খেলাঘরখেলাঘর

বর্ষা সবে শেষ হল। এবার মেঘরাজ্যে ভারী খাটুনি গেছে আগের বারের তুলনায়।

শরত এল


আগের আগের বার মেঘেদের খুব মজা ছিল। কাগজে কলমে বর্ষাকাল এসে গিয়েছিল কিন্তু বড়কর্তার প্ল্যান ছিল খালি ভয় দেখাতে হবে, জল ঢালা নয়। কিঞ্চিৎ গণ্ডগোল অবশ্য পাকিয়েছিল মেঘেদের কালো-কোলো ছানাগুলো; তারা তো এত মতলবের কথা জানেনা – কাজের সময় এসে গেছে, তাই তারা কোন এক জায়গার আকাশে গিয়ে ভীড় জমাল। ছোট তো, তাই উৎসাহ বেশি। সবাই ভাবল, “বাবা, আকাশ এতো কালো হয়ে গেল। এইবার নামবে জব্বর বৃষ্টি।” কড়-কড়-কড়াৎ- মেঘের ছানাগুলি বেজায় মারামারি শুরু করল, এক্কেবারে বজ্র নিয়ে লাঠালাঠি। তাই দেখে চাষীরা হাল-বলদ নিয়ে মহা আনন্দে মাঠে নেমে পড়ল চাষ করতে। কিন্তু ওমা! বড়কর্তার প্ল্যান-এ জল ঢালা, মানে আদেশ অমান্য করেই জল ঢালা, কি এতই সহজ? ঊনপঞ্চাশ পবনের বাহিনী এসে এমন ফুঁ লাগাল যে মেঘেরা পালিয়ে যাবার পথ পায় না। কোথায় বৃষ্টি, কোথায় কি, আকাশ ফর্সা।

এদিকে এইরকম কিছু ঘটলেই রাজা মিহিরকিরণের হয় বেজায় রাগ। মেঘলা দিনে তাঁর মনে একটু আশা জাগে, প্রতিদিন সারাদিন একটানা কাজ করতে হয়, সেই দিনগুলো একটু বিশ্রাম করা যাবে। হা হতোস্মি! সেদিন যেমন, মোটে রথ ঘুরিয়ে দু’মাইল গেছেন কি যাননি, আকাশ ফর্সা দেখে তাঁকে আবার রথ নিয়ে ছুটতে হল। বিধাতাপুরুষ বলে দিয়েছেন আকাশ খালি রাখা যাবে না। সে কথা তো আর অমান্য করা চলে না! রেগে মেগে তিনি ভীষণ তেজে জ্বলতে লাগলেন। রোজই প্রায় এক গল্প। পৃথিবীর মানুষ হতাশ হয়ে পড়ল। মাটি ফেটে চৌচির, সব ফসলের বীজ শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেল। চাষীরা হায় হায় করে মাথায় হাত দিয়ে বসল। এই ভাবেই কেটেছে গত বছর দু’য়েক।

কিন্তু এবার? বছরের প্রথমেই মেঘদের হাতে বড়কর্তা, যার নাম শ্রী বাসব, একটা তালিকা ধরিয়ে দিয়েছেন। সেটা দেখে সব মেঘেদের ভুরু গেল কুঁচকে। এবার এত আগে থেকে কাজ শুরু করতে হবে! ব্যাপার কি? একজন বলল, “আরে জাননা, গত পূজার সময় দুগ্‌গা মা তো হাতিতে চড়ে গিয়েছেন। পঞ্জিকাতে লেখা আছে না, গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা? বোধহয় সেই জন্যই।” আরেকজন বলল, “ছাই, এসব আবার কেউ মানে নাকি? এগুলো ফালতু কথা। আসলে কি হয়েছে জানো? পরপর কয়েক বছর এতো খরা গেছে যে মানুষ এখন আর বিরক্তও হচ্ছেনা। বরং বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন যাতে নকল জলভরা মেঘ তৈরী করে ইচ্ছামত বৃষ্টি ঝরানো যায়। কেমন মজা হবে বলতো? যখন দরকার হবে তখনই বৃষ্টি পাওয়া যাবে। এসব শুনে বড়কর্তা শ্রী বাসবের ভয় ধরেছে না?”

কথাটা খুব একটা ভুল বলেনি। শ্রী বাসব-এর বেজায় ভয় ধরেছে বটে। এত বছর ধরে তাঁর হাতে বৃষ্টি ঝরানোর ভার; এজন্য তাঁর কি প্রতাপ! সবাই তাঁকে বেশ সমীহ করে। আজ যদি এইসব ক্ষমতা চলে যায় তো লোকে কি তাঁকে আর মানবে? তাই এবছর প্রথম থেকেই তিনি বেশ সক্রিয় হয়েছেন। রীতিমত আটঘাট বেঁধে কাজ শুরু করিয়েছেন। মেঘদের তো আর এত চিন্তাভাবনা করার অভ্যেস নেই; তাদের বলা হয়েছে, আর তারাও জল ঢালতে শুরু করল। ফলে, এবার এতো বৃষ্টি হল যে চারদিক ভেসে গেল, রীতিমত বন্যা শুরু হয়ে গেল। তার ওপর অতিবৃষ্টিতে বাঁধ ভেসে যাচ্ছে দেখে সেখান থেকে জল ছাড়া হতে লাগল। ফলে মানুষের ত্রাহি মাং অবস্থা। আর কেউ বৃষ্টি চায় না। সকলের জীবন পচে গেল একেবারে।

তারপর একদিন এই লাগাতার বৃষ্টি থামল। মিঃ বাসব খুশমেজাজে গোঁফে তা দিয়ে নিজের মনেই হাসলেন, ভাবলেন, “কেন, এইবার ব্যাটারা বোঝ, কত ধানে কত চাল! আমার নামে অভিযোগ করা? আমি নাকি কাজে ফাঁকি দেই!” তিনি মনের খুশীতে পেল্লাই এক ডিনারের অর্ডার দিলেন। তাই দেখে মেঘেরা গেল বেজায় চটে। “ই---স, আমাদের নাওয়া খাওয়ার সময় ছিল না, সারা দেশ জুড়ে দৌড়ে দৌড়ে ঘড়া ঘড়া জল ঢালতে ঢালতে হাত পায়ের খিল খুলে গেল। একদিনও তো দেখতেও যাননি, আমরা কিভাবে কেমন কাজ করছি। আজ এখন সেলিব্রেট করতে ডিনার খেতে বসেছেন। যত্তোসব!” তারা গজগজ করতে লাগল। তাই আকাশ একটু হাল্কা হলেও মেঘের গুরু গুরু বন্ধ হলনা।

শরত এল
 
ভারী বর্ষাটা কেটে গেছে। তা বলে সমস্ত মেঘের কাজ কিন্তু একেবারে শেষ হয়ে যায় নি। মাঝে মাঝে এখানে সেখানে জল অল্প-স্বল্প জল ঢালার কাজ চলতেই থাকবে – বড়কর্তার হুকুম জারি হয়ে গেছে। এখন এই কাজটা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবার পালা। ছোট দলের লীডাররা এই কাজের ভার ফেলল দলের পুঁচকিগুলোর ঘাড়ে। তারা হৈ হৈ করে আজ এখানে কাল সেখানে জল ছড়িয়ে বেড়াতে লাগল। পৃথিবীর মানুষ হয়তো রোদ দেখে মহা আনন্দে পুজোর বাজার করতে বেড়িয়েছে, বা ছোটরা কলকল করতে করতে এ দোকান ও দোকানে রঙবেরঙ-এর জামা জুতো খুঁজছে। হঠাৎ আকাশ থেকে ফুলঝুরির মত বৃষ্টি ঝরে পড়ল। ছোট্‌, ছোট্‌, মূহুর্তে রাস্তা ফাঁকা। তাই দেখে উপর থেকে বালখিল্য মেঘের দল হেসেই কুটিপাটি, আর মানুষেরা ভুরু কুঁচকে ওপর দিকে তাকাবার আগেই ভ্যানিস। কোথায় মেঘ, কোথায় বৃষ্টি, নীল আকাশ ঝকঝক করছে।

শরত এলআর গাছপালারা? তাদের মন যে কী খারাপ হয়েছিল এতো বৃষ্টি দেখে। এখন ফাঁকা মাঠে যেখানে সেখানে কাশবন গজিয়ে উঠল। পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্না গায়ে মেখে বাতাসের ছোঁওয়া পেয়ে আনন্দে একে অন্যের গায়ে হেসে ঢলে পড়তে লাগল। বাতাস সেই আনন্দ বয়ে নিয়ে গেল মানুষের বাড়ি। সবাই খুশি হয়ে উঠল। এদিকে কুমোরপাড়ায় কি ব্যস্ততা! বৃষ্টিতে প্রতিমা যে শুকায় নি। এখন দ্রুতহাতে প্রতিমা শুকিয়ে তারা রঙ লাগাতে ব্যস্ত। দুগ্‌গা ঠাকুর যে আজকাল বিদেশেও পাড়ি দেন। আর দু’দিন বাদেই ঢাকে কাঠি পড়বে। ঢ্যাম কুড়কুড়, ঢ্যাম কুড়কুড়, দুগ্‌গা ঠাকুর আর কত দূর। বর্ষার সমস্ত ঘ্যানঘ্যানে কষ্ট কাটিয়ে আকাশে বাতাসে আজ একটাই সুর বাজছে শরৎ এলো, শরৎ এলো।


শুক্তি দত্ত
বৈষ্ণবঘাটা, কলকাতা

শুক্তি দত্ত ভালবেসে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। রূপকথা, প্রাচীন সাহিত্য, দেশবিদেশের লোকসাহিত্য, গল্পকথা পড়তে ভালবাসেন। সেগুলো নিয়ে আলোচনা বা শিশুদের সেই গল্প শোনাতেও ভালবাসেন। প্রধানতঃ শিশুমনস্তত্ত্ব ও তাদের শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। সেটা শুধু পড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি শিশু সাহিত্য, লোকসাহিত্য প্রভৃতিকে তাদের মূল্যবোধ বিকাশে কাজে লাগাতে চান।