সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
'গুগাবাবা' আর  শান্তির গল্প

একটা গল্প। একটা সিনেমা। দুজন মানুষ। একজন ভূতের রাজা। দুজন মানুষ রাজা । আর… নাহ এভাবে হবে না। যদিও আমি জানি তুমি নিশ্চয়ই লাফিয়ে উঠে হাত তুলেছ? –“গল্পটা আমি জানি!” "সিনেমাটা আমি দেখেছি!" আর গল্পটা পড়েছি বলার থেকে সিনেমাটা দেখেছি বলার বন্ধুই বেশি আমার ধারণা! হবেই তো। ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা একটি চমৎকার গল্প ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ থেকে কেমন অতি চমৎকার একটি সিনেমা বানিয়ে ফেললেন সেই ঠাকুরদাদার নাতি সত্যজিৎ রায় মশাই! অমন সিনেমা আগে আর দেখেনি আপামর বাঙালি। শুধু বাঙালি কেন? এই ছবির মত ছবি (এবার থেকে সিনেমাকে নাহয় ছবি বলি!) ভারতে, দেশের বাইরে সারা বিশ্বে খুব কমই হয়েছে। আমি তো এমন আর দ্বিতীয়টি দেখলাম না বাপু! এই ছবির পঞ্চাশ বছর হল এবার। ১৯৬৯ সালের মে মাসে মুক্তি পায় ছবিটি আর চলে টানা ১০২ সপ্তাহ! হিসেব করো দেখি মানে কত দিন, কত মাস? কত বছর? ঠিক গুপীর মতন অবাক হলে নাকি?

ভালোমানুষ সরল সাদাসিধে গোপীনাথ কাইনের বড় গান বাজনার শখ ছিলো কিন্তু গলায় সুরটি বিশেষ ছিলো না বুঝলে। কিন্তু মানুষটা বড় ভালো। অন্য মানুষের চালাকি, দুষ্টু বুদ্ধি ধরতে পারে না, এমনকি কে যে তাকে ঠকিয়ে দিলো, কে যে তামাশা করে রাজার কাছ থেকে শাস্তি পাওয়ার জন্যই বলল যে তার গান রাজামশাইকে শোনানো উচিত সে সব সে কিছুই বুঝতে পারে না ! এদিকে বাবার ওপর অভিমান করে ভাবে বাবাই বোধহ্য় মিথ্যে করে তাকে বলেন যে গলায় সুর নেই, গান হবে না! ওদিকে রাজামশাই তো গান (বেসুরো চিৎকার) শুনে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে রেগে টং হয়ে গেলো! পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে আনলো গুপীকে আর সেই যে গাঁয়ের মোড়লেরা যা চেয়েছিল, তাই হল- রাজামশাই গুপীর মুখে চুন কালি মাখিয়ে গাধার পিঠে চড়ে গাঁয়ের বাইরে বের করে দিতে হুকুম দিলো! আর বেচারা গুপীর সাধের তানপুরাটা আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলল টুকরো টুকরো করে। আসলে তো তানপুরাটা ছিল পাঁচপুকুরের গোঁসাইখুড়োর! তাঁর বাড়িতে তানপুরাটা ‘অপয়া’ বলে এককোণে পড়ে ছিল! কিন্তু তবু পল্লব গোঁসাই সেই এমনি পড়ে থাকা তানপুরার বিনিময়ে গুপীকে দিয়ে কী কী কাজ করিয়ে নিলেন বল দেখি? গরীব মুদি গুপীর বাবা, পয়সা তো দিতে পারবে না তাই গোঁসাইখুড়ো “…বললে তামুক সেজে দে। দেলাম। পা টিপে দে। তাও দেলাম। বলে, পাতকো থেকে জল তুলে দে। দেলাম। বলে, ভাঁড়ার ঘরে ইঁদুর ঢুকেছে, মেরে দে। তাও দেলাম এই ধাড়ি ধাড়ি ইঁদুর। বাঁশের এক এক ঘায়ে…” এবং এর পরে “যন্ত্রের সুর যন্ত্রের কানে আর তোমার সুর তোমার কানে” এই বলে তানপুরার এবং গুপীর কান ভালো করে মলে দিয়ে তবেই তিনি তানপুরাটা দেন গুপীকে। সেই কান মলার এমনই জোর যে গুপীর কানে অনেকক্ষণ যন্ত্রণা করে কিন্তু গোঁসাইখুড়ো এবং গাঁয়ের বটতলার মোড়লদের কাছে তা নিছকই মজা! তাহলেই ভাবো কীভাবে সব সময়েই এই সব সরল মানুষদের ‘বোকা’ বলে এবং বোকা বানিয়ে চালাকের দল নিজের কাজ করিয়ে নিয়ে আসছে? যাই হোক গুপী কিন্তু ভারী খুশি হয়েই তানপুরা নিয়ে ফিরছিলো , গর্ব করে সে মাঠে চাষ করতে থাকা দ্বিজুখুড়োকে দেখায় তার অর্জিত অমূল্য সম্পদ তানপুরাটি এবং হেসে জানায় “তুমি চাষা, আমি ওস্তাদ খাসা!” কিন্তু তার এই উক্তি চাষাকে অপমান করার জন্য নয়। দুটি আলাদা পেশার মানুষ তারা সেটাই সে বোঝাতে চায়! সে তো শিল্পী! সে তো আলাদা! গুপী তো আলাদা বটেই না হলে আস্ত একটা যুদ্ধ সে থামিয়ে দেয়! ওহ না না সে একা নয়। তার দোসর বাঘা বাইনের কথা ভুললে চলবে কেন? না আমি এখানে ছবির গল্পটা পুরো বলবো না, যারা এখনও দেখোনি তারা অতি অবশ্যই দেখো আর যারা আগে দেখেছ -না হয় আবার একবার দেখে ফেলো। এই পঞ্চাশ বছর আগের একটা ছবি আর তারও প্রায় ষাট বছর আগে লেখা একটা গল্পে কীভাবে যুদ্ধ বিরোধী মূল সুর কত সহজ ভাষায়, উপেন্দ্রকিশোর এবং সত্যজিৎ, ছোটদের জন্য লেখা, ছবিতে বুনে দিয়েছেন, তুলে ধরেছেন তা ভাবলে অবাক লাগে! যুদ্ধ তো করতেই হবে! কিন্তু অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে হানাহানির যুদ্ধ নয়; যুদ্ধ হবে মাঠের ফসল, নদীর মাছ, সুখ, শান্তির ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য। মানুষ আসলে সেটাই তো চায়! তাহলে যুদ্ধ বাধায় কারা? কারা যুদ্ধ চায়? কাদের লাভ?

সেই প্রশ্ন তো গুপী আর বাঘারও! গুপী তাই গান ধরে আর জিজ্ঞেস করে “তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?”… এই গানেই তো গুপীর মত মানুষের কথা বলা হয়েছে যাদের সেই রাজা মশাই, গোঁসাইখুড়ো আর গাঁয়ের মোড়লের মত মানুষেরা খালি ঠকিয়ে নেয় , তামাশা করে দুঃখ দুর্দশা, শখ আহ্লাদ নিয়ে ! সেই গুপীর মত প্রজাদের কী হয়? “ প্রজা পেয়ে অষ্টরম্ভা হল হীনবল” আর সেই অমোঘ সত্যি- “ মিথ্যে অস্ত্র শস্ত্র ধরে, প্রাণটা কেন যায় বেঘোরে , রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দে অমঙ্গল!” পরস্পরে দ্বন্দ্ব মানে মারামারি কাটাকাটি যদি কর, তাহলে আসলেই কিন্তু কারোর ভালো হয় না, শুধুই অমঙ্গল হয়। যে পক্ষ জয়ী হয়, তাদেরও কিন্তু অনেক সৈন্য মারা যায়। আর তাদের বীরের মর্যাদা যতই দেওয়া হোক না কেন, যতই শহীদ বলে সম্মান জানানো হোক না কেন, তাঁরা আর ফিরে আসেন না মা-বাবার কাছে, তাঁদের একরত্তি শিশুদের কাছে, তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর কাছে, তাঁদের ভাই বোন বন্ধুদের কাছে। এক একজন মানুষের অমূল্য প্রাণ চলে যায়, এক একটি পরিবার শেষ হয়ে যায় আর তাঁদের এই বলিদান হয় শুধুমাত্র ক্ষমতা লোভী কিছু মানুষের জন্য! বলছিলাম না যে এত বছর পরেও কেন এই ছবি সমান প্রাসঙ্গিক? তোমার মনে আছে আয়লান কুর্দি নামে লাল জামা পরা একটি ছোট্ট শিশুর উপুড় হয়ে থাকা মৃতদেহের কথা? কী অপরাধ ওই ছোট্ট শিশুটির ছিল বলতো? ওর বাবা মায়েরই বা কী অপরাধ? অপরাধ এই তারা দুই দেশের হানাহানির সময় একটি এমন দেশের অধিবাসী যেখান থেকে তাদের পালাতে হয়েছিল। তুমি ইজরায়েল, প্যালেস্টাইন এর নাম শুনেছ? একটু পারলে জানার চেষ্টা কোরো সেখানে কী চলছে? কীভাবে বাস করছে সেখানের মানুষজন, শিশুরা? কিডল বলে একটা অ্যাপ আছে গুগল এর ছোট বোন বলা যেতে পারে। সেখানে সার্চ করে দেখতে পারো অথবা বড়দের সাহায্য নিতে পারো।

আমি তোমার মন খারাপ করে দিলাম নাকি? তাহলে চল আবার আমরা ফিরে যাই আমাদের অতি আপন গুগাবাবা-র কাছে।

