খেলাঘরখেলাঘর

ক্র্যাশ কোর্স


-    এই রাগ্নিক, তোর লাল রঙের পেন্সিলটা আমায় একবার দিবি?
-    কি? কি বলে আমায় ডাকলি?
-    তোর নাম তো রাগ্নিক।
-    আর একবার যদি আমায় এই নামে ডাকিস তো এই পেন্সিলটা তোর দু আঙ্গুলের মাঝে রেখে এমন চাপ দেবো যে দুটো আঙ্গুলই মটমট করে ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে যাবে।
-    কিন্তু ওরা যে বলল !!
মুখ চুপসে যায় ছেলেটার। আজই স্কুলে প্রথম এসেছে। আর বাকি ছেলেরা কায়দা করে ঠিক তার পাশেই বসতে দিয়েছে। যত্তসব উদবিড়ালের দল। রাগে রিরি করে মাথাটা। হ্যাঁ, ঠিকই অন্য ছেলেদের থেকে সাগ্নিকের  একটু বেশিই রাগ হয়ে যায়। তা বলে ‘রাগ্নিক’ বলে ডাকবে? এমনকি এই নতুন ছেলেটাকে পর্যন্ত প্রথম দিনে সেটা শিখিয়েও দিয়েছে!!  
ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়তে সবার আগে বেরিয়ে আসে সাগ্নিক। ব্যাগ নিয়ে দে দৌড়। মঞ্জুকাকার জামাকাপড়ের দোকান, অসিতজেঠুর মিষ্টির দোকান পেরিয়ে বাঁই বাঁই করে দৌড়তে থাকে। বাঁদিকের গলি শেষ হয়েছে যে বড় রাস্তাটায় সেটা পেরিয়ে বাঁদিকে আরো কিছুটা গেলে নবারুন পার্ক। পার্কের কোন ঘেঁষে ওদের বাড়ি।
কাঁই কাঁই আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখে গলির মোড়ে একটা ছোট্ট কুকুর তিন পায়ে লেংচে লেংচে ছুটছে আর ওরই সমবয়সী কতকগুলো দুষ্টু ছেলে লাঠি নিয়ে তাকে তাড়া করেছে। কুকুর বলে কি তার কষ্ট হয়না!! গাছের একটা শুকনো ডাল ভেঙ্গে নিয়ে তেড়ে যায়।
-    ওকে মারছিস কেন রে? দেখছিস না ওর পায়ে কত লেগেছে। আমি যদি এই লাঠি দিয়ে তোদেরকে এক ঘা দিই তো কেমন লাগবে?
ছেলেগুলো ঘাবড়ে গিয়ে ছুটে পালায়। কুকুরটা দূরে দাঁড়িয়ে করুণ চোখে তাকিয়েছিল ওর দিকে। দেখেই এমন মায়া পড়ে গেল! একটা নামও দিয়ে ফেলল ততক্ষনাৎ -‘ফুটকি’। ফুটকিকে কোলে করে বাড়িতে নিয়ে যাবে। ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে রাখলে কদিনেই সেরে যাবে ওর পা। কিন্তু ফুটকিকে ধরতে যেতেই সে ছুটে পালালো। পেছন পেছন দৌড়ল ও। দৌড়তে দৌড়তে এসে পৌঁছলো একটা উঁচু বাঁধের কাছে। ফুটকি সেই বাঁধে উঠে ম্যাজিকের মত উবে গেল । সাগ্নিকের তখন হুঁশ ফিরলো। চারিদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সে রাস্তা হারিয়েছে। ফুটকিকে কেন যে ধরতে গেল!! সব রাগ গিয়ে পড়ল ঐ বজ্জ্বাত ফুটকিটার ওপর।
হতাশ হয়ে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। সামনে চোখে পড়ল একটা বিশাল পুকুর। তার চারিদিকে ঘনগাছপালা ভর্তি বাগান প্রায় জঙ্গলের আকার নিয়েছে। এই গ্রীষ্মের দুপুরেও বেশ মনোরম একটা হাওয়া দিচ্ছে। একটানা অনেকক্ষণ ছুটে ক্লান্তও লাগছিল খুব। পুকুরের ধারে ছায়ায় গিয়ে বসে। বসে বসে ঢিল ছোঁড়ে। দেখে জলের ঢেউগুলো কেমনভাবে সরে যাচ্ছে দূরে, আরো দূরে। পুকুরপাড়ের গাছগুলোর সবুজাভ কালো ছায়া জলের ঢেউ-এ এঁকেবেঁকে যাচ্ছে ক্রমাগত। শুকনো পাতারা গাছ থেকে ঝরে পড়ছে টুপটাপ আর নৌকোর মতো ভেসে চলেছে নিরুদ্দেশে। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগে।
হঠাৎ ওর ঢিলের পাশে আর একটা বড় ঢিল এসে পড়ে। আর তার জোরদার ঢেউয়ে ওর দুর্বল ঢেউটা ভেঙ্গেচুরে যায়। ও চেঁচিয়ে ওঠে, কে রে ঢিল ছুঁড়ছিস?
গম্ভীর গলায় উত্তর আসে, এমন সামান্য ব্যাপার নিয়ে চেঁচামিচি করছিস কেন?
তাকিয়ে দেখে পুকুরের জলের ওপর নুয়ে পড়া শিরিষগাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে এক অদ্ভূত দেখতে মানুষ। মিশমিশে কালো তার গায়ের রঙ, লিকলিকে সরু হাত-পা, লাললাল চোখ, চকচকে টাক মাথা, পরনে সাদা ধবধবে হাফ শার্ট আর হাফ প্যান্ট আর পিঠে একটা ইয়া বড় স্কুলের ব্যাগ। 
-    তুমি ঢিল ছুঁড়ে আমার ঢেউ নষ্ট করছো কেন?
-    আহা, ঢেউ কি আর তোমার আমার হয় নাকি ঢেউকে কেনা যায়?
-    কিন্তু ঢেউ তো তৈরী করা যায়?
-    ঢেউ তৈরী করে রাগও কমানো যায়। আবার ঢেউ দিয়ে ঢেউ ভাঙ্গাও যায়।
-    রাগ কমানো যায়?
-    হ্যাঁ, যায় তো। ঢিল ছুঁড়লেই রাগ ভাল হয়ে যায়। তাই রাগ হলেই আমি এই আমলকী বাগানে চলে আসি।
-    কতো রকমের ঢিল ছোঁড়া যায় জান? আমি এমন ভাবে ঢিল ছুঁড়তে পারি যে সেটা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে যাবে।
খুব অবাক হয়ে তাকালো লোকটা। সাগ্নিক একটা পাতলা টালির টুকরো জোগাড় করে জলের প্রায় সমান্তরালে ছুঁড়ে দিল। সেটা তিন বার লাফিয়ে ডুবে গেল জলে। লোকটা তাই দেখে বলল,
-    কয়েকবার চেষ্টা করলে আমিও পারবো এটা। কিন্তু আমি এমন অনেক কিছু পারি যা তুই ইচ্ছে করলেও পারবি না।
-    কেমন?
-    যেমন ধর, আমি এক সেকেন্ডের মধ্যে পুকুরের ওপারের গাছ থেকে একটা কয়েতবেল পেড়ে এনে দিতে পারি।
-    ধুত, তুমি কি আর সুপারম্যান নাকি!!
-    বিশ্বাস করছিস না!! তবে এই দ্যাখ।
বলেই লোকটা ডান হাতটা বিশাল লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে একটা পাকা কয়েত বেল পেড় এনে দিল। মুখ হাঁ হয়ে গেছে সাগ্নিকের – আর কি কি পারো তুমি? ভ্যানিশ হতে পারো?
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে আবার সশরীরে দেখা দিল।
-    তুমি কি ম্যাজিসিয়ান?
খুব তাচ্ছিল্যের সুরে সে বলল - নাহ, আমি হলাম ভজহরি। তবে তুই আমায় ভজহরিদা বলে ডাকবি। আমি বয়েসে তোর থেকে পাক্কা চার শতাব্দী বড়।
-    শতাব্দী মানে?
-    শতাব্দী মানে একশ বছর।
-    তোমরা শতাব্দীতে বয়স হিসেব কর কেন?
-    তোদের মানুষদের একরকম নিয়ম আর আমাদের ভূতেদের আর একরকম। যাদের যেমন সুবিধে।
-    ওহো তাই বলো। তুমি হলে ভূত। ভূতেরা হাত লম্বা করে বাগান থেকে লেবু তুলে আনতে পারে এসব আমি গল্পের বই-এ অনেক পড়েছি।  কিন্তু ভূত বলে আসলে তো কিছু নেই।
-    ওসব যারা কোনদিন ভূত দেখেনি তারা বলে। কিন্তু তুই তো আমায় নিজের চোখে দেখলি। যাকগে তোর সঙ্গে আমার এত বকবক করার সময় নেই এখন। একটা জরুরী কাজ সারতে হবে।
বলেই ভজহরিদা পিঠের ব্যাগ খুলে একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার বার করে ফেলল। তাতে চার হাত পায়ের কুড়িটা আঙ্গুল দিয়ে প্রচন্ড গতিতে লিখতে শুরু করল। এমন ইন্টারেস্টিং মানুষ থুড়ি ভূত সাগ্নিক কোনদিন দেখে নি। ও ভজহরিদার প্রায় গা ঘেঁষে বসে কার্যকলাপ দেখতে থাকল।
-    কী লিখছো ভজহরিদা?
-    সারাদিনের যা করেছি সব রিপোর্ট লিখে স্কুলের হেডস্যারকে পাঠাতে হবে।
সাগ্নিকের ছবি, কথাবার্তাও রেকর্ড করে ভিডিওটা লেখার মধ্যে জুড়ে দিল। তারপর লেখাটা ইমেল করে পাঠিয়ে দিল।
-    তুমি এই বাগানের মধ্যে বসে ইন্টারনেট পাচ্ছ কি করে ভজহরিদা?
-    আঃ!! ইন্টারনেট নয়, এসব হল ঘোস্টনেট। ইন্টারনেটের থেকে অনেক বেশী উন্নত।
-    এই কম্পিউটারে ভিডিও গেমস খেলা যায়?
-    যাবে না আবার! আমাদের স্কুলে সব পড়াশোনা তো ঐ সব গেমস দিয়েই শেখানো হয়।
-    কী ভালো স্কুল তোমার!! আমার বাড়ির কম্পিটারে তুমি একটা নতুন গেম ইন্সটল করে দেবে?
-    আমাদের ঘোষ্টওয়্যার তোদের মেশিনে চলবে না। কোন আদ্যিকালের কম্পিউটার ব্যবহার করিস তোরা। সফটওয়্যার আর হার্ডওয়্যার ছাড়া আর কিছুই শিখে উঠতে পারল না মানুষ। যাকগে,  তোর সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। আমি এখন স্কুলে যাই। আমার টিফিন ব্রেক শেষ।
বলেই ভজহরিদা তার কম্পিউটার পিঠের ব্যাগে পুরে দিল। খুব মন খারাপ হয়ে গেল সাগ্নিকের। ভেবেছিল ভজহরিদাকে জপিয়ে তার ল্যাপটপে একটু গেমস খেলে নেবে।
-    আবার তোমার সঙ্গে কবে দেখা হবে ভজহরিদা?
-    মাঝে মাঝে আমি এখানে আসি। তুই এলে দেখা হয়ে যাবে কোন দিন।
বলেই ভজহরিদা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে রাস্তা খুঁজে নিয়ে হতাশ মনে বাড়ি ফিরল সাগ্নিক।