সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
মাই হোম ইজ গ্রীন

একটা ছোট্ট পিঁপড়ে। সে একা একা থাকে। ধ্যাত, পিঁপড়েরা আবার একা একা থাকে নাকি? যখনই দেখা যায়, ওরা তো কেমন সার বেঁধে চলতে থাকে; এদিকে সেদিক খাবারের এক কণা পড়ে থাকার যো নেই, অমনি ছেঁকে ধরে। কিন্তু না, এই পিঁপড়েটা সত্যিই একদম একা একা থাকে। আর সে খুব দুঃখী। একটা বিশাল দুনিয়ায় একলা থাকলে দুঃখ তো হবেই। একা একাই সে গাছ পাতার আড়ালে আবডালে ঘুরে বেড়ায়, একা একাই শীতের জন্য খাবার সংগ্রহ করে। আর একা একাই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে বারবারই ফিরে ফিরে আসে একটা দুঃস্বপ্ন। এক অদ্ভূত বৃষ্টির দুঃস্বপ্ন। এক ভয়ানক শব্দ, সঙ্গে বড় বড় সাদা, সাদা ফোঁটা আছড়ে পড়ছে মাটিতে, আর সাথে সাথে প্রাণ হারাচ্ছে তার যত প্রিয়জন- মা, বাবা, ভাই, বোন, প্রিয় বন্ধু...সব্বাই। কতক্ষণ ধরে চলেছিল সেই বৃষ্টি, সে আর মনে করতে পারে না। শুধু জানে, সে নিজে একটা ফলের খোসার তলায় আশ্রয় নিয়েছিল বলে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। সেই সাদা তরল ছুঁতে পারেনি তার দেহ। কিন্তু তারপরে? একা, একেবারে একা হয়ে গেল সে। আর দেখতে দেখতে একা থাকার অভ্যাস হয়ে গেল।

মাই হোম ইজ গ্রীন

একদিন সকালে খাবার খুঁজতে গিয়ে এক ছোট্ট সাদা বলের মত জিনিষ দেখতে পেল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই, তাকে অবাক করে দিয়ে, সেই সাদা বল ফেটে বেরিয়ে এল একটা অদ্ভূত দেখতে পুঁচকে প্রাণী। পিঁপড়ে বুঝতে পারল, সাদা জিনিষটা ছিল একটা ডিম। কিন্তু ডিম ফেটে যে বেরোলো, সে কে? এমন কোন প্রাণীকে তো সে দেখেনি আগে। এদিকে সেই বড় বড় চোখওয়ালা সবুজ ছানা তো সদ্য জন্মেই বেজায় কান্নাকাটি শুরু করে দিল। পিঁপড়ে তখন তড়িঘড়ি খুঁজে তাকে পছন্দমত খাবার এনে দেওয়ার চেষ্টা করল, তার মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল।

ধীরে ধীরে একলা পিঁপড়ে আর সেই আহ্লাদী সবুজ ছোট্ট পোকা, দুইজনের মধ্যে ভাব হয়ে গেল।দুজনেই একা, তাই রোজ একে অপরের সাথে দেখা হলে ভালোই লাগে। তাদের জীবনে নানারকমের ছোটখাটো রোমাঞ্চকর অভিযানও ঘটতে লাগলো। শেষে গিয়ে দুইজনের বন্ধুত্ব কোন দিকে মোড় নিল, সেটা জানতে হলে এই গরমের ছুটিতে দেখে ফেল মাত্র মিনিট চল্লিশের স্বল্পদৈর্ঘ্যের অ্যানিমেটেড ফিল্ম 'মাই হোম ইজ গ্রীন'/ পাচিলাকুডু। ছবিটির পরিচালক সাজন সিন্ধু। ছবিটির প্রযোজনা করেছে কোট্টায়ামের ডিজিটাল মিডিয়া নামক এক সংস্থা। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত। ইউটিউবে এই ছবিটি বিনামূল্যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু ছবিটা দেখা শুরু করার আগে, জেনে নেওয়া জরুরী কেন এই গল্পের ভাবনা পরিচালক এবং তাঁর বন্ধুদের মাথায় এসেছিল। কারণটা জানতে পারলে এটাও বুঝতে পারবে কেন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে এই ছবিটার খবর সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাইছি। ছবির শুরুতেই স্ক্রীনে ফুটে ওঠে এক বার্তা। এই ছবিটি কেরালার কাসারগোড জেলার এণ্ডোসালফান দুর্ঘটনায় মৃত শিশুদের উৎসর্গ করেছেন ছবির নির্মাতারা। কী হয়েছিল কাসারগোডের শিশুদের?

কেরালার কাসারগোড জেলা জুড়ে রয়েছে প্রচুর কাজু বাগান, যেখানে কাজুবাদাম চাষ করা হয়। ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সাল অবধি , এই বাগান গুলিতে সরকারের তরফ থেকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে স্প্রে করা হতে থাকে এন্ডোসালফান নামের এক কমদামি কীটনাশক। প্রায় ১২০০০ একর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বাগান গুলির মধ্যে রয়েছে ছোট ছোট অনেক গ্রাম। কিছুদিনের মধ্যেই এই সব গ্রামের বাসিন্দারা লক্ষ্য করেন তাঁদের নানারকমের অসুখ হচ্ছে যেগুলো এন্ডোসালফান ছড়ানোর আগে ছিল না। মরে যেতে থাকে মাছ, মৌমাছি,সাপ, ব্যাং, পাখি, গরু-বাছুর। মরে যায় অনেক গাছপালা। তারপরে গ্রামের গবাদি পশুরা জন্ম দেয় বিকৃত শরীরের শাবকদের। গ্রামের বাসিন্দাদের পরিবারে একাধিক শিশুর জন্ম হয় নানারকমের শারিরীক বিকৃতি সহ; তাদের বাড় বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয় না। তাদের মধ্যে অনেকেই সেরিব্রাল পলসি, এপিলেপ্সি, ক্যানসার, বিকলাঙ্গতা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়। বহু ছেলেমেয়ে অকালে প্রাণ হারায়। কেরালার কাসারগোড অঞ্চলে ওই পঁচিশ বছর ধরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ এন্ডোসালফানের প্রভাবে নানারকমের ভয়াবহ শারিরীক এবং মানসিক সমস্যায় ভুগেছেন। বদলে গেছে ওই এলাকার স্বাভাবিক জীবন। এন্ডোসালফান এমনই এক ভয়ঙ্কর বিষাক্ত কীটনাশক, যা বাতাসে ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে সংক্রমিত করতে পারে গর্ভবতী মায়ের শরীর। সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পরে, মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার সময়ে শিশুর শরীরে সেই দুধের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এই বিষ। এই ধরনের প্রত্যক্ষ সংক্রমণ ছাড়াও, এন্ডোসালফানের প্রভাবের আওতায় থাকা জল, শক-সব্জী, ফল, মাছ ইত্যাদি খাওয়ার ফলেও হতে পারে এই সংক্রমন।

এণ্ডোসালফান এক ভয়ানক কীটনাশক, যা পৃথিবীর ৮০ টি দেশে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই তথ্য জানা সত্বেও, ভারতে এন্ডোসালফানের উৎপাদন , বিক্রি এবং প্রয়োগ বিশ্বের মধ্যে সবথেকে বেশি। ভারতে এন্ডোসালফানের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার জন্য লড়াই চালিয়েছেন বহু মানুষ। ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট ভারতে এন্ডোসালফান উৎপাদন, বিক্রি এবং ব্যবহার পুরোপুরি ভাবে নিষিদ্ধ করে। তবে আমাদের দেশের সরকার সহ আরো অনেকেই এই নিষেধ সহজে মেনে নিতে চাননি। কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট এ বিষয়ে অনড়। ২০১৭ সালের মধ্যে ভারতে থেকে এন্ডোসালফানের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ কয়ে যাওয়ার কথা। সেটা সত্যি কতদূর হয়, আমাদের সেদিকেই লক্ষ্য রাখা দরকার।

'মাই হোম ইজ গ্রীন' দেখার সময়ে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে, সেখানে এন্ডোসালফানের কৌটো দেখানো হয়েছে। আর আমাদের গল্পের মূল চরিত্র পিঁপড়ে আর তার বন্ধু এন্ডোসালফানের হাত থেকে বাঁচতে পারলো কীনা, সেটা জানতে হলে ছবিটার শেষ অবধি দেখতে হবে।

এই ফিল্মটি প্রযুক্তির দিক থেকে খুব উন্নত নয়। কিন্তু এর ভাবনা আর বার্তা এতটাই জোরালো এবং আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায় যে ছোটখাটো সব খামতিগুলো আর চোখে পড়ে না।এই ছবির পরিচালক সাজন সিন্ধু এবং তাঁর দলের বাকি সদস্যদের মধ্যে অনেকেই প্রথমবার এইধরনের একটা কাজ করছিলেন। কিন্তু ইন্টারনেট দেখে পড়াশোনা করে করে, অক্লান্ত পরিশ্রম আর অধ্যাবসায় বজায় রেখে, তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা, মোট নয়জন, এক বছর চার মাশ ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তৈরি করেন এই ফিল্মটি।

মানবজাতি আজ দ্রুত অনেক বেশি টাকা রোজগারের তাগিদে, অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে, যা শুধু প্রকৃতি আর পরিবেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, সাথে সাথে মানুষের নিজের জীবনেও বিপদ ডেকে আনছে। 'মাই হোম ইজ গ্রীন' আমাদের সেইরকমেরই এক বিপদের কথা জানায়। এইধরনের নানা বিপদ থেকে কেমন ভাবে আমরা নিজদের এবং পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো, সেটা আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে।


ছবিঃ ইউটিউব/ অ্যানিমেশন এক্সপ্রেস

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা