সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

আমি যখন বেশ ছোট ছিলাম, মানে এই ধর ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি, সেই সময়ে অনেকটাই সময় ধরে, দূরদর্শনে শুক্রবার রাত ন'টায় একটা হিন্দি ধারাবাহিক হত। তার নাম ছিল "ইন্তেজার"। ইন্তেজার একটা ছোট্ট অপরিচিত রেল স্টেশনকে ঘিরে থাকা অনেক মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে এগিয়ে চলা এক ধারাবাহিক ছিল। স্টেশনের নতুন স্টেশনমাস্টার, লাইন্‌সম্যান, অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার, চায়ের দোকানে মালিক, রেল পুলিশ- এইসব অতি সাধারণ চরিত্রদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই ধারাবাহিক। এই ধারাবাহিকের গল্প পরম্পরা আমার প্রায় এখনো অনেকটাই মনে আছে, যদিও তার পরে দেখা আরো অনেক জমকালো গল্প সব ভুলে গেছি।

গল্পের সেই স্টেশনটি এতই ছোট এবং এমনই একটি রুটে, যে সেখানে সারাদিনে মাত্র দুটি ট্রেন থামে। মোট ট্রেন যা সেই পথ দিয়ে যায় তার সংখ্যাও নগন্য। তাই রেলের কর্মচারীদের হাতে অফুরন্ত সময়। ফলে দিনের অনেকটা সময়ই অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার, গার্ড এবং রেলের অন্যান্য কর্মচারি যে এক দুজন আছে, তারা আশেপাশের বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়। আর মাঝে মাঝেই তারা সবাই মিলে কবাডি খেলে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ওপর।

টিভির গল্পের চরিত্রদের কবাডি খেলতে দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম বলতে হবে - না হলে সেই ছবিটা আমার এখনো মনে আছে কেন? সম্ভবতঃ অবাক হয়েছিলাম কারণ আমি নিজেও তখন জোর কদমে কবাডি খেলতাম। রোজ বিকেলে বন্ধুদের সাথে পাড়ার মাঠে মুখে দম টেনে "কবাডি...কবাডি..." বলতে বলতে অপরপক্ষের কোর্টে গিয়ে কাউকে ছুঁয়ে চলে আসার নেশা ছিল সাঙ্ঘাতিক। সবসময়ে যে পারতাম এমন নয়, কিন্তু তাও হারজিতের থেকে ওই খেলার মজাটাই বেশি ছিল।

তাই এই মাত্র কিছুদিন আগে যখন ভারতে প্রথমবার প্রো-কবাডি লিগ অনুষ্ঠিত হল, তখন বেশ উৎসাহ নিয়েই দেখতে বসেছিলাম। ভারতে তো পুরুষদের ক্রিকেট ছাড়া আর কোন খেলা এবং সেই খেলার কৃতি খেলোয়াড়দের যথাযথ মর্যাদা এবং গুরুত্ব দেওয়া হয়না। তাই ইদানীং ফুটবল, ব্যাডমিন্টন , এসবের পাশে পাশে যখন কবাডিরও প্রফেশন্যাল লিগ শুরু হল, তখন আন্তরিকভাবেই খুশি হয়েছি। কবাডির কিন্তু অপেক্ষাকৃত নির্ঝঞ্ঝাট এক খেলা শুধুমাত্র একটা হুইসল চাই, দুই দলকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য। খেলোয়াড়দের আলাদা করে কোন বিশেষ আত্মরক্ষার সরঞ্জাম চাই না, খেলার জন্য আলাদা কোন ব্যাট বা বল লাগে না। আলাদা করে কোর্ট বা পিচ তৈরি করতে হয়না। শারীরিক শক্তি, ক্ষিপ্রতা, উপস্থিত বুদ্ধি- এইসব থাকলেই কবাডি খেলতে পারা যায়। আর ঠিক সেই কারণেই, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জেও কবাডি খেলা পরিচিত এবং জনপ্রিয়।

এক ঝলকে কবাডি খেলার ইতিহাস

ভারতে বা এই উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে কবাডি খেলা কবে থেকে শুরু হয়েছিল বা জনপ্রিয় হয়েছিল , সেট সঠিক ভাবে কেউই বলতে পারেন না। ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে মহারাষ্ট্রের অমরাবতীর হনুমান ব্যায়াম প্রসারক সমিতি প্রথম কবাডির আন্তর্জাতিক প্রদর্শন করেন। ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান অলিম্পিক গেম্‌স্‌-এ এই খেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৫০ সালে অল ইন্ডিয়া কবাডি ফেডারেশন স্থাপিত হয়। যেহেতু ভারতে দুই-তিন ধরণের আলাদা নিয়মে কবাডি খেলা হয়ে থাকে, তাই সেগুলিকে সম্মিলিত করে কবাডি খেলার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন তৈরি করা হয়। এরপরে ১৯৭৩ সালে ভারতের অ্যামেচার কবাডি ফেডারেশনও স্থাপন করা হয়।

কবাডিকে আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় করার জন্য জাপান, কোরিয়া বিভিন্ন দেশে কবাডি খেলা শেখানোর ব্যবস্থাও করা হয় ভারত থেকে। যেহেতু বিভিন্ন দেশের মাটি বিভিন্ন ধরণের, এবং সেই তফাত খেলার ধরণ ধারণেও তফাত ফেলে, তাই সবার মধ্য সমতা আনার জন্য বাইরে খোলা আকাশে খেলার বদলে ইণ্ডোর স্টেডিয়ামে সিন্থেটিক ম্যাটের ওপর, জুতো পরে খেলার ব্যবস্থাকেও ক্রমশঃ প্রাধাণ্য দেওয়া হতে থাকে।

১৯৮০-র দশক থেকেই ভারত এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতে থাকে, এই খেলাকে জনপ্রিয় করার জন্য। ১৯৯০ সালের বেইজিং এশিয়ান গেম্‌স্‌ এ কবাডিকে প্রথম একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারত, চীন , জাপান, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান বাংলাদেশ- এই দেশগুলি সেই এশিয়ান গেম্‌স্‌ এ কবাডিতে অংশ নেয়, এবং ভারত স্বর্নপদক লাভ করে। এর পরে পরপর ছয়টি এশিয়ান গেম্‌স্‌ -এ ভারতই বাদ বার স্বর্নপদক জিতে আসে।

এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, কবাডি হল বাংলাদেশের জাতীয় খেলা।

প্রো কবাডি লীগ

যদিও আন্তর্জাতিক কবাডি ফেডারশনের তালিকায় ৩৪টি দেশের নাম আছে, কিন্তু আদতে ভারতের আশেপাশের কয়েকটি দেশ ছাড়া ইরান, জাপান, কোরিয়া- এই দেশগুলিতে কিছু মানুষ কবাডির খেলার নাম শুনে থাকলেও, বেশিরভাগ দেশের মানুষ কিন্তু কবাডি খেলা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আর তাই-ই, কবাডি খেলাকে আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত ও জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্য নিয়েই স্টার স্পোর্ট্‌স্‌-এর সহযোগিতায় ভারতের মশাল স্পোর্টস্‌ নামক সংস্থা এই বছরে প্রথম আয়োজনে করে প্রোফেশন্যাল কবাডি লীগ-এর। উৎসাহ দেওয়ার জন্য পাশে ছিলেন ক্রিকেট এবং সিনেমা দুনিয়ার জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরা। অন্যান্য প্রিমিয়ার লীগের ধাঁচেই ভারতের আটটি শহরের নামে আটটি দল বানানো হয়। শহরগুলি হল মুম্বই, জয়পুর, কলকাতা, দিল্লি, পুনা, বেঙ্গালুরু, পটনা আর ভাইজ্যাগ। এই দলগুলিতে যোগ দিয়েছেন শুধুমাত্র ভারত, পাকিস্থান, বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরাই না, সাথে আছে কোরিয়া, ইরান এবং ইংল্যান্ড-এর থেকে আসা খেলোয়াড়েরাও ! প্রো-কবাডি লীগের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি দলে ১২ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে তিন জন করে আছেন অন্যান্য দেশের খেলোয়াড়।

ওয়ার্ল্ড কবাডি লীগ

প্রো-কবাডি লীগ শেষ হতে না হতেই গত ৯ই আগস্ট শুরু হয়ে গেছে, কবাডির আরো বড় এক প্রতিযোগিতা - ওয়ার্ল্ড কবাডি লীগ। ওয়েভ নামক সংস্থা এর শিরোপা সম্মানের স্পন্সর বলে এই লীগকে ওয়েভ ওয়ার্ল্ড কবাডি লীগও বলা হচ্ছে। ২০১৪ সালেই এই সার্কেল স্টাইল কবাডি লীগ প্রথম খেলা হচ্ছে। সারা পৃথিবীর বাছাই ১৪৪ জন খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি হয়েছে আটটি আন্তর্জাতিক দল। এই দলগুলি ভারত, পাকিস্থান, কানাডা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যান্ডের ১৪টি বিভিন্ন শহরে - নিয় ইয়র্ক, লন্ডল, টরন্টো, ভ্যাঙ্কুভার, স্যাক্রামেন্টো, লুধিয়ানা, অমৃতসর, দিল্লি, লাহোর তাদের মধ্যে কয়েকটি নাম- চার মাস ধরে লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ম্যাচগুলি খেলবেন। ওয়ার্ল্ড কবাডি লীগের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, ফাইনাল খেলা হবে ৩০শে নভেম্বর, পাকিস্থানের লাহোরে। ওয়ার্ল্ড কবাডি লীগের তিনটি দলের মালিক হলে ভারতের বিনোদন দুনিয়ার তিন পরিচিত নাম- অক্ষয় কুমার, সোনাক্ষী সিন্‌হা আর ইয়ো ইয়ো হানি সিং। ভারতীয় উপমহাদেশের দর্শকেরা ছাড়াও, এই লীগ নিয়ে তুমুল উৎসাহ ছড়িয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অনাবাসী ভারতীয়দের মধ্যে। বিদেশের মাটিতে দেশের স্বাদ মেটানোর জন্য তাঁদের অনেকের কাছেই কবাডি এক প্রিয় খেলা।

পরিশেষে...
আজকাল আর বিকেলবেলা খেলার সময় কোথায় তোমার বল? স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসেই কোন না কোন স্যার বা দিদিমণির কাছে কিছু না কিছু নিয়ে পড়তে বসাই নিয়ম। যদিও বা কেউ কেউ খেলা করার সুযোগ পাও, কবাডি যে খেলোনা সেটা আমি জানি। তোমাদের দৌড় ক্রিকেট বা ফুটবলেই সীমাবদ্ধ। সব স্কুলেও হয়ত কবাডি খেলা নিয়ে বিশেষ উৎসাহ দেওয়া হয়না। কিন্তু এই খেলা হল শরীর-স্বাস্থ্য তৈরি করার এক সহজ উপায়। নিয়ম করে যোগব্যায়াম বা এরোবিক্‌স্‌ , কারাটে বা জুডো করতে আর কার ভাল লাগে? যদি তুমি শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য এইসবের কোন ক্লাস কর, অথবা নাও কর, তাহলেও কিন্তু খেলতে পার কবাডি। সারাটা শরীর এবং মনকে এক সাথে সচল রাখার মত এত সহজ খেলা খুব কমই আছে। আর হ্যাঁ, যদি এই মূহুর্তে চলতে থাকা ওয়ার্ল্ড কবাডি লীগের খেলা দেখতে চাও, তাহলে কবে কাদের খেলা হচ্ছে দেখার জন্য চোখ রাখ তাদের ওয়েবসাইট, ওয়ার্ল্ডকবাডিলীগ ডট নেট - এর পাতায়।


তথ্যসূত্র ও ছবিঃ
প্রোকবাডি ডট কম
ওয়ার্ল্ডকবাডিলীগ ডট নেট
ডিএনএইন্ডিয়া ডট কম
স্ক্রল ডট ইন
এবং অন্যান্য আরো অনেক ওয়েবসাইট

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা