সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
অ্যানিমেশনে 'গুগাবাবা'

এ বছর ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুর মতো অমর চরিত্রের স্রষ্টা, গুপী গাইন বাঘা বাইন ট্রিলজির নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হলো। তাই এবারের এই পুজো সংখ্যায় এমন এক অ্যানিমেটেড ছবির গল্প বলবো যেটা গুপী গাইন বাঘা বাইনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। ছবির নাম 'গুপী গাওয়াইয়া বাঘা বাজাইয়া'। মূলত হিন্দিতে তৈরি, ইংরেজি সাবটাইটেল আছে। ছবির পরিচালক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অ্যানিমেটর শিল্পা রানাডে। প্রযোজক চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি ইন্ডিয়া। টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, মুম্বই চলচ্চিত্র উৎসব এবং ভারতীয় আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটা প্রশংসিত হয়। ২০১৩ তে ছবির নির্মাণ শেষ হলেও হলে মুক্তি পায় ছ'বছর পর ২০১৯ এ।

তোমরা নিশ্চয়ই জানো গুপী-বাঘা সত্যজিতের সৃষ্ট চরিত্র নয়। গুগাবাবার প্রথম আত্মপ্রকাশ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর হাতে ১৯১৫ এর সন্দেশ পত্রিকায়। পরে সত্যজিৎ এই গল্পের উপর যে ছবি বানান সেটা মুক্তি পায় ১৯৬৯ এর মে মাসে। টানা ১০২ সপ্তাহ প্রেক্ষাগৃহে চলেছিল এই ছবি। সেটা আরেক ইতিহাস। আমি ধরে নিচ্ছি তোমরা ছবিটা দেখেছ বা গল্পটা পড়েছ অন্ততঃ, না পড়লে এই লেখা পড়ার আগে ছবিটা দেখে নিতে বলবো। নয়তো হয়তো এমন কিছু প্রসঙ্গ পাবে, যাতে তোমার মজা হবে মাটি।

এবার একটা ভারী শব্দ আসবে। 'অ্যাডাপটেশন'। গল্প, উপন্যাস, সিনেমা বা অন্য কোনো শিল্পমাধ্যম থেকে অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমে কোনো কাজ যদি রূপান্তরিত করা হয়, তবে তাকে চশমা আঁটা পন্ডিতরা ভারী ভাষায় বলেন অ্যাডাপটেশন। অ্যাডাপটেশন অনেকরকম হয়। যেমন ধরো, সত্যজিৎ যে তাঁর দাদুর লেখা গল্প থেকে ছবি বানালেন, সেটা ছিল একটা অ্যাডাপটেশন। গল্প থেকে সিনেমায় রূপান্তর। আবার ধরো, আরব্য রজনীর গল্প থেকে ডিজনি একটা গল্প তুলে নিয়ে যে আলাদিনের উপর একটা আস্ত সিনেমা বানিয়ে ফেলল, সেটাও অ্যাডাপটেশন। অ্যাডাপটেশন নিয়ে এসব বললাম কারণ শিল্পার কাজটা মূলত 'অ্যাডাপটেশন' গোত্রের কাজ। বলা যায়, অ্যাডাপটেশনের অ্যাডাপটেশন। সত্যজিৎ করেছিলেন প্রথম অ্যাডাপটেশন তাঁর দাদু উপেন্দ্রকিশোরের গল্প অবলম্বনে, শিল্পা করলেন সত্যজিতের কাজ অবলম্বনে আবার অ্যাডাপটেশন।

অ্যানিমেশনে 'গুগাবাবা'

মূল ছবিটা নিয়ে গল্প করার আগে তোমাদেরকে একটু শিল্পার কথা বলা দরকার। যখন তোমাদের মতো ছোট ছিলেন, তখন থেকেই তিনি ছবি আঁকা নিয়ে মশগুল থাকতেন। পরে যখন লন্ডনের রয়্যাল 'কলেজ অফ আর্ট'-এ পড়াশুনো করতে যান, তখন কাজ করেছিলেন ভারতের আদিম অধিবাসীদের নিজস্ব শিল্পরীতি নিয়ে। ভারতের প্রায় সব প্রান্তের নিজস্ব শিল্পরীতি আছে, যদি কোনোদিন কোনো একজিবিশনে, ফিল্ম স্ক্রিনিং এ বা ওয়েবসাইটে শিল্পার আগের সিনেমাগুলো দেখো, তাহলে সে ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাবে। শিল্পা নিজে যখন কাজ আরম্ভ করেছিলেন, তখন অ্যানিমেশন এর প্রযুক্তি আজকের মতো এত উন্নত ছিল না, তা সত্ত্বেও তিনি ভেবেচিন্তে বের করেছিলেন কীভাবে ভারতীয় অ্যানিমেশন কম খরচে ভালো কাজ করতে পারে। পাশ্চাত্যের শিল্পরীতির পরিবর্তে তুলে নিয়েছিলেন ভারতীয় শিল্পের আদর্শ। অজন্তা ইলোরার গুহাচিত্র থেকে গল্প বলার শৈলী আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করতেন তিনি। মজার ব্যাপার কী জানো? এই টাকা পয়সা নিয়ে টানাটানি সত্যজিৎ-এর ক্ষেত্রেও ছিল। তিনি নিজেও যখন গুগাবাবার ভূতের নাচের দৃশ্যতে অ্যানিমেশন ব্যবহার করার জন্য প্রযোজকের কাছে টাকা চেয়েছিলেন, তা তিনি পাননি। পরিবর্তে তখন তিনি নিজেই মাথা থেকে এমন এক উপায় বের করেন, যাতে ওই সাড়ে ছ মিনিটের ভূতের নাচের দৃশ্য সিনেমার ইতিহাসে অমর হয়ে যায়।

অ্যানিমেশনে 'গুগাবাবা'

আসি সিনেমায়। মূল গল্প প্রায় একই, শুধু এখানে গুপী-বাঘা তিনটে নয়, চারটে বর চেয়েছে। চতুর্থ বরকে রাখার জন্য গল্পেও কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে। চতুর্থ বর কী, সেটা একদম ছবির শেষে দেখা যায়। আমিও তা বলবো না, সেটা জানতে দেখে ফেলো সিনেমাটা। একশো মিনিটের ছবিতে মোট আটটা গান আছে, যেগুলো খুবই সাযুজ্যপূর্ণ। মূল গুগাবাবার গানগুলোর আভাস পাওয়া যায়, কিন্তু সেজন্য গায়ের জোরে ছকে ফেলার চেষ্টা করেননি পরিচালক। কোথাও কোথাও প্রয়োজনে ভেঙেছেন মেজাজ ও দৃশ্য। যেমন "মন্ত্রীমশাই ষড়যন্ত্রী মশাই" গানটার দৃশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে হালকা মেজাজের গান "হম তো বাস নাচেগা গায়েগা বাজায়েগা", উল্টোদিকে মূল গানের সিরিয়াস মেজাজ ধরা পড়েছে তার আগের "ইস্ক কর, বিতর্ক কর, সংঘর্ষ কর, বিরোধ কর..." গানে। হাল্লা রাজার সেনা যুদ্ধে যাওয়ার দৃশ্যে যেখানে "ওরে বাবা দেখো চেয়ে কত সেনা চলেছে সমরে" ছিল, সেখানে এসেছে "বস অব ইয়েহি ক্রান্তি হো/ হর জাগাহ অমন শান্তি হো" গানটা। এ ধরণের সিনেমায় ভাষার নিজস্বতা অতিক্রম করতে গেলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে অন্যকিছু দিয়ে সেটাকে পূরণ করা। আবার একটা ভারী শব্দ বলবো। যাঁরা গম্ভীর অনুবাদ করেন, তাঁরা একে বলেন 'কমপেনসেশন'। সিনেমাও তো একরকম অনুবাদ। একটা মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে অনুবাদ। তাই সেখানে এ ধরণের কাজ বেশ কঠিন। একটা উদাহরণ দিলে হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন ধরো, "মহারাজা তোমারে সেলাম" গানটা। শুনলে দেখবে ওটা আদপে বাঙালির গান:

"মহারাজা ! তোমারে সেলাম,
সেলাম, সেলাম।
মোরা বাংলাদেশের থেকে এলাম।"

গুপী বাঘা অকপটে স্বীকার করে:

"মোরা সাদা সিধা মাটির মানুষ, দেশে দেশে যাই,
মোদের নিজের ভাষা ভিন্ন আর ভাষা জানা নাই।"

