খেলাঘরখেলাঘর

বায়স্কোপের বারোকথা

(আগের সংখ্যার পর)

এই যে আমরা 'পথের পাঁচালী'র কথা এত গর্ব করে বলি, আমরা কি ভেবে দেখেছি , 'পথের পাঁচালী'র গল্প বলার সময়ে সত্যজিত রায় কোন চরিত্রের চোখ দিয়ে জীবনকে দেখেছিলেন? না, হরিহর, সর্বজয়া বা ইন্দির ঠাকরুনের চোখ দিয়ে নয়। এই দেখা এত নির্মল, এত সবুজ, এত শোকতাপহীন যে অপুর মত নিষ্পাপ বালক ছাড়া কেউই তা দেখতে পারে না ! এইজন্যই ছবিতে দিদি দুর্গার মৃত্যু ও ঠাকুমার মত ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যু আমাদের মনে কোন স্থায়ী মেঘ জমায় না। একটু পরেই জীবন বয়ে চলে; রোদ্দুর ওঠে।

এরকমভাবেই তৈরি হয়েছিল ঋত্বিক ঘটকের ছবি 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' । ছোটদের নিয়ে এত ভাল সিনেমা বাংলায় খুব কমই হয়েছে। কি সুন্দরই না ছিল কচি হাতের ছবিতে ভর্তি খালেদ চৌধুরির করা ছবির ক্রেডিট টাইটেল। এক ছোট ছেলে কাঞ্চন- সে বাড়ি থেকে পালিয়ে রূপকথার টানে তার স্বপ্নের দেশ 'এল ডোরাডো' খুঁজতে কলকাতায় আসে। তার চোখে দেখা কলকাতা কিন্তু খুব মনোরম নয়। তখন  অনেক গরিব মানুষের ভীড় কলকাতায়। নানারকম বাস্তুহারা মানুষ দেশবিভাগের ফলে কলকাতার রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। মানুষের পড়ার মত কাপড় নেই, খাওয়ার মত খাদ্য নেই । কাঞ্চন দেখে কত উঁচু বাড়ি! পরিচালক ক্যামেরাকে খুব নিচু থেকে ব্যবহার করায় বাড়িগুলি যত উঁচু তার থেকেও বেশি উঁচু দেখায়। কাঞ্চন তো গ্রামের ছেলে, সে আসলে এত উঁচু বাড়ি কখনো দেখেনি। কাঞ্চনেরই মত আরেকটি ছোট মেয়ে- সে অবশ্য এই শহরের বড়লোকের মেয়ে- অবাক হয়ে যায় যে বড়রা এত অবুঝ কেন। তার মনে হয় -
তেলের শিশি ভাংল বলে
খুকুর 'পরে রাগ কর
তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ কর
তার বেলা?

বাড়ি থেকে পালিয়ে
বাড়ি থেকে পালিয়ে

ঋত্বিক ঘটক অবশ্য ছোটদের ছবির ছাড়াও বড়দের জন্যউনেক ছবি করেছেন, আর তার জন্যই তাঁর এত নাম ডাক। তিনি জীবনে কোন বড় পুরষ্কার পাননি। কিন্তু বাঙালি সমঝদার দর্শক তাঁকে চিরদিন শ্রদ্ধা করবে। তিনি সেই যুগের সাধারণ মানুষের জীবনের কথা বলতেন, আর তার সাথে জুড়ে দিতেন রামায়ণ-মহাভারত-উপনিষদ-পুরাণের নানা গল্প। কেন দিতেন? কেননা তিনি মনে করতেন যে সময়ের দুঃসহ চাপে যেন আমরা অতীতের স্মৃতি না ভুলে যাই।

ঋত্বিক ঘটকের তৈরি 'অযান্ত্রিক', 'সুবর্ণরেখা', 'মেঘে ঢাকা তারা' আর 'তিতাস একটি নদীর নাম'- এইরকমের ছবি। তাঁর ছবিতে অনেক সময়েই শেষ মূহুর্তে একটি বালক বা শিশু থাকে; সে আমাদের জানায় যে ভবিষ্যত অন্যরকম হবে।

এই ভাবেই সামান্য মাঝিমাল্লার গল্প বলতে পেরেছিলেন রাজেন তরফদার তাঁর 'গঙ্গা' ছবিতে। এর আগে বাংলা সিনেমায় আমরা গরিব মানুষ দেখলেও এইভাবে দেখিনি। এই প্রথম আমরা দেখলাম যে যারা নৌকা বায়, মাছ ধরে, তাদের বেঁচে থাকা দুঃখময় হলেও সুন্দর। আমরা যেন নতুন করে চিনলাম এই সব মানুষদের।

এই দলেই একটু পরে যোগ দিলেন মৃণাল সেন। তাঁর প্রথম ছবি 'রাতভোর' তেমন ভাল হয়নি। কিন্তু '২২শে শ্রাবণ' নামে ছবিটি মানুষের মনে খুব রেখাপাত করল। ২২শে শ্রাবণ আমাদের জাতীয় শোকের দিন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতিথি। কিন্তু এই ছবিতে মৃণাল সেন রবীন্দ্রনাথের কথা বলেননি। এই ছবি একজন ফেরিওয়ালা ও তার স্ত্রীর জীবনের গল্প।

এই মৃণাল সেন ও পরের দিকে ছোটদের জন্য রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাপূরণ গল্পটিকে নিয়ে ছবি বানিয়েছিলেন। কিন্তু লোকে তাঁকে বড়দের ছবির জন্যই মনে রাখবে। তাঁর ছবির মধ্যে নামকরা ছবিগুলি হল 'আকাশকুসুম', 'ইন্টারভিউ', 'একদিন-প্রতিদিন'। হিন্দীতে তাঁর করা 'ভুবন সোম' ছবিটি আমাদের নতুন করে হিন্দী ছবি সম্পর্কে ভাবতে শিখিয়েছিল।


সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
অধ্যাপক
চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগ
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়



সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। ইচ্ছামতীর আবদারে ছোটদের জন্য প্রথম বাংলা ভাষায় বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন তিনি।