সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
অ্যান ফ্র্যাঙ্কের ডায়রি

১৯৪২ সালের ১২ জুন, অ্যান নামের হাসিখুশি মেয়েটা যেদিন তেরো বছর পূর্ণ করল, সেদিন বাবার কাছ থেকে জন্মদিনের উপহার পেল একটা লাল-সাদা খোপখোপ নকশার মলাট দেওয়া অটোগ্রাফ খাতা। অ্যান নিজেই সেটাকে কিছুদিন আগে পছন্দ করে এসেছিল। উপহার পেয়ে খুব খুশি হয়ে অ্যান ঠিক করল, এই নতুন খাতাটাই হবে তার নতুন ডায়রি। অ্যান শুরুর দিকে এই ডায়রিতে তার স্কুলের বন্ধুদের কথা, রোজকার জীবনের নানা ঘটনা লিখতে শুরু করে, ডায়রিকেই নিজের কাল্পনিক বন্ধু ভেবে নেয়। তার ডায়রির রোজনামচা বদলে যায় তার কাল্পনিক বন্ধু 'কিটি'কে লেখা চিঠিতে। নিজের মনের যে সমস্ত কথা সে আর কাউকে বলতে পারত না, এমন কী স্কুলের বন্ধুদের ও না, সেইসব কথা সে লিখে রাখতে শুরু করে তার ডায়রিতে।

ঠিক এক মাস পরে, বা সঠিক ভাবে বলতে গেলে, তারও আগে, ১৯৪২ সালের জুলাই মাসের ৬ তারিখে, অ্যান আর তার দিদি মার্গোট, তাদের মা ইডিথ ও বাবা অটো ফ্র্যাংকের সঙ্গে, সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ নিয়ে এক লুকানো জীবন বেছে নিতে বাধ্য হল। নিজেদের বাড়ি ছেড়ে , তারা গিয়ে আশ্রয় নিল অটো ফ্রাঙ্কের অফিসের একেবারে ওপরে লুকানো কয়েকটি ঘরে। অ্যানের ভাষায় সেই জায়গার নাম 'সিক্রেট অ্যানেক্স' - বাংলায় হয়ত বলা যেতে পারে লুকানো চিলেকোঠা। ক্রমে সেখানে ফ্র্যাঙ্ক পরিবারের সঙ্গে থাকতে আসে আরও চারজন মানুষ। লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁদের সবার প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিষের যোগান দিতেন অটোর বিশ্বস্ত কর্মচারীরা।

দীর্ঘ পঁচিশ মাস, আমস্টারডম শহরের সেই অফিস বাড়ির লুকানো চিলেকোঠায় বন্দীজীবন কাটিয়েছিল এই আটজন মানুষ। শেষে, ১৯৪৪ সালের অগাস্ট মাসের ৪ তারিখে, অ্যান পনেরো বছরের জন্মদিন পালন করার মাস দুয়েকের মধ্যেই তাঁদের সবার সেই লুকানো জীবন শেষ হয়।

করোনা ভাইরাসের ভয়ে আমরা সবাই ২০২০ সালে তিন-চার মাস করে লকডাউনে কাটালাম। ২০২১ সালেও চলছে লকডাউন। বন্ধ স্কুল, খেলাধুলো; বাতিল হচ্ছে পরীক্ষা। বাড়িতে বন্দী থাকতে হচ্ছে বলে, বেড়াতে যেতে পারছি না, সিনেমা হলে বা রেস্তোরাঁতে যেতে পারছি না বলে আমরা - ছোট-বড় সবাই — মাঝে মাঝেই একটু একটু করে বিরক্ত হয়ে যাই, হতাশ হয়ে যাই, অকারণে রেগে যাই বা কেঁদে ফেলি। যাদের সু্যোগ সুবিধা আছে তারা অনলাইন ক্লাস করছি, বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করছি, কিংবা ইচ্ছে হলে অনলাইনে গল্পের বই বা পত্রিকা পড়ছি, সিনেমা দেখছি। কিন্তু ১৯৪২ সালে তো এসব কিছুই ছিল না। সঙ্গে বন্ধ হয়েছিল অ্যানের স্কুল যাওয়া; আমস্টারডমের চওড়া রাস্তায় বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে স্কুল থেকে ফেরা; বা ঝিলের ধারে পাখি দেখার মত ছোট ছোট আনন্দ। এও তো ছিল একধরনের 'কোয়ারান্টাইন' থাকা বা অনিচ্ছা সত্বেও লকডাউনে বন্দী থাকার সমান। কিন্তু অ্যান, তার পরিবার বা বন্ধুদের কারোর তো কোনো অসুখ হয়নি, কোনো অজানা ভাইরাসের আক্রমণ ও হয়নি সেসময়ে। তাহলে কী হয়েছিল? এই পঁচিশ মাসে কেমন ভাবে বদলে গেছিল অ্যানের জীবন — বাড়িতে সবার থেকে ছোট বলে একটু বেশি আদরের অ্যান, যে ডায়রিতে মনের কথা লিখত, যে কিনা চেয়েছিল বড় হয়ে সাংবাদিক কিংবা লেখক হতে?

কেন অ্যানের পরিবারসহ আটজন মানুষ কয়েকটা লুকনো কুঠুরিতে আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হয়েছিল, আর কারাই বা তাদের ধরে নিয়ে গেল, বুঝতে হলে যেতে হবে খানিকটা ইতিহাসপাঠে । ফিরে যেতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিটলার এবং নাৎসিবাহিনীর কাজকর্মের কথায়। হিটলার এবং নাৎসিরা অন্যায়ভাবে ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করত, এবং তারা চেয়েছিল পৃথিবীর বুক থেকে ইহুদিদের পুরোপুরি সরিয়ে দিতে। তাদের ভয়েই জার্মান ইহুদী অটো ফ্র্যাঙ্ক তাঁর পরিবারকে নিয়ে আমস্টারডমে পালিয়ে চলে আসেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই নেদারল্যান্ডস্‌ ও চলে যায় নাৎসিদের কবলে। ফ্র্যাংকদের মত অন্যান্য ইহুদী পরিবারকে মেনে চলতে বাধ্য করা হয় নানা অন্যায় নিয়ম কানুন। শেষে যেদিন অ্যানের দিদি , ষোলো বছর বয়সী মার্গোটের নামে চিঠি আসে যে তাকে জার্মানিতে লেবর ডিউটি দিতে যেতে হবে, সেদিন অটো আর ইডিথ সিদ্ধান্ত নেন, পরিবারের কথা ভেবে এই লুকানো জীবন বেছে নেবেন। কারণ লেবার ডিউটি দিতে যাওয়া মানে আসলে গিয়ে পড়া কন্‌সেন্‌ট্রেশন ক্যাম্পে - যেখানে অসহায় ইহুদীদের নির্বিচারে হত্যা করত নাৎসি বাহিনী।

অ্যান ফ্র্যাঙ্কের ডায়রি

পঁচিশ মাস ধরে আত্মগোপন করে থাকা আটজন মানুষের জীবন কেমনভাবে কেটেছিল, জানার জন্য হাতের কাছে, বা বলা ভালো, মাউজের এক ক্লিকেই রয়েছে একটি অ্যানিমেটেড ছবি - 'অ্যান ফ্র্যাঙ্ক'স ডায়রি'। 'অ্যানিমে' শৈলীতে এই ছবিটি নির্মিত হয় ১৯৯৫ সালে। জাপানী ভাষায় এই ছবির নাম 'অ্যান নো নিক্কি' ; ১৯৪২-১৯৪৪ এর মধ্যে লেখা অ্যানের ডায়রিগুলির (The Diary of a Young Girl) ওপর ভিত্তি করে এই ছবির গল্প লেখেন হাচিরো কোনো এবং রজার পারবেস। ছবিটি পরিচালনা করেন আকিনোরি নাগাওকা। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন বৃটিশ সংগীত পরিচালক মাইকেল নাইম্যান।  ছবিটির প্রযোজনা করেন জাপানি অ্যানিমেশন স্টুডিও ম্যাডহাউজ।

কিন্তু যেকনো কারণেই হোক, এই জাপানী অ্যাডাপ্টেশন খুব বেশি জনপ্রিয় হয়নি। ১৯৯৯ সালে,  গ্লোবট্রটার নেটওয়ার্ক নামে এক ফরাসী প্রযোজনা সংস্থা, এবং এ টু এন প্রোডাকশন কমিটি,  সুইজারল্যান্ড এর অ্যান ফ্র্যাঙ্ক ফন্ডস্‌ —একত্রে মিলে এই ছবিটিকে নতুনভাবে সম্পাদনা করেন। অনেক বেশি সংলাপ যোগ করা হয়, ছবির সংগীত বদল করা হয় এবং ছবিটি ফরাসী ভাষাতেও প্রকাশিত হয়। এই নতুন সম্পাদিত ছবিটির নির্দেশক জুলিয়ান উলফ এবং নতুন করে সঙ্গীত সৃষ্টি এবং পরিচালনা করেন কারিন গাটলারনার। ১৯৯৯ সালেই এই ছবিটি শিকাগো আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে, চিল্ড্রেন জুরি প্রাইজেজ বিভাগে দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করে।

২০১৫ সালেই এই ছবিটি উত্তর আমেরিকায় অনলাইনে রিলিজ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। শেষ অবধি, ২০২০ সালের  ৩ মে, এই নতুনভাবে নির্মিত ছবিটির ইংরেজি সংস্করণ  বিনামূল্যে ইউটিউবে রিলিজ করা হয়।

ক্লাসিক সেল অ্যানিমেশন প্রক্রিয়া নির্মিত এই ছবিতে একটা হারিয়ে যাওয়া সময়কে অদ্ভূত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আমস্টারডম শহরের বিভিন্ন রাস্তাঘাট, পার্ক, বাড়িঘর, সেই সময়ের মানুষের পোষাক, যানবাহন ইত্যাদি সমস্ত কিছুকে পুরনো ছবি দেখে মিলিয়ে নির্মাণ করেছেন অ্যানিমেশন শিল্পীরা। সেই নির্মাণ এতই বাস্তবের কাছাকাছি যে দেখার সময়ে মনে হয় সেই সময়ের আসল আমস্টারডম শহরকেই দেখছি। তবে এই ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রগুলিকে যেভাবে আঁকা হয়েছে, সেগুলি আমার সব ভালো লাগেনি। যেমন আমার মনে হয়েছে, বাস্তব জীবনের অ্যান এই ছবির অ্যানের থেকে দেখতে অনেক বেশি মিষ্টি ছিল। এই ছবিতে সব চরিত্রগুলিই বড্ড কাঠের পুতুলের মত আঁকা। এছাড়া চরিত্রগুলির চলাফেরাতেও অল্প আড়ষ্টতা আছে। এটা হতে পারে যে নব্বই-এর দশকের জাপানি শিল্পীরা চল্লিশের দশকের ইউরোপীয়দের হাঁটাচলা সঠিভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন নি। এমন ও হতে পারে যে অ্যানের পরিবার এবং অন্যান্যদের মানসিক কষ্ট ফুটিয়ে তোলার জন্য, তাদের দমবন্ধ জীবন বোঝানোর জন্য ওইরকম আড়ষ্ট চরিত্র ইচ্ছে করেই সৃষ্টি করা হয়েছিল।

