ছুটি আর ছুটির মন
আজ সকাল থেকেই ছুটির মনটা তাধাই নাধাই আগাডুম্ বাগাডুম্ তিড়িং বিড়িং করছে। পড়ায় মন নেই। অবাধ্য মন কেবলই ছুটে যাচ্ছে বই থেকে। মা বাবা পিন্টুকাকুর বাড়ি গেছেন। পিন্টুকাকুর বাড়ি বাবা, মা প্রায়ঃশই যান। পিন্টুকাকু বাবার কেমন যেন দূরসম্পর্কের ভাই হন। মা যাবার সময় বলে গেছেন সব হোমওয়ার্ক শেষ করে রাখতে। হোমওয়ার্ক করা তো দূরের কথা। ছুটির মাথায় লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানারঙের ঢেউ। ঢেউগুলো কখনো থেমে থাকছে না। বিভিন্ন আকার অবয়ব নিচ্ছে ক্রমাগত। কখনো ত্রিভূজ, কখনো বর্গক্ষেত্র, কখনো আয়তক্ষেত্র, কখনো বা সম্পূর্ণ একটা রঙবাহারের বৃত্ত। তারই মধ্যে একটা অস্পষ্ট মুখ চিন্তাটাকে ভেঙেচুরে দিচ্ছে। ছুটির খুব কান্না পাচ্ছে। কেন এমন হয়?
সকাল থেকেই মনের কোন তল পাচ্ছে না সে। ঘুম থেকে উঠেই বাইরেটা দেখে ছুটির মনটা খুশীতে ভরে উঠেছিল। বৃষ্টিধোয়া সতেজ সবুজ দিনে আকাশ জুড়ে রামধনু দেখে ছুটির মনে আনন্দের বুদ্ বুদ্। কাল সারারাত্তির বৃষ্টি হয়েছে। এখন মেঘ কেটে পরিষ্কার আকাশে নানারঙের খেলা। রোদ ঝলমলে দিন হলেই ছুটির মন ভালো হয়ে যায়। মনের মধ্যে রিন্ রিন্ ঝিন্ ঝিন্ করে। ইস্কুলে যেতে মনখারাপ হয় না। আজ অবশ্য ছুটির ইস্কুল নেই। গতকাল থেকে গরমের ছুটি পড়েছে। এমনিতে ছুটি ইস্কুলে যেতে ভালোবাসে না। সে পড়াশোনায় খারাপ না। কিন্তু ইস্কুল তার একদম ভালো লাগে না। চারদেয়ালের মধ্যে ছুটির দম বন্ধ লাগে। কিন্তু আজ দিনটা অন্যরকম। ইস্কুল নেই। তার ওপরে চনমনে রোদ। ঘুম থেকে উঠেই ছুটির ভালোলাগায় মনটা ভরে উঠেছিলো।
এমনি সময়েই চোখে পড়লো মেয়েটাকে। ছুটিরই বয়সী। জামাকাপড় ময়লা। কাদা ভর্তি পা নিয়ে মুখ কালো করে বসে আছে। মুখটা খুব করুণ। ছুটির মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন দিনে কেউ মনে দুঃখ নিয়ে বসে থাকতে পারে? রোদ্দুর আর নানাবাহারের রঙের খেলা। তবুও মনে দুঃখ? কিসের কষ্ট ওর?
আর তারপর থেকেই মনটা ছুটির ছুটে গেছে। কারোর মনেই কষ্ট দেখতে পারে না ছুটি। ঠাম্মা বলেন ছুটির মনটা সমুদ্রের মতো অতল, অন্তহীন, গভীর। সবার জন্যই ছুটির মন কাঁদে। বাড়ির কাজের বুড়ি মা, দুধওয়ালা, বাড়িতে ধূপ বিক্রি করতে আসা বুড়ো লোকটা – সবাইকে দেখেই ছুটির কষ্ট হয়। আজকে ওই মেয়েটা ছুটির মনটা উল্টোপাল্টা করে দিয়েছে। অঙ্ক, ভূগোল, বিজ্ঞান – কোনকিছু্তেই মন লাগছে না তার আর। বাবা, মা চলে গেছেন কখন। কিন্তু দুটো দাগও দেয়নি সে খাতায়। কেন তার এত লাগামছাড়া মন? তার এমন কেন হয়?
নাম-না-জানা একটা কষ্ট ছুটির মনে। মেয়েটার মুখটা তার চোখের সামনে ছবি হয়ে আছে। ছুটি কষ্টটাকে রূপ দিতে পারছিলো না। মেয়েটার মুখটা রামধনুর লাল, নীল, বেগুনি রঙের সঙ্গে মিলেমিশে ঢেউয়ের মতো দুলছিল। আর ঠিক তখনই ছুটির রঙ, তুলি নিয়ে বসার ইচ্ছে হল। ছুটির মন খারাপ হলেই ছুটি আঁকতে ভালোবাসে। সাদা পাতায় জলরঙ ছাড়তেই আস্তে আস্তে বৃষ্টিধোয়া পৃথিবীতে ঘড়বাড়ি, গাছপালা সব কেমন ফুটে উঠতে লাগলো। তারমধ্যেই সাত রঙা রামধনু। ছুটির চোখ থেকে বড়ো বড়ো দুইফোঁটা জল পড়লো সাত রঙা রামধনুর মধ্যে। আস্তে আস্তে বিন্দুদুটো ছড়াতে ছড়াতে ছুটির চোখের সামনেই একটা অস্পষ্ট অবয়ব নিতে থাকলো। ঝাঁকড়া চুলের বড়ো বড়ো চোখের ফ্রক পড়া মেয়েটাকে বেশ চেনা যাচ্ছে। আকাশছোঁয়া রামধনুর একপ্রান্ত মেয়েটার হাতে ধরা। ময়লা জামাকাপড় আর চোখে পড়ে না। রামধনুর রঙে ধুয়ে গিয়েছে তার কাপড়জামা। মুখে একচিলতে হাসি। সাতরঙা রামধনুকে ধরে ফেলেছে যে সে! মনে তাই আর কোনও দুঃখ নেই তার। রামধনু কি সবাই ছুঁতে পারে না সবাই ছুঁতে চায়? ছুটির মনটাও ভালোলাগায় পিড়িং পিড়িং করে উঠলো। হঠাৎই মনে আর কোনও দুঃখ জরইলো না তার আর। এবারে হোমওয়ার্কটা শেষ করে ফেলতে হবে। মা, বাবার আসার সময় হয়ে এলো যে।
ঊর্মিঘোষ-দস্তিদার (দত্তগুপ্ত)
নিউ ইয়র্ক, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ঊর্মি ঘোষ দস্তিদার
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
রাজা ও রানী
রাজা নাম হলেও আসলে ও ভিখারীর ছেলে।ভিখারী আরজু ভিক্ষা করে দিন আনে দিন খায়।
ভিখারীর ছেলের নাম রাজা শুনে আশপাশের লোকেরা হাসে।
আরজু বলে,নাম রাখতে কোনো বাধা নাই।আমি আমার ছেলের নাম রাজা রাখি আর ফকির রাখি--কার কি বলো?
কথাটা তিন সত্য। ভগবান এমন অনেক কিছু দিয়েছেন--যাতে রাজা ফকিরের সমান হক বলা যায়।মাথার ওপরের আকাশ,দিন ভর বয়ে যাওয়া বাতাস,রাতের চন্দ্র,সূর্য্য, গ্রহ, তারা--এ সবই তো সবার জন্যে!ধনীর শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ যেমনটি হয় দরিদ্রেরও তাই! তবে কেন এ নিয়ে এত মাথা ব্যথা? আরজু ভিখারী বটে কিন্তু ইচ্ছে মত তার ছেলের নাম রাখার অধিকার তো তার আছে!
নীমা,রাজার মা,বলে ছিলো,ভিখারীর ঘরে আবার রাজা!
আরজু বৌকে বুঝিয়ে ছিলো,দেখ,নামে কি যায় আসে। আমাদের ছেলের নাম রাজা হলে ক্ষতি কি বল?মনের মত না হলেও নীমা,আরজুর বৌ,চুপ করে গিয়েছিল।
সেই রাজা,তিন বছরের ছোট্ট ছেলে।ঘরে বসে খেলা করে।খেলনা!নানা আকার প্রকারের টুকরো পাথর,ভাঙা বাক্স,শুকনো গাছের ডাল,আর বাপের কুড়িয়ে আনা একটা পুতুল,যার এক হাত নেই,এক পা নেই।এসব নিয়ে রাজা খেলে চলে আনন্দে।
কখনো পুতুল তুলে নিয়ে দেখে,ওর এক হাত নেই। তার নিজের হাত দুটো নাড়ে,আর পুতুলের হাতের বেমানান অবস্থা আন্দাজ করে!তেমনি পুতুলের এক পা আর ওর দু পা! এমনি ভাবনা ক্ষণেকের জন্যে এসেই আবার মিলিয়ে যায়।পর মুহূর্তেই সে পাথরের টুকরোগুলি নিয়ে খেলতে থাকে। কখনো সেগুলি ফেলছে,কখনো কুড়িয়ে নিয়ে আসছে। ফেলা আবার নিয়ে আসার মধ্যে কি সুন্দর খেলে যাচ্ছে রাজা!খেলার অভাব বোধ তার কোথায়!আনন্দে হাসছে,আনন্দে হাত তালি দিচ্ছে,পাথরে ঠোকা খেয়ে কাঁদছে...আবার খেলছে।
মা নীমার কোনো চিন্তা নেই।সে মাটির চুল্লিতে শুকনো ডালপালা গুঁজে দিয়ে ভাত ফুটা। ভাতের সঙ্গে দু টুকরো আলুও কখনো সখনো জুটে যায়।
রাজা খেয়ে নেয়।গপাগপ খেয়ে নেয়।মা কোনো দিন আধ সিদ্ধ আলু ভাতের সঙ্গে টিপে দেয়,অমৃতের মত রাজা তা খেয়ে নেয়। কোনো ব্যাপরে তার নতুন কোনো আব্দার নেই।
তিন বছরের রাজা কি নিজে নিজে খেতে পারে? হ্যাঁ,প্রায় দেড় বছর বয়স থেকেই রাজা নিজে নিজে খেতে শিখেছে। এ সব ভগবানের দান--গরীব ভিখারীর ঘরে এটা খাবো না,সেটা খবো না বললে চলে!না কি খাইয়ে না দিলে খাবো না বলে অভিমান করা সাজে!
সারাদিন বসে থাকে আরজু ও নীমা। মন্দিরের দেওয়াল ঘেঁষে বসে থাকে।তাদের সামনে বিছানো থাকে নোংরা চাদরের টুকরো।দয়ালু লোকেরা মন্দির দর্শনে আসেন।আর আরজু ও নীমার মত হাত জোড় করে বসে থাকা ভিখারীদের সামনে দিয়ে যান পয়সা।দিন ভর আরজু,নীমা এমনি ভাবে বসে থাক।নীমাকে মাঝে মাঝে ঘরে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসতে হয়।
দিনের শেষে ওরা পাততাড়ি গুটোয়.দুজনের ভিক্ষার পয়সার হিসাব হয। নব্বই টাকা--ওরে বাবা অনেক!ওদের গড়ে দিনে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা রোজগার হয়। কোনো দিন বিড়ালের ভাগ্যে যদি সিকা ছেড়ে তবে একশ টাকার উপরেও জুটে যায়।সে দিন তো ওদের মহা আনন্দ!
এক বছর আগেও নীমা রাজাকে কোলে নিয়ে চাদর পেতে বসে থাকত.এখন আর তা হয় না,রাজাকে সামলে রাখা যায় না। ঘরের গন্ডির বাইরে সে পা না বাড়ালে কি হবে,বাইরে এলে সমস্ত খোলা জাগাটাই তার আপন মনে হয়। ছুটে যেতে চায় এখানে ওখানে। মহা কষ্টে ওকে সামলাতে হয়।
নীমা দেখল,রাজা দিব্যি থেকে যায় ঝুপড়ি ঘরে। বাঁশের কঞ্চিতে বাঁধা দরজা,বাঁশ খুঁটিতে কোনো মত ঠেকিয়ে রাখা ঝুপড়ি ঘর। বেশী দাপাদাপিতে ভেঙে পড়তে পারে।কিন্তু সে ভাঙ্গার চেষ্টা রাজা করেনি। ওই তিন বছরের রাজাও জানে তাকে ওই গন্ডিতে থাকতে হবে। নইলে সমূহ বিপদ। সূক্ষ্ম বিচারের অনুভূতি ঐটুকু ভিখারীর ছেলের মধ্যেও ঢুকে গেছে। ওই বোধ টুকু ভগবান যদি ওদের না দেন তবে ওরা বাঁচবে কি করে!
রানীদের ঘর রাজাদের ঝুপড়ি ঘরের সামনে। মাঝখান দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা চলে গেছে। রানী একটি মেয়ের নাম। ধনী ঘরের মেয়ে রানী। চার তলা বিরাট বাড়ি ওদের।
চার বছর বয়েস রানীর।স্কুলে যায়। ডি.পী.সী.স্কুলে। রোজ সকালে স্কুলের গাড়ি আসে ওকে নিতে। বিকেলে ওই গাড়ি ওকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে যায়। পড়া লেখার চাপ বিশেষ নেই।হোম ওয়ার্ক--সে এক ঘন্টা বসেই শেষ করে নেয়।তারপর খেলা--কত রকম খেলনায় তার ঘর ভরা!কি নেই তাতে?চাবি দাও,মানুষ নাচে,গান করে। ট্রেন ছুটে চলে,পাখী উড়ে যায়। প্রকান্ড বড় বড় নানা রকম ডল। এ ছাড়া আছে রান্না বাটি খেলার সমস্ত সরঞ্জাম। যখন যে খেলা পছন্দ তাই নিয়ে খেলো!এত খেলনাও মাঝেমাঝে তার মন কাড়তে পারে না। নতুনত্বের খোঁজে সে বাবা মার কাছে বায়না ধরে--আরও চাই,আরও পুতুল,অন্য অন্য রকমের!
তিন তলায় রানীর পড়ার ঘর,শোয়ার ঘরও সেটাই.বাবা মার সঙ্গেই শোয় ও।
একদিন সে ওই তিনতলা থেকে আবিষ্কার করল একটা বাচ্চা ছেলেকে।ওদের বাড়ির নীচে,রাস্তার ওপারের ঝুপড়ি ঘরে বসে আছে ছেলেটা। ওই ঘরগুলি কেমন ভাঙাচোরা। দরজা,জানালা,দেওয়াল--কোনো কিছুরই ঠিক নেই!বোরা,প্লাস্টিক কাগজ,বাঁশ কঞ্চির ঘেরায় তৈরী। ঘরে ছেলেটা খেলা করছে -একা একা--ঘরের দরজা আধ খোলা।ছাদের রেলিং ধরে রানী উঁকি মেরে দেখছিল। সেই ছেলে পাথরের টুকরো ,গাছের ডালের টুকরো,ভাঙা পুতুল,বাক্স নিয়ে চুপ চাপ খেলা করছে।রানীর কাছে এ যেন এক আবিষ্কার।খেলা ধুলার ফাঁক,পড়া লেখার অবসরে ওই ছেলেটাকে দেখতে ও ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।ওর খেলা,ওর নাচানাচি,লাফালাফি সব কিছু দেখে রানী খুব আনন্দ পায়।
একদিন রানী দেখল রাজা খেলে বেড়াচ্ছে.ওদের ভাঙা ঘরের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে যে রোদের আলো গিয়ে পড়েছে।তাই দিয়ে ও খেলছে।কখনো ও ধরতে যাচ্ছে রোদের টুকরো,কখনো সে দেখে তার নিজের গায়েই লেগে আছে ওই টুকরো রোদ।ঝিকির মিকির রোদের খেলনা দেখতে দেখতে রাজা হাততালি দিয়ে উঠছে।খেলার এ দৃশ্য দেখে রানী নিজের অজান্তে হাততালি দিয়ে উঠলো।রাজার কান পর্যন্ত পৌঁছালো সে তালির শব্দ।হাততালির শব্দ মিলিয়ে রাজা ওদের আধ খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে রানীকে দেখতে পেল। দেখল তার মতই ছোট একজন--যে হাততালি দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।খুব আনন্দ হলো ওর।আনন্দে সেও রানীর দিকে তাকিয়ে আবার হাততালি দিয়ে উঠল।
দূরত্ব যাই থাক,রাজা রানী এখন বন্ধু। এ ওকে দেখে হাসে,হাততালি দেয়।
দূর থেকেই রানী তার খেলনা দেখায়। নতুন খেলনা দেখে চুপ করে রাজ কিছু সময় দেখে নেয়। তারপরেই সে তার চকমকি পাথর রানীর দিকে তুলে ধরে।
রানী অবাক হয়। রাজার হাতে চকচক করছে যে খেলনা--তেমনটা তো সে কখনো দেখে নি!
রানীকে স্কুল যাবার জন্যে নীচে নেমে আসতে হয়। বাবা মা কেউ না কেউ তাকে বাসে চড়িয়ে দেন। এই সময়টুকুর ফাঁকে সে রাজাদের ঘরের দিকে তাকিয়ে নেয়। যদি রাজার দেখা পায়,যদি তার দূর থেকে দেখা চকমকি খেলনার রহস্যের খোঁজ পাওয়া যায়!
মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায় রাজার সঙ্গে।আবার কোনো দিন বুঝতে পারে রানী--ওই ঝাটিমাটির দরজার,দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে দুটো চোখ যেন জুলজুল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে!
--বাস এসে গেছে রানী!
কখনো বাবা বা মার কথায় সম্বিত ফিরে পায় রানী। তাড়াতাড়ি গিয়ে বাসে ওঠে।
রাজা ওই মেয়েটাকে ভালো ভাবে চেনে,ছোট্ট রাজার জীবনের দূর থেকে দেখা রানী সে!অনেক সময় সে দেখতে থাকে রানী গাড়িতে উঠে চলে যায়,গাড়িতে আবার সে ঘরে ফিরে আসে।
একদিন রানী তার মা,অনিমাকে ডেকে দেখায়,মা,দেখ,দেখ না!
--কি,কি দেখব?মা বলে ওঠেন।
--ওই ঘরে না একটা ছেলে থাকে।আমার বড় ডলের মত ও!রানী বলে যায়.
মা দেখবার চেষ্টা করেন ছেলেটাকে। বলেন,কে,কোথায় ছেলে?
--ওই দেখ,ভাঙ্গা মত ঘরটার ফাঁক দিয়ে দেখ,রানী উত্সাহ নিয়ে বলে ওঠে।
--ও গুলো বস্তি বাড়ি,গরীব ভিখারীদের ঘর,বলেন রানীর মা।
--কিন্তু ও তো ভিখারী না মা,ও ঘরেই বসে থাকে। খেলা করে । আমায় ওর খেলনা দেখায়।ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আমায় হাত দেখায়।বলে চলে রানী।
--ওর মা,বাবা,ভিখারী,কালী মন্দিরের সামনে ভিক্ষার জন্যে সারা দিন বসে থাকে,মা বলে যেতে থাকেন।
রানী ভিখারী ধনীর পার্থক্য বোঝে না।ও বলে,না,মা,ও ভিখারী না,সুন্দর দেখতে,আমায় খেলতে ডাকে।এক দিন যাবো ওর ঘরে?
--না,না,ওরা খুব নোংরা থাকে,ওদের ঘরে গন্ধ,ওখনে গেলে ভালো লাগবে না তোর। রানীর মা বোঝাতে থাকেন মেয়েকে।
তবু রানী মানতে চায় না,বলে কই আমি তো পাই না!আমি তো গন্ধ পাই আমাদের বাড়ির পাশের নর্দমার!
কথা বলতে বলতে রানী হঠাৎ দেখতে পায় রাজা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা হাত বাড়িয়ে সে রানীকে ইশারায় ডেকে যাচ্ছে।রানীও হাত নাড়ে,মাকে বলে ওঠে,ওই দেখ,ওই দেখ মা,ও আমায় ডাকছে!
রানীর মা,অনিমা দেখলেন ঝুপড়ির দরজার ফাঁক দয়ে ছোট্ট একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। রানীকে হাত নেড়ে ডেকে চলেছে ও। ছেলেটা দেখতে ভালো।ছোট্ট বাচ্চা।বাচ্চা ছেলে কার না ভালো লাগে!
রানী,মা বাবার একমাত্র সন্তান। ওঁদের ইচ্ছে ছিলো রানীর একটা ভাই হোক।কিন্তু সে ইচ্ছা আর পুরন হয় নি।
সে দিন তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেল। স্কুলবাস রানীকে ঘরে পৌঁছে দিল। স্কুলের আগে ছুটি হবার কথা কারো জানা ছিলো না,তাই রানীকে নীচে থেকে নিয়ে যেতে কেউ এলো না। একটু সময় সে চুপ চাপ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। এমনি সময় তার মনে পড়ল বন্ধুর কথা। ও তাকালো সামনের বস্তির দিকে। ওই যে বস্তির ঘরগুলি।এরই একটাতে থাকে তার বন্ধু। রানী এগিয়ে গেল।খুঁজতে লাগলো সেই ঘরটা যাতে থাকে তার বন্ধু.এখনো সে বন্ধুর নাম জানে না!
রানী চিনতে পারলো,ওই তো ঐটাই রাজাদের ঘর।এগিয়ে গেল ও।বাঁশ কঞ্চির তৈরী দরজা,বাইরে থেকে ঘরে কেউ আছে বলে মনে হলো না।কাছে গিয়ে দরজার ফাঁকা দিয়ে উঁকি মারলো রানী।শুরুতে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়ল না।কিছু সময় পরেই ও দেখতে পেল,ঘুমোচ্ছে,তার বন্ধু ঘুমোচ্ছে! ঘরে আর কেউ নেই!
বন্ধুকে ডেকে উঠলো সে,এই,এই,এই...না,কোনো সাড়া নেই। এবার দরজায় ধাক্কা লাগলো রানী,একবার, দুবার,তিনবার,না ঘুম ভাঙ্গে না!দরজায় চড়ে চীত্কার করে ডাকবে কি না ভাবলো,দরজার ওপর অনেকটা ফাঁকা। ও ভাবলো দরজায় চড়ে ওই ফাঁকা জাগা দিয়ে ওকে ডাকলে কেমন হয়!দরজায় দুপা উঠতে গিয়েই ঘটে গেল বিপদ।লড়বড়ে দরজা নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেলো রানী. একেবারে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়ল।আচমকা ভয় পেয়ে গেল ও।পড়ে গিয়েই জোরে চীত্কার করে কেঁদে উঠলো।ওদিকে রাজার ঘুম ভেঙে গেল,সেও ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলো। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে দু তিন বার কান্নার সুর টেনে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো!উভয়ের মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটল।
রানী বলল,তোর নাম কি?
রাজা আধো কথা বলতে শিখেছে।খানিক তুতলে সে বলে উঠলো,নাজা!
--আমার নাম রানী.তুই আমায় চিনিস?রানী প্রশ্ন করল।
কথা বলল না রাজা,এক ধরণের চিনতে পারার হাসি হাসল।
--জানিস আমি ওই বাড়িতে থাকি,বলে আঙ্গুল দিয়ে রাস্তার ও পারের বড় বাড়িটা দেখিয়ে দিল রানী।
রাজা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলো,তারপর ওপরে যেখানে রানী দাঁড়িয়ে থাকে রাজা তার আঙ্গুল দিয়ে সে জায়গাটা দেখালো।আর হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,উখানে,উখানে ...
তুই কি খেলিস দেখাত আমাকে?চল আমরা খেলব.রাজাকে রানী বলে।
রাজা পরম উত্সাহে ঘরের এক কোন থেকে সব টেনেটুনে বের করে আনে। খেলার সমস্ত সরঞ্জাম তাতে রাখা।
রানীর খুব ভালো লাগলো।রাজার ছোট,বড়,সাদা,লাল,কালো,নানা রঙের পাথরগুলি,সত্যি দেখতে বেশ সুন্দর--এমন জিনিস তো তার কাছে নেই!
রাজাদের ঘর খুব নোংরা,ভাঙা,রানীর একদম ভালো লাগলো না.কিন্তু রাজা?সে তো ভালো,সুন্দর হাসে,সুন্দর আধ-আধ কথা বলে!দূর থেকে ইশারায় তাকে ডাকে।যেন কত দিনের বন্ধু ওরা!
এদিকে সময় কেটে গেছে অনেক।এতক্ষণ নিয়ম মত স্কুল বাসের এসে যাবার কথা। রানীর মা বাসের অপেক্ষায় ঘরবার করছেন।ব্যালকনি থেকে বারবার বাস এলো কিনা দেখছেন।কে জানে,এত দেরী হচ্ছে কেনো বাস আসার!
অগত্যা স্কুলে ফোন করা হল। জানা গেলো বেলা একটায় আজ ছুটি হয়ে গেছে।শুনে ভয় পেয়ে গেলেন রানীর মা।
ঘরের চাকর দীনু। ওকে পাঠানো হলো নীচে।রাস্তার আশপাশ,অলি গলিতে খুঁজে দেখতে।
রানীকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।রানীর বাবাকে ফোন করা হলো।খবর শুনে রানীর বাবা আঁতকে উঠলেন...আমি এক্ষুনি আসছি,বলে ফোন রাখলেন তিনি।
তখন সন্ধ্যে হয় হয়।রানীর মা কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গেলেন।রানীর বাবা স্কুলে খোঁজ নিতে গেলেন।
এমনি সময় রানীর বাড়ির কথা মনে পড়ল। ধীরে ধীরে বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো।
মা কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।সামনে মেয়েকে দেখে,কোথায় ছিলি,বলে জাপটে ধরলেন।
--আমি না বন্ধুর বাড়ি গিয়ে ছিলাম,রানী বলে ওঠে।
এবার ধমকে ওঠেন মা,না বলে কেন গিয়ে ছিলে?জানো না আমরা তোমার জন্যে কত চিন্তা করছি!
--কোথায় গিয়েছি!এই তো পাশে,সহজ ভাবে রানী বলে ওঠে।
--চুপ!আমরা চিন্তা করি তুমি জানো না বুঝি?মা আবার ধমকান।
--ঠিক আছে,না বলে আর যাব না,কেমন?রানী পাকা বুড়ির মত বলে চলে,আমার বন্ধু ওখানে থাকে তাই একটু গিয়ে ছিলাম।
মা আর থাকতে পারলেন না,মেয়েকে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকলেন।
সে দিন ছুটির দিন ছিলো,রবিবার।তখন রাত দশটা হবে। রাজাদের বস্তিঘরগুলিতে কিভাবে যেন আগুন লেগে গেলো। আটদশ ঘর একের পর এক দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো.চারি দিকে চীত্কার চেঁচামেচি-- আগুন,আগুন,করে সবাই ছুটোছুটি করতে লাগলো।বস্তির লোকেদের কান্নার রোল পড়ে গেলো।
হইহট্টগোল,কান্না চেঁচামেচিতে রানীর ঘুম ভেঙে গেলো। ধড়ফড় করে সে উঠে বসলো। দেখল মা,বাবা,কেউ তার পাশে নেই। ও ভয় পেয়ে চীত্কার করল।ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো।মা,বাবাকে দেখলো ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন।নীচে জ্বলে যাচ্ছে রাজাদের ঘরগুলি!
মা,বাবার কাছে তাড়াতাড়ি ছুটে গেলো রানী। সে চীত্কার করে কেঁদে উঠলো,আমার বন্ধু,আমার বন্ধু কই!
নীচে তখন বস্তির সব ঘর আগুনে ভস্মিভূত হোয়ে গেছে।
রানী প্রচন্ড চীত্কার করে কেঁদে বলে উঠলো,আমার বন্ধু কই!আমার বন্ধু কই?সিঁড়ি দিয়ে তড়তড় করে নীচে নেমে যেতে লাগলো। বাবা,মা'র শত বাধা ওকে যেন বাধ মানাতে পারছে না। রানী চীত্কার করে একই কথা বলে চলেছে,আমার বন্ধু,আমার বন্ধু কই!
জোর করে বাবা,মা তাকে আটকে রাখলেন । তাঁদের মনও ভালো নেই।রানীর বন্ধু,রাজার চিন্তা ওদের মনকেও বিষন্ন করে তুলেছে।
রাত শেষে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গলো সবার। রাতের দুঃস্বপ্নের ঘোর রানীর তখনও কাটে নি। মুখ চোখ তার শুকিয়ে গেছে।
বেলা দশটার পরে দীনু খবর নিয়ে এলো,ঝুপড়ি ঘরের ছেলেটার মা,বাবা,কাল রাতে পুড়ে মারা গেছে। ছেলেটা কি ভাবে যেন বেঁচে গেছে!
রানী জোরে কেঁদে উঠলো,রাজা,আমার রাজা কোথায় আছে বলো?
দীনু বলে,হ্যাঁ,রাজা নাম ছেলেটার,ও বেঁচে আছে।
রানীর মা,বাবা খুব দুঃখ পেলেন। মেয়ের দুঃখে ওঁরা বেশ চিন্তিত হলেন। সত্যি বন্ধুকে তাদের মেয়ে খুব ভালোবাসে।রানীর বাবা কিছু সময় ভেবে বলে উঠলেন,দিনু একটা কাজ করতে পারবে?
--কি?বলুন না বাবু!বিনত দীনু বলে ওঠে।
--একবার রাজা ছেলেটাকে এনে আমাদের দেখাতে পারবে? বাবা ধীর স্বরে বলে উঠলেন।
--বলেন যদি,দেখতে পারি,আনতে পারি কি না!দীনু বলে।
ঠিক দুপুর বেলা,দীনু রানীর বন্ধু রাজাকে কোলে নিয়ে হাজির হল।তখন কাঁদছিল রাজা,মুখ চোখ কেমন লাল লাল তার।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছিল।
রানীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো,দৌড়ে সে রাজার কাছে এসে দাঁড়ালো।
সুন্দর ছেলে রাজা।শরীরে কোথাও ভিখারীর ছেলে বলে লেখা নেই।রানীকে দেখা মাত্র কান্নার মধ্যেই সে কেমন হেসে উঠলো!
রানীর মা,বাবার দু জনের মনে একই কথা মনে হচ্ছিল,ভিখারীর অনাথ ছেলেটা বেশ সুন্দর।তাদের তো কোনো পুত্র সন্তান নেই।এই অনাথ ছেলেটিকে যদি ছেলে বলে মেনে নেওয়া যায়!ছেলের মত স্নেহ ভালোবাসা দেওয়া যায়!কেমন হয় তা হলে?
এমনি সময় দীনু দুঃখে কাতর হয়ে বলে ওঠে,ওর আর কেউ নেই গো,ও একা হয়ে গেলো,বেচারা!
রানীর বাবা যেন আর থাকতে পারলেন না,সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,আমরা আছি দীনু,আজ থেকে ও আমাদের এখানে থাকবে।
রানীর মা অবাধ খুশিতে কেঁদে ফেললেন। রানীর বাবাকে বলে উঠলেন,আমার মনের কথাটা তুমি বলে দিলে গো!
রানী তো খুব খুশি,উচ্ছল আনন্দে সে ডেকে উঠলো,বন্ধু!
রাজা তাকালো রানীর দিকে,তারপর তুতলিয়ে বলে উঠলো,ব ন ধু উ...!
তাপসকিরণ রায়.
জবলপুর , মধ্য প্রদেশ
ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন তাপস কিরণ রায়
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ক্র্যাশ-কোর্স
১
- এই রাগ্নিক, তোর লাল রঙের পেন্সিলটা আমায় একবার দিবি?
- কি? কি বলে আমায় ডাকলি?
- তোর নাম তো রাগ্নিক।
- আর একবার যদি আমায় এই নামে ডাকিস তো এই পেন্সিলটা তোর দু আঙ্গুলের মাঝে রেখে এমন চাপ দেবো যে দুটো আঙ্গুলই মটমট করে ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে যাবে।
- কিন্তু ওরা যে বলল !!
মুখ চুপসে যায় ছেলেটার। আজই স্কুলে প্রথম এসেছে। আর বাকি ছেলেরা কায়দা করে ঠিক তার পাশেই বসতে দিয়েছে। যত্তসব উদবিড়ালের দল। রাগে রিরি করে মাথাটা। হ্যাঁ, ঠিকই অন্য ছেলেদের থেকে সাগ্নিকের একটু বেশিই রাগ হয়ে যায়। তা বলে ‘রাগ্নিক’ বলে ডাকবে? এমনকি এই নতুন ছেলেটাকে পর্যন্ত প্রথম দিনে সেটা শিখিয়েও দিয়েছে!!
ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়তে সবার আগে বেরিয়ে আসে সাগ্নিক। ব্যাগ নিয়ে দে দৌড়। মঞ্জুকাকার জামাকাপড়ের দোকান, অসিতজেঠুর মিষ্টির দোকান পেরিয়ে বাঁই বাঁই করে দৌড়তে থাকে। বাঁদিকের গলি শেষ হয়েছে যে বড় রাস্তাটায় সেটা পেরিয়ে বাঁদিকে আরো কিছুটা গেলে নবারুন পার্ক। পার্কের কোন ঘেঁষে ওদের বাড়ি।
কাঁই কাঁই আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখে গলির মোড়ে একটা ছোট্ট কুকুর তিন পায়ে লেংচে লেংচে ছুটছে আর ওরই সমবয়সী কতকগুলো দুষ্টু ছেলে লাঠি নিয়ে তাকে তাড়া করেছে। কুকুর বলে কি তার কষ্ট হয়না!! গাছের একটা শুকনো ডাল ভেঙ্গে নিয়ে তেড়ে যায়।
- ওকে মারছিস কেন রে? দেখছিস না ওর পায়ে কত লেগেছে। আমি যদি এই লাঠি দিয়ে তোদেরকে এক ঘা দিই তো কেমন লাগবে?
ছেলেগুলো ঘাবড়ে গিয়ে ছুটে পালায়। কুকুরটা দূরে দাঁড়িয়ে করুণ চোখে তাকিয়েছিল ওর দিকে। দেখেই এমন মায়া পড়ে গেল! একটা নামও দিয়ে ফেলল ততক্ষনাৎ -‘ফুটকি’। ফুটকিকে কোলে করে বাড়িতে নিয়ে যাবে। ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে রাখলে কদিনেই সেরে যাবে ওর পা। কিন্তু ফুটকিকে ধরতে যেতেই সে ছুটে পালালো। পেছন পেছন দৌড়ল ও। দৌড়তে দৌড়তে এসে পৌঁছলো একটা উঁচু বাঁধের কাছে। ফুটকি সেই বাঁধে উঠে ম্যাজিকের মত উবে গেল । সাগ্নিকের তখন হুঁশ ফিরলো। চারিদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সে রাস্তা হারিয়েছে। ফুটকিকে কেন যে ধরতে গেল!! সব রাগ গিয়ে পড়ল ঐ বজ্জ্বাত ফুটকিটার ওপর।
হতাশ হয়ে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। সামনে চোখে পড়ল একটা বিশাল পুকুর। তার চারিদিকে ঘনগাছপালা ভর্তি বাগান প্রায় জঙ্গলের আকার নিয়েছে। এই গ্রীষ্মের দুপুরেও বেশ মনোরম একটা হাওয়া দিচ্ছে। একটানা অনেকক্ষণ ছুটে ক্লান্তও লাগছিল খুব। পুকুরের ধারে ছায়ায় গিয়ে বসে। বসে বসে ঢিল ছোঁড়ে। দেখে জলের ঢেউগুলো কেমনভাবে সরে যাচ্ছে দূরে, আরো দূরে। পুকুরপাড়ের গাছগুলোর সবুজাভ কালো ছায়া জলের ঢেউ-এ এঁকেবেঁকে যাচ্ছে ক্রমাগত। শুকনো পাতারা গাছ থেকে ঝরে পড়ছে টুপটাপ আর নৌকোর মতো ভেসে চলেছে নিরুদ্দেশে। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগে।
হঠাৎ ওর ঢিলের পাশে আর একটা বড় ঢিল এসে পড়ে। আর তার জোরদার ঢেউয়ে ওর দুর্বল ঢেউটা ভেঙ্গেচুরে যায়। ও চেঁচিয়ে ওঠে, কে রে ঢিল ছুঁড়ছিস?
গম্ভীর গলায় উত্তর আসে, এমন সামান্য ব্যাপার নিয়ে চেঁচামিচি করছিস কেন?
তাকিয়ে দেখে পুকুরের জলের ওপর নুয়ে পড়া শিরিষগাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে এক অদ্ভূত দেখতে মানুষ। মিশমিশে কালো তার গায়ের রঙ, লিকলিকে সরু হাত-পা, লাললাল চোখ, চকচকে টাক মাথা, পরনে সাদা ধবধবে হাফ শার্ট আর হাফ প্যান্ট আর পিঠে একটা ইয়া বড় স্কুলের ব্যাগ।
- তুমি ঢিল ছুঁড়ে আমার ঢেউ নষ্ট করছো কেন?
- আহা, ঢেউ কি আর তোমার আমার হয় নাকি ঢেউকে কেনা যায়?
- কিন্তু ঢেউ তো তৈরী করা যায়?
- ঢেউ তৈরী করে রাগও কমানো যায়। আবার ঢেউ দিয়ে ঢেউ ভাঙ্গাও যায়।
- রাগ কমানো যায়?
- হ্যাঁ, যায় তো। ঢিল ছুঁড়লেই রাগ ভাল হয়ে যায়। তাই রাগ হলেই আমি এই আমলকী বাগানে চলে আসি।
- কতো রকমের ঢিল ছোঁড়া যায় জান? আমি এমন ভাবে ঢিল ছুঁড়তে পারি যে সেটা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে যাবে।
খুব অবাক হয়ে তাকালো লোকটা। সাগ্নিক একটা পাতলা টালির টুকরো জোগাড় করে জলের প্রায় সমান্তরালে ছুঁড়ে দিল। সেটা তিন বার লাফিয়ে ডুবে গেল জলে। লোকটা তাই দেখে বলল,
- কয়েকবার চেষ্টা করলে আমিও পারবো এটা। কিন্তু আমি এমন অনেক কিছু পারি যা তুই ইচ্ছে করলেও পারবি না।
- কেমন?
- যেমন ধর, আমি এক সেকেন্ডের মধ্যে পুকুরের ওপারের গাছ থেকে একটা কয়েতবেল পেড়ে এনে দিতে পারি।
- ধুত, তুমি কি আর সুপারম্যান নাকি!!
- বিশ্বাস করছিস না!! তবে এই দ্যাখ।
বলেই লোকটা ডান হাতটা বিশাল লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে একটা পাকা কয়েত বেল পেড় এনে দিল। মুখ হাঁ হয়ে গেছে সাগ্নিকের – আর কি কি পারো তুমি? ভ্যানিশ হতে পারো?
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে আবার সশরীরে দেখা দিল।
- তুমি কি ম্যাজিসিয়ান?
খুব তাচ্ছিল্যের সুরে সে বলল - নাহ, আমি হলাম ভজহরি। তবে তুই আমায় ভজহরিদা বলে ডাকবি। আমি বয়েসে তোর থেকে পাক্কা চার শতাব্দী বড়।
- শতাব্দী মানে?
- শতাব্দী মানে একশ বছর।
- তোমরা শতাব্দীতে বয়স হিসেব কর কেন?
- তোদের মানুষদের একরকম নিয়ম আর আমাদের ভূতেদের আর একরকম। যাদের যেমন সুবিধে।
- ওহো তাই বলো। তুমি হলে ভূত। ভূতেরা হাত লম্বা করে বাগান থেকে লেবু তুলে আনতে পারে এসব আমি গল্পের বই-এ অনেক পড়েছি। কিন্তু ভূত বলে আসলে তো কিছু নেই।
- ওসব যারা কোনদিন ভূত দেখেনি তারা বলে। কিন্তু তুই তো আমায় নিজের চোখে দেখলি। যাকগে তোর সঙ্গে আমার এত বকবক করার সময় নেই এখন। একটা জরুরী কাজ সারতে হবে।
বলেই ভজহরিদা পিঠের ব্যাগ খুলে একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার বার করে ফেলল। তাতে চার হাত পায়ের কুড়িটা আঙ্গুল দিয়ে প্রচন্ড গতিতে লিখতে শুরু করল। এমন ইন্টারেস্টিং মানুষ থুড়ি ভূত সাগ্নিক কোনদিন দেখে নি। ও ভজহরিদার প্রায় গা ঘেঁষে বসে কার্যকলাপ দেখতে থাকল।
- কী লিখছো ভজহরিদা?
- সারাদিনের যা করেছি সব রিপোর্ট লিখে স্কুলের হেডস্যারকে পাঠাতে হবে।
সাগ্নিকের ছবি, কথাবার্তাও রেকর্ড করে ভিডিওটা লেখার মধ্যে জুড়ে দিল। তারপর লেখাটা ইমেল করে পাঠিয়ে দিল।
- তুমি এই বাগানের মধ্যে বসে ইন্টারনেট পাচ্ছ কি করে ভজহরিদা?
- আঃ!! ইন্টারনেট নয়, এসব হল ঘোস্টনেট। ইন্টারনেটের থেকে অনেক বেশী উন্নত।
- এই কম্পিউটারে ভিডিও গেমস খেলা যায়?
- যাবে না আবার! আমাদের স্কুলে সব পড়াশোনা তো ঐ সব গেমস দিয়েই শেখানো হয়।
- কী ভালো স্কুল তোমার!! আমার বাড়ির কম্পিটারে তুমি একটা নতুন গেম ইন্সটল করে দেবে?
- আমাদের ঘোষ্টওয়্যার তোদের মেশিনে চলবে না। কোন আদ্যিকালের কম্পিউটার ব্যবহার করিস তোরা। সফটওয়্যার আর হার্ডওয়্যার ছাড়া আর কিছুই শিখে উঠতে পারল না মানুষ। যাকগে, তোর সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। আমি এখন স্কুলে যাই। আমার টিফিন ব্রেক শেষ।
বলেই ভজহরিদা তার কম্পিউটার পিঠের ব্যাগে পুরে দিল। খুব মন খারাপ হয়ে গেল সাগ্নিকের। ভেবেছিল ভজহরিদাকে জপিয়ে তার ল্যাপটপে একটু গেমস খেলে নেবে।
- আবার তোমার সঙ্গে কবে দেখা হবে ভজহরিদা?
- মাঝে মাঝে আমি এখানে আসি। তুই এলে দেখা হয়ে যাবে কোন দিন।
বলেই ভজহরিদা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে রাস্তা খুঁজে নিয়ে হতাশ মনে বাড়ি ফিরল সাগ্নিক।
২
রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে মা বাবার সঙ্গে এক প্রস্থ চেঁচামিচি হয় সাগ্নিকের। সকালবেলা এত ঘুম পায়। তার ওপর মা একবার ডাকার পরেই ভয়ানক তাড়া লাগাতে থাকে। একটা হুংকার দিয়ে মাকে চুপ করায় তো শুরু হয়ে যায় বাবার বাজখাঁই গলায় হাঁকডাক। আজও সকালে ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে যুদ্ধ লেগে যাচ্ছিল প্রায়। কিন্তু হঠাৎ ভজহরিদার কথা মনে পড়ে গেল সাগ্নিকের। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দিল ছুট। বাড়ির পেছনের ছোট পুকুরটার সান বাঁধানো ঘাটে বসে বসে বেশ কয়েকটা ঢিল ছোঁড়ে। জলের ঢেউগুলোর দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুভব করে ম্যাজিকের মতো কখন যেন সত্যিই ওর রাগটা গায়েব হয়ে গেছে আর এই সুন্দর সকালটার মতো ঝকঝকে আলোময় হয়ে উঠেছে মনটা। নতুন শেখা রাগ কমানোর ম্যাজিকটা ওকে টগবগে আর উত্তেজিত রাখে বেশ কয়েকদিন।
একদিন স্কুলে পৌঁছতে দেরি হওয়ায় হেডস্যার খুব বকলেন। মেজাজ গুম হয়ে রইল। তারপর টিফিন টাইমে খাবে বলে সবে টিফিন বাক্সটা খুলেছে এমন সময় পলাশ এমন ধাক্কা দিলো যে সব খাবার পড়ে গেল মাটিতে। ও পলাশের চুলের মুটি ধরে দিল এক চাপ্পড়। পলাশ গিয়ে স্যারকে বলে দিল। স্যার এসে ওকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিল বেঞ্চের ওপর। মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল সারা টিফিন। রাগে দুঃখে চোখে জল এসে যাচ্ছিল।
স্কুল থেকে ফেরার পথে পড়ে রন্টুদার সাইকেল সারানোর দোকান। রন্টুদা ওকে দেখেই ডাক দেয়,
- সাইকেল চড়বি নাকি?
সাইকেলের কথা শুনে গুটিগুটি পায়ে রন্টুদার দোকানে এসে ঢোকে। একটা সাইকেল এগিয়ে দিয়ে রন্টুদা বলে,
- এই সাইকেলটা আজই সারিয়েছি। যা, একটা টেস্ট ড্রাইভ দিয়ে আয়।
সাইকেল উঠে জোরে পা চালায়। পৌঁছে যায় সেই আমলকী বাগানে। রাগ কমানোর জন্যে পুকুরপাড়ে বসে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে। কিন্তু কোন লাভ হয়না। বাড়ি ফিরে যাবে ভাবতে না ভাবতে ভজহরিদা হাজির।
- আজ খোকাবাবুর মন ভালো নেই কেন?
- এতগুলো ঢিল ছুঁড়লাম তাও আমার রাগ ভালো হল না।
- রাগ হল কেন?
- রাগ হবে না!! পলাশ ধাক্কা মেরে আমার সব টিফিন ফেলে দিল তার বেলা কিছু না। অথচ আমি ওকে এক ঘা মেরেছি বলে স্যার আমাকে সারা টিফিন ব্রেকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল।
- বুঝেছি। এটা ঢিল রাগ নয়, মিল রাগ। পেট ভরে খাবার মিললেই ভালো হয়ে যাবে।
ভজহরিদা মুহূর্তের মধ্যে কোথা থেকে অনেকগুলো আম নিয়ে হাজির। বলল,
- আমগুলো পুকুরের জলে ধুয়ে হাত দিয়ে সারা গা চটকে নরম করে ফেল। তারপর ডগার দিকে দাঁত দিয়ে কেটে একটা ফুটো করে মুখ লাগিয়ে খা।
ভজহরিদার কথা মত ও আমটা ধুয়ে, চটকে, ডগায় একটা ফুটো করে মুখ লাগিয়ে টান দেয়।
- আঃ!! কি দারুন খেতে ভজাদা। একেবারে আসল ফ্রুট জুস।
- রাগ কমল এইবার?
- একদম ভ্যানিশ। আচ্ছা, তুমি রাগ নিয়ে এতো কিছু জানো কি করে ?
- জানতেই হয়। আমাদের স্কুলে রাগ নিয়ে অনেক লেখাপড়া করতে হয়। রাগ কন্ট্রোল করতে না পারাটা ভূতকূলের এক বড় সমস্যা।
- কি রকম ?
- ভূতেরা ইচ্ছে মতন অদৃশ্য বা সশরীরী হতে পারে। কিন্তু রাগ হলে এই ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়। তখন ভূতেরা ইচ্ছে করলেও আর অদৃশ্য হতে পারেনা। ফলে আশেপাশে কোন মানুষ থাকলে তারা ভূতদের দেখে ফেলে আর অজ্ঞান হয়ে যায়। আমাদের জন্যে এটা খুব নিন্দনীয় ব্যাপার।
- তোমরা এসব নিয়ে এতো ভাবো?
- এই নিয়ে রীতিমত রিসার্চ হয়। রিসার্চে দেখা গেছে যে ভূতেরা যদি দশ সেকেন্ডের কম দেখা দেয় তাহলে মানুষরা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও অজ্ঞান হয়না। চোখ বন্ধ করে চোখ কচলে আবার যখন তাকায় ততক্ষনে ভূত ভ্যানিস। কিন্তু দশ সেকেন্ডের বেশি থাকলে সাধারনতঃ মানুষরা অজ্ঞান হয়ে যায়। এমনকী হার্ট ফেল করে মারাও যেতে পারে। একমাত্র পাগলরা মিনিট পাঁচেক দেখেও অজ্ঞান হয় না।
- কি ভাবে রাগ কমানো শেখায় তোমাদের?
- রাগ কমানো নয় রাগ কন্ট্রোল করা শেখায়। অনেক বই পড়তে হয়। প্রাক্টিস করার জন্যে অনেক ভিডিও গেমস খেলতে দেয়। পরীক্ষাও নেওয়া হয় ভিডিও গেমস খেলেই।
- কিরকম খেলা সেগুলো?
- খেলায় অনেক লেভেল আছে। প্রত্যেক লেভেলে নানারকম ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের রাগিয়ে দেওয়া হয়। রেগে গেলে মানুষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেপে দেখা হয় কে কত তাড়াতাড়ি রাগ কন্ট্রোল করে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। এরকম একশোটা লেভেলে পেরোতে পারলে তবেই পাস।
- আমারও খুব রাগ হয়ে যায় জানো। রাগ হলে আমি অনেক ভুল কাজ করে ফেলি। এমনকি পড়াও মনে করতে পারিনা। স্কুলে সব বন্ধুরা আমার পেছনে লাগে।
- রাগ তো সবারই কম বেশী হয়। কিন্তু রাগকে কন্ট্রোল করতে পারলেই কেল্লা ফতে। রাগ হবে তোর পোষা কুকুরের মতো।
- মানে?
- ধর তোর একটা কুকুর আছে। তার গলায় একটা চেন বাঁধা। চেনটা তুই শক্ত করে ধরে আছিস। এখন কুকুর যেদিকে যাবে তুই কি সেদিকেই যাবি নাকি তুই যেদিকে যেতে চাইবি কুকুরটাকে সেদিকেই নিয়ে যাবি?
- আমি যেদিকে যেতে চাইবো সেদিকেই কুকুরটাকে নিয়ে যাবো।
- হ্যাঁ ঠিক সেরকম। তোকে তোর রাগকে পোষা কুকুরের মতো কন্ট্রোলে রাখতে হবে। তুই যদি চাস তো আমি তোকে দুদিনের একটা ক্র্যাশ কোর্স করিয়ে দিতে পারি।
সাগ্নিক এককথায় রাজি।
দুদিন সারাদিন অদৃশ্য হয়ে সাগ্নিকের সঙ্গে সঙ্গে থাকল ভজহরিদা। রাগ নিয়ে অনেক কিছু শিখিয়ে দিল ওকে। রাগ নানারকমের হয় যেমন ঢিল রাগ, মিল রাগ, ফিল রাগ, কিল রাগ, চিল রাগ ইত্যাদি। কোন রাগ কিভাবে শনাক্ত করবে এবং কিভাবে তা কন্ট্রোল করবে সে সম্বন্ধে একটা হাল্কা ধারণাও দিয়ে দিল।
প্রথমদিন মা সকালে ঘুম থেকে ডাকতেই রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল ও। অমনি অদৃশ্য ভজহরিদা ফিসফিসিয়ে বলল, খিল রাগ, খিল রাগ।
- মানে?
- এটা রাগ কন্ট্রোল করার প্রথম পাঠ। ঘুম বা খিদে পেলে বা ক্লান্ত হয়ে গেলে সবারই কম বেশি রাগ হয়ে যায়। রাগ হয়েছে বুঝতে পারলেই মুখে খিল দেবে। মুখ বন্ধ রেখে ভাববে। ভাববে তুমি যা চাইছ সেটা হলে কি ভালো হবে? ধরো, তুমি ঘুম থেকে উঠতে চাইছো না। না উঠলে স্কুলে যেতে পারবে না। তুমি তাই চাও?
একটু ভেবে সাগ্নিক বলল, স্কুলে না গেলে, পড়াশোনা না করলে আমি বড় হব কি করে?
- তাহলে লক্ষী ছেলের মতো কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ো।
স্কুলে ফুটবল খেলতে গিয়ে মন্মথ-র সঙ্গে মারামারি হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। ও ঠিক করে পাসটা বাড়াতে পারেনি বলে মন্মথ মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল,
- দুধ সাবু খেয়ে রাজপুত্র নেমেছেন খেলতে। বলে শট মারছে না তো যেন ফুঁ দিচ্ছে।
আর একটু হলে সত্যি এক ঘা বসিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু ভজহরিদা বলল,
- ফিল রাগ। ফিল রাগ। মুখে খিল দিয়ে ফিল করো। অনুভব করো। এটা দ্বিতীয় পাঠ। ওর জায়গায় তুমি থাকলে কি করতে? এই সব নিরীহ কথা একদম গায়ে মেখো না। চেষ্টা করো আরো ভালো খেলতে। চেষ্টা করো নিজেকে নিয়ে একই রকম মজা করতে।
ব্যাপারটা বুঝতে সময় লেগেছিল ওর। হাফ টাইমে অনেকক্ষন ধরে ভজহরিদা ওকে বোঝালো। তারপরে কেমন একটা মনের জোর এসে গেলো। সেকেন্ড হাফে খেলতে নেমে মন্মথকে বলল,
- রাজপুত্র এইবার মাংস আর লুচি খেয়ে খেলতে নেমেছে।
সেদিন ওদের ব্লু হাউস টিম পাঁচটা গোল করেছিল গ্রীন হাউসকে। তার তিনিটে গোলই দিয়েছিল ও। ওকে নিয়ে কী আনন্দই না করেছিল সবাই । সেদিনের জেতার সব ক্রেডিট ছিল ভজহরিদার।
পরের দিন স্কুল ছুটি। সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি হচ্ছিল ঝিরঝির করে। বাইরে খেলতে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না। ভিডিও গেমস খেলার একেবারে আদর্শ দিন। কিন্তু মা কম্পিউটার ছুঁতে দিলনা। ভজহরিদার কথা মতো মায়ের সঙ্গে তর্ক না করে মুখে খিল দিয়ে রইল ও। কিন্তু রাগটা গজগজ করছিল মাথায়। কিছুই ভালো লাগছিল না। চিলেকোঠার ঘরে একা বসে বসে বৃষ্টি দেখছিল আর মন খারাপ করছিল। গাছের ডালে বসা শালিখটার মতো যদি ভিজতে পারতো !! কিন্তু কিছুই হওয়ার নয়।
ভজহরিদা আসতেই অভিযোগ করল, মা আমায় ভিডিও গেমস খেলতে দিচ্ছে না।
- খুব ভাল করেছে। ঘরে বসে খেলার থেকে মাঠে ঘাটে ছোটাছুটি করলে শরীর মন ভালো থাকবে।
- কিন্তু এত বৃষ্টিতে বাইরে বাইরে খেলা যায়?
- ঢিল রাগ, ঢিল রাগ। তৃতীয় পাঠ এটা। যখন বিশেষ কোন কারন খুঁজে পাওয়া যাবে না অথচ কিছুতেই মনটা ভালো লাগবে না তখন ঢিল ছুঁড়বি।
- এই বৃষ্টিতে কোথায় ঢিল ছুঁড়ব?
- ঢিল মানে কি সবসময় ঢিল নাকি? নিজের ঘরে যা। একটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে অন্য দেওয়ালে বল ছোঁড়। তারপর দেখ রাগ কমে কিনা।
বল ছোঁড়া শুরু করার একটু পরেই ওর মাথায় অনেক প্ল্যান আসতে শুরু করে।
- ভজহরিদা, তুমি লুডো খেলতে জানো?
পরের এক ঘন্টা লুডো খেলে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গেল! ও এখন অনেকটাই শিখে গেছে কি ভাবে রাগ কন্ট্রোল করতে হয়। ভজহরিদা বলেছে, মাথার সঙ্গে খাতা, পাতা আর ছাতার গভীর সম্পর্ক। কোন উপায়েই রাগ কন্ট্রোল করতে না পারলে রাগের কথা ডায়েরীতে লিখে ফেলতে। তাতে রাগগুলো মাথা থেকে খাতায় চলে যবে। একান্তই লিখতে ইচ্ছে না করলে গাছের কাছে গিয়ে পাতা ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলে দিতে পারে সব। নিমেষে রাগগুলো মাথা থেকে গাছের পাতায় চলে যাবে। বৃষ্টির দিনে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারে রাস্তায়। শুনতে পারে বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ। বৃষ্টির জলে ছাতার সঙ্গে মাথার রাগও সব ধুয়ে মুছে যাবে।
দ্বিতীয় দিনেই ভজহরিদা ঘোষণা করল যে, রাগ ম্যানেজমেন্টের ক্র্যাশ কোর্স শেষ। এখন থেকে ওকে নিজে নিজে রোজ বাড়িতে, স্কুলে, খেলার মাঠে সবসময়ই যা শিখেছে তা অভ্যাস করতে হবে। ও যেহেতু বুদ্ধিমান তাই রাগ কন্ট্রোল করতে ওর কোন অসুবিধে হবে না।
৩
মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ফেরার সময় সাগ্নিক রন্টুদার দোকানে ঢুঁ মারে। সাইকেল জোগাড় হলে চলে আসে আমলকী বাগানে। ভজহরিদার দেখা মিললে একটু গল্প গুজব হয়। একদিন দেখে, জলে টুপ টাপ একের পর এক ঢিল পড়ছে।
- কি ব্যাপার আমাকে দেখেও দেখা দিচ্ছ না যে।
অদৃশ্য ভজহরিদা সশরীরে দেখা দিল। মুখটা ম্রিয়মান। দুঃখী গলায় বলল,
- আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি।
- তাতে কি হয়েছে? পরের বছর ভালো করে পড়ে আবার পরীক্ষা দেবে।
সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল সাগ্নিক।
- ভূতসমাজে ফেল করলে শাস্তি দেওয়া হয়।
- এমন নিমপাতা মার্কা যাচ্ছেতাই নিয়ম কে বানিয়েছে?
- আমাদের মাননীয় সরকার।
- তোমাদেরও সরকার আছে?
- থাকবে না? এত বড় দেশ। রীতিমত ভূততান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার নির্বাচন করা হয়।
- শাস্তিটা কি?
- খুব অপমানজনক শাস্তি!! যারা পরীক্ষায় ফেল করে তাদেরকে এক ডোজ করে ভূতজোলাকিয়া খাওয়ানো হয়। তাতে সেই ভূত পরবর্তী এক শতাব্দীর জন্যে ভূতঘুমে চলে যায়।
- একশো বছর ধরে ঘুমাবে? কি অদ্ভূত শাস্তি !!
- হ্যাঁ। ফলে একশো বছরের জন্যে সরকার নিশ্চিন্ত। তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না। তাদের রাগ নিয়েও ভূত বা মনুষ্য সমাজে কোন সমস্যা তৈরী হবে না।
- কিন্তু তুমি আমাকে এতো ভালো রাগ কন্ট্রোল করা শিখিয়েছ। তুমি ফেল করলে কেন?
- ঐ যে সেদিন তোর সঙ্গে সশরীরে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম। ওরা ভেবেছে আমি আমার রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি। আসলে সেদিন তুই আমাকে দেখে একটুও ভয় পাসনি, বন্ধুর মতো কত গল্প করলি। তাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে তুই মানুষ আর তোর কাছে আমার অদৃশ্য থাকা উচিত।
- বুঝেছি। তুমি আমাকে তোমাদের হেডস্যারের কাছে নিয়ে চলো। আমি বুঝিয়ে বললে তিনি নিশ্চয় বুঝবেন।
ঝটিকা সফর। ওরা এসে পৌঁছলো এক শুনশান জায়গায়। এক দিকে ঘন বাঁশবন। বাঁশের গায়ে বাঁশ লেগে থেকে থেকে কটাকট্ট্ট্করে আওয়াজ হচ্ছে। অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ। আকাশে সরু একফালি চাঁদ। কেউ কোত্থাও নেই। এমনকী কোন ব্যাং বা ঝিঁঝিঁর ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। ভজহরিদা ফিসফিসিয়ে কি সব কথা বলল। তারপর আস্তে আস্তে চারপাশে দৃশ্যমান হতে থাকল আর এক দুনিয়া।
ঘরের মধ্যে ওরা দাঁড়িয়ে। চারিদিকে চেয়ার টেবিল, কম্পিউটার। অসংখ্য ভূত কাজ করছে। কেউ কেউ ব্যাস্ত হয়ে এদিক ওদিক যাতায়াত করছে। একটা বিশাল ভুঁড়িওয়ালা ভূত ভজহরিদার সঙ্গে কী সব আলোচনা করল। তারপর ওকে ধরে ঢুকিয়ে দিল একটা ছোট্ট কাঁচের ঘরে। সেখানে অনেক যন্ত্রপাতি। লাল নীল সবুজ রঙের আলো জ্বলছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সাগ্নিক জিগ্যেস করল,
- আমাকে এই ঘরে পুরে দেওয়া হল কেন জানতে পারি?
ভুঁড়িওয়ালা ভূত বলল, নিশ্চয়। এই যে এতগুলো ভূত একসঙ্গে দেখেও তুমি অজ্ঞান হচ্ছ না। আমরা আমাদের ভূতবুদ্ধিতে এটার ব্যাখ্যা করতে পারছি না। আমাদের ধারণা তুমি কোন বিশেষ গুনের অধিকারী। তাই আমরা একটু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে চাই।
সেই ঘরে একটা বেঁটে গুড়গুড়ে ভূত বুট জুতো পরে কম্পিউটারে নিয়ে বসেছিল। তার স্ক্রিনে ফুটে উঠতে থাকল নানান রকম ছবি। মাত্র কয়েক মিনিট। তারপরেই সে মতামত দিল যে, ওর মাথায় গিজগিজ করছে রাগ। সেই জন্যে সাধারন নিয়মগুলো কাজ করেনি।
সাগ্নিক বলল, হ্যাঁ আমার রাগ একটু বেশী। কিন্তু ভজহরিদাকে সশরীরে দেখেও অজ্ঞান না হয়ে যাওয়াটাতে ওর কোন দোষ ছিল না। তাই ওকে শাস্তি দেওয়াটা মোটেই তোমাদের উচিত হবে না।
ভূঁড়িওয়ালা ভূত বলল, সেদিন ভজহরি তোমার সঙ্গে সশরীরে প্রায় আধঘন্টা কথা বলেছিল। এটা আমাদের সর্বোচ্চ মাত্রার অনেক বেশী।
- হতে পারে। কিন্তু সেটার সঙ্গে রাগের কোন সম্পর্ক নেই। আমি ওকে দেখে এমন গল্প জুড়েছিলাম যে ভজহরিদা অদৃশ্য হতে ভুলে গিয়েছিল।
- গল্প করতে গিয়ে সাধারন নিয়ম কানুনগুলো ভুলে যাওয়ার ফল তো খুব মারাত্মক হতে পারে। ভূত ও মানুষ উভয়ের পক্ষেই এটা ক্ষতিকারক।
- বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু গল্প করলে ক্ষতি হবে কেন? তোমরা মানুষদের বন্ধু ভাবতে পারো না আর মানুষরাও তোমাদের বন্ধু ভাবে না তাই তো এত ঝামেলা। নাহলে মানুষরা তোমাদের দেখে অজ্ঞান হত না আর ভূতেদেরও এত নিয়ম কানুন আবিষ্কার করতে হত না।
সেই বেঁটে গুড়গুড়ে ভূতটি এতক্ষন চুপচাপ সব শুনছিল। এখন এগিয়ে এসে বলল,
- আমি এই স্কুলের হেডস্যার। আমি ভজহরির শাস্তিটাকে তুলে নিতে পারি। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। তোমাকে রাগ কমাতে হবে। কারন রাগ ভূতজগতে এবং মনুষ্যজগতে সমান নিন্দনীয় ও ক্ষতিকারক। আমাদের রিসার্চের রেজাল্ট অনুযায়ী ইচ্ছে থাকলে ও চেষ্টা করলে আশি শতাংশ পর্যান্ত রাগ সহজেই কমানো সম্ভব। এব্যাপারে ভজহরি তোমাকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দিয়ে দেবে। তোমাকে ঠিকঠাক শিক্ষা দিতে পারলে ভজহরির শাস্তি তুলে নেওয়া হবে।
ভজহরি চেঁচিয়ে বলে উঠলো, আমি রাগ ম্যানেজমেন্টের একটা ক্র্যাশ কোর্স ওকে আগেই করিয়ে দিয়েছি।
হেডস্যার শুনে অবাক। বলল, পরীক্ষা দিতে পারবে?
পরীক্ষার কথা শুনে বুকটা একটু কেঁপে গেল সাগ্নিকের। ভজহরিদা কানে কানে বলল,
- আরে, এই সুযোগে তুই ভিডিও গেমস খেলতে পাবি।
শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল ও।
ওকে বসিয়ে দিল একটা অদ্ভূত দেখতে কম্পিউটারের সামনে। মাথায় লাগিয়ে দিল হেলমেট।
- ভজহরিদা, মাউস নেই, কী বোর্ড নেই। কি করে খেলবো?
- কিচ্ছু লাগবে না। মাথায় ওটা লাগানো আছে না? যা ভাববি তাই ঘটতে থাকবে। দেখ না কি হয়। শুধু মনে রাখবি বুদ্ধিমানেরা কখনো রাগ করে না ।
সে এক রূদ্ধশ্বাস উত্তেজনাময় খেলা। যেন অন্য এক পৃথিবীতে এসে পড়েছে। যেখানে ওর বাড়ি, স্কুল সবই আছে, আছে এমনকি ওর পরিচিতরাও সবাই। সবাই নানা ভাবে ওকে রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ সে কিছুতেই রাগল না। যখন খেলা শেষ হলো তখন তার মুখ ভর্তি জয়ের হাসি।
যারপরনাই খুশী ভজহরিও। পরীক্ষায় সসম্মানে উর্ত্তীর্ন হল সাগ্নিক। ভজহরির শাস্তি তো মকুব হলই। উপরন্ত হেডস্যার ঘোষণা করলেন যে, ভজহরি রাগ নিয়ে রিসার্চের দুনিয়াতে ভূতেদের জন্যে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তাই ওকে স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হবে। এবং ভূতসমাজ ছাড়িয়ে মনুষ্যসমাজের জন্যেও ওর এই বিশেষ অবদানের জন্যে ওকে একটি পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হবে।
রুচিরা
ব্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক
ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন রুচিরা
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
দ্রাঘিমাংশ
আমাদের বিন্দুবাসিনী বয়েজ স্কুলের ভূগোল স্যারের নাম পরমহংস পোদ্দার। তাঁর দুই যমজ ছেলে অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ আমাদের সহপাঠী। ক্লাসের ফার্স্ট বয় অক্ষাংশ একটু ধীর স্থির স্বভাবের। পড়াশোনায় তার খুব মন। খটমটে ইংরেজি গ্রামার হোক কিংবা কঠিনস্য কঠিন জিওমেট্রি, ভূগোলেড় কূটকাচালি হোক কিংবা ইতিহাসের সন-তারিখের আদ্যশ্রাদ্ধ, সবই অক্ষাংশের কাছে জলভাত। সাম্নের বার মাধ্যমিক দিতে চলেছি আমরা। অক্ষাংশের ওপর আমাদের স্কুলের তাই অনেক আশা।
ওদিকে দ্রাঘিমাংশর ধরনটা আবার একটু আলাদা। সারাদিন মাঠেঘাটে টো টো করে ঘুরে বেড়ায় সে। সেদিন একতা জ্যান্ত ঢোঁড়া সাপ কোত্থেকে নিয়ে এসে সোমনাথের স্কুলব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল দ্রাঘিমাংশ। গতমাসে আবার অন্য ঘটনা। দুটো বিশাল সাইজের সোনাব্যাঙ ক্লাসের ভেতর ছেড়ে দিয়েছিল দ্রাঘিমাংশ। চিরকার চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিল সব, সে এক হুলুস্থূল কান্ড! হেডস্যার টানা তিন পিরিয়ড নিল ডাউন করে রেখেছিলেন দ্রাঘিমাংশকে।
পরমহংস স্যারের আবার নাটকের দিকে ঝোঁক।পুরিয়ড অফ থাকলে টিচার্স কমনরুমে নাটকের বই পড়েন। আমরা যেমন গানের কলি গুনগুন করি, স্যার মেজাজ শরিফ থাকলে নাটকের ডায়ালগ বলেন একা একা।
সেদিন পরমহংস স্যার আমাদের পড়িয়ে ক্লাস থেকে বেরোচ্ছিলেন। সৌপায়ন বলল, নাটক প্রতিযোগিতার খবরটা শুনেছেন স্যার?
ভুরু কুঁচকে পরমহংস স্যার বললেন, কী খবর?
সৌপায়ন বলল, এবার কুশীলব নাট্যগোষ্ঠীর সুবর্ণ জয়ন্তী। তাই সব স্কুল গুলোর ধ্যে একটা রবীন্দ্রনাটক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে ওরাও। আমরা তাতে নাম দিতে চাই স্যার।
পরমহংস স্যার একটু বাঁকা হেসে বললেন, নাটক করবি? তা কী নাটক করতে চাস তোরা?
সৌপায়ন বলল, বাংলার স্যার বিজনবাবুর কাছে আমরা সেদিন রবি ঠাকুকের বিসর্জন নাটকের গল্পটা শুনেছিলাম। ওটা করলে কেমন হয় স্যার?
পরমহংস স্যার তাচ্ছিল্যের একটা হাস হেসে বললেন, তোরা করবি অভিনয়? ও তোদের কম্ম নয়। ছাগল দিয়ে কি আর হালচাষ হয়!
সুমন বাংলায় প্রত্যেকবার হায়েস্ট মার্কস্ পায়, স্কুল ম্যাগাজিনে কবিতা-টবিতা লেখে। সুমন বলল, আপনি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিলে আমরা আলবাত পারব।
পরমহংস স্যার বোধ হয় একটু খুশি হলেন। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, কিন্তু একটু অসুবিধে আছে। গুনবতী আর অপর্ণার পার্ট করার জন্য আমি মেয়ে কোথায় পাব?
লাস্ট বেঞ্চ থেকে দ্রাঘিমাংশ ফুট কাটল, সোমনাথ আর রাজেশ একদম মেয়েদের মত দেখতে। দুটোই স্নো পাউডার মেখে স্কুলে আসে। ওদের খুব ভাল মানাবে মেয়েদের রোলে।
হাসির ফুলঝুরি ছুটছে গোটা ক্লাসে।সোমনাথ আর রাজেশ দুজনেই খুব ফর্সা। লজ্জ্বা পেয়ে গাল লাল হয়ে গিয়েছে দুজনের। সোমনাথ মিনমিন করে বলল, দ্রাঘিমাংশ বাজে কথা বলছে। আমরা মোটেই স্নো পাউডার মেখে স্কুলে আসিনা স্যার।
পরমহংস স্যার হাত তুলে থামিয়ে দিলেন তাকে। একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সোমনাথ আর রাজেশের দিকে। ভুরু কুঁচকে বললেন, সত্যি সত্যিই ওই দুটো চরিত্রে তোদের দারুণ মানাবে!
গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল দুজন। পরমহংস স্যার সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মেয়েদের পার্ট বলে মন খারাপের কিছু নেই। আগে যে গ্রামে গ্রামে পালাগান হত, তাতে ছেলেরাই তো শাড়ি টাড়ি পরে মঞ্চে উঠে সীতা বা দ্রৌপদী সাজত।
দ্রাঘিমাংশ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ইয়ে, মানে রঘুপতির রোলটা কে করবে?
পরমহংস স্যার বললেন, রঘুপতি সুমন করবে। অক্ষাংশ সাজবে রাজা গোবিন্দমাণিক্য। জয়সিংহের রোলে কাস্ট করা যেতে পারে কৌশিককে।
দ্রাঘিমাংশ হতাশ গলায় বললেন, আমি কোনও রোল পাব না?
পরমহংস স্যার দৃঢ় গলায় বললেন, না।
অন্যান্য চরিত্রগুলির হন্য সৌপায়ন, রনজয় আর অমিতদের মনোনীত করা হল। দ্রাঘিমাংশ কিছু বলল না। আমি ঢোঁক গিলে বললাম, আমাকে কোনও পার্ট দেবেন না স্যার?
পরমহংস স্যার বললেন, তুই প্রম্পট্ করবি। কেউ পার্ট ভুলে গেলে উইংসের ধার থেকে তুই ধরিয়ে দিবি, কেমন?
সুমন, অক্ষাংশ আর কৌশিকের দিকে তাকিয়ে পরমহংস স্যার বললেন, তোদের তিনজনের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে নাটকটা। বাকিরা তো দুধভাত। মনে রাখিস, তোরা ভাল না করতে পারলে পুরো নাটকটাই কিন্তু মার খেয়ে যাবে।
শুরু হয়ে গেল নাটকের রিহার্সাল। সবাই মিলে হাত লাগিয়ে বানিয়ে ফেলা হল নাটকের সেট। পোষাক বানাতে দেওয়া হল বলিউড টেইলার্সে। পরমহংস স্যারের সঙ্গে গিয়ে ইলেক্ট্রিক আর মাইকের দোকানেও কথা বলে আসা হল এক সময়ে। স্কুলছুটির পর হলঘরে শুরু হল আমাদের মহড়া। রিহার্সালে দ্রাঘিমাংশ এসে চুপটি করে বসত আমার পাশে। মনোযোগ গিয়ে সব দেখত। মহড়া শেষ হলে গুটিগুটি ফিরে যেত বাড়ির দিকে।
এসে পড়ল আমাদের নাটক প্রতিযোগিতার দিন। পাঁচটার সময়ে আমাদের নাটক। ঠিক সময়ে রবীন্দ্র ভবনে এসে পড়লাম সবাই।শুধু নক্ষত্র রায়ের পার্ট যে করবে সেই রণজয়ের তখনও কোনও পাত্তা নেই। পরমহংস স্যার পায়চারি করছেন আর ঘড়ি দেখছেন বারবার। পাঁচ মিনিট যায়, দশ মিনিট যায়, রণজয়ের দেখা নেই।
চারটের সময়ে রণজয়ের কাকা স্কুটার চালিয়ে এলেন রবীন্দ্র ভবনে। আমরা সবাই ঘিরে ধরলাম তাঁকে। ভদ্রলোক বললেন, দাদার সকাল থেকেই বুকে ব্যথা করছিল। ডাক্তারের কথামত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। ওঁর হার্টের অবস্থা ভাল নয়। রণজয় বাবার কাছে আছে, ওর পক্ষে আজ আর অভিনয় করা সম্ভব নয়।
পরমহংস স্যার শুকনো গলায় বললেন, সর্বনাশ! নক্ষত্র রায়ের পার্ট কে করবে এখন?
সবাই চুপ। পরমহংস স্যার এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন যেভাবে বানভাসি মানুষ আঁকড়ে ধরার জন্য খড়কুটো খোঁজে। হটাত করে আমার দিকে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে বললেন, তুই তো এতদিন প্রম্পটিং করেছিস। তুই পারবি না চালিয়ে দিতে?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, আমার সকাল থেকেই কেমন গা গুলোচ্ছে, আমি পারব না স্যার।
দ্রাঘিমাংশ পাশ থেকে বলল, আমি পারব।
পরমহংস স্যার বিস্মিত হয়ে বললেন, পাগল নাকি? পার্ট মুখস্থ না হলে কেমন করে ম্যানেজ করবি তুই?
দ্রাঘিমাংশ বলল, শুধু নক্ষত্র রায় কেন, একমাস ধরে মহড়ায় শুনে শুনে প্রত্যেকটা চরিত্রের পার্ট আমা্র আগাগোড়া মুখস্থ। শুনিয়ে দেব?
পরমহংস স্যার অসহায়ের মত ঠোঁট কামড়ালেন। তারপর দ্রাঘিমাংশর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, যা, তুই গ্রিনরুমে গিয়ে মেক আপ করে নে। তারপর যা আছে কপালে।
শুরু হল আমাদের নাটক। রঘুপতির ভূমিকায় দারুণ অভিনয় করল সুমন। গোবিন্দমাণিক্য আর জয়সিংহের চরিত্রে প্রচুর হাততালি পেল অক্ষাংশ আর কৌশিক। এমনকী গুণবতী আর অপর্ণার রোলেও দিব্যি মানিয়ে গেল রাজেশ আর সোমনাথকে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে নক্ষত্র রায়ের রোলে জমিয়ে দিল দ্রাঘিমাংশ। মনেই হল না একটুক্ষণ আগেই সে জানতে পেরেছে যে তাকে নক্ষত্র রায় সাজতে হবে। রঘুপতির প্ররোচনায় সিংহাসনে বসার লোভ কখনও চকচক করছে নক্ষত্র রায়ের চোখে। ওদিকে আবার দাদা গোবিন্দমাণিক্যর সামনে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে নক্ষত্রর ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ব। দ্রাঘিমাংশ এত সুন্দর তার চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলল যে জাজ্রা পর্যন্ত হাততালি দিয়ে উঠলেন সামনের সারি থেকে।
নাটক প্রতিযোগিতায় প্রায় সব প্রাইজ জিতে নিল আমাদের বিন্দুবাসিনী বয়েজ। সেরা নির্দেশকের প্রাইজ পেলেন পরমহংস স্যার। সুমন পেল শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার। নক্ষত্র রায়ের চরিত্রকে প্রাণদান করার জন্য দ্রাঘিমাংশ পেল বিশেষ পুরষ্কার। কুশীলবের প্রেসিডেণ্ট গ্রিনরুমে এসে দেখা করে গেলেন দ্রাঘিমাংশর সাথে। বললেন, তোমার ভেতরে নাটক আছে, তুমি অনেকদূর যাবে।
গ্রিনরুমে মেক আপ তুলছে নাটকের অভিনেতারা। আমরা সাহায্য করছি তাদের। পরমহংস স্যার কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছেন আমাদের মধ্যে। বড় একটা শ্বাস ফেলে পরমহংস স্যার বললেন, বেশ কয়েকবছর আগে কুশীলবের রিহার্সালে গিয়েছিলাম আমি। আমার ধারণা ছিল যে মূল চরিত্রে অভিনয় না করতে পারলে অভিনয় করাই বৃথা।
আমরা তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে। পরমহংস স্যার বললেন, আজ বুড়ো বয়সে আমার ছেলের কাছ থেকে এক বিরাট শিক্ষা পেলাম আমি।আসলে ছোট পার্ট বড় পার্ট বলে কিছু হয় না। ভাল অভিনয়টাই আসল, অন্য কিছু নয়। প্রত্যেক অভিনেতা সমান তালে অভিনয় না করলে কখনওই একটা সার্থক নাটক সৃষ্টি হয় না। শুধু তাই নয়, মঞ্চের বাইরে থেকে যারা রূপসজ্জা করে, আলোর কাজ করে, প্রপস্ সাজায় কিংবা শব্দ সংযোজনা করে তারা প্রত্যেকেই একটা বড় চাকার ছোট ছোট নাট বল্টুর মত গুরুত্বপূর্ন অংশ।
সবার চোখ চকচক করছে খুশিতে। সবাই আলিঙ্গন করছে দ্রাঘিমাংশকে। শেষে আমার টার্ন এল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরতেই আমার কানের কাছে মুখটা এনে দ্রাঘিমাংশ বলল, তুই অত দাঁত ক্যালাচ্ছিস কেন, সবার ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। প্রম্পটারের কথা কিন্তু কিছু বলা হয়নি!
আমি হাঁ করে তাকালাম ওর দিকে। আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে হো হো করে হেসে ফেলল দ্রাঘিমাংশ।
ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
মিষ্টি নিমপাতা
নেহা বড় হয়েছে । বছর পনের বয়েস । পরের বছর মাধ্যমিক । বোর্ডের প্রথম পরীক্ষা । নেহা খুব সিরিয়াস ছিল এতদিন পড়াশুনোর ব্যাপারে । ইদানিং কম্পিউটার একটু বেশি সময় খেয়ে নেয় তার । মায়ের কাছে এই নিয়ে বকুনিও কম শুনছে না । তবুও তার হেলদোল নেই ।
মা কিছু বললেই বলে "লাইট, লাইট"
মা জোরে কথা বললেই বলে "চিল, চিল"
মা পড়তে বসতে বললেই বলে "কুল, কুল"
মা বলে "কি কুলুক্ষণেই এই কম্পিউটারটা কিনে দিলাম তোকে, বোর্ড পরীক্ষার পর দিলেই হত"
নেহা বলে "কাম অন মা, কম্পিউটার তো স্কুলেই কিনতে বলেছিল, উফ্, তুমি এত টেনশান করোনা যে কি বলব ! রিল্যাক্স মা রিল্যাক্স ! আমাকে আমার মত থাকতে দাও না মা"
মা আবার নিজের কাজে ফিরে যান । ভাবেন সত্যি তো ! আমাদের এত চিন্তা ! আমাদের মা তো আমাদের বোর্ডের পরীক্ষার আগে এমন করে টেনশন করত না, আমি বোধ হয় একটু বেশি বাড়াবাড়িই করছি ।
পরক্ষণেই মায়া হয় নেহাটার জন্যে। এই একরত্তি মেয়েটা আমার; হঠাত কেমন যেন বড় হয়ে গেছে । আর পড়াশুনোতে তো বরাবরই ভালো করে নেহা । ফ্রিজ খুলে একটা গ্লাসে ম্যাঙ্গো-পাল্প, বরফকুচি , দই আর একস্কুপ আইসক্রিম দিয়ে চট করে বানিয়ে ফেলেন মকটেল । "এনে নেহা, খেয়ে নে তো এটা " নেহা বেজায় খুশি হয়ে আবার মন দেয় কম্পিউটারে । মা চলে যা্ন নিজের সেলাইফোঁড়াই, টুকিটাকি ঘর্-গেরস্থালির কাজে । আবার ভুলে যান নেহার মাধ্যমিক-প্রসঙ্গ। এমন ভাবেই চলতে থাকে.. কম্পিউটারের স্ক্রিন সেভারের মত । একবার মাধ্যমিক আর পরক্ষণেই নেহার পড়াশোনায় নিষ্ক্রিয়তা, কম্প্যুটার অনুষঙ্গ, সোশ্যালনেট...
বাবা বাড়ি এলে রাতে খাবার টেবিলে নেহার সারাদিনের সব প্রশ্নর উত্তর খোঁজার চেষ্টা শুরু হয় । রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বাবা একে একে সলভ করেন । খুবই গুরুগম্ভীর সে আলোচনা । ত্রিকোণমিতির সেই প্রবলেমটা, ফিজিক্সের সেই মেকানিক্সের পুলির অঙ্কটা , কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং, কেমিস্ট্রির সেই ভয়াবহ ব্যালেন্সিংটা, কিম্বা আর কিছু না হোক জিওমেট্রি বই বাঁহাতে খুলে একটা খতরনাক রাইডার । বাবা আর মেয়ের সারাদিনের মোলাকাতের সময় এই একটাই । আর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর বাবা হিসেবে তিনি যতটা পারেন প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যান । টেবিল জুড়ে চলতে থাকে টেষ্টপেপারের চাপান-উতোর । বেচারী মা কোণঠাসা হয়ে যান । মেয়ের যত পড়া বাবাকে দেখলে মনে পড়ে যায় । নেহা একসময় বলে ওঠে "জানো বাবা ? আজ ফেসবুকে স্তুতি বলছিল এবার নাকি আমাদের কোয়েশ্চেনে রিডিং টাইম দেওয়া হবে"
মা সেই অছিলায় একটু নালিশের ভঙ্গীতে বলে ওঠেন "আচ্ছা শোনো, তুমি কিন্তু ওকে এই কম্পিউটার করার সময়টা একটু বেঁধে দিলে ভালো হয়; আমি বললেই বলে ফেসবুক, অর্কুটে বন্ধুদের সাথে পড়ার কথাই তো বলছি"
নেহা বলে ওঠে "এই শুরু হল, বাবা দেখো আমি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে একটু রিলাক্স করি । খেলাধূলো করিনা, নাচটাও এবছর মা বন্ধ করে দিল ; মা কেবল আমার পড়া, পড়া, পড়া এই নিয়ে আমার পেছনে সারাদিন পড়ে থাকে । আমি পড়ছি, না কম্পিউটারে গেম খেলছি সারাদিন তাই মায়ের চিন্তা । বাবা "সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে"র মত নেহা আর তার মায়ের মাঝামাঝি থেকে বললেন "নো চাপ, তোমরা পারোও বটে !"
"আচ্ছা বাবা তুমিই বলো আমাদের এই যুগটাতে সোশ্যাল নেট না জানলে আমি তো কমপ্লিটলি পিছিয়ে পড়ব দুনিয়া থেকে । পড়াশুনো করে পরীক্ষা পাশ হবে কিন্তু সোশ্যাল নেটে না ঢুকলে আমায় বন্ধুরা ছি ছি করবে । আর আমার পরীক্ষার রেজাল্টটা দেখো । হ্যঁ, এবার না হয় আমি অঙ্কে আগের বারের চেয়ে কম পেয়েছি তার মানেই কি আমি পড়ছি না ? তুমি বলো বাবা !"
"ঠিক আছে, এবার থেকে মায়ের কথা শুনে ঘড়ি ধরে কম্পিউটারে থেকো " বাবা বললেন ।
"মা, তুমিও তো যখন বাবার ল্যাপটপে ব্রাউস করো তখন তোমার খেয়াল থাকে? সেদিন তো তোমার গ্যাসে দুধ পড়ে গেল । আরেকদিন ওই টিভি সিরিয়াল দেখতে গিয়ে আভেনে কেক পুড়ে গেল । প্লিজ মা, আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো" নেহা বলে।
মায়ের বিরুদ্ধে এহেন অনস্থা প্রস্তাবে মা'র নেহার ওপর খুব অভিমান হল ।
"একি তুমি খাবে না ?" বাবা বললেন।
মা বাকি খাবার দাবার ফ্রিজে তুলে রেখে নেহার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন "তোমার আস্কারায় আজ মেয়ে এত বাড় বেড়েছে । বাড়িতে থাকলে জানতে ও কতক্ষণ পড়ছে আর কতক্ষণ ঐ ফেসবুক আর অর্কুটে সময় দিচ্ছে"
নেহা মায়ের সাথে কথা বলল না আর মাকে একবারের জন্য সাধলোও না, খেয়ে নেওয়ার জন্য । বেচারা মা ঘরে গিয়ে অন্ধকার করে শুয়ে পড়লেন । মনে মনে ঠিক করলেন আর কোনোদিন নেহার পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো মাথা ঘামাবেন না । ও যা ভালো বোঝে তাই করুক । নেহার মাধ্যমিক নিয়ে আজ থেকে তাঁর আর কোনো দায় নেই । নেহা তার ঘরে গিয়ে যথারীতি কম্পিউটার অন করল আর জিটকের সবুজ হাতছানিকে উপেক্ষা করতে না পেরে বকে চলল অনর্গল। কত বন্ধু, কত পড়ার আলোচনা আর নতুন নতুন মুখোরোচক গসিপ। মাঝরাতে কখন সে শুয়ে পড়েছে তার খেয়াল নেই । মা এসে ঘরের আলো নিবিয়ে কম্পিউটার অফ করে চলে গেছেন সে জানেও না ।
নরমে গরমে চলছিল নেহার পড়ালেখা সাথে সোশ্যালনেটওয়ার্কিং, নতুন বন্ধুত্ব আর মাধ্যমিকের প্রস্তুতি। হঠাত ফেসবুকে তার বন্ধুত্ব হল নিমপাতার সাথে, প্রোফাইলে নিমপাতার ছবি । মেয়ে একটা, বয়স লেখা নেই । ইমেল এড্রেসও নেই । মেয়ে দেখে বন্ধুত্ব করে ফেলল আর রোজ কথা হতে লাগল । বেশ ভালো লাগছিল সেই মূহুর্তগুলো নেহার । রাত হলেই মা-বাবার ঘরের আলো নিবে যায় আর নেহার শুরু হয় সেই সবুজ আলোর মোম জোছনা, নতুন বন্ধুর সাথে কথা । খাওয়াদাওয়া, গল্পের বই, সিনেমা, গান কত কিছু জানে এই মেয়েটা আর নেহার ভালোলাগা গুলোর সাথে মিলেমিশে একাকার হয় ।
......
নেহা : তুমি আমার চেয়ে কি বয়সে বড় ? আমি এখন ষোলো ছুঁই ছুঁই । আর তুমি ?
নিমপাতা : কি হবে জেনে ? বেশ তো আমরা বন্ধু আছি এখানে । তোমার স্কুল কখন ?
নেহা : সকালে আটটায় আর বাড়ি ফিরি একটায়
নিমপাতা : তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ড কে?
নেহা : এতদিন আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল আমার মা । এখন আর মা আমার বন্ধু নেই গো।
নিমপাতা : ধুস্ মা আবার কারো প্রিয় বন্ধু হয় নাকি ? মা তো খালি শাসন করে, বকুনি দেয়, মারধোর করে
নেহা : না গো, আমার মা তেমন ছিল না । ইদানিং আমার মাধ্যমিক যত এগিয়ে আসছে মা তত যেন আমার সাথে কেমন করছে আর আমার এই কম্পিউটার খোলার ব্যাপারে মায়ের সাথে রোজ রোজ অশান্তি ; এখন মা আমার সাথে কথা বলছে না । আমিও বলিনা, শুধু দরকার ছাড়া ।
নিমপাতা : তুমি এখন বুঝবে না । যখন তুমি মা হবে তখন বুঝবে ।
নেহা : তুমি তাহলে আমার চেয়ে অনেক বড় । এমন বড়দের মত কথা বলছ যখন
নিমপাতা : যাকগে ওসব কথা, তোমার কি খেতে সবচেয়ে ভালো লাগে? আমার যেমন চাইনিজ ।
নেহাঃ আমার তন্দুরি খেতে বেষ্ট লাগে। জানো ? মা আমায় এত ভালোবাসে আমি তন্দুরী খেতে চাই বলে বই পড়ে, টিভি দেখে মা সব তন্দুরী রান্না বানায় আমার জন্যে ।
নিমপাতা : বাবা! তুমি কি লাকি গো ! আমাদের মা কিন্তু এমন না । আমরা অনেক ভাইবোন । মা কার কথা রাখবে বলো? এ বলে মাছের ঝোল, ও বলে ঝাল, ও বলে মাছ খাব না ...কিন্তু আমরা খুব মায়ের বাধ্য ছিলাম । মা যা করে দিত সেটাই হাসিমুখে খেয়ে নিতাম । আর কোনো কোনো দিন বায়না করলে মা বলত তোমরা হাত লাগাও আমার সাথে আমি বানিয়ে দিচ্ছি ।
নেহা : আমার মা আমাকে খুব প্যাম্পার করে, কোনো কাজ করতে দিতে চায় না । আমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে দেয় । আমি রোজ স্কুল থেকে ফিরে বইয়ের ব্যাগ সোফায়, স্কুলড্রেস খাটে ফেলে দিয়ে টিউশানের জন্যে তৈরী হই । মা সব জায়গায় তুলে রাখে আর আমাকে কেবল বলে তুই শুধু মন দিয়ে লেখাপড়াটা করে যা ।
নিমপাতা : আমার মা আবার ঠিক উল্টো ।মা বলতেন রোজ চা করতে হবে তোমাকে সকালে উঠে
আর বিছানাটা ঝেড়ে গুছিয়ে রেখে তারপর পড়তে বসতে হবে । আমি বলতাম , মা আমার যে বড্ড পড়ার চাপ । মা বলতেন সারাদিনে ওইটুকু কাজ করে পড়াশোনা করলে কোনো ক্ষতি হবে না ।
নেহা : তুমি করতে সব আর তারপর পড়তে?
নিমপাতা : হ্যাঁ,মায়ের মুখের ওপর কথা বলব কি! মায়ের চোখের দিকে তাকালেই মনে হত মা ই ঠিক বলছে । যা বলছে আমার ভালর জন্যে বলছে ।
নেহা : তোমার মা তোমাকে নিয়ে সিনেমা যেত?
নিমপাতা : হ্যাঁ, আমরা মায়ের সাথে সত্যজিত রায়ের ছবি, শরতচন্দ্রের গল্প নিয়ে ছবি, কিম্বা শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বক্সী দেখতে যেতাম ।
নেহা : আমিও মায়ের সাথে সবকটা হ্যারি পটার দেখেছি । নার্নিয়াও দেখেছি । আর লর্ড অফ দ্য রিংস দেখেছি বাবার সাথে, তুমি দেখনি?
নিমপাতা : না আমার দেখা হয় নি এখনো ।
নেহাঃ অনেক রাত হল। এবার শুতে হবে । মা নয়ত কাল সকালে আবার মুখ ভার করে থাকবে ।
নিমপাতা : কাল সকালে না হয় স্কুল নাই বা গেলে, আবার তোমার সাথে চ্যাট করব আমি ।
নেহা : ওরেব্বাবা, কাল স্কুল না গেলে আমার ইউনিট টেষ্টের মার্কস জানতে পারবো না যে । আর তাহলে মা যে আরো রেগে যাবে ।
নিমপাতা : তুমি তো দেখছি মাকে খুব ভয় করো ।
নেহা : না গো, ভয় করিনা , ভালোবাসি । আমার মা খুব ভালো মানুষ। শুধু আমাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা করে ।
নিমপাতা : বাহ্, তুমি মা কে খুব ভালোবাসো.. শুনে আমার খুব ভালো লাগল । তাহলে মা কে নিয়ে কাল স্কুল থেকে আমার বাড়ি চলে এসো । আলাপ হবে তোমার সাথে, তোমার মায়ের সাথে ।
নেহা : না গো পরীক্ষার পর যাবো একদিন । এখন থেকে আমাকে বোর্ডের এক্সামের জন্য বাড়তি পড়তে হবে । এখন আর অত বেড়ানো চলবে না ।
নিমপাতা: বেশ তাহলে গুডনাইট !
নেহা : গুড নাইট, আজকের মত ।
নেহা কম্পিউটার বন্ধ করে আলো নিবিয়ে শুতে যাবে, মনে পড়ে গেল স্কুলের ল্যাব-খাতা জমা দেওয়ার কথা । চোখে মুখে জল দিয়ে এসে হাত মুছে শুরু করে দিল লেখা ।
রাত তখন একটা। শেষ হল খাতা লেখা । টেবিলে গিয়ে স্কুলের ব্যাগ গোছতে যাবে মনে পড়ে গেল শ্রুতি মিস রেফারেন্স বই থেকে দশটা করে অঙ্ক রোজ কষে আনতে বলেছিলেন । কাল খাতা না নিয়ে স্কুলে গেলে গার্জেন কল হবে । এই নিয়ে দু দিন নেহা ভুলে গেছে । নেহার ওপর স্কুলের টিচারদের খুব আশা । মেয়েটা ইচ্ছে করলেই স্ট্যান্ড করতে পারে । নেহার মাথায় জেদ চেপে গেল । টেবিলে বসে মন দিয়ে সেদিনের আর গত দুদিনের মোট তিরিশটা অঙ্ক রেফারেন্স বুক থেকে করে ফেলল । কয়েকটা পারলনা । সেগুলো পরেরদিন বাবাকে জিগেস করে নেবে ঠিক করল । তখন বাজে রাত আড়াইটে । ঘুমে চোখ তার ঢুলে আসছিল । পরদিন সকালে ঘুম ভাঙালেন মা ।ভাগ্যি মা ছিল। আজ তাকে না ডেকে দিলে কি হত ! স্কুল যাবার সময় মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে নেহা বলল "ও মা, তুমি আমার ওপর এখনো রাগ করে আছো? , আমি তো পড়াশোনা সব করে নিচ্ছি , দেখো এবার আমি আরো ভালো করব"
মা কোনো উত্তর দিলেন না ।
ইউনিট টেষ্টের ফল বেরিয়েছে । একটাতেও নেহার মার্কস ভালো হয়নি এবার । টিচাররাও আপসেট । সেই সাথে নেহাও । বাড়ি ফিরে চুপচাপ খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে নেহা ভাবল বই খুলে বসে যাবে । কিন্তু ডেস্কটপের আবেদন তাকে টেনে নিয়ে গেল মাউসের দিকে । হাত সুড়সুড় করে উঠল । জ্বলে উঠল নীল আলো । সমুদ্রের ঢেউয়ের ওয়ালপেপার । অন করল ওয়াইফাই মোডেম । ফেসবুকে পৌঁছেই সেই অবারিত বন্ধুত্বের হাতছানি । কি ভাল লাগছে নেহার সেই মূহুর্ত্তে। সব জাগতিক দুঃখকেও ভুলে থাকা যায় । একে একে জ্বলে উঠেছে সকলের সবুজ আলোর বিন্দু । স্তুতি, তিথি, বন্দনা, শর্মিলা, আর সেই মহিলা যার সাথে আগের দিন রাতেও অনেক কথা হয়েছে , যার প্রোফাইল নাম "নিমপাতা"
নিমপাতা: হ্যালো নেহা! স্কুল থেকে ফিরলে?
নেহা : হ্যাঁ
নিমপাতা: কেমন মার্কস পেলে টেষ্টে?
নেহা : ভালো নয় ।
নিমপাতা : কেন? তুমি তো ভালো মেয়ে, মা'কে কত ভালোবাস !
নেহা : কিন্তু মায়ের কথা তো শুনিনা আজকাল । তাই তো আমার এত খারাপ হয়েছে এবার
নিমপাতা : ঠিক আছে । এবার থেকে মা যা চায় তাই কোরো , তোমার ভালো হবে দেখো ।
নেহা : আসলে আমি বুঝে উঠতে পারিনা কতক্ষণ সময় পড়ার টেবিলে দেব আর কতক্ষণ কম্পিউটারে । আর মা আমার টাইম ম্যানেজমেন্ট করে দিলেও রেগে যাই মায়ের ওপর ।
নিমপাতা : ঠিক আছে এবার থেকে মায়ের সব কথা শুনে চলো, সব ঠিক ঠাক হয়ে যাবে ।
নেহা : তুমি ঠিক বলছ তো নিমপাতা?
নিমপাতা : যাও গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে একটিবার বলো যে মা, আমি আগের মত লক্ষী হয়ে যাব, তোমার কথা শুনে চলব তাহলেই মা আর রাগ করবে না ।
নেহা দৌড়ে পাশের ঘরে গিয়ে মা, মা করে ডাকতে গেল কিন্তু মাকে দেখতে পেল না । খুব মন খারাপ আজ তার । বারান্দায় গিয়ে দ্যাখে মা বসে আছে পেছন ফিরে...জড়িয়ে গলাটা ধরে আদর করতে গিয়ে দেখতে পেল মায়ের কোলে ছোট্ট নোটবুক কম্পিউটার আর যথারীতি মা তখনো "নিমপাতা" হয়ে ফেসবুকের সবুজ ঘরে আলো জ্বেলে রেখেছে তার আদরের নেহার কথা শুনবে বলে ।
ইন্দিরা মুখার্জি
ভবানীপুর, কলকাতা
ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প