল্পের মতো। এখানে গপ্পের ছলে বলতে গিয়ে হয়তো আমি কিছুটা রংটং ধরিয়ে ফেলব গপ্পের কাঠামোর গায়ে, তাতে কিছু মনে কোরো না যেন! অনেক সময় গপ্পের ছলেও অনেক ভারভারিক্কি সত্যি কথা বলে ফেলা যায়, অনেক ভার নামিয়ে ফেলা যায়।

গল্পটা একটা মেয়েকে নিয়ে, আর তার ভাইকে নিয়ে, বুঝলে? অনেক অনেক বছর আগের কথা, আমাদের কথা বাদ দাও, আমাদের মা মাসিদেরও তখনও জন্ম হয়নি। মেয়েটার নাম কল্যাণী, সে তখন ফ্রক পরা খুকি, তার ভাই হাফপ্যান্ট পরা খোকা। কল্যাণী ছিল ভয়ানক চঞ্চল মেয়ে, সর্বক্ষণ মাথায় দুষ্টুমির পোকা কিলবিল করছে। দুপুরে মা ঘুমোলে রান্নাঘরের শেকল খুলে আচার চুরি করে খাওয়া, নিরীহ ভালোমানুষ ভাই অপকর্মের ভাগ নিতে না চাইলে তাকে চেপে ধরে তার মুখের ভেতরে আচার মাখিয়ে দেওয়া, বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়ার সময় ফ্রকের কোঁচড়ে করে ঢিল নিয়ে যাওয়া, মাঠে ছেলেপুলের দল পান থেকে চুন খসালে ঢিল মেরে তাদের মাথায় আলু গজিয়ে দেওয়া, সবরকম কাজেই সে ছিল ওস্তাদ। তার বাবা প্রায় প্রতি হপ্তায় একখানা করে বর্ণপরিচয় কিনে আনতেন, আর সে নতুন বইয়ের খানকয়েক পাতা স্রেফ চিবিয়ে হাপিশ করে ফেলত। খুবই গর্হিত সব কাজকর্ম, সবের বর্ণনা দেওয়াটা ঠিক হবে না, তোমরাও সেসব কাজকর্ম শিখে ফেললে বেজায় মুশকিল। আসল কথায় যাই চলো।

পয়লা বৈশাখে নতুন জামাকাপড় পরার চল, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার চল আছে, জানোই তো! সেসময়েও ছিল, হয়তো আরও বেশি ছিল। কল্যাণী আর তার ভাই একবার পয়লা বৈশাখের আগের দিন গিয়ে পৌঁছালো তাদের এক দূর সম্পর্কের মামারবাড়ি। দূর সম্পর্ক ঠিকই, কিন্তু যাওয়া আসা মেলামেশা খুবই ছিল, তাদের বাবা পৌঁছে দিয়ে চলে এলেন। মা যাননি, কল্যাণী তখন বছর বারোর মেয়ে, ভাই পাঁচ বছরের ছোট, দিদি ভাইকে ঠিক সামলে রাখতে পারবে, এই ভেবে মা দুই ভাইবোনকে ছাড়লেন। ভাইবোন তো আনন্দে আত্মহারা, ক'দিন খেতে বসে ভাত ফেললে মায়ের চোখ রাঙানো নেই, সকাল সন্ধে পড়তে বসা নেই, দুপুরে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতে হবে না, সকালে দিদার হাতের বেলপানা তো দুপুরে মামীর হাতের পাঁঠার কালিয়া, এতেও মানুষ আত্মহারা হবে না বলো?

পয়লা বৈশাখের সকালে উঠেই বাড়ির সবাইকে প্রণাম করতে হবে, মা পইপই করে বলে দিয়েছিল। তাও কল্যাণী ভুলে যাচ্ছিল, নাকে তখন লুচির গন্ধ ঢুকে পড়েছে, ওসব গন্ধ নাকে ঢুকলে আর কিছু মনে থাকে না। ভাইয়ের মনে ছিল, তাকে দেখে কল্যাণীও ঢিপঢিপ করে সেরে নিলো প্রণামগুলো। ব্যস, এইবারে পাত পেড়ে মহাভোজের পর্ব শুরু হবে!

