সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
হাত বাড়ালেই বন্ধু

তিতলির মন ভাল নেই। একে তো নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, একটা অস্বস্তি সারাক্ষণ মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার ওপর আবার আজ স্কুলের প্রথম দিনে মা ওকে পৌঁছে দিতেও যায়নি। এখন নাকি বাড়িতে অনেক কাজ, সকালে হুটহাট করে বেরনো যাবে না। তিতলিকে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে মা বাজার করতে চলে গেছে। বাবা তো সেই কোন ভোরেই অফিস চলে গেছে। নতুন জায়গায় অচেনা পরিবেশে একটা মেয়ের কতটা একা লাগতে পারে সেটা কি এরা কেউ ভাবে না? স্কুলবাসে বাকিরা সবাই গোটা রাস্তাটা তিতলিকে আড়চোখে মেপে গেল, কেউ এগিয়ে এসে ‘হাই’টুকুও বলল না। তিতলিও জেদী মেয়ে, সেও হাত বাড়ায়নি। ও কেন আগ বাড়িয়ে আলাপ করতে যাবে?

স্কুলেও সকালবেলায় একা একাই থেকেছে, ম্যামরা সবাই যদিও প্রতিটি ক্লাসেই সবার সঙ্গে "মিট শাওনী, ইওর নিউ ফ্রেণ্ড" বলে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু ক্লাসের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই নিজেদের বন্ধুমহলেই ব্যস্ত থেকেছে, তিতলিকে কেউ ডাকেনি।

ব্রেকে ক্যান্টিনে গিয়ে ও একাই খাচ্ছিল, তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ওদের ক্লাসেরই একটা মেয়ে ওর উল্টোদিকের চেয়ারে বসে খাচ্ছিল। খাচ্ছিল মানে, একজন আণ্টি ওকে খাইয়ে দিচ্ছিল, মেয়েটা খাবারে হাতই দিচ্ছিল না। আণ্টিটা চামচে করে ওর মুখের ভেতরে খাবার ঢুকিয়ে দিচ্ছিল, ঠোঁটে একটুও খাবার লাগছিল না। খাওয়াতে গিয়ে একবার আন্টিটার হাত ফসকে চামচটা মেয়েটার গায়ে পড়ে গেল। মেয়েটার হাতে, স্কার্টে খাবার লেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা চিৎকার করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল, খাবার ফেলে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে গেল বেসিনের কাছে, দুটো হাতের কবজি ঘষে হাত ধুতে শুরু করল। হাত ধোয়া শেষ হতেই স্কার্ট তুলে ধোয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
"না প্রীতি, জামা নামাও, জামা নামাও!" আন্টিটা শান্ত করার চেষ্টা করছে , পারছে না।

ওর হাত ধোয়া আর কান্নাকাটি দেখে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল, কেউ বিরক্ত হল, কেউ কেউ মুখ টিপে হাসতেও শুরু করল। তিতলি কিছুই বুঝতে পারছে না, ওরও খাওয়া থেমে গেছে। ওই আন্টি মেয়েটাকে শান্ত করতেই পারছে না, মেয়েটা বারবার হাত ধুচ্ছে আর হাতে হাত ঘষছে। ক্যাণ্টিনে গোলমাল শুনে ম্যামরাও চলে এসেছেন, মেয়েটার সঙ্গের আণ্টিটাকে জিজ্ঞেস করছেন কী হয়েছে। সব শুনেটুনে একজন চশমা পরা ম্যাম এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার হাত ধরলেন।
"ইটস ওকে প্রীতি, ইটস ওকে। চলো আমরা ভাল করে হাত ধুয়ে নিই। দ্যাখো, ভাল করে টাচ করে দেখো, আর কিচ্ছু লেগে নেই হাতে, ইটস ক্লিন নাউ।"
"ইটস ক্লিন নাউ।" প্রীতিও বলল। তখনও ওর মুখ ঘেন্নায় বেঁকে আছে। আণ্টি একটা টাওয়েল দিয়ে চেপে চেপে প্রীতির হাত মুছিয়ে দিচ্ছিলেন। বললেন,
"ভেরি গুড। চলো, ড্রেস চেঞ্জ করে নেবে। দিদি, ওকে ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে নিয়ে এস। তারপর আমরা লাঞ্চ ফিনিশ করব।"
তিতলি দেখল প্রীতির লাঞ্চবক্স মেঝেতে পড়ে গেছে। ম্যামকে ডেকে ও দেখাল সেটা। ওর কাছে এক্সট্রা লাঞ্চ নেই বটে, তবে আপেল আর বিস্কুট আছে।
"ম্যাম, আমি কি আমার আপেল আর বিস্কুট ওকে দিতে পারি?"
"দেবে? ওক্কে, দাও।"
একটু পরে প্রীতি অন্য একটা স্কার্ট পরে ফিরে এল। এটাতেও তিতলি একটু অবাক হল। ও তো স্কুলে এক্সট্রা স্কার্ট আনেনি! প্রীতি কেন এনেছে? ম্যামের দিকে তাকিয়ে দেখ ম্যাম ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। ও তাকাতেই ইশারা করলেন প্রীতিকে আপেল দেওয়ার জন্য। নিজেও এগোলেন প্রীতির দিকে।
"দ্যাখো প্রীতি, তোমার নতুন বন্ধু শাওনী। মিট ইওর নিউ ফ্রেণ্ড শাওনী। হাই শাওনী।"
‘হাই শাওনী।" প্রীতি বলল বটে, কিন্তু অন্যদিকে তাকিয়ে।
"হাই প্রীতি। এই আপেলটা আর বিস্কুটদুটো খেয়ে নে। লাঞ্চ তো খেতে পারলি না!"
প্রীতি আপেলটা নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল। হঠাৎ বলে উঠল,
"রেড অ্যাপেল!"
"ইয়েস! রেড ইজ ইওর ফেভরিট কালার, শি নোজ। ফ্রেণ্ডস নো দিজ। শাওনী, প্রীতি ইজ ইওর ফ্রেণ্ড। টেল হার হোয়াট ইজ ইওর ফেভরিট কালার?" ম্যাম তিতলির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
"মাই ফেভরিট ইজ পার্পল।"
"ওয়াও, দ্যাটস গ্রেট!"
"দ্যাটস গ্রেট!" ম্যামের কথাগুলো প্রীতি রিপিট করছে। নিজে কিছু বলছে না। শাওনীর সঙ্গে কথাও বলতে এগোল না। একটু আগে মনে হচ্ছিল প্রথমদিনে একটা বন্ধু অন্তত হবে, এতটা মন খারাপ থাকবে না। কোথায় কী? প্রীতি তো ওর সঙ্গে কথা বলছেই না। কেন?

লাঞ্চব্রেকের পর মিউজিক ক্লাস ছিল। মিউজিক টিচার এলেন কীবোর্ড নিয়ে। ম্যাম বাজাবেন, ওরা সবাই গাইবে। তারপর যারা কীবোর্ড শিখছে, তারা প্র্যাক্টিস করবে।

"শাওনী, তুমি তো আজ নতুন, তুমি বলো কোন গানটা জানো? আমি যদি নোটেশন জানি, বাজাব।"
তিতলি গেছে ঘাবড়ে। গান শোনে ও, কিন্তু গাইতে তো পারে না।
" ম্যাম, আমি গাইতে পারি না।"
"আরে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। গান গাইতে আমরা সবাই পারি। জানতে না পারি, কিন্তু মনের আনন্দে বা দুঃখে বা এমনিই ইচ্ছে হলে গুনগুন করে গাইতে আমরা সবাই পারি, তাই না?"
তিতলি ভাবল, ঠিকই তো!
"চলো শুরু করি।"
"প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ !"
এই গানটার কথা ভাল করে জানে না তিতলি, শুরুর ক’টা লাইন জানে, সেটুকুই গাইল, বাকিটা হুঁ হুঁ করে সুর মেলাল। ও অবাক হয়ে দেখল প্রীতিও গাইছে, কথা সব ভাল করে বলতে না পারলেও সুর ম্যামের সঙ্গে মোটামুটি মিলছে। কৌতুহল হল ওর, ক্যাণ্টিনে মেয়েটা কেমন করছিল, অস্থির, এখনও যে খুব শান্ত হয়ে বসে আছে তা নয়, ডানহাতটা সমানে নাড়িয়ে চলেছে, মনে হয় তাল দিতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।
মিউজিক ক্লাসের পর প্রীতি সেই আণ্টির সঙ্গে কোথায় যেন গেল।
তিতলি প্রীতিকে খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করছিল। বন্ধুদের সঙ্গে থাকলে হয়তো এতকিছু লক্ষ্য করার সময় পেত না, বা দেখলেও পাত্তা দিত না, বড়জোর একটু হাসাহাসি করত প্রীতির হাবভাব দেখে। হয়তো হাসি পাওয়ার মতোই ভাব, কিন্তু এখন তিতলির হাসি পাচ্ছে না। বরং জানতে ইচ্ছে করছে প্রীতি ওরকম করছে কেন? ক্লাসের আর কারও সঙ্গে তিতলির আলাপ হয়নি। কাকে জিজ্ঞেস করলে ঠিক উত্তর পাওয়া যাবে ভাবছিল, দেখল ক্যণ্টিনের সেই ম্যাম ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ও তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।
"সিট ডাউন শাওনী, আমি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলব। ক্লাসের বাকিদের একটু একটু বলেছি, তুমি নতুন, তোমারও জানা দরকার।"
"প্রীতি কোথায় গেল ম্যাম?"
"স্পেশাল ক্লাসে। কিছু সাবজেক্টের পড়াশোনার জন্য ওর একটু আলাদা গাইডেন্স দরকার হয়। তাই রোজ একটা করে স্পেশাল ক্লাসে ও জয়েন করে।"
তিতলির মনে হল এই ম্যামকেই প্রীতির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা যায়, ম্যাম কী বলবে বলে নিক আগে।
"প্রীতির সঙ্গে আলাপ হল তো?"
"ও তো আমার সঙ্গে কথাই বলেনি আন্টি! আমার দিকে তাকাচ্ছিল না। কেন? ওর কি শরীর খারাপ? নাকি আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায় না ও? "
"না না, আলাপ করতে চায় না নয়, তবে কীভাবে অন্যের সঙ্গে আলাপ করতে হয়, সেটা ও বুঝতে পারে না। শরীর খারাপ নয়, ওর একধরনের ডিজঅর্ডার আছে, যার নাম অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার। "

হাত বাড়ালেই বন্ধু

"সেটা কী?"
"এটা এক ধরনের নিউরোডেভেলপমেণ্টাল ডিজঅর্ডার।"
"কী হয় ম্যাম এতে?"
"অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার আছে এমন মানুষদের কয়েকটা ব্যাপারে অসুবিধা হয়। আমরা যারা অটিস্টিক মানুষদের বন্ধু হব, তারা সেই অসুবিধাগুলো কথা মনে রাখব, আর সেগুলো ম্যানেজ করার উপায় শিখব বা খুঁজে বের করব।"
"কী কী অসুবিধা হয় অটিজম থাকলে?"
"আজ হয়তো সবকিছু বলার সময় পাব না, একদিনে তোমরাও সব বুঝতে পারবে না। আস্তে আস্তে আরও অনেককিছু জানতে পারবে, বুঝতে পারবে। আজ কিছুটা শুরু করি।
প্রথম অসুবিধা, অন্যের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে সমস্যা হয়। আমার নিজের চাহিদা, আমি মনে মনে কী ভাবছি , অন্যকে কী বলতে চাইছি সেসব কিছুই অন্যকে বুঝিয়ে বলতে অসুবিধা হয়। ধরো আমার খিদে পেয়েছে, কিন্তু সেটা অন্য কাউকে বোঝালে তবে তো সে আমায় খেতে দেবে? বা কোনও গান শুনে আমার মনে দুঃখ হচ্ছে, সেটা অন্যকে বললে তবে তো সে বুঝবে? অটিজম থাকলে এই অন্য কাউকে বোঝানোর কাজটা কঠিন হয়ে যায়।"
"কমিউনিকেট করতে শেখা যায় না?"
"যায় তো, নিশ্চয়ই যায়! ছবির মাধ্যমে, বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে কমিউনিকেট করতে শেখানো যায়। কীভাবে কমিউনিকেট করব, সেটা যদি আমরা বন্ধুরাও শিখতে পারি তাহলে আমরাও কিছুটা হেল্প করতে পারি।"
"কীভাবে?"
"অনেকরকম উপায় আছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। ধরো তোমরা পাঁচজন বন্ধু খেলা করছ। কী খেলবে সেই নিয়ে আলোচনা চলছে। কেউ বলছ লুকোচুরি খেলবে, কেউ বলছ ক্রিকেট খেলবে, আবার কারও ইচ্ছে ফ্রগ রেস খেলার। তোমাদের মধ্যে একজনের অটিজম আছে। সে তোমাদের মতো করে এই আলোচনায় নিজের মত দিতে পারছে না। তোমরা যদি একটা কাগজে তিনটে খেলার ছবি এঁকে বা নাম লিখে সেই ছবি বা লেখা দেখিয়ে নিজেদের মতামত দাও, তাহলে বন্ধুর পক্ষেও ছবি দেখিয়ে খেলা পছন্দ করা সুবিধাজনক হবে।"
"আর কী অসুবিধা হয়?"
"অটিজমের সঙ্গে জড়িত আরেকটা বড় অসুবিধা হল সেন্সরি ইন্টিগ্রেশনে সমস্যা।"
তিতলি কথাটা শুনে হাঁ করে ম্যামের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী ভীষণ কঠিন শব্দ!
"কী? খুব কঠিন কথা?"
"হ্যাঁ ম্যাম। বুঝতে পারছি না।"
"আমাদের শরীরে সাতটা সেন্স আছে। sight, hear, smell, taste, touch, vestibular and proprioception. অর্থাৎ দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, ব্যালেন্স আর বডি অ্যাওয়ারনেস।"
"শেষেরটার মানে কী ম্যাম?"
"আমরা আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে কোথায় কীভাবে রাখব, হাত পা-কে কীভাবে নাড়াচাড়া করব, সেটা বুঝতে পারা, ঠিক করার সেন্স হল বডি অ্যাওয়ারনেস। ধরো, তুমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছ। কোন পা আগে ফেলবে, তখন কোন হাত দিয়ে রেলিং ধরবে, একটা করে ধাপ ডিঙিয়ে উঠবে নাকি প্রতিটি ধাপে পা রেখে উঠবে, তখন তোমার বডি সোজা থাকবে নাকি কোনো একদিকে হেলে থাকবে, এগুলো তুমি নিজের অজান্তেই ডিসাইড করছ। এই সেন্সটাকে বডি অ্যাওয়ারনেস বলতে পারো, আবার ভেস্টিব্যুলার, অর্থাৎ ব্যালেন্সের সেন্সকেও এখানে কাজে লাগানো হচ্ছে।
