খেলাঘরখেলাঘর

সুমো খেলা শুরু হয়েছিল জাপানে। আর জাপানই একমাত্র দেশ যেখানে সুমো পেশাদারীভাবে খেলা হয়। সুমোকে বলা হয় আধুনিক জাপানি মার্শাল আর্ট, কিন্তু সুমোর চর্চা বহুযুগ ধরে জাপানে হয়ে আসছে। বহু শতাব্দী আগে থেকেই জাপানের নিজস্ব শিন্টো ধর্মের সাথে সুমো জড়িয়ে আছে। প্রায় ১৫০০ বছর আগে থেকে সুমো খেলা হয় ভাল ফসলের প্রার্থনায়।আজকের দিনের সুমো খেলাতেও অনেক প্রাচীন নিয়ম কানুন মেনে চলা হয়, যেমন খেলা শুরুর আগে নুন ছোঁড়া।জাপানের কিছু কিছু শিন্টো নিয়মের মধ্যে একটা হল এক বিশেষ ধরনের নাচ, যেখানে বলা হয় মানুষ শিল্পী এক দৈবী আত্মা 'কামি'-র সাথে কুস্তি করছেন।

ছবি
সুমো খেলার মঞ্চ-দোহিও

সুমো খেলা হয় এক গোলাকার রিং এর মধ্যে, তার নাম দোহিও। দোহিওর ব্যাস ১৪.৯ ফিট আর তার আয়তন ১৭৫ বর্গ ফিট। এই রিং তৈরি হয় কাদা, বালি আর খড়ের গাদা দিয়ে।প্রতিটা টুর্নামেন্ট এর আগে নতুন করে দোহিয়ো বানানো হয়। দোহিওর মাঝখানে থাকে দুট সাদা দাগ। খেলা শুরুর আগে দুই প্রতিযোগী এই দাগদুটির দুইপাশে দাঁড়ান। রিং এর মাপ বললাম আর খেলোয়াড়দের চেহারা নিয়ে বলব না? সুমো কুস্তীগীরেরা মোটামুটি ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা হল, আর তাঁদের ওজন ১৮০ কেজির আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। সুমো প্রতিযোগিতা হয় দুই প্রতিদ্বন্দীর মধ্যে। নিয়ম অনুযায়ী, খেলোয়াড়েরা মাটিতে পায়ের পাতা ছাড়া আর কিছু ঠেকাতে পারবেন না। প্রতিযোগীরা চেষ্টা চালাতে থাকেন অন্যজনকে এমনভাবে পাকে ফেলার যাতে তাঁর শরীরের অন্য কোন অংশ মাটিতে ঠেকে যায়। আবার এটাও নিয়ম যে, যিনি আগে অন্যজনকে ঠেলে রিং এর বাইরে ফেলতে পারবেন, তিনিই বিজয়ী। তাই দেখতে গেলে, সুমো খেলার নিয়ম কাকুন এমন কিছু কঠিন হয়। বেশিরভাগ ম্যাচ কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।

ছবি
প্রতিযোগিতা চলছে

পেশাদারী সুমো টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছিল ১৬৮৪ সালে, টোমিওকা হাচিমান উপাসনালয়ে। পেশাদারী সুমোর ছয়টি ডিভিশনআছে - মাকুচি, জুরিয়ো, মাকুশিতা, সান্দানমে, জোনিদান আর জোনোকুচি। কুস্তীগীরদের প্রথম নাম লেখাতে হয় সবথেকে নিচের জোনোকুচি ্ডিভিশনে। কঠিণ পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তারা ওপরের বিভাগ গুলিতে উঠতে পারে।

এই নিচের বিভাগের কুস্তীগীরদের বলা হয় রিকিশি। রিকিশি হওয়া কিন্তু সহজ নয়। বরং বেশ কঠিণ। তুমি যদি রিকিশি হতে চাও, তাহলে তোমাকে প্রচুর নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে। তার মধ্যে প্রথম হল সমবেত ভাবে সুমো প্রশিক্ষনের জায়গায় থাকা। জাপানী ভাষায় এই সুমো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিকে বলে হেয়া। কুস্তীগীরদের কিভাবে থাকতে হবে, সেই বিষয়ে সুমো অ্যাসোসিয়েশনের বেশ লম্বা একটা ফিরিস্তি আছে। তার মধ্যে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হল এইরকমঃ
- কুস্তীগীরেররা নিজেদের গাড়ি নিজেরা চালাতে পারবেন না।
- সুমো কুস্তিগীর হতে গেলে, তাঁদের লম্বা চুল রাখতে হবে, যাতে প্রাচীন সামুরাইদের মত মাথার ওপরে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখতে পারেন।
- জনসাধারণের সামনে বেরোলে মাথায় ওই ঝুঁটি, যার জাপানী নাম 'চোনমাগে' , এবং তার সাথে প্রথাগত জাপানী পোষাক পরে বেরোতে হবে।
-কুস্তিগীরদের খ্যাতি এবং ক্ষমতা অনুযায়ী তাঁদের পোষাকের ধরণ নির্ভর করবে।
-যারা রিকিশি, তাদের সবার আগে, ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে প্রশিক্ষনের জন্য। যাঁরা অভিজ্ঞ সেকিতোরি তাঁরা সাতটা থেকে শুরু করতে পারেন।
- শিক্ষানবীশ রিকিশিদের পোষাক হিসাবে দেওয়া হয় শুধুমাত্র পাতলা সুতির একটা আলখাল্লা, আর কিছহু না। এমনকি ঘোর শীতেও তাঁদের খালি ওই পোষাক পরে থাকতে হয়। বাইরে বেরোলে তারা পরে একধরনের কাঠের তৈরি চটি, যেটা পরে হাঁটলেই ক্লিপ-ক্লপ করে আওয়াজ বেরোয়।
-মাঝারি বিভাগের কুস্তিগীরদের এই আলখাল্লার ওপরে একটা ছোট ওভারকোট আর কাঠের বদলে খড়ের চটি পরার অনুমতি দেওয়া হয়। যাঁরা বেশি অভিজ্ঞ কুস্তীগীর, অর্থাৎ সেকিতোরি, তাঁরা নিজেদের পছন্দমত সিল্কের আলখাল্লা পরতে পারেন। তাঁদের মাথার ঝুঁটিও অনেক বেশি কায়দাকরে বাঁধা হয়।
-রিকিশিদের সকালবেলার জলখাবার দেওয়া হয় না। তারা একেবারে দুপুরে প্রচুর মাছ-মাংস-সব্জী-ভাত এবং বিয়ার খেয়ে ঘুমায়। কেন জান? কারণ যাতে তাদের ওজন বাড়ে , এবং কুস্তী করতে সুবিধা হয়।
-রিকিশিদের আরো অনেক কাজ করতে হয় - রান্নায় সাহায্য করা, ধোয়া-কাচা করা, পড়াশোনা করা। তারা চাইলেই বাইরে যেতে পারে না। এইসব কারণে পেশাদারী সুমোতে নাম অনেকেই লেখায় বটে, তবে প্রথম ধাপ পেরোনোর আগেই ছেড়ে চলে যায়।

ছবি
ইয়োকজুনারা মঞ্ছে প্রবেশ করেন আলাদা আড়ম্বড়ের সাথে

পেশাদারী সুমোর সবথেকে বড় উপাধি হল ইয়োকোজুনা। অনেক পরিশ্রম করে এবং অনেক ধাপ পেরিয়ে ইয়োকোজুনা হওয়া যায়। একটা মজার ব্যাপার হল, কেউ যদি একবার গ্র্যান্ড মাস্টার বা ইয়োকোজুনার উপাধি পান, তাহলে তাঁকে সব টুর্নামেন্ট-এ জিততে হবে, কারণ, তিনি নিজের উপাধি কাউকে দিতে পারবেন না। তাই সাধারণতঃ ইয়োকোজুনা হয়ে গেলে সেই কুস্তীগীর খেলা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

আগে সুমো একমাত্র জাপানীরাই পেশা হিসেবে নিতে পারতেন। ইদানীং অন্যান্য দেশের কিছু খেলোয়াড়দের সুমো কুস্তীগীর হতে দেওয়া হচ্ছে। অ্যামেচার সুমো খেলাও অনেক দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

মহাশ্বেতা রায়
তথ্যঃবিভিন্ন ওয়েবসাইট
ছবিঃউইকিপিডিয়া

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।