খেলাঘরখেলাঘর

চাঁদু

--‘চাঁদু,তোর খিদে পেয়েছে?’ঘরের গিন্নীমা চাঁদুকে ডেকে বললেন। অমনি চাঁদু মুখ কাঁদু কাঁদু করে মুখটা একবার ওপরে ওঠাল, একবার নিচে নামাল, তার মানে,হ্যাঁ,ওর খিদে পেয়েছে।
গিন্নীমা ওর রকম সকম দেখে হাসে,তারপর ঘরের ভিতর থেকে দুটো পাকা কলা এনে তার একটা চাঁদুর হাতে দেন।ও সঙ্গে সঙ্গে কলা ধরে নেয়,তারপর সেটা ছুলে খেয়ে ফেলে।
--‘আর একটা খাবি চাঁদু?’আবার গৃহিণী মা প্রশ্ন করেন।
আমার চাঁদু তেমনি আগের মত মাথা নাড়িয়ে ওঠে। গৃহিণীর হাতের কলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
ইচ্ছে করেই গিন্নীমা নিজের হাতে কলাটা ধরে থাকেন--চাঁদু কি করে,দেখবেন বলে।
না,চাঁদু বাঁদরামো করল না--লাফাল না,ঝাঁপাল না—গিন্নীমার দিকে এগোল না--কলাটা নেবে বলে।এখনো কেন দিচ্ছেন না--এ ধরণের কোন প্রতিবাদই ও করল না।শুধু মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কলার দিকে তাকাতে লাগল।অবশেষে গিন্নীমা ওর কাছে এসে ওর হাতে কলা তুলে দিলেন--ওর গলায়,মাথায় আদর করে দিলেন।চাঁদু আদর খেতে খেতে মুহূর্তের মধ্যে কলা ছুলে মুখে পুরে দিল।
--‘দুষ্টু কোথাকার,আমার আদরের বাঁদর!’বলে চাঁদুকে খানিক আদর করে নিজের কাজে অন্য ঘরে চলে গেলেন।
রবিবার গৃহ কর্তার ছুটি,মনে হয় সে দিন চাঁদুরও যেন ছুটি!স্কুলের যেমন ছুটি হয় সপ্তাহে এক দিন ঠিক তেমনি যেন ওরও ছুটি।ওর গলায় সে দিন চামড়ার বেল্ট কিম্বা অন্য কোন কিছুর বন্ধন থাকে না।সুবিধা,অসুবিধা সব ঘরের কর্তাই সামলে নেন। চাঁদু দুষ্টুমি বিশেষ একটা করে না,ঘরের বাইরে বেরোবার বিশেষ কোন প্রচেষ্টা ওর মধ্যে নেই।কর্তা সময়ে সময়ে ওর খবর নিয়ে যান,কখনো হয় তো জিগ্যেস করেন,‘কেমন আছিস চাঁদু--চাঙ্গা তো?’
--‘হু,হু’,ধরণের শব্দ করে ওঠে চাঁদু।কর্তাবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে।আর তাঁকে ঘিরে এপাশ ওপাশ ঘুরতে থাকে।কর্তা ওকে সপ্তাহে দু,তিন দিন স্নান করিয়ে দেন।অনেক সময় সাবান,শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করে ও।না,তাতে কোন আপত্তি নেই তার--দিব্বি কল তলায় দাঁড়িয়ে গায়ে জল নেয়।আর কর্তার দিকে মিটি মিটি তাকাতে থাকে।ওকে দেখলে বোঝা যায় যে ও স্নান করে বেশ মজা পাচ্ছে!
ঘরে কর্তা,গিন্নী--দু জনের সংসার।না,এমনি বলাটা ঠিক হল না।আসলে তিন জনের সংসার--চাঁদুর কথা বাদ দিলে চলবে কেন?কেউ তো নেই,কোন সন্তান হল না তাঁদের ঘরে।দুটি প্রাণী মিলে বাস করতেন--কর্তা আর গিন্নী।বহু দিন যাবত এমনি চলছিল।
এক দিন হল কি—তখন ঠিক দুপুর বেলা--কর্তার ঘরে আসার সময় হয় হয়।এমনি সময় তিনি অফিস থেকে ঘরে লাঞ্চ নিতে আসেন।সবে মাত্র বাইরে থেকে ঘরের বারান্দায় পা দিয়েছেন, এমনি সময় ঘরের ছাদে খ্যাঁক, খ্যাঁক,ধূপধাপ,সে সঙ্গে হুপ,হুপ শব্দ হতে লাগলো। বোঝা গেলো যে বাঁদরের দল এসেছে,ওরাই এমনি উধম করে চলেছে।ওদের উপদ্রবে ঘরের ছাদে কিছুটি শুকোতে দেবার জো নেই--কিছু না হোক কাপড় চোপর তো মেলতেই হয়।সে দিন বাঁদরের চিল্লামিল্লি ওঁদের ছাদেই যেন বেশী ঠেকছিল!
কর্তা ঘরে ঢুকলেন।বাঁদরের চেঁচামেচি শুনে তিনি ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন,তাঁর স্ত্রীর সাড়ি নিয়ে ওগুলো টানাটানি করে চলেছে!তিনি তাড়াতাড়ি গিন্নীকে ডেকে বললেন,‘কি গো! আমি ছাদে যাচ্ছি--দেখলাম তোমার সাড়ি নিয়ে বাঁদরেরা টানাটানি করছে!’
--‘সে কি!সাড়ি আবার খাবার জিনিস নাকি?’গিন্নী উতলা হোয়ে বলে উঠলেন।ঠিক এমনি সময় তার সাড়ি ধুপ,সামান্য শব্দ করে নিচে এসে পড়ল।গৃহিণী ছুটে গেলেন সাড়ি আনতে।কিন্তু এ কি!সাড়িতে কি যেন প্যাঁচিয়ে আছে না?কেমন যেন নাড়াচাড়া হচ্ছে সেটা!সাড়ির কাছে গিয়ে চীত্কার করে উঠলেন তিনি।চীত্কার শুনে তাড়াতাড়ি কর্তা,‘কি হল,কি হল?’বলে ছুটে এলেন।ওরা উভয়ে বিস্ময়ে হতবাক। বাঁদরের একটা খুব ছোট্ট বাচ্চা সাড়িতে প্যাঁচিয়ে রয়েছে--ওটা এত প্যাঁচিয়ে গেছে সাড়ির সঙ্গে যে বেচারা কোন রকম নাড়াচাড়া বা মুখ খুলে জোরে শব্দ পর্যন্ত করতে পারছে না!
বাঁদরের বাচ্চাটা খুব ছোট।দেখলে মনে হয় দু তিন দিনের বাচ্চা--গায়ে লোম পর্যন্ত ভালো ভাবে গজায় নি!খুব রোগা লিকলিকে--একেবারে মানুষের সন্তানের মত মনে হচ্ছিল ওটাকে!
কর্তা,গিন্নী বাচ্চাকে সাড়ি প্যাঁচানো অবস্থাতেই ঘরে নিয়ে এলেন।এ দিকে ছাদের ওপর বান্দরদের লাফালাফি দাপাদাপি সে সঙ্গে চীৎকার চেঁচামেচি সমানে চলছে।মনে হল সাড়ি প্যাঁচানো বাঁদরের বাচ্চাকে নিয়েই যত গণ্ডগোল।কিন্তু সাড়ি প্যাঁচিয়ে,সমস্ত শরীর জড়িয়ে বাচ্চা যে নিচে পড়ে গেছে তা হয়তো ওদের দল বুঝতে পারেনি।তাই ওদের এই হল্লাগুল্লা কেবল ছাদ ঘিরেই।এর মধ্যে বোঝা যাচ্ছিল একটা বাঁদর শুধু এ ছাদ থেকে ও ছাদ বিনা বাক্যব্যয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছিল।ও নিশ্চয়ই ওর বাচ্চাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।আর এদিকে দু দলে ঝগড়া চলছিল-- কে জানে ঠিক কি নিয়ে ঝগড়া!এ দিকে বাঁদরের কুট্টি বাচ্চাটা কিন্তু বেশী একটা ছটফট করছিল না।কর্তা ধীরে ধীরে ওর শরীর থেকে সাড়ির প্যাঁচ খুলে ওকে মুক্ত করলেন।বেচারা ব্যথা পেয়েছে নিশ্চয়!চুপচাপ অবশের মত শুয়ে আছে।আর জুলজুল করে তাকিয়ে আছে।কর্তার শুরুতে মনে হোয়ে ছিল,মরে যাবে না তো!মাথায় বড় আঘাত লাগে নি তো ওর?
--‘ও বাঁচবে তো?ও চুপ করে শুয়ে আছে কেন?’গিন্নী মা ভয়ে ভয়ে বলে উঠলেন।
কর্তা বাবু হাত নিয়ে গেলেন বাচ্চার সামনে,শুরুতে ও দু বার হাঁ করল,বোধ হয় কর্তাকে ভয় দেখাতে চাইল।তারপর বাচ্চাটা কি সুন্দর ভাবে নিজের হাত দুটো দিয়ে কর্তার হাত চেপে ধরল।আনন্দে কর্তা বলে উঠলেন,‘না গো, ভালো আছে,দেখো আমার হাত কেমন সুন্দর করে ধরেছে?’তাই দেখে গিন্নীও তাঁর হাত বাড়ালেন। ওমা,কর্তার হাত ছেড়ে দিয়ে এবার দু হাত বাড়িয়ে ও গিন্নীমার হাত চেপে ধরল।
বাচ্চাটা কেন যেন মানুষকে ভয় পাচ্ছিল না।ও এত ছোট বলে হয় তো--মানুষ আর বাঁদর জাতির প্রভেদ এখনো জানে না!
ব্যাস,তারপর থেকেই বাঁদরের বাচ্চা থেকে গেলো এই বাড়িতে।ওর বাঁদর মা অবশ্য এ দিকে কয়েক বার এসে ছিল,খুঁজেছিল বাড়ির আশপাশে,এমন কি ঘরের ভেতরেও অনেকবার উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে ছিল,কিন্তু বাচ্চাকে পাবে কি করে ?কর্তা বাবু,গিন্নীমা তখন বাচ্চাকে লুকিয়ে রেখে ছিলেন ওর মার থেকে আড়াল করে।
ওঁরা ওকে নিজের বাচ্চার মত পালতে লাগলেন।ওর নাম রাখা হল,চাঁদু।চাঁদু মানুষের মতই বড় হতে লাগলো।ওর জন্যে ফিডিং বোতল,দুধ সব কিছুর ব্যবস্থা হোয়ে ছিল।ও মানুষের মত ভাত, তরিতরকারি,এমন কি মাছ,মাংস পর্যন্ত খেত।তবে প্রকৃতির নিয়ম হিসাবে ও ফল খুব ভালো বাসতো--বিশেষ করে পাকা কলা,পাকা কলা ছিল ওর সবচে প্রিয় বস্তু।
দু চারটে কথাও চাঁদু মানুষের মত বলার চেষ্টা করত,যেমন ‘হ্যাঁ’,কে ‘হু’,বলত।মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ,না, জানাত।'কে'বলে কলার কথা বুঝাতো—‘ভা,দা’,বলে ভাত আর ডালের কথা বলতো।
বলতে গেলে চাঁদুই এ বাড়ির সন্তান হোয়ে গেছিলো।
ছোট থাকতেই ওর জন্যে জামা,প্যান্ট তৈরি করে পরানো হতো।ও বেশ দিব্বি ও গুলি পরে ঘরে ঘুরে ফিরে বেড়াত।ওকে বাইরে বিশেষ একটা যেতে দেওয়া হতো না।কারণ অন্য বাঁদরেরা দেখলে ওকে মারতে পারে বা ও বাঁদরের দলে মিশেও তো যাতে পারে!তা ছাড়া বাইরে আছে কুকুরের দল—ওরা তো ওকে ধরার জন্যে যেন ওত পেতে থাকে।
চাঁদুকে যদি বলা হতো, ‘বাবা,একটু নাচ দেখাও তো!’ও ‘নাচ’ শব্দ বুঝে নিত পারত।টিভিতে দেখা নাচের ভঙ্গী নিয়ে নাচার চেষ্টা করত।আশপাশের ছেলে মেয়েরাও ওকে দেখতে আসত।ওর সঙ্গে খেলা করার চেষ্টা করতো।ও কাউকে কোন দিন মারে নি—খেঁচ,খেঁচ,করে ধমক দিত--রেগে গেলে কেবল হাত তুলে থাপ্পড়ের মত দেখাত।
সেই বাচ্চা চাঁদু আজ ঘরের খুব আদরের।এখন আর ও বাচ্চা নেই।অনেক বড় হোয়ে গেছে।সব সময় ওকে ছেড়ে রাখা যায় না।গলায় লাগা থাকে তার দামী চামড়ার বেল্ট,তাতে লাগানো ঝকঝকে কারুকাজ করা রূপালি প্লেট!খায় ও থালা গ্লাসে,শোয় রীতিমত ভালো চাদর পাতা বিছানার খাটে।নিয়ম মত খাওয়া,পরা, স্নান করতে ও ভালোবাসে।কর্তা বাবু, গিন্নী মার আদর তো ও রোজ পায়--আর কি চাই ওর!
এমনি এক দিনের কথা--চাঁদুর ভাগ্যে নেমে এলো মহা বিপর্যয়।ক দিনের জ্বর,অসুখে হঠাৎ গিন্নী মা মারা গেলেন।চাঁদুর মুখ লটকে গেল--ও ‘গুঁ,গুঁ’ আওয়াজ করে কাঁদতে লাগলো।ঘরের আশপাশের লোকেরা দেখল,ও কাঁদছে--ওর চোখ ভরা জল!কর্তা বাবুও চাঁদুকে ধরে কাঁদছিলেন।চাঁদু বার বার ঘুরে ঘুরে ওর গিন্নী মার মৃত দেহের কাছে আসছিল,তাঁর দেহের ঢাকা সাদা চাদর সরিয়ে দিচ্ছিল।করুণ ভাবে তাকিয়ে ছিল গিন্নী মায়ের মৃত মুখের দিকে !
হঠাৎ গিন্নী মা কি ভাবে মারা গেলেন?সন্দেহের বশে কর্তা বাবুর ঘরে পুলিশ এলো।কর্তা বাবুকে সন্দেহ করে পুলিশ থানায় নিয়ে গেলো।
চাঁদু তখন ঘরে একা!জানলার শিকে ও শিকলে বাঁধা।বেচারাকে কে দেবে খেতে!ও এক দিন না খেয়ে থাকলো।পাড়ার লোকেরা ওকে খাবার দিয়ে গেলো।ও কিছুই খেলো না।আশপাশের বাচ্চারা ওকে কলা এনে দিলো।ও সামান্য মুখে ছুঁইয়ে ফেলে দিলো।দিন ভর বিষণ্ণ হোয়ে,মাথা নিচু করে বসে থাকলো চাঁদু।
এমনি ভাবে আরও দুটো দিন কেটে গেলো।গৃহকর্তা তখনও জেলে।সন্দেহের ঘেরায় তখনও তিনি পুলিশ হাজতে।তিনি হাতজোড় করে পুলিশ অফিসারকে অনুরোধ করলেন,‘স্যার, আমার ঘরে আমার চাঁদু একা আছে—ও খুব দুঃখ পেয়েছে। শুনলাম তিন দিন ধরে ও কিছুই খায় নি।দয়া করে আমায় কিছু সময়ের জন্যে যদি একবার ঘরে যেতে দেন!’
পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন,‘চাঁদু আপনার ছেলে নাকি?’
--‘হ্যাঁ,না,মানে,ছেলের মতই’,কর্তা বাবু সামান্য ইতস্তত করে বলে উঠলেন।
--‘ছেলের মতই মানে?’ পুলিশ সন্দেহের সুর টেনে বলে উঠলেন।
--‘স্যার,ও একটা বাঁদর,ওকে ছোট্ট বেলা থেকে আমরা মানুষ করেছি।’কর্তা বললেন।
--‘বাঁদর!আপনাদের ছেলে!’বিদ্রূপের সুর বেরিয়ে এলো পুলিশের মুখ থেকে।
পুলিশের লোক পর দিন কর্তাকে নিয়ে তাঁর ঘরে গেলেন।চাঁদু তাঁর খাটে শুয়ে আছে--মনে হল নিশ্চিতে ও ঘুমিয়ে আছে।পুলিশরা ওকে এমনি মানুষের মত ধুপদুরস্ত বিছানাতে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল।
--‘চাঁদু,চাঁদু,বাবা!’কর্তা বাবু তাড়াতাড়ি চাঁদুকে ডেকে উঠলেন।
চাঁদু তেমনি ভাবেই শুয়ে রইল।
কর্তা বাবু ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে আবার ডেকে উঠলেন, ‘বাবা, চাঁদু! চাঁদু!!...’
চাঁদু আর উঠলো না--ওর ঘুম আর ভাঙ্গল না--ও তো চির দিনের মত ঘুমিয়ে পড়েছে!
কর্তা,‘চাঁদু,চাঁদু,বলে আকাশ ফাটা চীত্কার করে উঠলেন।
পুলিশের লোকেরাও তখন ঘরের এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।

তাপসকিরণ রায়স
জবলপুর, মধ্যপ্রদেশ

তাপস কিরণ রায় অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কুলে শিক্ষকতা করেন বেশ কিছু বছর। পরে আয়কর বিভাগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি মধ্য প্রদেশের জবলপুর শহরে বাস করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখা তাঁর অনেকগুলি বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।