খেলাঘরখেলাঘর

সৃজন ও তার ময়না টিয়া
সৃজনের বাড়িতে ছিলো দুটো পাখী।ময়না ও টিয়া।দুটো খাঁচায় ওরা থাকত। ওদের মধ্যে ছিলো ভীষণ ভাব।সময় সুযোগ পেলেই ওরা নিজেদের মধ্যে খুব কথা বলত।হ্যাঁ,মানুষের মতই ওরা বেশ কিছু কথা বলতে পারত।সৃজন ওদের ছোট বেলা থেকেই কথা বলার শিক্ষা দিত।তাই ওরা মানুষের ভাষা যেমন অনেকটাই বুঝতে পারত তেমনি বলতেও পারত।এমনি ভাবে সৃজনও ওদের বন্ধু বনে গিয়েছিল।

ময়না একদিন বললো,টিয়া আমরা খুব ভাল আছি,দেখ তুই যা খাস আমিও তা খাই।তোকে যখন বন্ধু সৃজন স্নান করায়,আমাকেও করায়।আমাদের তো মজাই মজা,তাই না?
টিয়া বললো,তা বলেছিস ঠিক।আমরা তিন বন্ধু আছি তা না হলে,শুধু এক জন হলে কত খারাপ লাগত বল ?
--কেন?খারাপ কেন?ময়না জেনে শুনেও প্রশ্ন করল।
--ওই দেখ না,আকাশটা দেখ না কি সুন্দর!আর দেখ,আমাদের জাত ভাইরা কেমন উড়ে বেড়াচ্ছে স্বচ্ছন্দে!তোর আমারও তো ইচ্ছে করে বল,ওই আকাশটায় উড়ে বেড়িয়ে আসতে--ঘুরে বেড়িয়ে আসতে?টিয়া তার মনের কথা বলে চলল,এমনি সময় ঘরের বাইরে নীল আকাশে এক ঝাঁক পাখীর দল টি-টি,টি-টি শব্দ করে উড়ে গেলো।টিয়া তা চুপ করে কান পেতে  শুনলো। ময়নাকে আবার সে বলে উঠলো,ওই দেখ,আমার জাত ভাইরা আমায় ডেকে ডেকে চলে যাচ্ছে!রোজ ওরা এমনি ডেকে যায় কিন্তু আমি যেতে পারি না,আমি তো বন্দী !
ময়নার টিয়ার কথা সত্যি মনে হলো,ও সান্ত্বনা দিয়ে টিয়াকে বললো,তুই সত্যি বলেছিস টিয়া,আমরা বন্দী বটে!তবু একটা সময় আসে আমাদের ভালো লাগে--আমরা যখন খাই--আমরা যখন স্নান করি--আর আমাদের বন্ধু সৃজন আমাদের সঙ্গে যখন কথা বলে--শিশ দিয়ে কথা বলতে ওই তো আমাদের শিখিয়েছে!ও কিন্তু আমাদের খুব ভালবাসে রে !মাঝে মাঝে মনে হয় যদি সত্যি আমরা উড়ে যাই তা হলে সৃজন খুব দুঃখ পাবে।ওর জন্যে আমাদের মনও কাঁদবে রে !
টিয়া বললো,আমার মন কাঁদবে না।আমার কাছে ওই নীলাকাশ,সঙ্গী সাথীদের নিয়ে উড়ে যাওয়া--অনেক,অনেক ভালো লাগবে।
সৃজন পাখীদের কথা আড়াল থেকে শুন ছিলো।পাখীরা ওকে ভালোবাসে না।ও এত ভালোবাসে ওদের,আর,ওরা?চলে যেতে চায় ওকে ছেড়ে?
সৃজনের মনে আছে এক বছর আগের কথা--এক পাখীওয়ালা তাদের বাড়ি এসেছিল।অনেক পাখী ছিলো,এক এক খাঁচায় এক একটা করে পাখী ছিলো। কেবল একটা খাঁচায় দুটো ছোট্ট ছোট্ট পাখীর বাচ্চা রাখা ছিলো। পাখীওয়ালা বলেছিল,ওরা নাকি ডিম ফুটে ক দিন আগেই বেরিয়েছে। ছোট ছোট লোম নিয়ে ওরা চুপ করে জড়সড় হয়ে বসে ছিলো--তখনও পালক গজায় নি ওদের গায়ে!সৃজন বাবা,মার কাছে বায়না ধরেছিল ওই দুটো পাখীই তাকে কিনে দিতে হবে বলে!
দুটো পাখীর একটা ছিলো টিয়া,অন্যটি ময়না।অনেক দাম--কিন্তু পাখী দুটো ছোট ছিলো বলে কম দামে দিয়ে গিয়ে ছিল পাখীওয়ালা। বাবা,মা, বললেন,এবার ঠেলা সামলাও,ভালো করে ওরা খেতেই শেখে নি! তোমাকেই ও পাখীদের বারবার খাওয়াতে হবে।
কষ্ট করে ছিলো সৃজন।পাখীদের ঠোঁট ফাঁক করিয়ে ছাতু,আটার গোলা, ভেজানো চানা-মটরের টুকরো করে খাইয়েছে।এমনি ভাবেই টিয়া,ময়না বড় হয়েছে।খাওয়া পড়া শেখানোর সব করেছে সৃজন।মা,বাবা মাঝে মধ্যে একটু আধটু সাহায্য করেছেন ঠিকই,সে সঙ্গে পড়ালেখার অনেক খোঁটাও দিয়েছেন,বলেছেন,সৃজন তোমার পড়ালেখা কিন্তু গোল্লায় গেলো!সারাক্ষন তুমি পাখীদের নিয়ে বসে থাকো!কিন্তু পাখীদের জন্যে এত কিছু করার পরও ওকে ছেড়ে ওরা উড়ে যেতে চায়!ওদের কথা শুনে ওর মন খুব খারাপ হয়ে গেলো--মনে মনে বেশ রাগ হলো,ঘরে ঢুকে পাখীদের কাছে গিয়ে বললো, টিয়া ,ময়না,তোরা কি আমায় ছেড়ে চলে যেতে চাস?আমার জন্যে তোদের এতটুকু ভালবাসা নেই !
ময়না বললো,আমি তোমায় ভালোবাসি,তবু মাঝে মাঝে মনটা উড়ু উড়ু হয়--মনে হয় ওই খোলা আকাশটা ঘুরে আসি--মনে হয়,পাখা ছড়িয়ে একটু আকাশের নীল রঙ আর রোদ্দুর মেখে নিই !
টিয়া বললো,একটু না,অনেক,অনেক ঘুরব,আকাশের আমার আত্মীয় পাখীদের ঝাঁকের সাথে ঘুরব.নীল আকাশটা পেরোব,সাদা মেঘে চড়ে খেলে বেড়াব--কি মজা ! কি মজা !
--ঠিক আছে,ঠিক আছে,ভীষণ রাগ হলো সৃজনের,মনে মনে বললো,পাজি! খুব খারাপ!!তোদের কাছে এই ভালবাসার মূল্য?দুটো খাঁচার দ্বারই ও খুলে দিয়ে বললো,তোরা কেউ আমার বন্ধু না,যা,চলে যা তোরা,আমার কাছে  আর কখনো আসবি না !
খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে এলো টিয়া,ময়না--সৃজনের কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে ওরা তাকিয়েও যেন তাকালো না!ওরা শুধু রোদমাখা আকাশের দিকে তাকালো।আর ফর ফর উড়তে গিয়ে দুবার পড়ে গিয়ে তারপর উড়ে গেলো আকাশে!
সৃজন স্কুলে গেলো না--সারা দিন মন মরা হয়ে পাখীদের কথাই ভাবতে লাগলো।ও কাঁদছিল,আকাশের মাঝে ও ওর টিয়া,ময়নাকে খুঁজতে খুঁজতে  কাঁদছিল।
দিনের আলো নিভে আসতে লাগলো।সব পাখীরা তখন ফিরছে নিজের নিজের বাসায়।পলকহীন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল সৃজন--ওর টিয়া, ময়না হারিয়ে গেছে--আর ফিরবে না ওরা--!
তখন সন্ধ্যে হয় হয়--এমনি সময় সৃজন শুনতে পেল ময়না তাকে ডেকে বলছে,সৃজন বন্ধু! আমি ফিরে এসেছি,বন্ধু!ছুটে গেলো সৃজন বাইরে, দেখল, সত্যি ওদের দরজার ওপরে বসে ময়না মিটিমিটি হাসছে। কিন্তু টিয়া?সে তো এলো না!রাত নামল,অন্ধকারে সৃজন ও ময়না বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।কিছু পরে বাইরে থেকে টিয়ার কান্না শোনা গেলো,ও সৃজন বন্ধু আমায়  বাঁচাও। তাড়াতাড়ি সৃজন বাইরে বেরিয়ে এলো,দেখতে পেল, ধুলোয় লুটিয়ে আছে টিয়া! ওর একটা ডানা ভেঙে গেছে--ও উড়তে পরছিলো না।সমস্ত গা ওর ধুলোয় মাখা! সৃজন কেঁদে উঠলো, বললো, তোমার কি হয়েছে বন্ধু,টিয়ে !
টিয়ে কেঁদে বললো,আমার স্বজনেরা আমায় নিলো না বন্ধু,আমায় ওরা মেরেছে,আর তা ছাড়া,আমি ভালো উড়তে জানি না।আমি আর বাঁচবো না বন্ধু! সুজন কেঁদে উঠলো,ওকে কোলে নিলো,বললো,না,তুমি বাঁচবে,তোমায় আমি মরতে দেবো না!
টিয়ে বললো,সৃজন বন্ধু,আমি বুঝতে পেরেছি,এ খাঁচাই আমার ঘর,এখান থেকেই আমি বাইরের নীল আকাশ দেখে আনন্দ পাবো !
খাঁচা থেকে ময়না বলে উঠলো,ঠিক বলেছ বন্ধু!সৃজন বন্ধুকে দেখো--আমাদের থেকে চেহারায় কত বড়--তবু ঘরের মতই একটা খাঁচাতে ও আমাদের মতই বাস করে !
                                                                              
                                        

তাপসকিরণ রায়
জবলপুর, মধ্যপ্রদেশ                                      

   


   

তাপস কিরণ রায় অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কুলে শিক্ষকতা করেন বেশ কিছু বছর। পরে আয়কর বিভাগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি মধ্য প্রদেশের জবলপুর শহরে বাস করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখা তাঁর অনেকগুলি বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।