খেলাঘরখেলাঘর

মুক্তধারা

একটা জেলখানা। তার বিরাট উঁচু পাঁচিল, তালা লাগানো বড় বড় লোহার দরজা, ছোট্টছোট্ট কুঠুরি, সেখানে সূর্যের আলো প্রায় ঢোকেই না; আর সেই সব কুঠুরিতে বন্দী থাকে তারা, যারা কোন না কোন খারাপ কাজ করেছে। তাদের অন্যায়ের বিচার হয়েছে, আর বিচারের সাজা হয়েছে জেলখানায় বন্দী জীবন কাটানো। কারোর কয়েক মাস, কারোর অনেক বছর, কারোর বা সারা জীবন। সেখানে এই সব মানুষকে নানারকমের হাতের কাজ ও অন্যান্য কাজ করতে সেখানো হয়, পড়াশোনা করতে উৎসাহ দেওয়া হয়, যাতে সাজার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তারা জেলের বাইরে এসে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত সৎ পথে উপার্জন করতে পারে। এই কারণেই জেলখানার নতুন নাম সংশোধনাগার।
মুক্তধারা

কিন্তু সংশোধন করতে চাইলেই তো আর সবাই বদলে যেতে চায় না। তাই আমাদের গল্পের এই জেলখানায়ও আছে এমন কিছু কয়েদী, যারা জেলের ভেতরেও খুব ভয়ঙ্কর। তারা অন্য কয়েদীদের ওপর অত্যাচার করে, জেলের মধ্যে থেকেও নানা রকমের খারাপ কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে সবথেকে ভয়ঙ্কর কয়েদী হল ইউসুফ মহম্মদ। সে প্রচুর নিরপরাধ মানুষকে মেরেছে। সে কাউকে পরোয়া করে না। সবাই তাকে ভয় পায়, সমঝে চলে। এই অবস্থায় রাজ্যের কারা বিভাগের নতুন ইন্সপেক্টর জেনারেল হয়ে এলেন বৃজভূষণ দত্ত। কয়েদীদের মানসিক উন্নতি করানোর ব্যাপারে তাঁর নানা ধরণের পরিকল্পনা। তাঁর সাথে একদিন আলাপ হল নীহারিকা চ্যাটার্জির। নীহারিকা একজন নৃত্যশিল্পী , কিন্তু তিনি পেশাদার নন।মূক-বধির ছোট্ট মেয়ে স্পৃহাকে নিয়েই সময় কাটে তাঁর।  আই. জি. দত্ত নীহারিকাকে বললেন সংশোধনাগারে এসে কয়েদীদের নাচ শেখাতে।তাঁর মতে, এই ধরণের 'কালচার থেরাপি', অর্থাৎ সুস্থ-সুন্দর সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করাতে পারলে অনেক কয়েদীর মানসিক অবস্থার পরিবর্তন আনা সম্ভব। প্রথমে রাজি না হলেও, পরে তাঁর কথায় সংশোধনাগারে যেতে রাজি হলেন নীহারিকা।

কিন্তু শেখাতে গেলেই তো আর হল না। বাছাই করা কয়েদীরা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, তার ওপরে আবার পুরুষ, তাই তারা কিছুতেই নাচ শিখতে রাজি হল না। নীহারিকা তাদেরকে জোর করলেন না। তাদের সাথে প্রথমে তিনি বন্ধুত্ব পাতালেন। একটু একটু করে তারা সহজ হল, নানারকমের শারিরীক কসরত শিখতে শুরু করল। এইভাবে ক্লাস নিতে নিতেই নীহারিকা একদিন ঠিক করলেন, তিনি তাঁর ছাত্রদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "বাল্মিকী প্রতিভা" নৃত্যনাট্য করাবেন। 'বাল্মিকী প্রতিভা'র গল্প জান নিশ্চই। পুরাণের সেই গল্প, যেখানে দস্যু রত্নাকর, মা সরস্বতীর কৃপায় হয়ে ওঠেন কবি আর রচনা করেন 'রামায়ণ'; আর সেই নৃত্যনাট্যে বাল্মিকীর চরিত্রে অভিনয় করবে আর কেউ নয়, ইউসুফ মহম্মদ।



ইউসুফকে কোনমতে রাজি করানো গেল। কিন্তু সে মনে মনে অন্য মতলব আঁটলো। সে ঠিক করল কয়েকজন সঙ্গী সাথীকে নিয়ে সে অনুষ্ঠান চলতে চলতে সন্ধ্যের অন্ধকারে পালিয়ে যাবে। সেইমত সে তার সঙ্গীদের সাথে নিয়ে ফাঁসির মঞ্চের তলার সুড়ঙ্গের পথও খুঁজে ফেলল। আর অনুষ্ঠানের সন্ধ্যেবেলায়, যখন নৃত্যনাট্য চলছে, তখন এক সময়ে তারা পাঁচজনে সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে পালিয়েও গেল!

এর পরে কি হবে? নৃত্যনাট্য কি মাঝপথে থেমে যাবে? যারা বৃজভূষণ দত্ত আর নীহারিকার প্রচেষ্টাকে ব্যঙ্গ করে বলেছিল, এইসব আসামীদের মধ্যে কখনই বদল আনা যাবে না, তাদের কথাই কি শেষ পর্যন্ত সত্যি হবে? হেরে যাবেন আই. জি. আর নীহারিকা? সেটা জানতে হলে শেষ অবধি দেখতে হবে  পরিচালক যুগল নন্দিতা রায় আর শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত বাংলা ছবি 'মুক্তধারা'।

 তুমি হয়ত ভাবছ, 'মুক্তধারা' যে ছোটদের জন্য তৈরি করা ছবি, এমন তো শুনিনি...

ঠিক, তা হয়ত শোননি, কিন্তু 'মুক্তধারা' বড়দের সাথে সাথে ছোটদেরও দেখার আর ভাললাগার মত একটা খুব ভাল ছবি। আর এই ছবির অবাক করা ব্যাপারটা কি জান, এটা কিন্তু বানানো গল্প নয়। এই ছবির গল্প কিন্তু আসলে একদম সত্যি ঘটনা। নীহারিকা চ্যাটার্জির চরিত্রটা তৈরি হয়েছে বাংলার প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী শ্রীমতি অলকানন্দা রায়ের আদলে। অলকানন্দা সত্যিই কলকাতার এক সংশোধনাগারে গিয়ে সেখানকার বন্দীদের সাথে নাচের ওয়ার্কশপ করেন এবং তাদের সাথে নিয়ে, সংশোধনাগারের বাইরে পেশাদারী মঞ্চে এসে 'বাল্মিকী প্রতিভা' অনুষ্ঠিত করান। আর এই ছবির বিস্ময় হলেন ইউসুফ মহম্মদের চরিত্রের অভিনেতা নাইজেল আকারা। নাইজেল কিন্তু একজন সত্যি অপরাধী, এবং তিনি নানারকমের অপরাধের সাজা পেয়ে সংশোধনাগারে বন্দী ছিলেন। অলকানন্দা রায়ের সংস্পর্শে এসে তিনি এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষে পরিণত হন। তিনি এখন সংশোধনাগার থেকে ছাড়া পেয়ে গেছেন, সৎপথে উপার্জন করছেন, আর এই ছবিতেও অভিনয় করেছেন। সঠিক সুযোগ দিলে কোন তথাকথিত খারাপ মানুষও যে ভাল হয়ে উঠতে পারে, তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন নাইজেল আকারা।
আর এই ছবির আরেকজন বিশেষ শিল্পী হল ছোট্ট মেয়ে সুচিত্রা চক্রবর্তী। স্পৃহার ভূমিকায় কলকাতা ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুলের এই ছাত্রী অভিনয় করেছে।
'...এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়...' রবি ঠাকুরের গানের এই পংক্তি 'মুক্তধারা' ছবির ট্যাগলাইন। মুক্তধারা দেয় সেই মুক্তির আস্বাদ। সেই মুক্তি কিন্তু কারাগার ভাঙার মুক্তি নয়, সেই মুক্তি হল মনের মুক্তি, চেতনার মুক্তি...
এই ছুটিতে, যোগাড় করে ফেল মুক্তধারার ডিভিডি। আর ঠাকুর দেখার ফাঁকে সময় করে দেখে ফেল মন ভাল করে দেওয়া এই ছবি।


মহাশ্বেতা রায়
কলকাতা

ছবিঃ মুক্তধারা ওয়েবসাইট

 

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।