খেলাঘরখেলাঘর

জেলি

নতুন জ্যাম-জেলির কৌটো কখনও খুলবার চেষ্টা করেছ ? পারবেই না খুলতে। কেননা এত শক্ত করে আঁটা থাকে ! সেই রান্নাঘরে গিয়ে  মা-এর সাহায্যই নিতে হবে!দেখ মা কেমন করে খোলেন সেটা।
     
মা  সসপ্যানে খানিকটা জল গরম করে কৌটোর ঢাকনার দিকটা জলের মধ্যে ডুবিয়ে ( অর্থাৎ কৌটোটা উল্টো করে) দিলেন। কিছুক্ষণ রাখার পর সেটা তুলে ধাতব ঢাকনায় সামান্য চাপ দিয়ে ঘোরাতেই সেটা খুলে গেল!
     
কি করে হল বল দেখি। খুলতেই চাইছিল না, একটু গরম করতেই কেমন চট করে খুলে গেল ম্যাজিকের মত। আসলে  গরম পেয়ে কৌটোর ঢাকনাটা সামান্য একটু বড় হয়ে গিয়ে এই কান্ডটা ঘটালো। বড় হয়ে গেলে কাচের কৌটোর গায়ে চেপে বসা ঢাকনাটা ত আলগা হবেই, তাহলে আর খুলতে অসুবিধেটা কোথায়! কিন্তু একটা কথা রয়েছে, ধাতব ঢাকনার সাথে সাথে কৌটোর কাচটাও ত বড় হবে, তাহলে আর ঢাকনাটা আলগা হবে কি করে, তাই না! কিন্তু তাহলেও ঢাকনাটা একটু বেশী বাড়বে, দুটো কারণে। এক, গরম জলের সংষ্পর্শে থাকায় ধাতব ঢাকনাটা বেশী গরম হবে, আর দুই,কাচের তুলনায় ধাতু বেশী বেড়ে যায়।                              

বেড়ে যাওয়ার মানেটা বুঝলে ? সেটা বলি শোন। আমরা আমাদের চারপাশে যত জিনিষ দেখি, সবগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। এই তিনটি ভাগের নাম হল, কঠিন, তরল আর গ্যাসীয় পদার্থ। এদের নানা ধর্ম আছে, তার মধ্যে একটি হল, গরম হলে এরা প্রত্যেকেই আকারে বেড়ে যায়। এই বেড়ে যাওয়া বা প্রসারিত হওয়াকে বলে 'পদার্থের প্রসারন'। জ্যামের কৌটোটা কাচের আর ঢাকনাটা ধাতুর তৈরী, সুতরাং কঠিন পদার্থ। তাই এদের প্রসারনকে  বলে 'কঠিন পদার্থের প্রসারন'।
     
এমন প্রসারনের আর একটা উদাহরন দিচ্ছি। কলকাতা শহরে ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানীর বিদ্যুতবাহী তার মাটির তলা দিয়ে গেলেও অন্যত্র রাস্তার পাশে খুঁটির পর খুঁটি পুঁতে তার টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। দিনের বেলায় দু'টি খুঁটির মধ্যেকার তার মোটামুটি টানটান থাকলেও সন্ধ্যার পর সেই তার একটু ঝুলে যায়। লক্ষ্য করেছ কখনও ? না করে থাকলে এবার করবে। বলতে পারবে তার কেন ঝুলে যায় ?
      
দিনের তুলনায় রাতে বেশী বিদ্যুৎ চলাচল করে, ফলে তার বেশী গরম হয়ে প্রসারিত হয়ে ঝুলে যায়! কোন পরিবাহিতে ( এখানে ধাতব তার ) বিদ্যুত প্রবাহিত হলে সেটা গরম হয়ে যায় কিনা!
      
গরম হলে যেমন পদার্থ প্রসারিত হয়, ঠান্ডা হলে তেমনই সংকুচিত হয় বা ছোট হয়ে যায়।  জ্যামের কৌটো গরম জলে না ডুবিয়ে ঠান্ডা জলে ডোবালে ঢাকনাটা আরও চেপে বসে যেত। খোলাই যেত না।
      
এ'ত গেল কঠিন পদার্থের প্রসারনের কথা। এবার তরলের প্রসারনের কথা।
      
সংকোচন  দিয়ে শুরু করি। সরু মুখের কাচের একটা বোতল পুরো জলভর্তি কর (একেবারে বোতলের মুখ পর্যন্ত টায় টায়)। টোম্যাটো সসের বোতল হলেও চলবে। ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে একটা বাটিতে রাখ আর বরফের মধ্যে জলভর্তি বোতলটা বসিয়ে দাও। কিছুক্ষণ পর দেখ। কি দেখবে বল দেখি ? জলের লেভেল কিছুটা নেমে এসেছে। কারণ হল বোতলের জল ঠান্ডা বরফের সান্নিধ্যে এসে সংকুচিত হয়ে গেছে। তাই লেভেল নেমে গেছে।
     
এবার বোতলটা বরফ থেকে বের করে টেবিলের ওপর রাখ। টেবিল বরফের চেয়ে গরম, সুতরাং জল এবার গরম হতে থাকবে। একটু পরে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে বোতলে জলের লেভেল আবার উঠে গিয়ে আগের অবস্থায় চলে এসেছে। এর মানে কি হল ? এর মানে হল জল গরম হওয়ার কারণে প্রসারিত হল।
      
বোতলটা যদি গরমজলে বসিয়ে দাও তাহলে দেখতে পাবে যে বোতলের জল উপচে পড়ে যাচ্ছে, কারণটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ! জল তাপ পেয়ে আয়তনে বাড়ছে। জল না হয়ে অন্য কোন তরল হলেও একই ফল হত। এই প্রসারনকে বলে 'তরলের প্রসারন'।
      
এ রকম আর একটা উদাহরণ দিই। জ্বর হলে আমরা থারমোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা দেখি,তা থেকে বুঝতে পারি শরীর কতটা উত্তপ্ত । থারমোমিটারের কুন্ডতে যে রুপোলী পদার্থ থাকে সেটা হল তরল ধাতু 'পারদ'। কুন্ডটা শরীরের সংস্পর্শে আনলে তরল পারদ শরীরের উত্তাপ অনুযায়ী প্রসারিত হয়,আর থারমোমিটার -এ সেটা দেখে আমরা বুঝতে পারি কতটা জ্বর হল।

বাড়িতে থারমোমিটার আছে ত ? তার কুন্ড বা বাল্‌ব্‌টা হাতের মুঠোয় ধর, দেখ কেমন করে পারদ উঠে যাচ্ছে তরতর করে। এখানেও একটা কথা আছে, পারদের সাথ সাথে কাচও বাড়বে তবে পারদের বৃদ্ধিটা এতই বেশী যে কাচেরটা বোঝাই যায় না! তরলের বৃদ্ধির হার কঠিনের চেয়ে বেশী।

বেলুন
      
এবার গ্যাসের প্রসারনটা কি দেখা যাক। একটা বেলুন টান টান করে, মানে বেশী করে হাওয়া ভরে ফুলিয়ে মুখটা ভাল করে বাঁধ যাতে হাওয়া বেরিয়ে না যায়। এবারে সেটাকে রোদে ফেলে রাখ। একটু পরে দেখবে অবাক কান্ড! ফটাস করে বেলুনটা ফেটে যাবে! কেন, সেটা বুঝলে কিছু ?
      
আসলে বেলুনটা রোদে ফেলে রাখলে বেলুনের ভেতরের বাতাস গরম হয়ে আয়তনে বাড়তে থাকে, আর তাতে বেলুনও আরও ফুলতে থাকে। কিন্তু কতক্ষণ আর ফুলবে ? একসময় ত ফেটে যাবেই! কিনা বল !
     
যদি ফোলানো বেলুনটা রোদে না রেখে ফ্রিজের ভেতর রেখে দাও তাহলে কিছুক্ষণ পর কি দেখবে বলত!বেলুনটা রীতিমত চুপসে ছোট হয়ে গেছে! কারণটা কি ? কি আবার! ঠান্ডায় বেলুনের বাতাস আয়তনে কমে গেছে আর তাতেই বেলুন ছোট হয়ে গেছে!
     
তাহলে দেখতে পেলে, কঠিন আর তরলের মত বাতাস বা অন্য গ্যাসও তাপ পেলে আয়তনে বাড়ে ঠান্ডা হলে আয়তনে কমে। এর নাম 'গ্যাসের প্রসারন'। গ্যাসের প্রসারনের হার তরলের চেয়ে বেশী।
      
নানাভাবে পদার্থের এই সব  প্রসারন আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। এ বিষয়ে বড় হয়ে আরও অনেককিছু জানতে পারবে।


সন্তোষ কুমার রায়
কোদালিয়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা

ছবিঃ ইন্টারনেট

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।