খেলাঘরখেলাঘর

অদ্‌-ভূত প্রতিশোধ

ভোরের আগেই দারোয়ানরা পুকুর পাড় থেকে কোন রকমে উঠে পালিয়ে গেলো নিজেদের বাড়ি আড়া ছাপড়ার দিকে – এত বড় বাড়ি একেবারে শুনশান। সকাল বেলাতেই চণ্ডীকা চরণের মেয়েরা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরা এক কাপড়ে রওয়ানা দিলো নিজেদের বাড়ির দিকে – টাকা পয়সা, সোনা দানা, কাপড় চোপড় সবই রয়ে গেলো বাড়ির ভেতরে পচা কাদা ও গোবরে মাখামাখি হয়ে। শুধু জমিদার গিন্নী একা বুক চাপড়ে কেঁদে গেলেন সারা দিন – ওকে সান্তনা দেওয়ারও কেউ রইলো না। বিকেলের দিকে নর নারায়ণ হাজির হলেন গ্রামে যেন এই মাত্র খবর পেয়েছেন। ওকে দেখে গ্রামের লোক ঘিরে ধরেছে – হাজার প্রশ্ন চার দিক থেকে। নর নারায়ণ ধীরে ধীরে বললেন,
    ‘সবই ভগবানের বিচার – বোধ হয় পাপের পাল্লা বেশী ভারি হয়ে যাওয়াতে স্বয়ং মহাদেব নিজের চেলা চামুণ্ডাদের পাঠিয়েছিলেন শাস্তি দেওয়ার জন্য না হলে এরকম ঘটনা তো ঘটতে পারে না। আমার মনে হয় কারুরই ও বাড়িতে ঢোকা আর উচিত হবে না।’    
গ্রামের সাধারণ মানুষ এক বাক্যে স্বীকার করে নিলো পণ্ডিত মশাইর কথা। বয়স্ক লোকেরা মাথা নেড়ে বললো,
    ‘পণ্ডিত মশাই সর্বজ্ঞ – উনি ঠিকই বলেছেন – এ রকম ভূতের নেত্যর কথা তো আমরা বাপের জন্মেও শুনি নি। ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় আমরা আর যাচ্ছি না।’
        সেদিন রাত্রে বিলের ধারে আবার জমায়েত – ছায়ারা সবাই ভীষণ খুশি – ওদের আনন্দ দেখবার মত – অনেকে তো চারদিকে নেচে বেড়াচ্ছে। নর নারায়ণ সবাইকে থামিয়ে দিলেন।
    ‘এবার সব থেকে দরকারি কাজ – আমি ভূতনাথকে অনুরোধ করবো জমিদারির সমস্ত গ্রামে অরাজকতা শুরু হবার আগেই এক জন করে মোড়ল ঠিক করে দিতে – নাম পরিচয় জানালে আমি নিজে প্রত্যেকটা গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে মোড়ল নির্বাচন করে দেবো। জমিদার বাড়িতে যত টাকা পয়সা, সোনা দানা চার দিকে ছড়িয়ে আছে সেগুলো এক জায়গায় জড়ো করে সিন্দুকে ঢুকিয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো কিছু সাহসী লোক টাকা পয়সার লোভে ওই বাড়িতে হানা দিতে পারে তাই তোমাদের কয়েকজনকে বাড়ি পাহারার জন্য ওখানে থাকতে হবে। এই সবের বিলি ব্যবস্থা কি ভাবে করা হবে সেটা ভূতনাথের সাথে বসে তোমরাই ঠিক করবে। চণ্ডীকা চরণ যাদের জমি জবর দখল করেছিলো তার সমস্ত দলিল সিন্দুক থেকে বের করে আসল মালিকদের ফেরৎ দিয়ে দাও। গ্রামের যারা এত দিন জমিদারের দালালি করতো ওদের জলবিছুটির কয়েক ঘা দিয়ে ছেড়ে দেবে তার বেশী দরকার হবে না। জমিদার বাড়িও যেন ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয় যাতে কেউ কোন দিনও ওখানে বসবাস করতে না পারে। এই সমস্ত কাজ শেষ হবার পরই তোমাদের ছুটি – পরানের কাছে সব কিছু ভালো ভাবে শেষ হবার খবর পেলে আমি বিশেষ পূজা এবং শ্রাদ্ধ করে তোমাদের সবার এই ভূত জীবন থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করবো।’
ছায়ারা নরনারায়ণের জয়ধ্বনি দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে প্রণাম করলো – ওদের সবার মনে এই ভূত জীবন থেকে চিরতরে মুক্তির আশার আলো।


অঞ্জন নাথ
ব্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক

ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
কলকাতা