পরস্পরে দ্বন্দ্ব করলে কী হয় তা তো টের পাচ্ছি কিন্তু পরস্পরের হাতে হাতে তালি দিলে? যদি দুজনেই ভালো মানুষ হয় এবং মানুষের ভালো, এই পৃথিবীর সবার ভালো চায় দুজনেই –তাহলে যে কী চমৎকার কাজ তারা করতে পারে তার প্রমাণ গুপী আর বাঘার যুগলবন্দী। অবশ্য ভূতের রাজার বর ছিল বলেই হয়ত এসব সম্ভব হল। জীবনটা বদলে গেল ওদের। কিন্তু আমরা তো জানি যে, ওরা তো আসলে খুব ভালো ,সৎ দুজন মানুষ যারা অন্যকে ঠকায় না, কারোর ক্ষতি চায় না । ওরা চায় দেশের মানুষ- সব দেশের সব সাধারণ মানুষ দুবেলা পেটপুরে খেতে পাক, শান্তিতে থাকুক আর ওরা দুজন একটু নিশ্চিন্তে গান বাজনা করুক আর দেশে দেখে বেড়াক। এখন কোন দেশই তো আর সেই দেশের সাধারণ মানুষকে বাদ দিয়ে নয়! তাই নানা দেশ দেখা মানে নানা সংস্কৃতি, নানা ভাষায় কথা বলা, নানা পোশাক পরা মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করাও তো বটে! যুদ্ধ তো কোনো দেশের মানুষ চায় না। যারা চায় তারা ওই রাজা-মন্ত্রী গোছের খুব কম কিছু মানুষ আর যাদের মগজ ধোলাই তারা করে দেয়, তারাই তাদের সমর্থন করে। এই মগজ ধোলাই এর বিষয়টা সত্যজিৎ রায়ের আরেকটি গুপী বাঘাকে নিয়ে ছবি ‘হীরকরাজার দেশে’ তে খুব ভালো করে দেখানো আছে।
'গুগাবাবা' আর  শান্তির গল্প

কিন্তু এই ছবিটায় বাঘা আর গুপী যে একজোট হয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, অস্ত্রের বিরুদ্ধে, হানাহানির বিরুদ্ধে লড়াই করল, তাদের সঙ্গেও কিন্তু দুইজন রাজা - ভালো রাজা শুন্ডীর রাজা আর আরেকজন ওদের গান বাজনা শুনে খুশি হওয়া ভূতের রাজার অবদান কম নয়। সেই যে গুপীকে তাড়িয়ে দেওয়া হল ঘাড় ধরে? গাধার পিঠে চাপিয়ে? ওর বাবা বেচারি চোখের জল মুছতে মুছতে দাঁড়িয়ে দেখলো সেই দৃশ্য আর সেই গাঁয়ের মাতব্বররা হেসে হেসে উপভোগ করল তামাশা। গুপী বেচারি চোখের জল মুছতে মুছতে ঘন জঙ্গলে গিয়ে পড়ার আগে গাধাটাকে ছেড়ে দিল নিজের আমলকী গ্রামের দিকে মুখ করে। এতেও বোঝা যায় গুপী নিজের এত কষ্ট হলেও অবলা প্রাণীটির কথা ভাবতে ভোলে না! তারপরে সেই জঙ্গলে আধাঁর নামে আর শব্দ হয় ঢপ ঢপ করে; গুপী গিয়ে দেখে আরেকজন মানুষ ওখানে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে হাঁ করে ঘুমোচ্ছে আর ঢোলের ওপর গাছের পাতা থেকে জল পড়ছে আর আওয়াজ উঠছে ঢপ ঢপ। আহা এই বেঘো জঙ্গলে আরেকজন মানুষ! সঙ্গী! গুপী খুশি হয়ে যায়। সে তো অল্পতেই খুশি। তার ওপর আবার এই লোকটি প্রায় সমবয়সী! তারপরে তার হাসির চোটে তো ঘুম ভেঙ্গে যায় সেই ঘুমন্ত মানুষের। গুপী খুব মজা করে তাকে নকল করতে থাকে। সে যা বলে গুপীও তাই বলে। সে যদি বলে “চোপ”! গুপীও বলে “চোপ”! সে যদি বলে “খবরদার”! গুপীও বলে “খবরদার!” তারপর এ যদি হাই তোলে, গুপীও তাই, এ যদি ধিনতাক ধিনতাক তাক ধিন ধিনতাক- বলে হাঁটু বাজায়, গুপীও তাই করে! এতদিন সবাই গুপীকে নিয়ে মজা এসেছে, নিষ্ঠুর সে সব ‘মজা’ – তাই এখন যদি গুপী এই ঘন জঙ্গলে গ্রাম ছাড়া হয়ে এই নির্দোষ মজা করে একটু আমোদ করে তাকে দোষ দিই কি করে? কিন্তু তাই বলে যার সঙ্গে এই মজা করা হচ্ছে তার কেন ভালো লাগবে? সে কতক্ষণ খায়নি বা কেন এই গভীর জঙ্গলে এসে ঘুমোচ্ছে শুধু একটা মাত্র ঢোল নিয়ে এসে সে কি আমরা জানি? তার দুঃখ না সুখ কোনটা বেশি এখন? তাও কি ছাই জানি? কিন্তু জানতে পারি একটু পরেই যখন রেগে মেগে সে “তবে রে” বলে লাফিয়ে ওঠে আর দূর থেকে শোনা যায় বাঘের ডাক ! বাইরের শত্রু বা কোন বিপদ কিন্তু এক করে মিলিয়ে দেয় অনেক সময় অনেক অপরিচিত সাধারণ মানুষকে। বেঁচে থাকা, শান্তিতে বেঁচে থাকাই যাদের উদ্দেশ্য তারা শান্তি বজায় রাখার জন্য একজোট হয়ে যায়! এভাবেই বজায় থাকে দুনিয়া। তা যাই হোক বাঘের ডাকের ভয়ে যখন দুজনে কাছাকাছি এল একে অন্যের পরিচয় জানতে পারল। গুপী গাইন আর বাঘা বাইন। দুজনকেই রাজা মশাই বের করে দিয়েছে তাদের গান বাজনার শখের জন্য। একজনের গ্রাম আমলকী আর আরেকজনের হরিতকী!

