খেলাঘরখেলাঘর

           রাজা ও রানী                     
                               

রাজা নাম হলেও আসলে ও ভিখারীর ছেলে।ভিখারী আরজু ভিক্ষা করে দিন আনে দিন খায়।
ভিখারীর ছেলের নাম রাজা শুনে আশপাশের লোকেরা হাসে।
আরজু বলে,নাম রাখতে কোনো বাধা নাই।আমি আমার ছেলের নাম রাজা রাখি আর ফকির রাখি--কার কি বলো?
কথাটা তিন সত্য। ভগবান এমন অনেক কিছু দিয়েছেন--যাতে রাজা ফকিরের সমান হক বলা যায়।মাথার ওপরের আকাশ,দিন ভর বয়ে যাওয়া বাতাস,রাতের চন্দ্র,সূর্য্য, গ্রহ, তারা--এ সবই তো সবার জন্যে!ধনীর শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ যেমনটি হয় দরিদ্রেরও তাই! তবে কেন এ নিয়ে এত মাথা ব্যথা? আরজু ভিখারী বটে কিন্তু ইচ্ছে মত তার ছেলের নাম রাখার অধিকার তো তার আছে!
নীমা,রাজার মা,বলে ছিলো,ভিখারীর ঘরে আবার রাজা!
আরজু বৌকে বুঝিয়ে ছিলো,দেখ,নামে কি যায় আসে। আমাদের ছেলের নাম রাজা হলে ক্ষতি কি বল?মনের মত না হলেও নীমা,আরজুর বৌ,চুপ করে গিয়েছিল।

সেই রাজা,তিন বছরের ছোট্ট ছেলে।ঘরে বসে খেলা করে।খেলনা!নানা আকার প্রকারের টুকরো পাথর,ভাঙা বাক্স,শুকনো গাছের ডাল,আর বাপের কুড়িয়ে আনা একটা পুতুল,যার এক হাত নেই,এক পা নেই।এসব নিয়ে রাজা খেলে চলে আনন্দে।

কখনো পুতুল তুলে নিয়ে দেখে,ওর এক হাত নেই। তার নিজের হাত দুটো নাড়ে,আর পুতুলের হাতের বেমানান অবস্থা আন্দাজ করে!তেমনি পুতুলের এক পা আর ওর দু পা! এমনি ভাবনা ক্ষণেকের জন্যে এসেই আবার মিলিয়ে যায়।পর মুহূর্তেই সে পাথরের টুকরোগুলি নিয়ে খেলতে থাকে। কখনো সেগুলি ফেলছে,কখনো কুড়িয়ে নিয়ে আসছে। ফেলা আবার নিয়ে আসার মধ্যে কি সুন্দর খেলে যাচ্ছে রাজা!খেলার অভাব বোধ তার কোথায়!আনন্দে হাসছে,আনন্দে হাত তালি দিচ্ছে,পাথরে ঠোকা খেয়ে কাঁদছে...আবার খেলছে।
মা নীমার কোনো চিন্তা নেই।সে মাটির চুল্লিতে শুকনো ডালপালা গুঁজে দিয়ে ভাত ফুটা। ভাতের সঙ্গে দু টুকরো আলুও কখনো সখনো জুটে যায়।

রাজা খেয়ে নেয়।গপাগপ খেয়ে নেয়।মা কোনো দিন আধ সিদ্ধ আলু ভাতের সঙ্গে টিপে দেয়,অমৃতের মত রাজা তা খেয়ে নেয়। কোনো ব্যাপরে তার নতুন কোনো আব্দার নেই।

তিন বছরের রাজা কি নিজে নিজে খেতে পারে? হ্যাঁ,প্রায় দেড় বছর বয়স থেকেই রাজা নিজে নিজে খেতে শিখেছে। এ সব ভগবানের দান--গরীব ভিখারীর ঘরে এটা খাবো না,সেটা খবো না বললে চলে!না কি খাইয়ে না দিলে খাবো না বলে অভিমান করা সাজে!

সারাদিন বসে থাকে আরজু ও নীমা। মন্দিরের দেওয়াল ঘেঁষে বসে থাকে।তাদের সামনে বিছানো থাকে নোংরা চাদরের টুকরো।দয়ালু লোকেরা মন্দির দর্শনে আসেন।আর আরজু ও নীমার মত হাত জোড় করে বসে থাকা ভিখারীদের সামনে দিয়ে যান পয়সা।দিন ভর আরজু,নীমা এমনি ভাবে বসে থাক।নীমাকে মাঝে মাঝে ঘরে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসতে হয়।
দিনের শেষে ওরা পাততাড়ি গুটোয়.দুজনের ভিক্ষার পয়সার হিসাব হয। নব্বই টাকা--ওরে বাবা অনেক!ওদের গড়ে দিনে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা রোজগার হয়। কোনো দিন বিড়ালের ভাগ্যে যদি সিকা ছেড়ে তবে একশ টাকার উপরেও জুটে যায়।সে দিন তো ওদের মহা আনন্দ!

এক বছর আগেও নীমা রাজাকে কোলে নিয়ে চাদর পেতে বসে থাকত.এখন আর তা হয় না,রাজাকে সামলে রাখা যায় না। ঘরের গন্ডির বাইরে সে পা না বাড়ালে কি হবে,বাইরে এলে সমস্ত খোলা জাগাটাই তার আপন মনে হয়। ছুটে যেতে চায় এখানে ওখানে। মহা কষ্টে ওকে সামলাতে হয়।

নীমা দেখল,রাজা দিব্যি থেকে যায় ঝুপড়ি ঘরে। বাঁশের কঞ্চিতে বাঁধা দরজা,বাঁশ খুঁটিতে কোনো মত ঠেকিয়ে রাখা ঝুপড়ি ঘর। বেশী দাপাদাপিতে ভেঙে পড়তে পারে।কিন্তু সে ভাঙ্গার চেষ্টা রাজা করেনি। ওই তিন বছরের রাজাও জানে তাকে ওই গন্ডিতে থাকতে হবে। নইলে সমূহ বিপদ। সূক্ষ্ম বিচারের অনুভূতি ঐটুকু ভিখারীর ছেলের মধ্যেও ঢুকে গেছে। ওই বোধ টুকু ভগবান যদি ওদের না দেন তবে ওরা বাঁচবে কি করে!    
 

তাপস কিরণ রায় অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কুলে শিক্ষকতা করেন বেশ কিছু বছর। পরে আয়কর বিভাগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি মধ্য প্রদেশের জবলপুর শহরে বাস করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখা তাঁর অনেকগুলি বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।