ইউটিউবে এই ছবিটির ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বেশ সহজ, শুনে বুঝতে অসুবিধা হবে না বলা যায়। বরং সঙ্গে যে ইংরেজি সাবটাইটেল আছে, সেটি প্রচুর ভুলে ভরা। ওই সাবটাইটেল না পড়াই ভালো। এমন একটা ছবিতে এত খারাপ সাবটাইটেল দেখব, ভাবিনি।

তবুও, সব মিলিয়ে, অ্যানিমেটেড ছবি হলেও, এই ছবিটি চারিত্রিক গুণে সেলুলয়েডে নির্মিত ছায়াছবির সঙ্গে পাল্লা দেয়। অ্যানিমেশন ছবি মানেই যে শুধুই নানারকমের সুন্দর ও মজাদার চরিত্রদের রহস্য রোমাঞ্চ হাসিতে ভরপুর জীবন নয়, খুব গভীর, কষ্টের এবং বাস্তব বিষয়কেও তুলে ধরা যায়, এই ছবি সেটা প্রমাণ করে। সঙ্গে সঙ্গে এই ছবিটি আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দেয় —জাত, ধর্ম বা অন্যান্য মানুষেরই তৈরি নিয়মের ভিত্তিতে আমরা কোনোদিন কোনো মানুষকে ঘৃণা করতে বা মেরে ফেলতে পারিনা, তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারি না। যারা সেরকম কিছু করে, তারা যতই ক্ষমতাশালী হোক, তারা অন্যায় করে।

নিজের বয়সের তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল ছিল কিশোরী অ্যান। সে নিজের মত করে যুদ্ধকে বুঝেছিল, নিজেদের জীবনের অসহায়তা বুঝেছিল। তবুও অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে, কষ্টকর বন্দীদশার মধ্যে থেকে, প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয়ে থেকেও সে জীবনকে যতটা সম্ভব উপভোগ করতে চেয়েছিল, তার ভাবনা, স্বপ্ন, আদর্শগুলোকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। তাই অতি সহজেই সে লিখে ফেলতে পারত এমন সব কথাঃ

How wonderful it is that nobody needs to wait a single moment before starting to improve the world.
Human greatness does not lie in wealth or power, but in character and goodness.
It's difficult in times like these: ideals, dreams and cherished hopes rise within us, only to be crushed by grim reality. It's a wonder I haven't abandoned all my ideals, they seem so absurd and impractical. Yet I cling to them because I still believe, in spite of everything, that people are truly good at heart.

বেঁচে থাকলে অ্যানের বয়স আজ হত বিরানব্বই বছর। যদি বেঁচে থাকতেন তিনি, তাহলে কি হয়ে উঠতেন বিখ্যাত কোনো সাহিত্যিক বা সাংবাদিক? কে জানে!

এই ছবিটি দেখার পরে, যদি আগে না পড়ে থাকো, তবে অবশ্যই পড়ে ফেলো অ্যান ফ্র্যাঙ্কের লেখা ' দ্য ডায়রি অফ এ ইয়ং গার্ল'। বিশ্বের প্রায় সত্তরটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে এই বেস্টসেলার বইটি এবং বহু স্কুলে এই বইটির কিছু অংশ বা পুরোটা পড়ানো হয়। আজ যখন আমরা সবাই নানারকমের মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে চলেছি, তখন অ্যানের মনের জোর আমাদেরও মনের জোর বাড়াবে না, কে বলতে পারে?

অ্যান ফ্র্যাংক আর তার ডায়রিকে নিয়ে আরও বেশি জানতে চাইলে দেখতে পারো এই দুইটি ওয়েবসাইট - https://www.annefrank.ch/en এবং https://www.annefrank.org/en/

অ্যান ফ্র্যাঙ্ক-এর ডায়রি পড়ার জন্য ডাউনলোড করতে পারো এই লিঙ্ক থেকেঃ https://freeditorial.com/en/books/the-diary-of-a-young-girl

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা