খেলাঘরখেলাঘর

মেডেল নিলেন না নন্দপিশি

দেবীপুরের নন্দপিসি এক স্যাম্পেল। দেবীপুর জায়গাটাকে এই একবিংশ শতাব্দীতেও মোটামুটি গণ্ডগ্রামই বলা চলে। তবে ইদানীং সেখানেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখানে-সেখানে পাকা বাড়ি। কাঁচা রাস্তার মাঝে মাঝে কিছু বাঁধানো সড়ক – সাইকেল, রিকশা ও ভ্যান রিকশার পাশাপাশি তাই এসে গেছে বাস, অটো, এমনকি দু-চারখান চারচাকা। বিজলি এসেছে, তবে অল্প কিছু ঘরেই। যেখানে নেই, সেখানেও অবশ্য পালে-পার্বণে সিনেমা-টিনেমা দেখার জন্য আসে ভাড়া করা জেনারেটার।
এসবের মধ্যে নন্দপিসি অর্থাৎ নন্দরাণী চৌধুরানি যেন একশো বছর আগেকার বাংলার থেকে কেটে বসানো এক জগদম্বা বা ক্ষেমঙ্করী। ছেলে, বুড়ো, জোয়ান সবারই তিনি ‘পিসি’। তাঁর দাদাশ্বশুর ডাকসাইটে জমিদার দেবীপ্রসন্ন চৌধুরির নামেই নাকি এ গাঁয়ের নাম। শ্বশুর মুকুন্দনারায়ণও ছিলেন খুব দাপুটে। মুকুন্দের দুই ছেলে উমাশঙ্কর ও কিরণশঙ্কর লেখাপড়া শিখে চাকরির জন্য কলকাতা পারি দেন। কিরণ বাপের অমতেও শেষ অবধি সেখানে পরিবার নিয়ে যান। কিন্তু বড়ছেলে উমার স্ত্রী নন্দ শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে নড়তে রাজি হন না, ফলে উমারও শনি-রবি ও ছুটিছাটায় গ্রাম-শহর যাতায়াত থেকে রেহাই মেলে না। সঙ্গহীন মুকুন্দ পুত্রবধূ নন্দকে মেয়ের মতো স্নেহ করতেন। ছেলেদের আশা ছেড়ে নন্দকেই তিনি জমিদারি দেখাশোনা ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কাজ শিখিয়েছিলেন। লোকে বলে সেই জন্যেই নাকি পিসির চলনে-বলনে খানিকটা পুরুষালি ভাব।
সে অবশ্য শোনা কথা। তারপর ইচ্ছামতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ইতিমধ্যে পিসির শ্বশুর-শাশুড়ী ও স্বামী গত হয়েছেন। ছেলে-মেয়েরাও শহরে প্রতিষ্ঠিত। তাদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও পিসি এখনো একা এই দেবীপুরেই পড়ে আছেন, শ্বশুরের ভিটে আগলে। এবং এভাবেই শেষ দিন অবধি থাকবেন বলে ঘোষণাও করেছেন। ছেলেমেয়েরা অগত্যা মাঝেমাঝে মা’কে দেখে যায়, কৌশলে কিছু সাহায্য করারও চেষ্টা করে। কৌশলেই, কারণ জমিদারি কবে চলে গেলেও পিসির মটমটে আত্মসম্মান। নাতি-নাতনির হাত দিয়ে কিছু পাঠালে অবশ্য তিনি প্রাণে ধরে ফেরাতে পারেন না আর এই চালাকিটা ছেলেমেয়েরা শিখে নিয়েছে।

অবশ্য তেমন কিছু দরকারও হয় না। জমিদারি গিয়েও বাড়ির লাগোয়া কিছু বাগান, খেত, ফলের গাছ আছে – সেসবে যা ফলে তাতে পিসির অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার রসদ অনায়াসে জুটে যায়। বাড়িতে বসে গাছের ফলপাকড় পাহারা দেওয়া এখন পিসির অন্যতম কাজ। এ ব্যাপারে তিনি দারোগার মতোই কড়া। মাঝে মাঝে ঘরে বসে হাঁক পাড়েন, “অ্যাই, কে রে? পালা বলছি, নইলে দাঁড়া বন্দুক বের করছি –”
ফল সংগ্রহে ইচ্ছুক ছেলেমেয়েরা কখনো ভয় পায়, কখনো খিলখিলিয়ে হাসে, “বাপ রে, ভয়েই ম’লুম – পিসি বন্দুক চালাবে!” পিসির ঘরে অবিশ্যি সত্যিই তাঁর শ্বশুরের আমলের একটা দোনলা বন্দুক টাঙানো। সেটা মাঝেমধ্যে সাফসুতরোও হয়। তবে পিসির যতই পাহারাওয়ালা-সুলভ জাঁদরেল চেহারা ও ব্যক্তিত্ব থাকুক না কেন সে বন্দুক চালাচ্ছে ভাবলেই –
হাঁকে কাজ না হলে পিসি অগত্যা “কোন লক্ষ্মীছাড়ার দল রে!” বলতে বলতে আসরে নামেন। এবার কাজ হয় – বালখিল্যের দল ছুট লাগায়। কিছু দুঃসাহসী অবশ্য অত সহজে পিটটান দিতে রাজি হয় না। তখন শুরু হয় সম্মুখসমর এবং বলা বাহুল্য, পিসিই শেষ হাসি হাসেন। একবার নাকি তিনি কাকে গাছে উঠে ঠ্যাং ধ’রে টেনে নামিয়েছিলেন।
কিন্তু নিক না দু'টো ফল? তুমি নিজে আর ক'টা খাও, শেষ অব্দি তো সেই বিলিয়েই দাও? না, সে চলবে না। চেয়ে নাও, ঠিক আছে। কিন্তু চুরি – অধম্মকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে? লোকে অবিশ্যি বলে, তা নয়। আসলে কেউ চুরি করে নিয়ে গেলে পিসির আঁতে ঘা লাগে।
তা, ছেলেমেয়েদেরও কি প্রেস্টিজ নেই? কোন মুখে গিয়ে তারা পিসির কাছে হাত পেতে দাঁড়াবে? আর চুরি করা ফলের স্বাদ কি কখনো চেয়ে নেওয়া জিনিসে পাওয়া যায়? সুতরাং ঠাণ্ডা লড়াই চলতেই থাকে। তবু এই বালখিল্যদের নিয়েই পিসির জীবন। পালে-পার্বণে তাদের পিঠে-পুলি, নাড়ু-মোওয়া  না খাওয়ানো অবধি তাঁর শান্তি হয় না।

পারতপক্ষে পিসি বাড়ি ছেড়ে নড়েন না। মাঝে মাঝে কয়েক কিলোমিটার দূরে ব্যাঙ্কে যান, তখন রিকশা বা ভ্যান রিকশা নেন। কিন্তু অটোরিক্সা, বাস কদাপি নয়। কলের গাড়িকে তাঁর ঘোর অবিশ্বাস – তারা যে কখন মানুষের ঘাড়ে চাপবে বা যাত্রীকে উলটে দেবে, তার নাকি কোনো ঠিক নেই। একদিন মধুর ভ্যান রিকশায় উঠে দেখেন সেখানে মোটর লাগানো। "চল তোকে পুলিশে দিই" বলে তার ঘাড় এমন জোরে ধরেছিলেন যে সে বেচারা মাপ-টাপ চেয়ে দু'দিনের মধ্যেই আবার ওসব খুলে ফেলবে বলে নাকে খৎ দিয়ে তবে রেহাই পায়।
হাসপাতাল-ডাক্তারখানা? ওসব পিসির লাগে বলে কেউ শোনেনি। বয়েস সত্তর না আশির কোঠায় কে জানে – কিন্তু তাঁর দাঁত একটাও পড়েনি, চুল দু-একগাছার বেশি পাকেনি। চশমা ছাড়াই ব্যাঙ্ক ও বিষয়সম্পত্তি সংক্রান্ত সব দরকারি কাগজপত্তর নিজেই দেখাশোনা করতে পারেন।
তা, বিষয়-সম্পত্তি যখন আছে, থানা-পুলিশ নেই? না, তেমন দরকারও ওখানে বড় একটা হয় না। গ্রামের লোকেরা সাদা-সরল। মাথা গরমে কিছু ঝগড়া-বিবাদ হলে সে তারা মাথা ঠাণ্ডা হলে আবার নিজেরাই সালিশি করে নেয়। আর লোকের পেটে ভাত থাকলেও সোনা-দানা বড় একটা নেই। তাই চোর-ডাকাত পণ্ডশ্রম বুঝে সেদিক ঘেঁষে না।
অন্ততঃ ঘেঁষতো না। কিন্তু তারপর একদিন মুখুজ্জেরা গ্রামে এলেন।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।