খেলাঘরখেলাঘর

অ্যালজেব্রা


পিসিমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আহা রে, মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে বুঝি?’

আসলে আমি তখন সবে সবে দুধের গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে সাবাড় করছি। অন্যান্য সময় বাড়ি ফিরে দুধের গ্লাস তেমনই থেকে যায়। মা বলাবলি করতেই থাকে। আজকে খেলে ধুলো মেখে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। বাড়ির কথা বা মার কথা একটুও মনে নেই। কিন্তু পিসির কথায় একটু লজ্জা পেয়ে ঘাড় নাড়লাম। এখানে আমি পড়াশুনো করতে এসেছি, খেলে বেড়াতে নয়। বীজগণিত যদি শিখতে না পারি তাহলে মহা মুশকিল। দুধ, টোস্ট আর মিষ্টি খেতে খেতে আবার মনে পড়ল, এখানে মিষ্টির দোকানে অদ্ভূত নামের কথা। তাই ভাবলাম পটাশ আর ফটাশ দুটো যা ফাজিল ওদের কাছ থেকে হয়তো কোনদিনই সত্যিটা জানতে পারব না, বরং পিসিকেই জিজ্ঞেস করি।

‘আচ্ছা, তোমাদের এখানে মিষ্টির দোকানে নাম এরকম কেন?’
‘সে এক গল্প। এখানে মানুষের বিশ্বাস যে মিষ্টি খেলে নাকি বুদ্ধি বাড়ে-’
‘তাই নাকি? সত্যি বাড়ে?’
‘সত্যি মিথ্যে তো জানি না। তবে শুনেছি এই গ্রামের এক মহা পন্ডিত ছিলেন। তিনি মিষ্টি খেতে বড় ভালোবাসতেন। একটা দোকান থেকে মিষ্টি কিনে রোজ বাড়ি ফিরতেন রাত্রিবেলা। তখনকার দিনে এত পড়াশুনো জানা লোক আর এই গ্রামে ছিলেন না। তাই সেই মিষ্টি দোকানের নাম রাখে জ্ঞানভান্ডার। আর আজকাল এইটেই হুজুগ হয়ে গেছে। তবে এসব তো আমার শোনা গল্প। তোমার পিশেমশাই বরং ভালো করে গুছিয়ে বলতে পারবেন এই নিয়ে-’

আমি মনে মনে ভাবছিলাম একটা সময় তো পড়তে বসতে হবেই। এবার বোধহয় পিসেমশাই ডাকবেন। ডাকলেন বটে, তবে সেটা দেখতে যে আমি খেলাধুলো করে বাড়ি ফেরেছি কিনা দেখার জন্য। তারপর খাবার টেবিলে এসে আমার পাশেই  পড়লেন। আমি একটু ঢোক গিলে বললাম, ‘অঙ্ক বইটা কি আনব পিসেমশাই?’

উনি একটু চমকে বললেন, ‘বই আনবে কেন? তা আনো’

আমি একছুটে গিয়ে ব্যাগ থেকে অঙ্ক বইটা নিয়ে এসে হাজির হলাম। এই সেই বই যা নিয়ে আমার দুঃস্বপ্নের শেষ নেই। কানগুলো কিরকম চনমন করে উঠল, স্কেলের বাড়ির কথা মনে পড়ে হাতের চেটোদুটোও একটু টনটন করে উঠল। শেষমেষ বইখানা পিসেমশাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘এই যে-’
উনি নরম গলায় বললেন, ‘তা কোন জায়গাটা ঠিক বুঝতে পারছো না?’
-‘এই যে বীজগণিতটা বিশেষ করে’  
-‘আচ্ছা, তুমি বরং এক কাজ কর। আজকে নিজে নিজে অঙ্কগুলো একবার দেখো। আমায় জিজ্ঞেস করার দরকার নেই, আমার মনে হয় তুমি নিজেই পারবে। কোথাও যদি আটকে যাও, তাহলে ফুটবল মাঠের কথা মনে করে দেখো। অঙ্কটা যেন বিপক্ষ দলের গোল। তোমাকে ওদের ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে বলটায় কেবল আলতো করে পা ছুঁইয়ে দিলেই ব্যাস। তারপর যদি একেবারেই হচ্ছে না, তাহলে কালকে তোমায় নিয়ে বসব, কেমন?’
আমিও ভালো ছেলের মত ঘাড় নেড়ে বললাম। পিসেমশাই বলেন কি? তবে অঙ্ক বইটা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে বুকটা ভয়ে ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল সেই ভাবটা কোথাও মিলিয়ে গেল। আজকে বিকেলেই দুটো গোল নিজে করেছি আরেকটা হয়েছে আমার বাড়ানো পাসেই। ওফফ কি দুর্দান্তই ছিল ম্যাচটা। এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি অঙ্ক বই খুলে প্রথম অঙ্কটা পড়লাম, খাতা টেনে নিয়ে দু লাইন লিখে অঙ্কটা করেও ফেললাম। বীজগণিতের সব ছোট্ট ছোট্ট অঙ্ক। এক দু লাইনেই নেমে যাচ্ছে। এক সময়ে দেখি সবকটা অঙ্কই হয়ে গেছে। এবার কি করব কি করব ভাবছি, অমনি পটাশ আর ফটাশ লাফাতে লাফাতে এসে হাজির। ব্যস আর কি, পড়া মাথায় উঠল।

পরদিন সকালে পিসেমশাইয়ের কাছে অঙ্ক বই নিয়ে আবার হাজির হলাম। পিসেমশাই তখন নিজে নিজে দাবা খেলছেন, মানে সাদা আর কালো দুপক্ষের হয়ে নিজেই চাল দিচ্ছেন। আমি অঙ্কের বইটা এগিয়ে দিলাম। বললাম, ‘অঙ্কগুলো হয়ে গেছে’

 ‘বাহ বাহ, এ তো খুব আনন্দের কথা। আর হবে নাইই বা কেন? অঙ্ক তো হওয়ার জন্যেই’
-‘তাহলে এবার কি করব?’
-‘কি করবে? আচ্ছা, আরেকবার বইটা খুলে পরের প্রশ্নমালার অঙ্কগুলো দেখো তো ঠিক বুঝতে পারছো কিনা-’

আমি বই খুলে বীজগণিতের নতুন প্রশ্নমালার একটা অঙ্ক দেখতেই চোখের সামনে ছবির মত অঙ্কটা ভেসে উঠল। আমি ভ্যাব্যাচাকা খেয়ে পিসেমশাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি দাবার বোর্ড থেকে চোখ না তুলেই বললেন, ‘কি হল? কিছু বলবে?’  

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম না। ভয়ে ভয়ে পরের অঙ্কটার দিকে তাকালাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই অঙ্কটাও কেমন যেন নিজেই নিজেকে করে ফেললে। তারপর আরেকটা। তারপর আরও একটা। এরকম করে এক এক করে দেখি অনেক গুলো অঙ্কই নিজে নিজে হয়ে গেল। চোখ তুলে তাকাতে দেখি পিসেমশাই হাসছেন, ‘কি মনে পড়ছে না বুঝি? বেশ বেশ। পরে হবে এখন’
আমি তখন ভাবতে শুরু করেছি – ব্যাপারটা কি হল? এই কদিন আগেও অঙ্ক বইটা খুললে জ্বর আসছিল। আজকে সবকটা অঙ্ক কি মুখে মুখেই হয়ে গেল? পিসেমশাই কি ম্যাজিক জানেন নাকি? আচ্ছা, তোমরাই বল, এরকম হয়?