খেলাঘরখেলাঘর

অদ্‌-ভূত প্রতিশোধ


আজ জমিদার চণ্ডীকা চরণ চৌধুরীর পারলৌকিক কাজ – হৈ হৈ ব্যাপার। দুই মেয়ে সপরিবারে এসেছে এ ছাড়াও দূর দূর থেকে আসা অনেক আত্মীয় স্বজনে এত বড় জমিদার বাড়ি একেবারে গম গম করছে। দুপুরে জমিদারির ছয় সাতটা গ্রামের প্রায় হাজার দুয়েক লোক পাত পেড়ে খাবে পাশের মাঠে – সেখানে বিরাট বিরাট সামিয়ানা খাটানো হয়েছে আর একদিকে কলাপাতার ঢাঁই – আশে পাশের গ্রামের কারুর বাড়িতে কলাপাতা বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। শ খানেকের উপর গ্রামের লোক বেগার খাটছে মাঠে, রান্নার কাজে। রান্নার বিশাল আয়োজন – সে এক এলাহি ব্যাপার – সারা রাত ধরে হ্যাজাকের আলোতে গ্রামের জনা কুড়ি বৌ ঝি তরকারি কুটে পাহাড় বানিয়েছে আর সেই সাথে জোগালিরা মশলা বেঁটে পরাতের উপর স্তুপ করেছে – এখন পোস্ত বাটা চলছে। কাক ভোর থেকেই রান্না শুরু – জনা দশেক রাঁধুনী বিরাট বিরাট কাঠের উনুনে বড় বড় হাণ্ডা ও কড়াই চাপিয়েছে পোলাও, ফুলকপির কালিয়া, আলু পোস্ত, পায়েস, ইত্যাদি রান্নার জন্য – ওদের সাথে জনা পনের লোক খেটে চলেছে অবিরাম। সবার গলদঘর্ম অবস্থা – রান্না ভালো না হলে কারুর ঘাড়েই মাথা থাকবে না। দুদিন আগে থেকেই মিষ্টি তৈরির ভিয়েন বসেছে তিন চার ধরনের মিষ্টি, দৈ ও বোঁদে বানানোর জন্য তাই দূর শহর থেকে চার পাঁচ জন ময়রা এসেছে এই কাজে মানে ওদের ধরে আনা হয়েছে। বিরাট সব কাঠের পরাতে মিষ্টি ও বোঁদের পাহাড় হয়ে আছে আর শ দুয়েক গাড়িতে দৈ বসানো হয়েছে। জমিদারবাবুর বড় ছেলে কন্দর্প কান্তি চৌধুরী বাবার শেষ কাজ খুবই ধুমধাম করে করছেন যাতে জমিদারির সমস্ত লোক বলে, হয়েছিলো বটে খাওয়া দাওয়া জমিদারবাবুর শ্রাদ্ধে – জীবনে এত ভালো কোথাও খাই নি। জমিদারবাবুর পেয়ারের লেঠেলরা চার দিকে নজর রেখেছে – ওদের ভয়ে রাঁধুনী বা অন্যান্য কাজের লোক তটস্থ – কারুর মুখেই কোন কথা নেই – একটু এদিক ওদিক হলেই ঘাড় থেকে মাথা নেমে যাবে। জমিদারবাবুর দৌলতে এই লেঠেলদের সাত খুন মাপ – পুলিশের মুখ উপযুক্ত দক্ষিণাতে বন্ধই থাকে। অনেককে মেরে বিলের কাদায় পুঁতে দিয়েছে – গ্রামের কারুর টুঁ শব্দ করার উপায় নেই – বাড়ির লোক ভয়ে কাঁদতে পারে নি শ্রাদ্ধ তো দূরে থাক।
       
ভোর বেলা থেকে জমিদার বাড়ির বিরাট উঠানে সামিয়ানা খাটিয়ে চলেছে শ্রাদ্ধের কাজের আয়োজন – বড় বড় ঝুড়িতে ফুল, মালা আর তার সাথে কলা, আপেল, মুসাম্বি, বেদানা ইত্যাদি নানা রকমের ফল, সুগন্ধী বাসমতি চাল, জমিদারবাবুর পছন্দের সব রকম তরকারি ইত্যাদি – শ্রাদ্ধের দানের জন্য প্রচুর কাপড়, ধুতি ও অন্যান্য জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। শ্রাদ্ধের কাজ করছেন নর নারায়ণ তর্করত্ন মশাই – এই এলাকার সব থেকে বড় পণ্ডিত ও খুবই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। ছোট বেলায় নবদ্বীপের টোলে পড়াশুনা করে অনেক বছর বারাণসীতে শাস্ত্র চর্চা করেছেন – বেদ উপনিষদ একেবারে কণ্ঠস্থ। গ্রামে ফিরে এসে নিজের একটা টোল খুলেছেন ওখানে জনা দশেক ছেলে বিনা পারিশ্রমিকে শাস্ত্র পড়ে। খুবই সাধারণ জীবন যাত্রা – কোন রকম অহংকার বা বাহুল্য নেই – বিয়েও করেন নি – স্বপাকেই খান। রোগা ছিপছিপে ফরসা চেহারা, মাথায় বেশ মোটা টিকি – বাকি চুল কামানো, কপালে শ্বেত চন্দনের ফোঁটা – শীত গ্রীষ্ম বারো মাস পরনে সাদা ধুতি আর গায়ে একটা চাদর – সাধারণতঃ খালি পায়ে নয়তো খড়ম পরেই থাকেন তবে দূরে কোথাও যেতে হলে ক্যানভাসের জুতো। জমিদারবাবুর শ্রাদ্ধের কাজটা নিতে ওকে প্রায় বাধ্য করা হয়েছে – জলে থেকে তো আর কুমিরের সাথে বিবাদ  করা যায় না – সকালে লেঠেলদের সর্দার নিজে এসে ওকে নিয়ে এসেছে। আজ কাজের জন্য উপবাস করেছেন – একেবারে বাড়ি ফিরে খাবেন। শ্রাদ্ধের কাজটা অবশ্য খুবই নিষ্ঠার সাথেই করছেন – শেষ হতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেলো। জমিদারবাবুর প্রেতাত্মার শান্তি ও অক্ষয় স্বর্গ লাভের ব্যবস্থা করে শ্রাদ্ধ শেষ করলেন। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান থেকে কিছুই নেবেন না – শেষে কন্দর্প কান্তি জোর করে এক বিঘা জমি ওর নামে দেবোত্তর করে দেওয়ার দলিলটা ধরিয়ে দিলেন। ওদিকে দুপুর থেকেই মাঠে খাওয়া দাওয়া চলেছে – যত খুশি খাও – পেট পুরে খেয়ে গ্রামের লোকজন ছেলে মেয়েদের হাত ধরে প্রয়াত জমিদারবাবুর জয়ধ্বনি দিতে দিতে বাড়ির পথ ধরেছে সঙ্গে বাড়ির মেয়েদের জন্য খাবারের পোঁটলা। যারা লোভে পড়ে অতিরিক্ত খেয়ে নিয়েছে তারা আশে পাশের গাছের ছায়াতে শুয়ে পড়েছে – হেঁটে বাড়ি ফেরার অবস্থায় নেই। থানার দারোগাবাবু ও সেপাইরা আজ বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিত – খাওয়া দাওয়ার পর সবাইকে উপযুক্ত ভেটও দেওয়া হয়েছে।