খেলাঘরখেলাঘর

হ্যুগো

১৯৩১ সাল। প্যারিসের এক রেল স্টেশনের বড় বড়  ঘড়িতে দম দেয় ছোট্ট ছেলে হ্যুগো। তার বাবা মা নেই। মায়ের মৃত্যুর পরে হ্যুগো তার বাবার সাথে থাকত, যিনি ছিলেন একজন দক্ষ ঘড়ি-নির্মাতা। একদিন তাঁর কাজের জায়গায় আগুন লাগলে তিনি মারা যান। তখন হ্যুগোকে নিজের কাছে নিয়ে এসে রাখেন তার কাকা, যিনি স্টেশনে ঘড়িতে দম দেওয়ার কাজ করেন। কিন্তু সেই কাকাও একদিন উধাও হয়ে যান।

হ্যুগো

হ্যুগো সবার অলক্ষ্যে কাকার কাজটা চালিয়ে যেতে থাকে। সে থাকে রেল -স্টেশনের দেওয়ালের মধ্যে, ঘড়ির যন্ত্রপাতির ফাঁকে একটা কুঠুরিতে, চুরি করে খায়, আর মাঝেমধ্যে একটা খেলনার দোকান থেকে নানারকমের যন্ত্রের অংশ চুরি করে। কেন চুরি করে?

হ্যুগোর যখন বাবার সাথে থাকত, সেই সময়ে তিনি একদিন জাদুঘরে ফেলে দেওয়া জিনিষের মধ্যে থেকে একটি  অটোমেটন নিয়ে আসেন। আজকের দিনে তাকে বলা যেতে পারে রোবটের পূর্বসুরী। তার হাতে একটা কলম, অর্থাৎ চাবি দিয়ে দম দিলে সে লিখতে পারবে। হ্যুগোর বাবা স্থির করেন তিনি সেই অটোমেটনটাকে ঠিক করবেন। কিন্তু  পুরোপুরি ঠিক করার আগেই তিনি মারা যান। তখন ছোট্ট হ্যুগো ঠিক করে সে নিজেই এই অটোমেটনটাকে সচল করে ফেলবে। সে মনে করে তার বাবা তার জন্য এর ভেতরে কোন বার্তা রেখে গেছেন। আর সচল করতে চায় বলেই সে স্টেশনের খেলনার দোকান থেকে মাঝেমধ্যেই কলকব্জা চুরি করে।

মেলিয়েস

একদিন কিন্তু তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন দোকানের বয়স্ক মালিক। তিনি হ্যুগোর কাছ থেকে কেড়ে নেন তার নোটবুক, যার ভেতরে ছবি এঁকে বুঝিয়ে দেওয়া আছে অটোমেটনটাকে কিভাবে চালু করতে হবে। নোটবইটাকে ফেরত পাওয়ার জন্য তাঁর পিছুপিছু তাঁর বাড়ি গিয়ে হ্যুগোর আলাপ হয় তাঁর পালিতা মেয়ে ইসাবেলের সাথে।

হুগো আর ইসাবেল

কিন্তু নোটবই সে ফিরে পায়না। পরের দিন  সেই প্রৌঢ় মানুষটি তাকে রুমালে বাঁধা খানিকটা ছাই দেখিয়ে বলেন তিনি নোটবইটা পুড়িয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ইসাবেল হ্যুগো কে জানায় তিনি আসলে সেটাকে পুড়িয়ে ফেলেন নি। ইসাবেলের পালন পিতা জর্জ হ্যুগোকে বলেন যে যদি তাঁর দোকানে কাজ করে তার সব চুরির প্রায়শ্চিত্ত করতে পারে, তাহলে তিনি তার নোটবই ফেরত দেবেন।

অটোমেটন

ইসাবেল রহস্য-রোমাঞ্চ পছন্দ করে। তাই সে হ্যুগোর সাথে তার কুঠুরিতে যায়। সেখানে হ্যুগোর অটোমেটন চলতে  শুরু করে, যখন ইসাবেলের গলার চেনে আটকানো একটা হৃদয় আকৃতির চাবি তার চাবির গর্তে সঠিকভাবে লেগে যায়। আর সেই অটোমেটনের হাত চলতে থাকে। সে কাগজে - না, লেখে না ,বরং একটা ছবি আঁকে। সেই ছবির তলায় সে সই করে 'জর্জ মেলিয়ে' নাম দিয়ে। হ্যুগো খুবই অবাক হয় এই দেখে যে ছবিটা তার আর তার বাবার পছন্দের একটা সিনেমার দৃশ্যের মত। আর ইসাবেল অবাক হয়, কারণ তার পালক পিতার নাম জর্জ মেলিয়ে। আরো রহস্য, অটোমেটনকে চালু করার চাবি ইসাবেলের কাছেই বা এল কি করে?

ছবি

এই সমস্ত রহস্যের সমাধান অবশ্যই করে ফেলে হ্যুগো আর ইসাবেল। কিভাবে, সেটা জানতে হলে দেখতে হবে ২০১১ সালে তৈরি, পাঁচটি অস্কার সম্মান পাওয়া , পরিচালক মার্টিন স্করসেসের ছবি 'হ্যুগো'। হ্যুগো আর ইসাবেলের রহস্য সমাধানের মধ্যে দিয়ে উঠে আসে সিনেমার ইতিহাসের এক প্রায় ভুলে যাওয়া অধ্যায়। সিনেমার আদি যুগের ফরাসী চলচ্চিত্রকার জর্জ মেলিয়ের জীবনের ঘটনাপ্রবাহের সাথে জড়িয়ে যায় অনাথ বালক হ্যুগোর স্বপ্ন - সত্যি আর স্বপ্নের মিশেলে তৈরি হয় এক রোমাঞ্চকর দুনিয়া।

ফিল্ম

এই ছবিতে নানাভাবে থ্রি-ডি অ্যানিমেশন ব্যবহার করা হয়েছে।  থ্রি-ডি অ্যানিমেশনের জাদুতে  জীবন্ত হয়ে উঠেছে ঘড়ির ভেতরের কলকব্জা, রেল দুর্ঘটনা বা অটোমেটনের কাজকর্ম। হ্যুগোর চরিত্রে আসা বাটারফিল্ড, ইসাবেলের ভূমিকায় ক্লো গ্রেস মোরেত্‌জ আর জর্জ মেলিয়ের ভূমিকায় কিংবদন্তী অভিনেতা বেন কিংস্‌লের নাম করতেই হয়। এই ছবির উপরি পাওনা হল জর্জ মেলিয়ের তৈরি করা বিভিন্ন ছবির এক অসাধারণ কোলাজ। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি আগে,  আধুনিক মানুষের জীবনের অন্যতম বিনোদন, গল্প বলা সিনেমা তৈরির প্রথম প্রচেষ্টা শুরু করেন জর্জ মেলিয়ে। সেই ধারাই বজায় রেখে তাঁর সময়, জীবন ও কাজ নিয়ে গল্প বলছে আজকের ছায়াছবি 'হ্যুগো'।


মহাশ্বেতা রায়
কলকাতা





মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।