খেলাঘরখেলাঘর

চিলাপাতার জঙ্গলে

মাদারিহাট পর্যটন লজের সামনে কালচে সবুজ জঙ্গলের ঠিক ওপরটা দিয়ে সিঁদুরের গোল টিপের মতো সূর্য পাটে যেতে বসেছে। পশ্চিম আকাশে রং ময়ূরনীল ছিল একটু আগেও, এখন অচেনা একটা জাফরানি বর্ণ এসে মিশেছে আকাশে। বিচ্ছুরিত রজন হলুদকে সরিয়ে দিয়ে উঁকি দিচ্ছে মিষ্টি একটা ম্যাজেন্টা। আমি আর ইমন চা খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখছিলাম। ইমন বলল, বুঝলি রাহুল, ডুয়ার্সের প্রকৃতি যে আমাদের এমন করে দেবে সেটা আমি ভাবতেই পারিনি।

আমি বললাম, যা বলেছিস। পরের বার আরও বেশিদিন হাতে নিয়ে আসব এখানে।

ইমন আর আমি ক্লাসমেট। একবার স্কুল থেকে অযোধ্যা পাহাড়ে এক্সকারশানে গিয়েছিলাম আমরা। তখনই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়েছিল। স্কুল থেকে বেরিয়ে আমরা একই কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। তখন আমরা দুজন ঘুরে বেড়িয়েছি প্রচুর। একটা আ্যড এজেন্সিতে দুজন চাকরি পেয়েছি একই সঙ্গে। তারপর বাউন্ডুলেপনা আরও যেন বেড়েছে আমাদের। পাহাড় আর সমুদ্রে আমরা গিয়েছি বেশ কয়েকবার। তবে ডুয়ার্সের সবুজ অরণ্যে ঢুঁ মারা আমাদের এই প্রথম।

ইমন বই পড়তে ভালোবাসে। বেড়াতে এলও এক-আধটা বই ওর ট্রাভেলব্যাগ থাকে। এবার ইমন ব্যাগের ভেতর একটা মহাভারত বয়ে এনেছে। ট্রেনে করে আসার সময় সুযোগ পেলেই গাব্দাগোব্দা সাইজের সেই বই পড়ে সময় কাটিয়েছে ইমন। আমি বিরক্ত হয়ে বলেছি, মহাভারত তো আমাদের সকলেরই পড়া। এর কাহিনি মোটামুটি প্রায় সব লোকেরই মুখস্ত।     কতবার পড়বি এক বই।

মহাভারতকে বলা হয় পঞ্চম বেদ জানিস তো, পৃথিবীর যাবতীয় ভাষায় রচিত মহাকাব্যের মধ্যে মহাভারত শুধু বৃহত্তমই নয়, নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম। ইমন হেসে বলেছে, মহাভারত কখনও পুরানো হয় না রে রাহুল। যতবার পড়ি, নতুন লাগে।

মাদারিহাটের কাছেই খয়েরবাড়ি প্রকৃতি উদ্যান। কাল বিকেলে গিয়েছিলাম সেখানে। হাতির পিঠে চেপে জলদাপাড়ার জঙ্গল চষেছি আজ সকালে। হলং, মালঙ্গী, চিরখাওয়া, বুড়িবসরা, সিসামারা আর ভালুক নদী বয়ে গিয়েছে বনের ভেতর দিয়ে। নদীর জলে কচুরিপানা খেতে আসা হাতির ছোট একটা পাল দেখতে পেয়ছি। এছাড়াও একটা গন্ডার, প্রচুর চেনা-অচেনা পাখি, কয়েকটা ময়ূর আর বাঁদর দেখতে পেয়ছি জঙ্গল সাফারি করার সময়।

আমাদের পর্যটন লজের ম্যানেজারের নাম নিত্য নিয়োগী। কাঁচাপাকা চুল, তামাটে গায়ের রং ঈষৎ প্রৌঢ় ভদ্রলোক লনে দঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের বারান্দায় দেখতে পেয়ে উঁচু গলায় বললেন, আপনারা তো কাল ফিরছেন ?

আমি চায়ে আরাম করে শেষ চুমুকটা দিয়ে গলা তুলে বললাম, কাল সকালে আলিপুরদুয়ার থেকে ট্রেন। কিন্তু আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দেবার জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হয় যে !

নিত্যবাবু বললেন, ভাববেন না। পদম প্রধান নামে একজন চেনা ড্রাইভার আছে। খবর পাঠিয়েছি, সে এসে পড়বে এখনই।

আমরা ধন্যবাদ জানালাম। নিত্যবাবু হেসে বললেন, এরপর এলে একটু সময় হাতে নিয়ে আসবেন। নলরাজার গড় জায়গটা তো এবার আপনাদের দেখা হল না। পরের বার ওটা মিস করবেন না।

আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, নলরাজার গড় ? সেটা আবার কোথায় ?

নিত্যবাবু বারান্দায় উঠে এসেছেন। একটা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, কোচ রাজবংশের আদিপুরুষ বিশ্বসিংহের তৃ্তীয় পুত্র ছিলেন চিলা রায়। তিনি নাকি চিলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তেন শত্রুর ওপর। চিলাপাতার জঙ্গল নামটা তাঁর নাম থেকেই এসেছে। সেই চিলা রায় এই জঙ্গলে একটি দুর্গ স্থাপন করান। সেই দুর্গই হল নলরাজার গড়।

আমাদের কথার মধ্যেই ইঞ্জিনের শব্দ পাওয়া গেল। কাঁচা রাস্তাটা দিয়ে শুকনো শালপাতা উড়িয়ে একটা জিপ ঢুকে পড়ল লজের কম্পাউন্ডের ভেতরে। নিত্যবাবু বললেন, ওই যে, পদম চলে এসেছে গাড়ি নিয়ে। ওর সঙ্গে কাল সকালে স্টেশনে যাবার ব্যাপারে কথা বলে নিন।

পদম ঘাড় নাড়ল। ইমন কবজির দিকে একবার চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করল, চিলাপাতার জঙ্গলে এখন নলরাজার গড়ে গিয়ে কি ঘুরে আসা যাবে একবার ?

পদম বলল, এখন বেরোলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে স্যার।

নিত্যবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন, এখন আর চিলাপাতার জঙ্গলে যাবেন না। এই জঙ্গলে হিংস্র জন্তু যেমন আছে, তেমনি রয়েছে চোরাশিকারিদের দল। একটু বাদেই অন্ধকার নেমে আসবে। রাতের জঙ্গল কিন্তু ভীষণ ভয়ংকর। একটু গলা খাঁকড়ে ভদ্রলোক বললেন, তাছাড়া অন্য ভয়ও আছে সেখানে।

ইমন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, অন্য ভয় আছে মানে ?

নিত্যবাবু ইতস্তত করে বললেন, ঘটনাটা খুলেই বলি। গত সপ্তাহে দক্ষিণ ভারতীয় এক সাংবাদিক এই লজে এসেছিলেন। একটা ইংরেজি কাগজে ট্রাভেলিং নিয়ে লেখালেখি করেন উনি। আলিপুরদুয়ার থেকে গাড়ি ভাড়া করে এসে বিকেলের দিকে নলরাজার গড় দেখতে ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন। অনেক রাতে যখন ফিরলেন তখন চোখমুখ বদলে গেছে, ভয়ে রীতিমত কাঁপছেন ভদ্রলোক। তিনি একা নন,  ড্রাইভার ছোকরার অবস্থাও একিরকম। জঙ্গলের মধ্যে নাকি একটা জলজমিতে একজোড়া বিশাল সাইজের মানুষের পায়ের ছাপ দেখেছেন তাঁরা।

ইমন কৌতূহলী স্বরে বলল, বিশাল সাইজ মানে ?

নিত্যবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, যত বড় পায়ের মাপের কথা ভদ্রলোক বললেন তাতে ওই পায়ের মালিককে জুতো পরাতে হলে জুতো কোম্পানিকে কুড়ি নম্বর সাইজ জুতো তৈ্রি করতে হবে ! এ তো রীতিমত ভৌতিক ব্যাপার মশাই ! সে কারণেই বলছিলাম আপনারা রাতের বেলা চিলাপাতার জঙ্গলে যাবেন না।

ইমন তাঁকে আশ্বস্ত করার ঢঙে বলল, জঙ্গলে যারা চোরা শিকার করে গাছ কাটে তারাই সম্ভবত এই কাজ করছে। সাধারণ মানুষ যাতে জঙ্গলে গভীরে না ঢোকে সেজন্য তাদের ভয় পাওয়াবার জন্য তারা নকল পায়ের ছাপ তৈ্রি করে ভয় দেখাছে।

জলপাইগুড়ির বাসিন্দা মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালিখিতে হাতেখড়ি। পেশায় সরকারি চাকুরে মৃগাঙ্ক নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিষ্টিত এবং স্বল্প পরিচিত কাগুজে পত্রিকায় এবং ওয়েব ম্যাগাজিনে বড়দের এবং ছোটদের জন্য গল্প এবং ভ্রমণকাহিনী লেখেন। লেখালিখির পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠে নেমে পড়েন মৃগাঙ্ক।