তারপর বাঘ আসে। ওদের দাঁতকপাটি লাগে। বাঘ চলেও যায়। তখনই জানা যায় যে ‘বয়ে কাটি, ঘয়ে কাটি’ বাঘার নামের জন্যই তাকে দেখে বাঘ পালিয়েছে ভয়ে। বাঘা বাইনের নাম জানতে পারে গুপী। ওরা ভাবে গান গাইলে, বাজনা বাজালে বাঘ আসবে না অতএব দুজনে মিলে কোনমতে বাঘের গান গেয়ে ঢোল বাজিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তাল দেয়। আর সেই গান চলতে চলতেই বাঁশবনে নেমে আসে অন্ধকার। একে একে ছায়ামূর্তি ভেসে আসে ওদের গান বাজনা শুনে নাচতে নাচতে। তারপর গুপী-বাঘা থেমে গেলে শুরু হয় তাদের নিজেদের নাচ আর শেষে ভূতের রাজা খুশি হয়ে ওদের বর দিতে চান। তিন বর। জবর জবর। খুশি হওয়ার অন্যতম আসল কারণ কী বলতো? “তোরা বড় ভালো ছেলে...” । তিন বরে তো খাওয়া পরার অভাব ঘুচে গেলো, দেশ দেখার উপায় হল আর গান বাজনায় সুর, তাল, লয়ের মিশেলে ম্যাজিক হল- যে ম্যাজিকে তাদের গান-বাজনা শুনে “লোকে শুনে ভ্যাবাচ্যাকা স্থির হয়ে থেমে যাবে”। কিন্তু একা একা হবে না সে সব। দুজনে মিলে হাতে তালি দিলেই হবে। গান বাজনা যদিও বা একা হবে কিন্তু খাবার, পোশাক আর দেশ ঘোরার জন্য দুজনকেই জোট বেঁধে, একসঙ্গে থাকতে হবে। কিন্তু ওদের থাকার কোন ব্যবস্থা তো হল না?

তাই নিয়ে যখন গুপী-বাঘা চিন্তিত, তখনই দেখতে পায় গানের ওস্তাদের দল চলেছে শুন্ডি রাজার রাজসভায় গানের বাজিতে। যে জিতবে সে হবে সভা গায়ক আর রাজবাড়িতেই থাকতে পাবে। অতএব গুপী-বাঘা গান শুনিয়ে বাজি জেতার কথা ভাবে , কারণ তাহলে একই সঙ্গে ওদের থাকার সমস্যাও মিটে যায়, গান বাজনার চর্চাও বজায় থাকে আবার চাইকি রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ের সম্ভাবনাও প্রবল হয়। ভুল করে শুন্ডির বদলে ঝুন্ডিতে গিয়ে ঠাণ্ডায় কেঁপে আর তারপর হুন্ডিতে গিয়ে প্রবল গরমে ছটফট করে অবশেষে তারা শুণ্ডি পৌঁছয়।

শুন্ডি দেশটা কেমন? হাল্লা রাজার গুপ্তচরের মুখেই শুনি? সে জানায় শুন্ডিতে যুদ্ধের কোন ব্যবস্থাই নেই। না আছে সৈন্য দল, না আছে, হাতি, ঘোড়া, উট- সেনারা তো এই সবের পিঠে চেপেই যুদ্ধ করে সেখানে! না আছে যুদ্ধের কোন সাজসরঞ্জাম, অস্ত্র শস্ত্র- না আছে যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছে! এই শুনে একই সঙ্গে খুশি এবং অবাক হয়ে মন্ত্রী যখন জানতে চায় ,“তাহলে আছেটা কী?” তখন গুপ্তচর জানায় “খেতে ফসল আছে। গাছে ফল আছে, ফুল আছে। পাখি আছে। দেশে শান্তি আছে, সুখ আছে, হাসি আছে...” এত সুন্দর এই দেশ শুণ্ডি কিন্তু হাল্লা দেশের রাজা আর মন্ত্রী যে দেশটা যুদ্ধ করে কব্জা করবে ভাবছে! রাজা অবশ্য সবসময় এমনটা ভাবে – তা নয়।
'গুগাবাবা' আর  শান্তির গল্প

যখন গানের বাজি জিতে গুপী-বাঘা সভা গায়ক রূপে রাজবাড়িতে থাকতে পেল, তারপরেই রাজসভায় তাদের সামনেই হাল্লা রাজ্যের দূত এসে যুদ্ধের ঘোষণালিপি দিয়ে গেল । আর সেই পড়েই তো ভালমানুষ রাজা ‘হা হতোস্মি’ বলে মূর্চ্ছা গেলেন! তারপরে চাঁদনি রাতে রাজপ্রাসাদের ছাদে বসে শুণ্ডির রাজা ওদের জানান যে হাল্লা রাজা তো তাঁর আপন ভাই! শিশুর মত সরল! বহুদিন সংবাদ নেই কোনো আর এখন এই সর্বনাশের বার্তা! আসলে তো মন্ত্রীটাই পাজি! ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ বাধাতে চায় সে নিজের ফায়দার জন্য। যে কোন যুদ্ধেই এই মন্ত্রীর মত মানুষগুলোই বড় ভূমিকা নেয়। দুজন ভালমানুষ যদি মিলে মিশে শান্তিতে থাকে তাহলে তার চলে কী করে? চললেও তার তো লোভ অনেক বেশি! সে জাদুকর বরফিকে দিয়ে কড়া নেশার উত্তেজক ওষুধ খাইয়ে রাজাকে  আচ্ছন্ন করে রাখে। রাজা নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে সেই ওষুধের প্রভাবে। আর নেশা করলেই তার চোখ মুখও নিষ্টুর হয়ে যায়। সে তখন যুদ্ধ চায়, গরীব প্রজাদের খাজনা দিতে না পারার অপরাধে গর্দান নেওয়ার আদেশ দেয় আর হিংস্র হয়ে পড়ে তার আচরণ! আর রাজা যখন ওষুধের প্রভাব মুক্ত হয়ে যুদ্ধ করবে না বলে তখন মন্ত্রী তাকে জোর করে ওষুধ খাওয়ায়, মিষ্টি হেসে যুদ্ধ শেষেই রাজার ছুটি মঞ্জুর করে আর জানায় খুব বড় যুদ্ধ না হলে “... রাজ্য বাড়াবে কী করে বল তো? অস্ত্রশস্ত্রে যে মরচে ধরে যাবে।” এভাবেই নেশা করিয়ে মন্ত্রীর মতন লোকেরা দুই শান্তিপ্রিয় ভাইয়ের মধ্যে লড়াই বাধিয়ে দেয়।

কোনো দেশের সাধারণ মানুষই তো যুদ্ধ চায় না! তারা যা চায় তা গুপ্তচরের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন এই ছবির আসল কথক সত্যজিৎ রায়। আর মন্ত্রীরা তাদের প্রয়োজন মত নেশা করিয়ে চলে কারণ রাজার নেশার ঝোঁকে আবার তার গর্দান ও চলে যেতে পারে ! এ নেশা এমনই নেশা যাতে অন্য দেশের রাজাদের সঙ্গে সৌজন্য শিষ্টাচার কিছুই বজায় রাখা যায় না। সবাই শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায় আর শুধুই হিংস্র প্রবৃত্তিগুলো বেরিয়ে আসে দাঁত নখ বের করে। জল্লাদকে তার ইয়া বড় অস্ত্র নিয়ে আসতে বলে রাজা দেশ বিদেশের অতিথি রাজাদের গাইতে বাধ্য করেন। না গাইলেই গর্দান নেবে জল্লাদ! এর আগেও এই ওষুধের প্রভাবে খড়ের পুতুলের পেটে বল্লমের ডগা ঢুকিয়ে দেন। মানুষ মারাতেই তখন তাঁর আনন্দ। অথচ গুপী বাঘার গানের সুরে-কথায় নেশা ছুটে গেলে তখন রাজার চোখে জল দেখতে পায় বাঘা। রাজা যে আসলে ভালো। বেশিরভাগ মানুষই যে আসলে ভালো। নান কারণে তাদের ভেতরে থাকা খারাপ প্রবৃত্তিগুলো এভাবে বের করে আনে কিছু দুষ্টু লোক বা প্রতিকূল পরিবেশ!

এদিকে যুদ্ধ জয় করলেই তো হল না! তাতেও তো মন্ত্রীর শান্তি নেই! কারণ প্রজারা যদি বোবা হয় তাহলে তো মুশকিল! হ্যাঁ এটা বলা হয়নি যে শুন্ডি রাজ্যে এত শান্তি কিন্তু প্রজারা সকলেই বোবা। রাজা কথা বলতে পারেন কারণ তিনি যখন সপরিবারে একবার তীর্থ করতে গিয়েছিলেন, তখন এক ভয়ানক মহামারি হয়েছিল রাজ্যে। একটা ভয়ানক ছোঁয়াচে কো্নো অসুখ ছড়িয়ে পড়েছিল আর সেই কারণেই রাজ্যের সকল প্রজা বোবা হলেও রাজা এবং তার পরিবার সেই অসুখ থেকে বেঁচে গিয়েছলেন। কিন্তু বোবা প্রজা দিয়ে মন্ত্রীর মতন দুষ্টু লোকেদের তো চলবে না? তারা তো প্রজাপালনের জন্য রাজ্য চায় না, শুধু ক্ষমতার লোভে আর প্রজাদের লুট করে নিজের সম্পত্তি বাড়ানোর জন্যই সিংহাসন চায়! তাই সে বরফিকে বোবাদের কথা বলানোর ওষুধ তৈরি করতে বলে কারণ প্রজারা “ যা চায়, সেটা যদি না বলে তাহলে তাদের সেটা পাবার পথ বন্ধ করা যায় কি?” ভেবে দেখো তো সাম্প্রতিক কালের অনেক ঘটনার সঙ্গে মিল পাচ্ছ? এই যে আমাদের দেশ ভারত এর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, চীন এদের শত্রুতার বীজ বুনে জিইয়ে রেখে কাদের লাভ? এদের সঙ্গে যুদ্ধ করে কাদের লাভ? আমাদের মত সাধারণ মানুষের? কোন দেশেই তোমার মত স্কুলে পড়া হাসিখুশি বাচ্চারা চায় না কি যুদ্ধ? না কি তাদের বাবা মায়েরা চায়? .হাল্লা রাজার গুপ্তচর এবং এমনকি সেনাপতি আর রাজাও যুদ্ধ করতে চায় না! কিন্তু মন্ত্রী যুদ্ধ করবেই আর সবাইকে সেই মত নেশা করিয়ে, বকে ধমকে ভয় দেখিয়ে আবার বরফির মত জাদুকর কে টাকা দিয়ে সে যুদ্ধের হুংকার বন্ধ হতে দেয় না। সৈন্যরা তো খেতেই পায় না। হাড় জিরজিরে চেহারা। ঘুমিয়ে পড়ছে ক্লান্তিতে, যুদ্ধে যাবে কি? তাদের লাভ কি বরং প্রাণ খুইয়ে আসতে হতে পারে। এমনকি সৈন্যরা কেউ সেনাপতির কথা না শুনে হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে থাকে। বয়ে গেছে তাদের যুদ্ধে যেতে! সেনাপতিও কিন্তু বলেই ফেলে “ সৈন্য কি না পাঠালেই নয়?...মানে, আমি বলছিলাম, যুদ্ধের কি খুব একটা প্রয়োজন আছে?” কিন্তু মন্ত্রী তো যাবেই। রাজ্য জয় করতেই হবে আর সৈন্যদের নিয়ে যেতেই হবে! অতএব আবার বরফিকে দিয়ে জাদু করিয়ে সৈন্যদের বাঁদরনাচ নাচিয়ে অট্টহাসি হেসে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পাঠায়।