তা হয়েছিলও মহাভোজ। লুচি পায়েসের পর্ব মিটিয়ে দৌড়ঝাঁপ সেরে চানটান করে ভাত খেতে বসে থালার দিকে চোখ পড়তেই কল্যাণী হাঁ! ওরা দু'ভাইবোনে যা যা খেতে ভালবাসে সঅব হয়েছে! বাড়িতে মাছ হলে মাংস হয় না, মাংস হলে চিংড়ি হয় না, মাকে জিজ্ঞেস করলে মা বলে ওসব একসঙ্গে নেমন্তন্নবাড়িতে ছাড়া করতে নেই। তাহলে আজ কি এটা নেমন্তন্নবাড়ি?

ভাই তো ছোট, ও মাছ চিংড়ি মাংস একসঙ্গে সব খেতেই পারল না। রাতের জন্য তোলা রইল। কল্যাণী যদিও সব শেষ করে ফেলেছে, তবে ওকেও কি রাতে একটু চিংড়ি দেবে না?

দুপুরে ঘুমোতে নেই, সবাই জানে। বাড়িতে মা একটু গড়িয়ে নেয়, আর ওদের বকাবকি করে একটুও না জিরিয়ে ছাদে বারান্দায় টহল দিয়ে বেড়ানোর জন্য। এখানে কেউ বকবে না দুপুরে না শুলে। মামী নিজেই একটু ঘুমোয়, দিদা ছাদে গেছে আচার শুকোতে, রোদ্দুর পড়লে নামবে। ভাইকে কল্যাণী বলল, "চ ছোঁয়াছুঁয়ি খেলি।" ভাইয়ের অন্য কিছু খেলার ইচ্ছে হয়নি, সে দিদির কথাতেই ওঠে বসে।
খেলা জমে উঠল দেখতে দেখতে। বাড়ির উঠোন যথেষ্ট বড়, দৌড়োদৌড়ি করার অনেকটা জায়গা, তাতেও কুলোচ্ছিল না দুজনের, হুড়োহুড়ি করতে করতে একবার দিদি ভাইকে তাড়া করল, ভাই দৌড়োলো সদর দরজা খুলে গলির দিকে। সেই গলি গিয়ে পড়েছে বড় লেনে। চওড়া রাস্তা, তবে খুব যে বড় তা নয়, সাইকেল আর রিকশা ছাড়া বিশেষ কিছু চলে না। ভাই দৌড়ে গিয়ে রাস্তায় নেমে পেছন ফিরে দেখল দিদি কতটা দূরে, কল্যাণী চেঁচিয়ে উঠল, "রাস্তায় নয় ভাই, উঠে আয়!" শোনা হল না ভাইয়ের, একটা লরি এসে ভাইকে পিষে দিয়ে চলে গেল।

দলা পাকানো ভাই রাস্তায় পড়ে আছে রক্তের মাঝে। কল্যাণী চিৎকার করতেও পারছে না, ঠোঁটের ওপর আঠা লাগিয়ে দিয়েছে নাকি কেউ? অবস্থা দেখে রাস্তায় লোকজন ভিড় করে এসেছে, কেউ হয়তো মামারবাড়িতে খবর দিয়েছিল, দাদু মামা বেরিয়ে এসে ভিড় সরাচ্ছে, মামী এসে কল্যাণীকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছে। কল্যণীর পা রাস্তায় আটকে গেছে, নড়তে পারছে না ও। আর চোখের সামনে আটকে রয়েছে আরও দুটো চোখের ছবি। চোখ বন্ধ করলেও মুছছে না ছবিটা। ভেজা ন্যাতা চোখে বুলোলে মুছবে কি?

বিকেল আসছে তখন, পয়লা বৈশাখের বিকেল। বাজারে হাটে দোকানগুলো সেজে উঠছে একে একে, একটু বড় দোকানে হাল্কা সুরে সানাই, গোলাপজলের গন্ধও রয়েছে।

গল্পের মতো

কল্যাণীর ভাইকে পিষে দিয়ে চলে যাওয়া লরিটার ড্রাইভার আর খালাসি ধরা পড়েছিল শেষ পর্যন্ত। আরেকজন কাউকে চাপা দিয়ে ওরা পালাচ্ছিল দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে, বড় রাস্তা ছেড়ে পালানোর জন্য লেনে ঢুকে পড়েছিল তাই। পরপর দুটো অ্যাক্সিডেণ্ট হয়ে যাওয়ায় আর বেশিদূর পালাতে পারেনি।

খুনি লরির ড্রাইভার আর খালাসি যে ওরাই, নিশ্চিত করতে সাক্ষীর প্রয়োজন ছিল। কল্যাণীর চোখের সামনে ঘটেছিল গোটা ঘটনাটা, স্বাভাবিকভাবেই ওর ডাক পড়েছিল আদালতে। মা তখন সদ্য ছেলেকে হারিয়ে শোকে প্রায় পাথর, মেয়েকে কাছছাড়া করতে চাইছেন না কিছুতেই। কেন ওদের একলা যেতে দিয়েছিলেন ওবাড়িতে, সেই ভেবে নিজেকে দুষে চলেছেন অহরহ, আর কখনও যে মেয়েকে কোলছাড়া করতে পারবেন, সে জোর নিজের মধ্যে পাচ্ছেন না। মেয়ের কাকা আশ্বাস দিলেন, তিনি ভাইঝির সঙ্গে থাকবেন, কিচ্ছু হবে না কল্যাণীর। ও চলুক, দেখুক লোকগুলোকে কোনওভাবে চিনতে পারে কি না। ও যদি চিনিয়ে দিতে পারে, তাহলে লোকগুলোর শাস্তি হবে। কল্যাণী নিজে যেতে চায় তো?

সত্যি বলতে কী, কল্যাণী সাক্ষী দিতে যেতে চায় কি না সেসব ভাবার মতো অবস্থা তখন ওর ছিল না। ভাইয়ের সঙ্গে কী কী খেলা বাকি রয়ে গেল, সেসবের কথা মাথায় ঘুরছে সারাক্ষণ, খেতে বসলেই সেদিনের দুপুরের থালাগুলোর ছবি মনে পড়ে যাচ্ছে। আর, চোখ বুজলে, চোখ খুললে, সারাক্ষণই সামনে আসছে একটা ছবি। সাক্ষী দিয়ে এলে সেই ছবিটা ঝাপসা হয়ে যাবে কি? তাহ‌লে যাবে কল্যাণী। মা ভয় পাচ্ছে, বাবা দুর্বল হাতে আদর করছেন ঠিকই, কিন্তু জোরগলায় বলতে পারছেন না কিছু। কল্যাণীর সাক্ষ্যের ওপর নাকি নির্ভর করছে লোকগুলোর শাস্তি। কী করবে ও? পারবে আঙুল তুলে চিনিয়ে দিতে?

পেরেছিল কল্যাণী। কয়েকজন লোকের মধ্যে থেকে সেই চোখদুটোকে খুঁজে বের করতে পেরেছিল। দু'নম্বর অ্যাক্সিডেণ্টটাও ঘটে যাওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্য লোকটা লরির জানলা দিয়ে মুখ বের করে দেখেছিল ড্রাইভার কী সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলেছে! কল্যাণীর দৃষ্টি তখন ভাই আর ওর আশেপাশের সবকিছুকে প্রাণপণে শুষে নিচ্ছে নিজের অজান্তেই। ও তখনও জানে না ওই সময়ে শুষে নেওয়া ছবিগুলো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভুলতে পারবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে আসবে সে স্মৃতি, কিন্তু পুরোপুরি ভুলে যাওয়া যাবে না। জানলা দিয়ে বের করা একটা মুখ আর দুটো চোখকে চিনতে পারা সেই মেয়ের কাছে কী আর এমন কঠিন কাজ? কল্যাণী পেরেছিল। শাস্তি হয়েছিল লোকগুলোর। কী শাস্তি, কল্যাণী জানে না। ওর তখন ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে, মায়ের কোলের এক্কেবারে ভেতরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।

ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে সাংসারিক কাজের মাঝে সু্যোগ পেলেই পড়া আর লেখার আনন্দে মাতার চেষ্টায় থাকেন। সেই গোত্রের মানুষ, যারা আর কিছু না পেলে ঠোঙ্গায় ছাপা খবরও মন দিয়ে পড়েন। সারাদিনের অনেকটা সময় কাটে মেয়ে কুটুনের সঙ্গে; তার কীর্তিকলাপ মাঝেমধ্যে লিখতে চেষ্টা করেন;বর্তমানে ধানবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা