খেলাঘরখেলাঘর

মিষ্টি নিমপাতা
নেহা বড় হয়েছে । বছর পনের বয়েস । পরের বছর মাধ্যমিক । বোর্ডের প্রথম পরীক্ষা । নেহা খুব সিরিয়াস ছিল এতদিন পড়াশুনোর ব্যাপারে । ইদানিং কম্পিউটার একটু বেশি সময় খেয়ে নেয়  তার । মায়ের  কাছে এই নিয়ে বকুনিও কম শুনছে না । তবুও তার হেলদোল নেই ।
মা কিছু বললেই বলে "লাইট, লাইট"
মা জোরে কথা বললেই বলে "চিল, চিল"
মা পড়তে বসতে বললেই বলে "কুল, কুল"
মা বলে "কি কুলুক্ষণেই এই কম্পিউটারটা কিনে দিলাম তোকে, বোর্ড পরীক্ষার পর দিলেই হত"
নেহা বলে "কাম অন মা, কম্পিউটার তো স্কুলেই কিনতে বলেছিল, উফ্‌, তুমি এত টেনশান করোনা যে কি বলব ! রিল্যাক্স মা রিল্যাক্স ! আমাকে আমার মত থাকতে দাও না মা"

মা আবার নিজের কাজে ফিরে যান । ভাবেন সত্যি তো ! আমাদের এত চিন্তা ! আমাদের মা তো আমাদের বোর্ডের পরীক্ষার আগে এমন করে টেনশন করত না, আমি বোধ হয় একটু বেশি বাড়াবাড়িই করছি । 


পরক্ষণেই মায়া হয় নেহাটার জন্যে। এই একরত্তি মেয়েটা আমার; হঠাত কেমন যেন বড় হয়ে গেছে  । আর পড়াশুনোতে তো বরাবরই ভালো করে নেহা । ফ্রিজ খুলে একটা গ্লাসে ম্যাঙ্গো-পাল্প, বরফকুচি , দ‌ই আর একস্কুপ আইসক্রিম দিয়ে চট করে বানিয়ে ফেলেন মকটেল ।  "এনে নেহা, খেয়ে নে তো এটা " নেহা বেজায় খুশি হয়ে আবার মন দেয় কম্পিউটারে । মা চলে যা্ন নিজের সেলাইফোঁড়াই, টুকিটাকি ঘর্-গেরস্থালির কাজে । আবার ভুলে যান নেহার মাধ্যমিক-প্রসঙ্গ। এমন ভাবেই চলতে থাকে.. কম্পিউটারের স্ক্রিন সেভারের মত । একবার মাধ্যমিক আর পরক্ষণেই নেহার পড়াশোনায় নিষ্ক্রিয়তা, কম্প্যুটার অনুষঙ্গ, সোশ্যালনেট... 
বাবা বাড়ি এলে রাতে খাবার টেবিলে নেহার সারাদিনের সব প্রশ্নর  উত্তর খোঁজার চেষ্টা শুরু হয় । রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বাবা একে একে সলভ করেন । খুবই গুরুগম্ভীর সে আলোচনা । ত্রিকোণমিতির সেই প্রবলেমটা, ফিজিক্সের সেই মেকানিক্সের পুলির অঙ্কটা , কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং, কেমিস্ট্রির সেই ভয়াবহ ব্যালেন্সিংটা, কিম্বা আর কিছু না হোক  জিওমেট্রি ব‌ই বাঁহাতে খুলে একটা খতরনাক রাইডার । বাবা আর মেয়ের সারাদিনের মোলাকাতের সময় এই একটাই । আর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর বাবা হিসেবে তিনি যতটা পারেন প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যান ।  টেবিল জুড়ে চলতে থাকে টেষ্টপেপারের চাপান-উতোর । বেচারী মা কোণঠাসা হয়ে যান । মেয়ের যত পড়া বাবাকে দেখলে মনে পড়ে যায় । নেহা একসময় বলে ওঠে "জানো বাবা ? আজ ফেসবুকে স্তুতি বলছিল এবার নাকি আমাদের কোয়েশ্চেনে রিডিং টাইম দেওয়া হবে" 


মা সেই অছিলায় একটু নালিশের ভঙ্গীতে বলে ওঠেন "আচ্ছা শোনো, তুমি কিন্তু ওকে এই কম্পিউটার করার সময়টা একটু  বেঁধে দিলে ভালো হয়; আমি বললেই বলে  ফেসবুক,  অর্কুটে বন্ধুদের সাথে পড়ার কথাই তো বলছি"


নেহা বলে ওঠে "এই শুরু হল,  বাবা দেখো আমি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে একটু রিলাক্স করি । খেলাধূলো করিনা, নাচটাও এবছর মা বন্ধ করে দিল ; মা কেবল আমার পড়া, পড়া, পড়া এই নিয়ে আমার পেছনে সারাদিন পড়ে থাকে । আমি পড়ছি, না কম্পিউটারে গেম খেলছি সারাদিন তাই মায়ের চিন্তা । বাবা "সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে"র মত নেহা আর তার মায়ের মাঝামাঝি থেকে বললেন "নো চাপ, তোমরা পারোও বটে !"


"আচ্ছা বাবা তুমিই বলো আমাদের এই যুগটাতে সোশ্যাল নেট না জানলে আমি তো কমপ্লিটলি পিছিয়ে পড়ব দুনিয়া থেকে । পড়াশুনো করে পরীক্ষা পাশ হবে কিন্তু সোশ্যাল নেটে না ঢুকলে আমায় বন্ধুরা ছি ছি করবে । আর আমার পরীক্ষার রেজাল্টটা দেখো । হ্যঁ, এবার না হয় আমি অঙ্কে আগের বারের চেয়ে কম পেয়েছি  তার মানেই কি আমি পড়ছি না ? তুমি বলো বাবা !" 
"ঠিক আছে, এবার থেকে মায়ের কথা শুনে ঘড়ি ধরে কম্পিউটারে থেকো " বাবা বললেন ।  
"মা, তুমিও তো যখন বাবার ল্যাপটপে ব্রাউস করো তখন তোমার খেয়াল থাকে?  সেদিন তো তোমার গ্যাসে দুধ পড়ে গেল । আরেকদিন ওই টিভি সিরিয়াল দেখতে গিয়ে আভেনে কেক পুড়ে গেল ।  প্লিজ মা, আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো" নেহা বলে।
মায়ের বিরুদ্ধে এহেন অনস্থা প্রস্তাবে মা'র নেহার ওপর খুব অভিমান হল  ।
"একি তুমি খাবে না ?" বাবা বললেন।


মা বাকি খাবার দাবার ফ্রিজে তুলে রেখে নেহার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন "তোমার আস্কারায় আজ মেয়ে এত বাড় বেড়েছে । বাড়িতে থাকলে জানতে ও কতক্ষণ পড়ছে আর কতক্ষণ ঐ ফেসবুক আর অর্কুটে সময় দিচ্ছে"


 নেহা মায়ের সাথে কথা বলল না আর মাকে একবারের জন্য সাধলোও না, খেয়ে নেওয়ার জন্য । বেচারা মা ঘরে গিয়ে অন্ধকার করে শুয়ে পড়লেন । মনে মনে ঠিক করলেন আর কোনোদিন নেহার পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো মাথা ঘামাবেন না । ও যা ভালো বোঝে তাই করুক । নেহার মাধ্যমিক নিয়ে আজ থেকে তাঁর আর কোনো দায় নেই । নেহা তার ঘরে গিয়ে যথারীতি কম্পিউটার অন করল আর জিটকের সবুজ হাতছানিকে উপেক্ষা করতে না পেরে বকে চলল অনর্গল। কত বন্ধু, কত পড়ার আলোচনা আর নতুন নতুন মুখোরোচক গসিপ।   মাঝরাতে কখন সে শুয়ে পড়েছে তার খেয়াল নেই । মা এসে ঘরের আলো নিবিয়ে কম্পিউটার অফ করে চলে গেছেন সে জানেও না ।   

ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত বিভিন্ন কাগুজে পত্রিকা এবং ওয়েবম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালিখি করেন। কবিতা-গল্প-ভ্রমণকাহিনী লেখা ছাড়াও, রসায়নশাস্ত্রের এই ছাত্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে ভাল বই পড়া, ভ্রমণ, সঙ্গীতচর্চা এবং রান্না-বান্না। 'প্যাপিরাস' ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ইন্দিরা মুখার্জির সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিভিন্ন স্বাদের বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।