ওদিকে রাজার নেশা কেটে গেছে যে, কয়েদখানায় বন্দী গুপীর গান শুনে আর বাঘার মাঝে মাঝে সমঝদারের মত সঙ্গত শুনে। তারা তো বলে দিয়েছে রাজার দুঃখ তারা বুঝতে পেরেছে। একটা প্রাসাদে সারাক্ষণ বন্দী থাকা তো বড় শাস্তি! খোলা মাঠে নেমে হাওয়া খেলেই যে রাজা শান্তি পাবে সাধারণ মানুষের মত এই কথা তারা গানে জানিয়ে দেয়। আর রাশি রাশি সোনাদানার মালিক হলেই যে সুখ শান্তি পাওয়া যায়না সেটাও তো তারা এই রাজাকে দেখে বুঝতে পারছে! নিজের প্রজাদের আর যাকে ইচ্ছে তাকে শাস্তি দিয়ে রাজার মনেও যে স্বস্তি হয় না, সেই হিংস্রতা যে শুধুই নেশার প্রভাবে তাও তো তারা বুঝতে পেরেছে! এই মিঠে সুরের গান শুনে তো রাজার মনের ভালো দিকগুলো আবার জিতে গেছে! তার মনে পড়ে গেছে শুণ্ডি রাজ্যে তার ভাই রয়েছে আর একজন দস্যু তাকে ...আর এই সময়েই মন্ত্রী জানায় সে নিজেই সেই দস্যু! রাজা প্রবল বেগে মাথা নেড়ে অস্বীকার করে যুদ্ধ করতে। জানায় “আমি যুদ্ধ করব না। আমি যুদ্ধ করব না-” কিন্তু বরফি আবার তাকে বেঁহুশ করে দিয়ে জানায় তিনদিনের আগে রাজার জ্ঞান ফিরবে না আর মন্ত্রী শুনে খুশি হয় কারণ এর মধ্যেই তার কাজ হাসিল আর তারপরে এই রাজাকে তার আর দরকার নেই। হয়ত মেরেই ফেলবে তাকে। সে বলে “রাজাবাবু তোমার মেয়াদ ফুরিয়ে এল।” কয়েদখানা থেকে গুপী বাঘা পালাতে পারে কারণ প্রহরী ওদের ভালো ভালো খাবার খেতে দেখে । প্রহরীও তো খেতে পায় না। শুধু মন্ত্রী ভালো ভালো খাবার খায় আর বাকীদের বলে “তোমরা সবসময় খাই খাই করো কেন বল তো? আজ বাদে কাল যুদ্ধ হবে। ... এর মধ্যে খাই খাই, খাই খাই...” নিজে মাংস খায় আর গুপী বাঘা যখন খুব বাজে একটা খাবার খেতে ইতস্তত করে তখন বলে “রাজ্যিসুদ্ধু লোক এ খাবার খাচ্ছে, আর এনারা কোথাকার নবাব-বাদশা এলেন! তোলো-তোলো!” গুপী বাঘা খায় কিছুটা কিন্তু মন্ত্রী চলে গেলে, পরে যখন প্রহরী ঘুমিয়ে পড়ে, তখন ভূতের রাজার বর কাজে লাগিয়ে ভালো ভালো পোনামাছ, ইলিশমাছ, মাংস, পটলের দোরমা সব আনিয়ে খেতে থাকে প্রহরী ঘুম ভেঙ্গে দেখে অবাক! সে কতদিন পেটভরে এমনি খাবারই খেতে পায় না আর এই সব ভালো ভালো পদ! সে তো জানে মন্ত্রীর শয়তানি! তাই যেই ওরা ওকে খাওয়ার প্রস্তাব দেয়, অমনি সে চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে খেতে থাকে আর ওরা এই সুযোগে পালায়। চটি তো পড়ে আছে সেইখানে যেখান থেকে ওদের ধরে এনেছিল গুপ্তচরের দল যখন ভরপেট খেয়ে বেচারারা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল! না হলে ওরা কয়েদ হয়ে থাকে! কখন পালিয়ে যেত এর হাতে ওর হাতে তালি দিয়ে! এখন ওদের কাছে বোবা মুখে ভাষা ফোটানোর ওষুধ রয়েছে যেটা মন্ত্রীর ঘরে বরফি এনেছিলো! যে ওষুধ এক চিমটে মাটিতে ফেলে আগুন জ্বালিয়ে দিতে হবে আর ধোঁয়া বেরোলে সারা রাজ্যে সেই ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লেই সবাই কথা বলতে পারবে আবার! ওরা বেরিয়েই দৌড়য় ওদের ফেলে আসা চটি আর ঢোলের সন্ধানে। তারপর সোজা সৈন্যদের কাছে পৌঁছে যায়! গান ধরে আর বলে এই আধপেটা খাওয়া সৈন্যরা বুঝি খিদের চোটেই মরে যাবে- তাদের চেহারা দেখে সেই ভয়টাই করে। আর তারপরেই প্রথমে যে বলেছিলাম? সেটাই জিজ্ঞেস করে তারা “ওরে হাল্লা রাজার সেনা তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল-... মিথ্যে অস্ত্রশস্ত্র ধরে প্রাণটা কেন যায় বেঘোরে। রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল, ওরে রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল- তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল!”

তারপরেই অভুক্ত সৈন্যদের জন্য নামিয়ে আনে হাঁড়ি বোঝাই মন্ডা মেঠাই কাঁড়ি কাঁড়ি আর সেই সব হাঁড়িতে আরও থাকে মিহিদানা, পুলিপিঠে, জিবেগজা মিঠে মিঠে আর যত সেরা মিষ্টি -সব কিছু বৃষ্টির মত ঝরে পড়ে। ব্যস! একটুও রক্তপাত না করে, গান গেয়ে সৈন্যদের ওপর বরফির জাদুর প্রভাব হটিয়ে দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েত করে দিল আমাদের ভালোমানুষ গুপী বাঘা! সব সৈন্যরা পাগলের মত মিষ্টি খেতে লাগল, মিষ্টির হাঁড়ি আঁকড়ে পড়ে রইল। সে তো সব ভূতের রাজার বরে আনা মেঠাই। বুঝতেই পারছো তার কিরকম স্বর্গীয় স্বাদ! রাজারও নেশা কেটে যায়! রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে তিনি ‘ছুটি ছুটি’ বলে দৌড়তে থাকেন আনন্দে। ব্যাটা দুষ্টু মন্ত্রীও একটা মিষ্টির হাঁড়ি আঁকড়ে ছিল কিন্তু সৈন্যদের পায়ের চাপে সেই হাঁড়ি ভেঙ্গে যায়। উচিত শাস্তি হয়। তারপর গুপী বাঘা রাজার জন্য একটা হাঁড়ি এনে তাকে দিয়ে রাজাকে মাঝখানে রেখে এর হাতে ওর হাতে তালি দিয়ে সোজা শুন্ডি! শুণ্ডির রাজাকে দেখেই হাল্লার রাজা “ভাইরে! তুই বদলাসনি!” বলে অবাক হয় আর শুণ্ডির রাজাও অবাক হয় ভাইকে দেখে! হাল্লার রাজা জানায় “সেই ব্যাটা দস্যু আমাকে সিংহাসনে বসিয়ে এক জাদুকরকে দিয়ে আমাকে ওষুধ খাইয়ে কী না করিয়েছে!” আমরা তো আগেই জানি সেই দস্যু আর জাদুকর মিলে কেমন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছিল! গুপীকে যে গোঁসাইখুড়ো একটা এমনি ফেলে দেওয়ার জন্য রেখে দেওয়া তানপুরার বিনিময়ে কত খাটিয়ে নিয়েও আবার জোরে কান মলা দিয়েছিল মনে আছে? তাই ভালমানুষকে দিয়ে দুষ্টূ লোকেরা কীভাবে কাজ করিয়ে নেয় আর অত্যাচার করে, তাতো গুপীর জানা! আর বাঘার তিনকূলে কেউ নেই কিন্তু তারও তো এক দশা ছিল গ্রামে...ফলে এরা মন্ত্রীর চালাকি-কেরদানি ধরে ফেলতে সময় নেয়নি। তাই ভাইয়ে ভাইয়ে মিল হয় আবার।

এদিকে গুপী বাঘা আগুনে সেই গুঁড়ো ওষুধ ফেলে দেয় আর সারা দেশে সেই ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। প্রজারা স্বর ফিরে পায়! আর শুন্ডির রাজা “কী আনন্দ! কী আনন্দ! কী আনন্দ! কী আনন্দ!” বলতে পারেন শুধু অবাক বিস্ময়ে, আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে।

