আমাদের বিন্দুবাসিনী বয়েজ স্কুলের ভূগোল স্যারের নাম পরমহংস পোদ্দার। তাঁর দুই যমজ ছেলে অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ আমাদের সহপাঠী। ক্লাসের ফার্স্ট বয় অক্ষাংশ একটু ধীর স্থির স্বভাবের। পড়াশোনায় তার খুব মন। খটমটে ইংরেজি গ্রামার হোক কিংবা কঠিনস্য কঠিন জিওমেট্রি, ভূগোলেড় কূটকাচালি হোক কিংবা ইতিহাসের সন-তারিখের আদ্যশ্রাদ্ধ, সবই অক্ষাংশের কাছে জলভাত। সাম্নের বার মাধ্যমিক দিতে চলেছি আমরা। অক্ষাংশের ওপর আমাদের স্কুলের তাই অনেক আশা।
ওদিকে দ্রাঘিমাংশর ধরনটা আবার একটু আলাদা। সারাদিন মাঠেঘাটে টো টো করে ঘুরে বেড়ায় সে। সেদিন একতা জ্যান্ত ঢোঁড়া সাপ কোত্থেকে নিয়ে এসে সোমনাথের স্কুলব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল দ্রাঘিমাংশ। গতমাসে আবার অন্য ঘটনা। দুটো বিশাল সাইজের সোনাব্যাঙ ক্লাসের ভেতর ছেড়ে দিয়েছিল দ্রাঘিমাংশ। চিরকার চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিল সব, সে এক হুলুস্থূল কান্ড! হেডস্যার টানা তিন পিরিয়ড নিল ডাউন করে রেখেছিলেন দ্রাঘিমাংশকে।
পরমহংস স্যারের আবার নাটকের দিকে ঝোঁক।পুরিয়ড অফ থাকলে টিচার্স কমনরুমে নাটকের বই পড়েন। আমরা যেমন গানের কলি গুনগুন করি, স্যার মেজাজ শরিফ থাকলে নাটকের ডায়ালগ বলেন একা একা।
সেদিন পরমহংস স্যার আমাদের পড়িয়ে ক্লাস থেকে বেরোচ্ছিলেন। সৌপায়ন বলল, নাটক প্রতিযোগিতার খবরটা শুনেছেন স্যার?
ভুরু কুঁচকে পরমহংস স্যার বললেন, কী খবর?
সৌপায়ন বলল, এবার কুশীলব নাট্যগোষ্ঠীর সুবর্ণ জয়ন্তী। তাই সব স্কুল গুলোর ধ্যে একটা রবীন্দ্রনাটক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে ওরাও। আমরা তাতে নাম দিতে চাই স্যার।
পরমহংস স্যার একটু বাঁকা হেসে বললেন, নাটক করবি? তা কী নাটক করতে চাস তোরা?
সৌপায়ন বলল, বাংলার স্যার বিজনবাবুর কাছে আমরা সেদিন রবি ঠাকুকের বিসর্জন নাটকের গল্পটা শুনেছিলাম। ওটা করলে কেমন হয় স্যার?
পরমহংস স্যার তাচ্ছিল্যের একটা হাস হেসে বললেন, তোরা করবি অভিনয়? ও তোদের কম্ম নয়। ছাগল দিয়ে কি আর হালচাষ হয়!
সুমন বাংলায় প্রত্যেকবার হায়েস্ট মার্কস্ পায়, স্কুল ম্যাগাজিনে কবিতা-টবিতা লেখে। সুমন বলল, আপনি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিলে আমরা আলবাত পারব।
পরমহংস স্যার বোধ হয় একটু খুশি হলেন। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, কিন্তু একটু অসুবিধে আছে। গুনবতী আর অপর্ণার পার্ট করার জন্য আমি মেয়ে কোথায় পাব?
লাস্ট বেঞ্চ থেকে দ্রাঘিমাংশ ফুট কাটল, সোমনাথ আর রাজেশ একদম মেয়েদের মত দেখতে। দুটোই স্নো পাউডার মেখে স্কুলে আসে। ওদের খুব ভাল মানাবে মেয়েদের রোলে।
হাসির ফুলঝুরি ছুটছে গোটা ক্লাসে।সোমনাথ আর রাজেশ দুজনেই খুব ফর্সা। লজ্জ্বা পেয়ে গাল লাল হয়ে গিয়েছে দুজনের। সোমনাথ মিনমিন করে বলল, দ্রাঘিমাংশ বাজে কথা বলছে। আমরা মোটেই স্নো পাউডার মেখে স্কুলে আসিনা স্যার।
পরমহংস স্যার হাত তুলে থামিয়ে দিলেন তাকে। একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সোমনাথ আর রাজেশের দিকে। ভুরু কুঁচকে বললেন, সত্যি সত্যিই ওই দুটো চরিত্রে তোদের দারুণ মানাবে!
গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল দুজন। পরমহংস স্যার সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মেয়েদের পার্ট বলে মন খারাপের কিছু নেই। আগে যে গ্রামে গ্রামে পালাগান হত, তাতে ছেলেরাই তো শাড়ি টাড়ি পরে মঞ্চে উঠে সীতা বা দ্রৌপদী সাজত।
দ্রাঘিমাংশ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ইয়ে, মানে রঘুপতির রোলটা কে করবে?
পরমহংস স্যার বললেন, রঘুপতি সুমন করবে। অক্ষাংশ সাজবে রাজা গোবিন্দমাণিক্য। জয়সিংহের রোলে কাস্ট করা যেতে পারে কৌশিককে।
দ্রাঘিমাংশ হতাশ গলায় বললেন, আমি কোনও রোল পাব না?
পরমহংস স্যার দৃঢ় গলায় বললেন, না।
অন্যান্য চরিত্রগুলির হন্য সৌপায়ন, রনজয় আর অমিতদের মনোনীত করা হল। দ্রাঘিমাংশ কিছু বলল না। আমি ঢোঁক গিলে বললাম, আমাকে কোনও পার্ট দেবেন না স্যার?
পরমহংস স্যার বললেন, তুই প্রম্পট্ করবি। কেউ পার্ট ভুলে গেলে উইংসের ধার থেকে তুই ধরিয়ে দিবি, কেমন?
সুমন, অক্ষাংশ আর কৌশিকের দিকে তাকিয়ে পরমহংস স্যার বললেন, তোদের তিনজনের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে নাটকটা। বাকিরা তো দুধভাত। মনে রাখিস, তোরা ভাল না করতে পারলে পুরো নাটকটাই কিন্তু মার খেয়ে যাবে।