কিন্তু তারা অন্য এক ভাষা জানে- গানের ভাষা, প্রাণের ভাষা। সেটা দিয়েই তারা মন জয় করতে চায়। তারা জানায়:

"মোরা সেই ভাষাতেই করি গান,
রাজা শোন ভরে মন প্রাণ।

এ যে সুরেরই ভাষা, ছন্দেরই ভাষা
তালেরই ভাষা, আনন্দেরই ভাষা" ইত্যাদি

এবার ভাবো, এ গানের অনুবাদ করতে গেলে পরিচালককে কী সমস্যাতেই না পড়তে হবে। কারণ অ্যানিমেটেড সিনেমায় গুপী বাঘা তো আর বাঙালি নয়! দুজন হিন্দিতে গান গাইছে। তাই পরিচালক 'কমপেনসেশন' এর সাহায্য নেন। এই দৃশ্যে রাখলেন "শুন্ডি কে রাজা কো সালাম" গানটা। সেখানে ভাষার প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছেন। শুধু রাজার প্রশংসা। উল্টোদিকে হুন্ডি (হাল্লা রাজ্যের এই সিনেমায় নাম) রাজ্যে গিয়ে যখন তারা একই গান গায় "হুন্ডি কে রাজা কো সালাম" তখন তার শব্দগুলো সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে যায়। প্রশংসার বদলে হয়ে যায় বিদ্রুপাত্মক।

অ্যানিমেশনের মূল নিহিত থাকে অলংকরণে। প্রথমে দেখে ভাবতে পারো চরিত্রগুলোকে দেখতে তেমন একটা ভালো নয়, কেমন একটা দাগ কাটা কাটা। এর কারণ, ওই যে শুরুতে বলেছি: শিল্পা ভারতীয় প্রথা অনুসারী। এই চরিত্রগুলোর চিত্রণে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে কর্ণাটকের এক বিশেষ পুতুলনাচ 'তোগালু গোম্বেআতা" রীতি। একটা সাদা কাপড়ের পর্দা টাঙিয়ে তার পিছনের দিকে আলো জ্বেলে এই চামড়ার পুতুল নাচ হতো। অনেকটা একইরকম অন্ধ্রপ্রদেশেও এক পুতুল নাচ হয়, তার নাম 'থলু বোম্মালাতা'। এইসব পুতুল নাচে যে চামড়ার পুতুল ব্যবহার করা হয় সেগুলোর হাত-পা যেভাবে সেলাই করা থাকে, তার অনুকরণেই এই চরিত্রগুলো তৈরি। পোষাকে ব্যবহৃত হয়েছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের টেক্সটাইলের মোটিফ। দৃশ্যগুলোর পিছনের ডিটেলস নজর করলেও দেখবে চমৎকার ছবি।

সিনেমাটা দেখতে দেখতে মোটেও টের পাবে না এটা অ্যাডাপটেশন। শিল্পা গুলজারের অনুবাদে উপেন্দ্রকিশোরের গুপী গাইন বাঘা বাইনের অলংকরণ করছিলেন। তখনই গল্পটা তাঁর ভালো লেগে যায়। পরে সন্দীপ রায়ের কাছ থেকে স্বত্ব নেন সিনেমাটা করার জন্য। কিন্তু গুগাবাবার মতো সবার এত প্রিয় একটা ছবির অ্যাডাপটেশন করা তো খুব কঠিন। ভালো না লাগলেই মানুষ খাপ্পা হয়ে যাবে। সেই অসাধ্যসাধন কীভাবে করলেন শিল্পা এবং এই অনবদ্য গানগুলোই বা কী সুন্দর ভাবে বানিয়েছেন 'থ্রি ব্রাদার্স এন্ড এ ভায়োলিন' গ্রুপ সেটা জানতে দেখতেই হবে এই ছবিটা।

ছবিটা দেখতে পাওয়া যাবে এক জনপ্রিয় ও টি টি প্ল্যাটফর্মে।

নীচে দেওয়া রইল 'গুপী গাওয়াইয়া বাঘা বাজাইয়া' ছবির ট্রেলারঃ

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। লেখালিখি এবং পড়াশোনার মধ্যেই থাকতে ভালোবাসেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা