খেলাঘরখেলাঘর



ছোট্ট ছোট্ট শাদা মেঘের নৌকা আমার পাশ দিয়ে, হাতের কাছ ঘেঁষে নীল আকাশে ডিঙি বেয়ে এগিয়ে চলেছে। আমি চুপটি করে প্লেনের জানলার কাছে বসে ভাবছি তোমার কথা সিরাজুল। ভাবছি তুমি আর আমি এমনি এক বর্ষার দিনে সুন্দরবনের হরিণভাঙা নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। তাও কতদিন আগে তাই না? হ্যাঁ তখন তোমার এখনকার মতো গোঁফের রেখা ওঠেনি সিরাজুল। ওমা, ওকি লজ্জা পেলে নাকি? ধুর বোকা, আমি তো গল্প করছি তোমার সাথে। আচ্ছা ঠিক আছে আমি বলবো না তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার সদ্য ওঠা গোঁফে কেমন করে তা দাও। আর তোমার বোন আনন্দি লুকিয়ে সেটা দেখে ফেললেই তার ওপর তর্জন গর্জন করো। ওকি...চললে কোথায়? আচ্ছা ঠিক আছে এই কান ধরছি সিরাজুল আর বলবো না। সত্যি আর বলবো না দক্ষিণ রায়ের মিশ কালো গোঁফের মতো তোমার গোঁফটাও বেশ হৃষ্ট পুষ্ট হবে আর আমার সেই ছোট্ট সিরাজুল, যে আমাকে শোনাতো কুমীরের গল্প তার গোঁফ দেখতে আমার মনটা উড়তে চাইবে আকাশে। এই বর্ষার সকালে ছুট্টে চলে যেতে চাইবে সুন্দর বনে। ওই দেখ আবার রাগ করে! বুঝতে পারছো না এটা গল্প...আরে বাবা আমি সত্যি সত্যি তো উড়ছি আকাশে। 
এর আগে আমি কোনোদিন প্লেনে উঠিনি জানো। অনেক দিন আগে থেকেই মনটা খুশিতে নেচে উঠছিলো, তারপর আবার কেমন যেন একটু ভয় ভয় করছিলো। অতো ওপর দিয়ে যেতে যেতে তোমার সুন্দর বনের সেই দুষ্টু ঈগলটার সাথে যদি দেখা হয়ে যায়। পাইলট মানে যিনি প্লেন চালান, তাঁর গুরু গম্ভীর কন্ঠে বলে দিলেন বাইরের আবহাওয়া খুব খারাপ, বৃষ্টি পড়ছে, তাই কেউ দুষ্টুমি করবে না, সবাই প্লেনের সিট বেল্ট বেঁধে চুপটি করে বসে থাকবে। তুমি জানো সিরাজুল একটু পরেই প্লেন দৌড়োতে শুরু করলো সাঁ সাঁ...আমি ভাবলাম ওমা, এটা আবার দৌড়ায় কেনো? উড়বে তো! পাশের বন্ধু বিরক্ত হলো। আর ঠিক তোমার মতো বকে দিলো সিরাজুল। আমি দেখলাম এক ঝাঁকুনিতে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্লেন...। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, অনেক নীচে... আমার পায়ের তলায় হারিয়ে যাচ্ছে আমার প্রিয় শহর, আমার মন কেমনের সব কিছু। আচ্ছা সিরাজুল এই যে এতোক্ষণ আমি বক বক করে তোমার মাথা ধরিয়ে দিলাম তবুও কি তুমি আমায় বলবে না এই বছরে খলসি ফুলের মধু রেখেছো কিনা আমার জন্যে? বলবে না তো আনন্দি এখোনো তার সেই ছোট্ট ডিঙাতে মাছ ধরতে যায় কিনা? রাতের বেলায় কুপি জ্বালিয়ে তোমরা দুই ভাই বোন পড়তে বসো কিনা দাওয়ায়? এখোনো কি সেই দুষ্টি বাঘটা এসে গ্রামের বাইরে হালুম হালুম করে ভয় দেখায়? ও আচ্ছা রাগ হয়েছে? অনেকদিন চিঠি লিখি না তাই? কী করবো বলো? আমিও তো অনেকদিন কোথাও বেরোয়নি। সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি দিয়ে আমাকে কে যেনো ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলো অনেক দিন।  আমার পোষ্ট বক্সে অনেকদিন কেউ বেড়ানোর চিঠি রেখে যাইনি যে সিরাজুল। তাই একদিন সকালে আমার মোবাইলের ইনবক্সে যখন মেঘালয় থেকে উড়ে এলো নেমনতন্নের চিঠি তখন আনন্দে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। বাইরের কদম ফুলের গাছা হাওয়ায় পাতা নেড়ে বলেছিলো এবার তুমি বেরিয়ে পড়ো টুকনু। খেয়াঘাটের বুড়ো মাঝি বলেছিলো থেমে থেকোনা বাবু...নদী কি থেমে থাকে? সে কেমন আপন মনে একা একা বয়ে চলে সবাইকে নিয়ে। আমিও আপন মনে বয়ে চলছি সিরাজুল। হ্যাঁ এই তো দেখো না, আমাদের প্লেন নামবে এবার গৌহাটি বিমান বন্দরে। এই তো আমি ওপর থেকে দেখতে দেখতে পাচ্ছি বহ্মপুত্র নদীকে। মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে আমি এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে। ঝির-ঝিরে বৃষ্টি আমার জানলা ধুয়ে দিচ্ছে। আর আমার কানের কাছে শিরশিরে হাওয়া বলে যাচ্ছে, মেঘ বৃষ্টির দেশে তোমাকে স্বাগত টুকনু।

তুমি কি বিরক্ত হয়ে পড়ছো সিরাজুল? আমি জানি তুমি যত রাগ করেই থাকো না কেনো আমার নীল খামের চিঠিটা তুমি এতোক্ষণে রফিকুল, আনন্দি এদের সবাইকে পড়ে শুনিয়ে দিয়েছো। গৌহাটি থেকে নেমে আমরা যাবো শিলং। বাইরে অপেক্ষা করে আছে আনন্দ। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার। সেই আমাদের নিয়ে যাবে শিলং। গাড়িতে চেপে বুঝতে পারলাম ক্ষিদে পেয়েছে। একটু পরেই শহর ছাড়তেই পথের ধারে পাহাড় আর জঙ্গল আমার অনেক অনেক চেনা কিছু ছবি মনে করিয়ে দিলো।

আমার মনে পড়ে গেলো উত্তরবঙ্গের চিলাপাতার কথা। জঙ্গলে ঘেরা গ্রামের কথা। আন্দু রাভা, জয়ন্তী মেচ, সুনীল নার্জিনারিন, হেমবং টোটো, ফুলমণি মেচ সবার কথা। মনে মনে ঠিক করলাম আর আমি সোনার কাঠি-রুপোর কাঠির ছোঁওয়ায় ঘুমিয়ে থাকবো না সিরাজুল... বেরিয়ে পড়বো আমার পিঠের সেই বড় বোঁচকাটা নিয়ে। আবার সবার সাথে দেখা করবো। আবার তিস্তার চরে সবার সাথে কাশ ফুলের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে বেড়াবো। আনন্দ গাড়ি থামালো। আনারস বিক্রি হচ্ছে। খুব মিষ্টি আনারস খেলাম আমরা। এখানে আনারস খুব শস্তা। বর্ষার যেসব ফল হয় আনারস তার মধ্যে প্রধান।

রাস্তার চারপাশে জঙ্গল, পাহাড় দেখতে দেখতে আর আনন্দের গল্প শুনতে শুনতে কখন যে চলে এসেছি শিলং বুঝতেই পারিনি। টিপটিপ বৃষ্টি আর শীত শীত ঠান্ডা হাওয়া আমাদের নিয়ে চললো পুলিশ বাজারের দিকে। ওকি আবার পুলিশের কথা শুনে ভয় পাচ্ছো। নানা সিরাজুল পুলিশ বাজার নাম শুনেই ভেবো না সব কিছু পুলিশদের। আসলে এটা শিলংয়ের সবচেয়ে বড় বাজার। অনেক কিছু বিক্রি হয় এখানে। আর এখানেই হোটেল পাইন বোরোতে আমরা কিছুদিন থাকবো। আনন্দকে ফিরতে হবে গৌহাটি...অনেক খানি রাস্তা। চলে গেলো সে। কথা থাকলো আবার দেখা হবে, গৌহাটিতে, মাত্র কয়েকদিন পরেই।

কে যেনো একটা ঠান্ডা হাত পিঠে রাখলো। পেছন ফিরে দেখি, এখানকার খাশিয়াদের মতো সুন্দর দেখতে বাপী। হ্যাঁ এবার তার ট্যাক্সিতেই আমরা শিলং দেখবো। বাপী আমাদের নিয়ে গেলো ইন্টারন্যাশানাল গলফ মাঠে। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার বাড়িতে। এখানে বেশ কিছুদিন কবি ছিলেন। লিখতে শুরু করেছিলেন শেষের কবিতা। বড় হয়ে সে না হয় তুমি পোড়ো। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলো সিরাজুল। তারপর থেকে একটুও ঘুম এলো না আর। কারণ কাল সকালে উঠেই যে আমরা যাবো চেরাপুঞ্জি। সেই কবেকার ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি...। বাইরে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে আমার ঘরের কাঁচের জানলায়। সেই তুমুল বৃষ্টি আর বিদ্যুতের মধ্যে হঠাত ঠক ঠক আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভুল শুনছি না তো? না, ওই তো আবার। ঠক ঠক...। এতো রাতে দরজায় আওয়াজ করছে কে? শরীরের মধ্যে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। হোটেলে ভূত-টুত নেই তো? বালিশের পাশ থেকে হাতড়ে টর্চটাকে খুঁজে বের করলাম। ধুর ছাই, কাজের সময় বিগরোবে। জ্বলছে না। আবার আওয়াজ, ঠক...ঠক...ঠক...। শরীরের মধ্যে দিয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। আস্তে আস্তে উঠে দরজার দিকে যাবো আর ঠিক সেই সময় কড়কড় করে বাজ পড়লো। দমকা হাওয়ায় খুলে গেলো দরজা। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগলো আমার মুখে। সেই আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম তালগাছের মতো লম্বা একটা কি যেনো। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। (চলবে)


লেখা ও ছবি
কল্লোল লাহিড়ী
উত্তরপাড়া, হুগলী

চলচ্চিত্রবিদ্যা বিষয়ে অধ্যাপনা, তথ্যচিত্র নির্মাণ, ফিল্ম ও টেলিভিশন ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যরচনা, এবং ফাঁকে ফাঁকে পেলে নিজের ব্লগে নানা স্বাদের লেখালিখি - বিবিধ ধারার ব্যস্ততার মধ্যে চাঁদের বুড়ির সাথে ইচ্ছামতীর প্রথম পায়ে হাঁটার দিনগুলিতে হাত ধরেছিলেন কল্লোল । এখনো সময় পেলে মাঝেমধ্যেই ইচ্ছামতীর জন্য কলম ধরেন হুগলী, উত্তরপাড়া নিবাসী কল্লোল।