তারপর রাজকন্যার বিষয়টা কী হল? ওটুকু তুমি দেখে নিও। শুধু একটা কথা ভুলো না যে, এই শুণ্ডি আর হাল্লা রাজ্যের মত সব দেশেরই সাধারণ মানুষ সুখ, চায়, শান্তি চায়, খেতের ফসল, পুকুরের মাছ চায় আর দু বেলা ভরপেট খেতে চায়। শিক্ষা চায়। হাল্লা রাজ্যের প্রজা, সৈন্য, প্রহরী, সেনাপতি এমনকী রাজাও যুদ্ধ চায়নি। শুধু দুষ্টু মন্ত্রী যে কিনা আসলে একটা দস্যু- সে ক্ষমতার লোভে যুদ্ধ চেয়েছিল, আর তাই সবাইকে আধপেটা খাইয়ে রেখে, রাজা প্রজা সবাইকে নেশা করিয়ে জাদুর ছড়ি ঘুরিয়ে নিজের ইচ্ছে মত কাজ করে নিত যাতে যুদ্ধ বাধে আর জাদুকর বরফি টাকার জন্য এই সব কুকর্মে মদত দিত! দুই ভাইয়ের কেউ যুদ্ধ চায় নি- ওই যে! “রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল!” দ্বন্দ্ব মানে বিরোধ, মারামারি, যুদ্ধ কিন্তু পরস্পরে যদি মিলে মিশে থেকে যুদ্ধের বিরোধিতা করা যায়? তাহলে হাল্লা রাজার মন্ত্রীর জারিজুরি ধরে ফেলতে আর তাকে থামিয়ে দিতে ঠিকই পারা যাবে।

ভূতের রাজার বর হয়ত পাওয়া যাবে না কিন্তু নিজেরা একজোট হলে আজকের এই ডিজিটাল যুগে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সশরীরে না পৌঁছতে পারলেও ভার্চুয়ালি বা কার্যত পৌঁছতে কত সময়ই বা লাগে! এই যে কিছুদিন আগেই আমাদের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ রব উঠেছিল, দুই দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষেরা একজোট হয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। তারা দুই দেশের বিভিন্ন শহরে একই দিনে, একই সময়ে পায়ে হেঁটে, ঘৃণা নয়, ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছিল। তারা আরও বলেছে পেট ভরানোর খাবার আর মানসিক বিকাশের শিক্ষা প্রয়োজন। চিকিৎসা প্রয়োজন সাধারণ মানুষের। পরিবেশ রক্ষা করা প্রয়োজন। যুদ্ধে যে পরিমাণ ক্ষতি মানুষের হয়, পরিবেশেরও সেই একই ক্ষতি হয়, যা আসলে আবার মানুষ-পশু-পাখি-জীব–জন্তু-গাছপালা নিয়ে তৈরি বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যকেই ধ্বংস করে দেয় সম্পূর্ণ রূপে। এই কথা হাজার হাজার মানুষ বলল আর সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে গেল নিমেষে। ভূতের রাজার বরের চেয়ে কম কি বল?

তাহলে যা বলছিলাম, রাজকন্যার বিষয়টা, ছবিটা না দেখে থাকলে, দেখে নিও, জেনে নিও। শুধু এটাই বলি যে রাজকন্যাদের জন্য অথবা মেয়েদের জন্য যুদ্ধ হয় এই কথা যদি কোথাও শোনো এই ছবির কথা মনে রেখো। কেমন? এখানে কোন রাজকন্যার জন্য যুদ্ধ হয় নি। যুদ্ধে থেমেছিল বলা যেতেও পারে কারণ গুপী বাঘার যুদ্ধ বন্ধ করার পেছনে রাজকন্যা লাভের একটা বিষয়ও জড়িয়ে ছিল! আর যারা যুদ্ধ বাধায় তারা সবসময়েই নিজের ক্ষমতার লোভ আড়াল করতে একটা না একটা অজুহাত খুঁজে বের করেই। ওই রাজকন্যা বা মেয়েরাও ওরকম একটা অজুহাত, যেমন মন্ত্রী রাজাকে সামনে রেখেছিলো যুদ্ধের অজুহাত হিসেবে! তাই চোখ-কান-মন আর বুদ্ধি খোলা রাখো আর মনে রাখো পঞ্চাশ বছর আগে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটির প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি বাক্য। দেখবে খুব সহজ ভাবে কেমন তুমি হানাহানির, যুদ্ধের বিরুদ্ধে গিয়ে শান্তির পক্ষে জোট বাঁধতে শিখে গেছ খুব তাড়াতাড়ি। সেদিন আবার আমরা একসঙ্গে বসে না হয় এই ছবিটা দেখব !

(ঋণ স্বীকারঃ গুগাবাবা বিশেষ সংগ্রহ; চিত্রনাট্য সত্যজিৎ রায় কাহিনি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী; সম্পাদনা সুমিতা সামন্ত সহযোগিতা সৌম্যেন পাল, সপ্তর্ষি প্রকাশন, জানুয়ারি ২০১৪)

 

ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট

মৌপিয়া অধ্যাপনা করেন। পাশাপাশি নানা জায়গায় বেড়াতে, খেতে এবং খাওয়াতে, দিশি-বিলিতি ছবি দেখতে আর বই পড়তে বড়ই ভালবাসেন। দুষ্টু-মিষ্টি কচিকাঁচাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চান। 'কুটুস' এর সাথে মৌপিয়ার নিত্যিদিনের ওঠাবসা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা