খেলাঘরখেলাঘর

(গত সংখ্যার পরবর্তী অংশ)?

এত সব ধরনের আয়না, যে সব হাসিঘরে দেখলাম---- তা কিন্তু এমনি এমনি বানানো হয়নি। কোনও কোনটা হয়ত কাজে লাগে না, বাকীগুলো কিন্তু কাজের। যেমন, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন দূরবীক্ষন , অনুবীক্ষন ---প্রভৃতি যন্ত্রে খুব ব্যবহৃত হয় বিশেষত, অবতল আয়না। গাড়ীর কথা ত আগেই বলেছি। এছাড়া আছে পেরিস্কোপের মত যন্ত্রও।

পেরিস্কোপের কথায় মনে পড়ল ছোট বেলার একটা ঘটনার কথা। এখন যেমন বড় বড় ফুটবল খেলা হয় বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রিড়াঙ্গনে, তখন হত ময়দানের তিনটি কাঠের গ্যালারীঘেরা ছোট মাঠে, অবশ্য এখনও হয়। এইসব মাঠের তিনদিক ঘেরা থাকলেও একদিক থাকত উন্মুক্ত, কিন্তু সেখানে থাকত কাঁটাতারের বেড়া। একে বলে 'র‌্যাম্পার্ট'। ভিড়ের দরুন যারা টিকিট পেত না তারা এখানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখত। কিন্তু সেখানেও খুব ভিড় হত, ফলে পেছনের দর্শকেরা সবার ঘাড় ডিঙ্গিয়ে প্রায় কিছুই দেখতে পেত না।

তখন ওরা কি করত জান ? কাছে গাছতলায় বসে থাকা দু'একজন ব্যবসায়ির কাছ থেকে পেরিস্কোপ ভাড়া নিয়ে আসত সস্তায়। এই পেরিস্কোপগুলো অতি সরল এক একটি যন্ত্র, কিন্তু সরল হলেও বেশ কাজের। এমন যন্ত্র তোমরাও বাড়িতে তৈরী করতে পারবে। কি করে করবে সেটা বলি এখন।

ছবি
পেরিস্কোপ তৈরি হয় এইভাবে

একটা কাঠের ফ্রেম বানাতে হবে, যেটা হবে আয়তাকার (rectangular), যার বাহুগুলির দৈর্ঘ দেড় থেকে দু' ফুট আর প্রস্থ সাত আট ইঞ্চির মত। যে কাঠ দিয়ে বানাবে সেটা কিন্তু ইঞ্চিদেড়েকের মত চৌকো হতে হবে। ফ্রেম তৈরী হবার পর দু'খানা ইঞ্চিছয়েক দীর্ঘ ভাল আয়না যোগাড় করে নাও। বাড়িতে থাকলে ভাল, না হলে দোকান থেকে কেনা ছাড়া উপায় নেই।

এবার প্রস্থ-বাহুদুটির সাথে আয়না দুটি আটকে নিতে হবে এমন ভাবে যাতে তারা ফ্রেমের দৈর্ঘ-দন্ডের সাথে ৪৫ ডিগ্রী কোণ করে থাকে। আর ওপরের আয়নার সোজা দিক ( মানে চকচকে দিক) যেন যা দেখতে চাইছ সেদিকে আর নীচের আয়না তোমার দিকে থাকে। (ফ্রেমের সাথে আয়না আটকানো একটু ঝামেলার ব্যাপার, বড়দের সাহায্য নিতে হবে)। ব্যস হয়ে গেল পেরিস্কোপ। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দুরের জিনিষ দেখতে চাইলে, সবার মাথার ওপর দিয়ে ওপরের আয়নাটা বাড়িয়ে দাও আর নীচের আয়নায় চোখ রাখ, যা দেখতে চাও নির্বিবাদে দেখে যাও।

অন্য ভাবেও করতে পার, একটা কার্ডবোর্ডের দীর্ঘাকৃতির বাক্সের (জুতোর বাক্সের মত) দু'প্রান্তের বিপরীত দিকে চৌকো করে খানিকটা করে কেটে নিয়ে, ঠিক আগের মত করে আয়না আটকে নিলেই তৈরী হয়ে গেল পেরিস্কোপ।**

ডুবোজাহাজের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই, যে কিনা ডুবে ডুবে জলের নিচ দিয়ে চলে। কিন্তু ওপরে, মানে জলের ওপরে, কি হচ্ছে মাঝে মাঝে দেখার দরকার হয়ে পড়ে। তখন তাকে জলের ওপর ভেসে উঠতে হয়। কিন্তু কয়েক বার উঠতে গেলে হয়েছে আর কি। সময় আর জ্বালানীর অনর্থক অপচয়। কিন্তু এর প্রতিকারের কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল পেরিস্কোপের কথা। বিশেষ ধরনের পেরিস্কোপ তৈরী করা হল। একটা জলরোধী দীর্ঘ ধাতব নলের দু'প্রান্তে ভাল আয়না লাগিয়ে তৈরী হল সেই পেরিস্কোপ, ঠিক যেমন করে ওপরের পেরিস্কোপ বানাবার কথা লিখেছি তেমন করে। একে প্রয়োজন মত জলের তলায় চলতে থাকা অবস্থায় ওপরের দিকে ঠেলে তুলে জলের ওপরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সহজেই নীচে জাহাজে বসে জানতে পারা যায়।

ছবি
ডুবোজাহাজ-জলের ওপর বেরিয়ে আছে পেরিস্কোপ

সমতল আয়না দিয়ে সুর্যের আলোকে প্রতিফলিত করা যায় এটা জান ত ? এরকমভাবে কতকগুলো (ধর ৫/৬ খানা) আয়না দিয়ে সুর্যের আলো প্রতিফলিত করে যদি এক জায়গায় ফেলা যায়, তাহলে সেই জায়গাটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, এমন গরম হতে পারে যে তাতে রান্নাও করা যেতে পারে! অবতল আয়নায় প্রতিফলিত করলেও সুর্যের আলো এক জায়গায় মিলিত হয়ে সেই জায়গাটাকে অত্যন্ত গরম করে ফেলে, গায়ে পড়ে ফোস্কা পড়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই ! উত্তল আয়নায় অবশ্য এমন হওয়ার উপায় নেই।

কাচে আলোর প্রতিফলন হলে আয়নার ভেতরে আমরা নিজের বা বাইরের অন্য কিছুর যে ছবি দেখি তাকে বলে প্রতিবিম্ব।

আচ্ছা, এটা কখনও ভেবে দেখেছ যে কেবলমাত্র কাচনির্মিত আয়নাতেই কেন প্রতিফলন হয়, আর প্রতিবিম্ব তৈরী হয় ? কাঠে বা কাগজেও ত হতে পারত ! তাই কিনা বল ? কিন্তু হয় না। কেন হয়না সেটা ত জান না! আসলে কাঠ বা কাগজের তল একেবারেই অমসৃন, তা তুমি যতই পালিশ করে চকচকে করার চেষ্টা কর না কেন।

প্রতিফলক, মানে যাতে প্রতিফলন হয়, অর্থাৎ আয়নার মত জিনিষ সর্বদাই মসৃন হতে হয়। এমন কটা মসৃন তলের কথা জান যাতে ভাল করে প্রতিবিম্ব তৈরী হয় না ? আমি কিন্তু কয়েকটার কথা বলতে পারি। যেমন, কোন বাটিতে বা থালায় রাখা জল যদি স্থির থাকে তবে জলতল মসৃন (পুকুরের স্থির জলতলও মসৃন, ঢেউ থাকলে অমসৃন); শ্বেতপাথরের মেঝেতে জল পড়লে মেঝে কিছুটা মসৃন হয় ( ফলে আংশিক প্রতিফলন হয়)। এছাড়া স্টেনলেস স্টীলের নতুন থালা মসৃন ( তবে স্টীলের থালা এমন মসৃন নয় যে পরিষ্কার প্রতিবিম্ব তৈরী হয়)। এমন সব প্রতিফলক থেকেই আংশিক প্রতিফলনের জন্য অস্পস্ট প্রতিবিম্ব তৈরী হয়। এরকম আরও প্রতিফলক আছে যারা আংশিক প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রতিবিম্ব তৈরী করতে পারে তাদের নাম মনে আসছে না এখনই। জলতল খুব মসৃন হলেও যেহেতু জলে আলো পড়লে তা অনেকটা শোষিত হয়ে যায়, তাই প্রতিফলন হলেও সেটা খুব উজ্জ্বল হয় না। আর একটা উদাহরণ দিই। মুল্যবান ম্যাগাজিন বা সাময়িকপত্র ছাপা হয় একরকম কাগজে, যা রীতিমত মসৃন এবং চকচকে, কিন্তু একেবারেই প্রতিফলন হয়না। কেন হয়না বল দেখি। বলি সেটা।

অনুবীক্ষণ যন্ত্র দেখেছ ? স্কুলের উঁচু শ্রেনীতে যারা পড়ে তারা দেখে থাকবে। সেই যন্ত্রের তলায় এক টুকরো ঐ চকচকে কাগজ রেখে দেখলে হঠাৎ মনে হতে পারে, আরে! কোন খানাখন্দে এসে পড়লাম নাকি! এত অমসৃন ঐ কাগজের চকচকে তল! তাহলে এতে আর প্রতিফলন হবে কি করে ?

আমাদের ধারনা ধাতু সাধারনত এবরো-খেবরো বা অমসৃন হয়, কিন্তু মনে কোরো না যে ধাতুকে মসৃন করা যায় না। এক রকমের সংকর ধাতুকে পালিশ করে করে এমন মসৃন আর চকচকে করে ফেলা যায় যে সেই ধাতুকে আয়নার মত ব্যবহার করা যায়, যা কিনা কাচের আয়নার থেকেও উজ্জ্বল আর নিখুঁত প্রতিবিম্ব গঠন করে।

ছবি
আরানমুলার ধাতুর আয়না

প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের দেশের কেরালা প্রদেশে, আরানমুলা বলে একটা জায়গা আছে যেখানে কয়েকটি পরিবার পুরুষানুক্রমে এই আয়না প্রস্তুত করে, এবং দেশবিদেশের মানুষ সেগুলো সংগ্রহ করেন। ইচ্ছে করলে তোমরাও পার।

এখন এই পর্যন্ত থাক ?

আয়নায় প্রতিফলন নিয়ে আরও কথা জানতে পারবে যদি বড় হয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে উঁচু শ্রেনীতে পড়।

সন্তোষ কূমার রায়
কোদালিয়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা

ছবিঃউইকিপিডিয়া

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।