খেলাঘরখেলাঘর

অ্যালজেব্রা

পিসির বাড়ি বেড়াতে এসে একদিনের মধ্যেই বেশ বুঝলাম যে এই জায়গাটা অদ্ভূত। এমনটা যেন আগে কোথাও দেখেনি। প্রথমেই যেটা চোখে লাগল তা হচ্ছে এখানে মিষ্টির দোকানের নাম ‘সরকার জ্ঞানভান্ডার’। প্রথমে মনে হল বোধহয় শখ করে দিয়ে থাকবে। তারপরে দেখি আরেকটা দোকানের নাম ‘জ্ঞানের মজারু সন্দেশ’, তারপর আরেকটায় ‘জ্ঞানগম্যি মিষ্টান্ন ভান্ডার’। দেখছি আর ভাবছি এ আবার কেমন ধারা মিষ্টির দোকান। ভুল দেখছি না তো? তারপর দেখি না – দিব্যি থরে থরে সাজানো রয়েছে রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলিপি।
পটাশকে জিজ্ঞেস করতে সে অম্লান বদনে বললে, ‘বাহ রে, তাই তো নাম হওয়া উচিত। নইলে বুদ্ধি বাড়বে কেমন করে?’
পটাশের সাথে আলাপ হয়েছে সকালেই। এ বাড়িতে আমার বয়সী বলতে দুজন – পটাশ আর ফটাশ। যমজ ভাই। আমার চেয়ে এক ক্লাস নিচুতে পড়লে কি হবে, কোন অংশে তারা কম যায় না। আমি পটাশের উত্তর শুনে ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললাম, ‘মিষ্টির দোকানের নামের সাথে বুদ্ধির কি সম্পর্ক?’
উত্তরে কিছু না বললে পটাশ এমন করে তাকাল যেন এই কথাটা বলা কি সাংঘাতিক অন্যায় হয়েছে, একথার কোন উত্তরই হয় না।
শুধু এটুকু হলেও না হয় কথা ছিল। পটাশকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের ইস্কুলেও গরমের ছুটি পড়েছে বুঝি?’
‘না না, এখন তো গরমের ইস্কুল।’
‘গরমের ইস্কুলটা আবার কি?’
‘কেন? গরমটা বাদ যাবে কেন?’  
‘তার মানে সারা মাস ধরে ছুটির কাজ করো, আবার ছাতাপড়া রোদ্দুর মাথায় নিয়ে ইস্কুলেও যাও?’
‘না না, তা কেন? গরমের ইস্কুল তো বেশ মজার-’
‘সে কেমন?’
‘অতশত এক্ষুনি বলা যাবে না। তবে তোমার যদি ইচ্ছে করে, ওবেলা যেও না হয় আমাদের সঙ্গে -’
তাহলেই বোঝ কি গোলমেলে ব্যাপার। এই দুপুর গরমে যেতে হবে কিনা ইস্কুল? এদিকে আমাকে প্রায় একরকম জোর করেই পাঠানো হয়েছে পিসির বাড়ি। কেন? সে আরেক বৃত্তান্ত। অঙ্কে আমি বরাবরই কাঁচা। ক্লাস সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষায় মেরে কেটে পেয়েছি উনচল্লিশ। তার পর থেকে কপালে দুঃস্বপ্নের মত এল বীজগণিত। ইস্কুলের প্রথম পরীক্ষা দিয়ে বুঝলাম এবারে উনচল্লিশ কেন, নয় ও পাবো না।

সব শুনে টুনে বাবা আর দেরী করতে চাইলেন না। আমাকে পাঠিয়ে দিলেন পিসির বাড়ি। আমার পিশেমশাই আবার বেশ নামকরা অঙ্কের মাস্টারমশাই। গ্রামে থাকলে কি হবে, মহা বড় বড় অঙ্ক উনি নাকি একেবারে মুখে মুখে করে দিতে পারেন তা সে হিসেবের খাতা হোক, কি বর্গমূল হোক বা ভগ্নাংশই হোক। শুনেছি ওনার নাকি ক্যালকুলেটর লাগে না। যে কোন সংখ্যার নামতা এমনিই বলে যেতে পারেন। কি করে পারেন কে জানে, তবে আমার রেজাল্টের এই অবস্থা শুনে উনি নিজেই নাকি বলেছেন যে আমি যেন গরমের ছুটিটা পিসির বাড়ি গিয়ে কাটিয়ে আসি, উনি তাহলে আমাকে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে পারবেন আর কি! বাবা মা শুনে খুব খুশি। এর চেয়ে ভালো যেন কিছুই হতে পারে না। তাই যেমন কথা তেমন কাজ। গরমের ছুটি পড়তে না পড়তেই আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল এখানে।  

আমাদের ইস্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই গোবিন্দ স্যারের কথা ভেবে আমি একটু ভয় ভয়েই ছিলাম। প্রত্যেক মাস্টারের ছাত্রদের ভয় দেখানোর কিছু না কিছু ভয়ঙ্কর শাস্তির উপায় থাকে। চড় চাপড়, স্কেলের বাড়ী, বেঞ্চের ওপর দাঁড়ানো বা কানমলা এইসব তো এখন পুরনোই হয়ে গেছে বলতে গেলে। আর সত্যি কথা কি, ঐসব কোনদিনই আমার ওপর তেমন কাজ করেনি। বরাবর কানমলা খাওয়ার পর দেখি অঙ্কটা আমার আরো গুলিয়ে যায়। অঙ্ক করাতে বসলে তো পিসেমশাই পিশেমশাই থাকবেন না, অঙ্ক স্যার হয়ে না জানি কি রূপ ধরবেন এই ভয়েই আমি অস্থির। ওদিকে পিসির বাড়ি সবাই জেনে যাবে, বা হয়তো জেনেই গেছে, যে আমি অঙ্ক পারি না, এই সব ভেবেই আমার হাত পা যেন পেটের ভেতর সেঁধিয়ে আসছিল।

অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে আসার পর থেকে কেউ আমাকে পড়তে বসতেই বলেনি।  ভোর ভোর ছোটকাকুর সাথে এখানে এসেছি আর আমাকে পৌঁছে দিয়ে কাকু একটু বাদেই ফিরে গেছে। সবার আগে পিসিমা একটু মাথায় হাতটাত বুলিয়ে বাইরের ঘরে পাঠালেন। পিসেমশাই তখন বাইরের ঘরে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একখানা বইয়ের পাতা উলটোচ্ছিলেন। আমি কিছু বলার আগে উনি নিজেই আমায় বললেন, ‘এই সবে এলে এখন একটু ঘোরাঘুরি করো, পটাশ আর ফটাশ আমার দাদার ছেলে। তোমারই বয়সী হবে। তোমরা বরং আগে আলাপ টালাপ করে নাও। খেলাধুলো করো। তুমি আসবে বলে তোমার পিসিমা অনেক রান্নাটান্না করেছেন। সেসব খাওদাওয়া করো-’

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আর অঙ্ক?’
‘ওহ অঙ্ক, কেন অঙ্কে বুঝি তোমার ভীষন ভয়’
থতমত খেয়ে বললুম, ‘হ্যাঁ, মানে না, তবে ঐ একটু’
পিসেমশাই হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘সে হবে এখন। দিকশূন্যপুরে থাকতে আর তোমায় আর অঙ্কে ভয় পেতে হবে না’।

পিসেমশাইয়ের কথা শুনে আমার মনটা একটু চনমনিয়ে উঠেই আবার থমকে গেল। আমাকে বাড়িতে কোনদিন পড়া শেষ না করে খেলতে দেওয়া হয় না। এখানে যে দেখি উলটো নিয়ম। কে জানে কি আছে আমার কপালে।