খেলাঘরখেলাঘর

পিন্টু ও একটি চশমা



ঘড়ির দিকে আরেকবার তাকালাম। প্রায় সাড়ে সাতটা। ইতিহাসটা নিয়ে বসেছি বটে, কিন্তু চোখদুটো খুব বেশিক্ষন বইয়ের পাতার দিকে থাকছে না। অন্যান্য দিন ইতিহাস পড়তে বসলে এই সময়ে রানা প্রতাপের চৈতক লাফ দিয়ে পেরিয়ে যায় দুই পাহাড়ের মধ্যের গভীর খাদ বা পৃত্থীরাজের ঘোড়া টগবগিয়ে পিছনে ফেলে দেয় পিছু নিয়ে আসা সৈন্যের দল নাহলে কখনো কখনো দুই দলে লেগে যায় প্রচন্ড লড়াই। যাদের কথা বইতে পড়ি, তাদের সব্বাইকে যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে গল্পের মত। আজকে শিবাজীর গল্প পড়ছিলাম। কি দারুনভাবে শিবাজী পালিয়ে যাবেন ফুলের টুকরিতে লুকিয়ে। কিন্তু সেই দৃশ্যটা সিনেমার মত চোখের সামনে ভেসে উঠছে না। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে পড়ায় মন নেই। আজকে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যে আমি আর টুবলু দুজনেই বেশ কিছুটা চমকে গেছি। এমনিতে কোন ব্যাপারেই আমাদের জুড়ি মেলা ভার। আমরা খেলাধুলোয় চ্যাম্পিয়ন, কোন কিছুতে ভয়ও পাই না, পড়াশুনোয় যে একেবারে ধ্যাদ্ধেড়ে এমনও নয় কিন্তু তা সত্তেও এমন একটা ঘটনাবে যে আমরা এক্কেবারে চুপসে যাব, তা কক্ষনও  ভাবিনি। চোখ বারবার চলে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটার দিকে। আটটা কতক্ষনে বাজবে কে জানে?

এই সবের মূলে আছে বিন্তি, আমার পিসতুতো বোন। আমাদের চেয়ে এক ক্লাস নিচুতে পড়ে। ওকে দেখতে খুদে এইটুকুন হলে কি হবে, ওর চোখেমুখে কথার খই ফোটে। প্রতিবারই পিসিরা যখন ছুটিতে আমাদের বাড়ি আসে, তখন কিছু না কিছু করে আমাকে চমকে দেয়। এবারে আমি আর পিন্টু দুজনেই ঠিক করে রেখেছিলাম, যে বিন্তি যাই করুক না কেন, ওকে আমাদের টেক্কা দিতে দেওয়া চলবে না। সে গুড়ে বালি। আজকে বিকেলে খেলে যথারীতি নোংরা হয়ে ঘামে ভিজে আমরা বাড়ি ফিরছি, এমন সময় দেখি ও একটা অদ্ভূত চশমা পরে আমাদের বাগানে ঘুরছে - তাও আবার একা একা। অদ্ভূত বললাম এই কারনে, যে চশমাটা ওর চোখের তুলনায় বেশ বড় আর ওর তো চোখ খারাপ নয় যে চশমা পড়বে।

আমার বা টুবলুর কারোরই চশমা নেই। তাই একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “কি রে, তুই অত্তবড় একটা চশমা নাকের ওপর চড়িয়েছিস কেন?”
এমনিতে বিন্তি খুব ছটফটে, হাসিখুশি। কিন্তু আজ সে মুখ গম্ভীর করে বলল, “তোরা বুঝবি না।”
বুঝব না? এই কথা শুনলে কার না রাগ হয়। আমি চোখের ঈশারায় একবার টুবলুর সাথে  কথা বলে নিলাম। তারপর কোন রকমে রাগ চেপে বললাম - “বুঝব না মানে? তুই আমার ছোটবোন হয়ে বুঝবি আর আমরা বুঝব না?”
-“না, মানে বুঝতে না পারলে আমায় বলতে আসিস না। এ অনেক জটিল ব্যাপার।”
-“তা শুনি কিরকম জটিল ব্যাপার?”
-“এ যে সে চশমা নয়। এটা স্পেকট্রোস্কোপ”
   
একটু থমকে গেলাম। স্টেথিস্কোপ, টেলিস্কোপ, পেরিস্কোপ শুনেছি। স্পেকট্রোস্কোপটা আবার কি? আমি আর টুবলু আবার চোখাচোখি করলাম। ও ও জানে না। কিন্তু একটু কটমট করে তাকালো, যার মানে হচ্ছে এত সহজে ব্যাপারটা মেনে নিলে চলবে না।
একটু ঢোক গিলে বললাম, “স্পেকট্রোস্কোপ আবার কি?”
-“সারাদিন মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াবি তো আর জানবি কি করে। এটা একটা যন্ত্র। এটা দিয়ে ভূত দেখা যায়”
টুবলু এতক্ষন চুপ করে ছিল। এবার একটু গাঁইগুই করে বললে, “ভূত বলে কিছু নেই।”
-“আচ্ছা, তাই নাকি? কে বলেছে যে ভূত নেই?”
টুবলু বলল, “বেশ তো, আছেই যদি তবে দে দেখি তোর চশমাটা, আমরাও দেখি।”
-“প্রথম  কথা এটা চশমা নয় একটা যন্ত্র। আর দ্বিতীয়তঃ তোদের চিল্লামিল্লিতে ভূত পালিয়ে গেছে।”
-“বাহ, তাহলে প্রমান হবে কি করে?”
-“প্রমান হবে। আজ রাত আটটায়।”
ঠিক কি করে প্রমান হবে জানতে চাইছিলাম, তার আগেই বিন্তি আর কিছু না বলে একছুটে বাড়ির মধ্যে পালাল।
টুবলু খানিক দাঁড়িয়ে, মাথা চুলকে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দেওয়ার আগে আমার দিকে ভ্যাবলার মত চাইল। এমনিতে আমাদের দুজনের মধ্যে ও-ই একটু বেশি ওয়াকিবহাল সব বিষয়ে। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি যে এবারে বেড়াতে এসেও বিন্তি বেশ একচোট নিয়ে গেল দেখে ও মনে মনে একটু দমে গেছে। আর কিছু না বলেই টুবলুও নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল। ভাবখানা এই যে - “আমি তো আর রাত আটটার সময় এইখানে থাকতে পারব না। তুই কিন্তু চোখ কান খোলা রাখিস।” কিন্তু আমি তো আর সর্বজ্ঞ নই। এমনিতেই টুবলু পাশে না থাকলে আমার সাহস কমে আসে। এখানে অবশ্য সাহসের প্রশ্ন না। চোখা কান খোলা রাখতে হবে আর কি।