এবার আসি সেন্সরি ইন্টিগ্রেশন কাকে বলে সেই কথায়। এই যে সাতটা সেন্স, এরা সবাই একসঙ্গে কাজ করে বলে আমরা নিজেদের অজান্তেই রোজ নিজেদের কাজগুলো করে ফেলতে পারি, আলাদা করে সব সেন্সগুলোর কথা বোঝার দরকার হয় না। যাদের সেন্সরি ইণ্টিগ্রেশনে সমস্যা, তাদের ক্ষেত্রে এই সবক’টা সেন্স একসঙ্গে কাজ করতে পারে না। বা কোনও সেন্স খুব বেশি কাজ করে, কোনও সেন্স খুব কম কাজ করে। যার ফলে রোজকার কাজে খুব ছোটোখাটো থেকে শুরু করে অনেক বড় অসুবিধাও হতে পারে। প্রীতির গায়ে খাবার পড়ার পর ও কান্নাকাটি করছিল মনে আছে?"
"হ্যাঁ।"
"ওর টাচ সেন্স হাইপারসেন্সিটিভ, অতিরিক্ত বেশি কাজ করে। যার ফলে খাবার বা অন্য কিছু গায়ে লাগলেও ওর ভীষণ অস্বস্তি হয়, এতটাই অস্বস্তি যে ও স্থির শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারে না। যেহেতু কমিউনিকেট করতে অসুবিধা, কী সমস্যা হচ্ছে সেটা বুঝিয়ে বলতে পারে না, তাই তখন ও চিৎকার করে, কান্নাকাটি করে। কারণ কান্না বা চিৎকার হল কমিউনিকেশনের সবচেয়ে সহজ উপায়। বুঝতে পারছ আমি কী বলছি?"
"একটু একটু ম্যাম।"
"কারও কারও অডিটরি সেন্স, মানে শোনার সেন্স হাইপারসেন্সিটিভ হয়। খুব কম আওয়াজ, যেমন মশা ওড়ার আওয়াজ, যেগুলো আমরা খেয়ালও করি না, সেগুলোও তাদের কানে ধরা পড়ে। আর সাধারণ আওয়াজ, যেমন পাখা চলার আওয়াজ, গাড়ি চলার আওয়াজ, যেগুলোতে আমরা অভ্যস্ত, সেসব আওয়াজ তাদের কানে এত জোরে পৌঁছোয় যে তাতে খুব অসুবিধা হয়। অনেককেই দেখবে ভিড় জায়গায় গিয়ে ভয় পায়, কানে হাত চাপা দেয়, ট্রেন বা গাড়ির হর্নে ভয় পায়, কান্নাকাটি করে। তাদের অডিটরি সেন্স হাইপারসেন্সিটিভ হতে পারে।
আবার কারও কারও ক্ষেত্রে কিছু সেন্সেশন সিকিং বিহেভিয়ার দেখা যেতে পারে, অর্থাৎ কোনও তার যে সেন্স কম কাজ করে, তার চাহিদা মেটানোর জন্য সে এমন কিছু কাজ করে যা তার পক্ষে বিপজ্জনক বা অন্যের কাছে বিরক্তিকর। ধরো, কেউ সারাক্ষণ সব জিনিসের গন্ধ শোঁকে। নতুন কোনও জিনিস পেলে বা নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ হলে তাদের গায়ের গন্ধ শোঁকে। জিনিসটা অন্যের কাছে খুব বিরক্তিকর, জানি। কিন্তু সে কেন এরকম করছে সেটা যদি আমরা বুঝতে পারি, তাহলে জানব গন্ধ শোঁকার কাজটা সে ইচ্ছে করে অন্যকে বিরক্ত করার জন্য করছে না। গন্ধ শোঁকার কাজটা তার সেন্সরি নিড, শরীরের চাহিদা। এই গন্ধ শোঁকার কাজটা যদি আমরা তাকে অন্যভাবে দিতে পারি, তাহলে অন্যের গায়ের গন্ধ শোঁকার চাহিদা তার কমতে পারে।"
"এটা অন্যভাবে কী করে দেব ম্যাম?"
"বন্ধুকে আমরা স্মেলবক্স বানিয়ে দিতে পারি। নুন গোলমরিচ রাখার ছোট শিশিগুলো, যাতে ছোট্ট ছোট্ট গর্ত থাকে, সেরকম কিছু শিশিতে একটু চড়া গন্ধওয়ালা জিনিস রেখে স্মেলবক্স বানাতে পারি, গন্ধ নেওয়ার প্রয়োজন যখন হবে, তখন সে এই স্মেলবক্সের গন্ধ শুঁকবে। এরকমভাবে বিভিন্ন উপায়ে আমরা আমাদের অটিস্টিক বন্ধুদের বিভিন্ন সেন্সরি চাহিদা মেটানোর সুযোগ করে দিতেই পারি।"
"ম্যাম, আমার একটা কোশ্চেন আছে। আমার মায়ের হাতে ঘি লাগলে মা খুব ঘেন্না পায়, তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে ফেলে। ঘিয়ের শিশিতে মা হাত দেয় না, দরকার লাগলে আমাদের দিতে বলে। এটাও কি প্রীতির মতো সমস্যা?"
"কিছুটা তেমনই বলতে পারো। তোমার মা তাঁর অসুবিধাটা বুঝিয়ে বলতে পারেন, কী করলে তাঁর অসুবিধা কমবে, সেটা খুঁজে বের করতে পারেন, তাই তাঁর অসুবিধাটা খুব বেশি সমস্যা তৈরি করে না। কিন্তু প্রীতি যেহেতু নিজের অসুবিধার কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না, তাই ওর ক্ষেত্রে সমস্যাটা বড় আকার নেয়। তাই আমরা যারা প্রীতির বন্ধু, তারা ওর হয়ে অসুবিধাগুলো অন্যদের বুঝিয়ে বলব, কী করলে ওর অসুবিধাগুলো কম হবে, সেগুলো খুঁজে বের করব। তাই তো?"

এতক্ষণে তিতলি খেয়াল করল, ওর আশেপাশে আরও কয়েকজন এসে বসেছে, ম্যামের কথা শুনছে। তিতলির সঙ্গে কারও আলাপ হয়নি, নাম জানে না কারও। একজন জিজ্ঞেস করল,
"ও সমানে হাত নাড়ায় কেন?"
"সবসময় হাত নাড়ায় কি? খেয়াল করে দেখবে, সবসময় নাড়ায় না। যখন যখন ও এক্সাইটেড হয়, কোনও কাজ ভাল লাগে বা খারাপ লাগে, তখন ও হাত নাড়ায়। তোমরা একটু ভেবে দেখো, পরীক্ষার আগে টেনশনে তোমরা কে কে নখ খাও? বা আঙুল মটকাও?"
তিন-চারটে হাত উঠল।
"প্রীতির হাত নাড়ার ব্যাপারটাও সেরকমই। যখন ও কোনও কারণে টেনশন করে, বা খুব খুশি হয়, তখন ও হাত নাড়ে। গান গাইতে ও ভালবাসে, কিন্তু ক্লাসে সবার সঙ্গে গাওয়ার সময়ে কিছুটা টেনশনও হচ্ছিল। তাই সমানে হাত নাড়াচ্ছিল ও। এগুলো একধরনের অভ্যেস, নিজেকে শান্ত রাখার অভ্যেস। অটিস্টিক বা অটিস্টিক নয়, এরকম সব মানুষেরই এরকম নানান অভ্যেস আছে।"

এরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়েই ম্যাম হইহই করে উঠলেন।
"এ বাবা, ছুটির সময় হয়ে গেল তো! চল চল আজ এই পর্যন্তই, আবার আরেকদিন আরও অনেক কথা বলব। অটিজম নিয়ে অনেক কিছু জানার আছে, সব যে আমিও জানি তা নয়, আমিও শিখছি। প্রীতি, বা আরও অনেকে, যাদের অটিজম আছে, তাদের কাছে প্রতি মুহূর্তে অনেক কিছু শিখছি আমরা। বলতে পারিস একটা নতুন জগতের কথা জানছি।"
"ম্যাম, একটা কথা বলব?" কোণের দিকে থেকে একটা ছেলে হাত তুলল।
"বলো।"
"আমাদের ওয়র্ক এডুকেশন প্রজেক্টে ওইরকম স্মেলবক্স বানাতে পারি আমরা? যাদের দরকার হবে তাদের গিফট করব?"
ম্যাম কিছুক্ষণ ভেবে বলেন, "ওয়াও, গ্রেট আইডিয়া সায়ন্তন! আমি প্রিন্সিপ্যাল ম্যামকে বলব অবশ্যই, শুধু স্মেলবক্স নয় জানিস, আরও অনেক কিছু বানানো যায়, যেগুলো ইউজ করলে আমাদের অটিস্টিক বন্ধুদের রোজকার কাজে, কিংবা অন্যের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে অনেক বেশি সুবিধা হবে। সেসব জিনিস বানাতে রাজি আছ তোমরা? তাহলে আমরা কাজ শুরু করার ভাবনাচিন্তা করতে পারি।"
"ইয়েস ম্যাম!" সমস্বরে অনেকগুলো গলা বলে উঠল। তিতলিও হাত তুলল আস্তে আস্তে, সবার সঙ্গে। ততক্ষণে স্পেশাল ক্লাস করে প্রীতিও ওদের কাছে চলে এসেছে। তিতলি প্রীতির ব্যাগটা ডেস্ক থেকে তুলে নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল। নতুন স্কুলে প্রথমদিনের ক্লাস ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে বন্ধুত্ব শুরু করতে হলে অন্যপক্ষ কখন এগিয়ে আসবে তার জন্য অপেক্ষা করলে চলে না, নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় নতুন বন্ধুত্বের দিকে, নিজের হাত বাড়ালে তবেই অন্যদের হাতগুলো ছোঁয়া যায়।

(অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার নিয়ে ছোটদের মধ্যে সচেতনতা আনার চেষ্টা এই লেখা। তবে অটিজম স্পেকট্রাম এতটাই বিশাল আর বৈচিত্র্যপূর্ণ যে তা নিয়ে আলোচনা একটিমাত্র পর্বের মধ্যে ধরানো সম্ভব হয়নি। আংশিকভাবে কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখানে বলা হয়েছে।প্রয়াস থাকবে এরপরেও গল্পের ছলে এই বিষয়ে আরও কিছু লেখার।)

পরবর্তী পর্বগুলিঃ

হাত বাড়ালেই বন্ধুঃ দ্বিতীয় পর্ব
হাত বাড়ালেই বন্ধুঃ তৃতীয় পর্ব
হাত বাড়ালেই বন্ধুঃ চতুর্থ পর্ব

ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে সাংসারিক কাজের মাঝে সু্যোগ পেলেই পড়া আর লেখার আনন্দে মাতার চেষ্টায় থাকেন। সেই গোত্রের মানুষ, যারা আর কিছু না পেলে ঠোঙ্গায় ছাপা খবরও মন দিয়ে পড়েন। সারাদিনের অনেকটা সময় কাটে মেয়ে কুটুনের সঙ্গে; তার কীর্তিকলাপ মাঝেমধ্যে লিখতে চেষ্টা করেন;বর্তমানে ধানবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা