খেলাঘরখেলাঘর

সজারু

পর্ব চার

গত সংখ্যায় সন্ধ্যাবেলার ভাল লাগার কথা বলেছিলাম, এবারসন্ধ্যার খারাপ লাগার কথা বলি। ছোটবেলায় প্রায় সবাই একটু ভিতু থাকে বোধ হয়,তাই না? আমিও ছিলাম।
লন্ঠনের আলোয় ঘরের দেওয়ালে পড়া লম্বা লম্বা ছায়াগুলো দেখলে গা ছম ছম করত। দাদুর কাছে শোনা গল্পের মধ্যে কোনটা ভূতের হলে তো কথাই নেই। দিয়ানীর কোলে  সেঁধিয়ে যেতাম একেবারে।

পড়া হয়ে গেলে রোজই ছিল দাদুর কাছে গল্প শোনা। কাজ  সেরে বড়রা একে একে জড়ো হতেন দাদুর ঘরের দাওয়ায়। দাদু আলবোলায় গুরুক গুরুক করে তামাক খেতেন। নানা রকমের কথা হত সে সময়।

কি একটা পাখি এক নাগাড়ে কুঁক কুঁক করে চলত। একঘেয়ে ঐ ডাকটাকে কেন জানিনা ভয় পেতাম দারুন।

দাদুর একটা বন্দুক ছিল। সেটা ছিল গ্রামের মানুষের বল ভরসা। কোনো বিপদ আপদ হলেই তারা দাদুর কাছে সাহায্যের জন্য ছুটে আসত।

একবার কি হয়েছিল শোনো। ক'দিন ধরে শোনা যেতে লাগল কি একটা জানোয়ার এসেছে গ্রামে । বিটকেল দেখতে  । খরগোশের মত বড়। গায়ে বড় বড় কাঁটা, দৌড়লে নাকি ঝুম ঝুম করে আওয়াজ হয় । তাড়া করলে গর্তে বা ঝোপ ঝাড়ে লুকিয়ে পড়ে।

মাতব্বরেরা দাদুর কাছে এলেন এই আবেদন নিয়ে যে ওটাকে মারতে হবে । সব কিছু শুনে দাদু বললেন যে ওটা সজারু হতে পারে। নিরীহ প্রানী, কোনো ক্ষতি করবে না। তাই মারবার দরকার নেই।

কিন্তু কে শোনে সে সব কথা।সবার এক অনুরোধ ওটাকে মারতে হবে। অগত্যা দাদু রাজী হলেন।

একদিন বিকেলের দিকে কয়েকজন লোক এসে দাদুকে ডেকে নিয়ে গেল।সন্ধ্যের মুখে মড়া জানোয়ারটাকে নিয়ে অনেকেই এলেন আমাদের বাড়ীতে।কৌতুহল  নিয়ে দেখতে গিয়ে ভয়ে গুটিয়ে গেলাম। গায়ে বড় বড় কাঁটাওয়ালা ছিন্ন ভিন্ন জন্তুর মরদেহ থেকে বিকট দুর্গন্ধ বেরচ্ছে। ঐ সব দেখে শুনে আর গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল একেবারে। দিয়ানীর আঁচল ধরে পেছন থেকে উঁকি মেরে দেখতে দেখতে দুচোখ ভরে জল এলো। সজারুটার জন্য তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।

অনেকেই বলাবলি করছিল যে ওর একটা জোড়া থাকা সম্ভব। সেদিন সন্ধ্যা থেকে কোন শব্দ হলেই কেবলই মনে হত যে জোড়ার অপর সজারুটা এসেছে বোধ হয়। এই বোধ হয় তেড়ে কামড়াতে এল বা ভয়ংকর কাঁটা ফোটাতে এল। আর ঐ বোঁটকা গন্ধটা যেন নাকের সাথে লেপ্টে আছে। কত দিন যে ছিল !

সজারু সম্পর্কে কিছু কথা এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি । এ সব তখন জানতাম না পরে জেনেছি।ওদের গায়ে যে কাঁটা হয় সেগুলো তিন চার ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। আর খুব ছুঁচলো। আমার কাছে ঐ কাঁটা কয়েকটা অনেক দিন ছিল, এখন হারিয়ে গেছে। সজারু ভয় পেলে নিজের শরীরটাকে গুটিয়ে কাঁটাওয়ালা গোল বলের মত করে ফেলে যাতে কেউ আক্রমন করতে না পারে। করতে এলে সে কাঁটার খোঁচা খেয়ে পালিয়ে যায়।

কিন্তু শেয়াল ভারি চালাক। সজারুর মাংস খেতে খুব ভালবাসে। সে কাঁটার বলের মত সজারুকে সাবধানে ঠেলে ঠেলে কোন পুকুর বা জমা জলের মধ্যে ফেলে দেয়। সজারু ডুবে যাবার ভয়ে হাত পা ছড়িয়ে সাঁতার দিতে গেলে শেয়াল আক্রমন করে তাকে মেরে ফেলে।

যাক যে কথা বলছিলাম। দাদুর দাওয়ায় সন্ধ্যার আড্ডার মধ্যেই আমার খাবার ডাক পড়তো সবার আগে। সবার ছোটো কিনা তাই। দাদুর ঘরটা ছিল বড় উঠোনের এক ধারে। আর রান্নাঘর ছিল ভেতরের উঠোনে। দাওয়ায় সবাই বসে থাকত তাই নির্ভয়ে এক দৌড়ে গিয়ে খেয়ে আবার এক দৌড়ে ফিরে আসতাম।

কিন্তু মুশকিল হত এর পর। বড়দের খাবার ডাক পরলে।সবাই চলে যেত রান্নাঘরে। আমি একা শুয়ে  থাকতাম দাদুর ঘরে দিয়ানীর খাটে। ভয় পেতাম খুব। হয়ত একটা শেয়াল ডেকে উঠল কোথাও বা অন্য কোন শব্দ হল, আর সেই  পাখিটা ডেকেই চলত। চমকে চমকে উঠতাম।

এই সময় রোজই প্রায় ঘড়ি ধরে আসার মত আসত প্রানগোপাল দা। হাতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে আর তালে তালে গান গাইতে গাইতে সে আসত। কোথা কোথা থেকে যাত্রা দেখে এসে সেই সব গান গাইত উচ্চকন্ঠে। অনেক দূর থেকে তার আসার আওয়াজ পাওয়া যেতো এতে। ও যেত বড় উঠোন দিয়ে। এক দিক দিয়ে ঢুকে আর এক দিক দিয়ে বেরিয়ে যেত। এটা ছিল ওর শর্টকাট। ওর গান গাওয়া আর লাঠি ঠোকার শব্দে আমার ভয় অনেকটাই কেটে যেত।

প্রানগোপালদা'র কথা আগে বলা হয়নি। আমাদের বাইরের উঠোনের পাশে ছিল কাছারিঘর। তার একটা অংশে ছিল একটা মুদিখানা। হরেন মামাকে মুদিখানাটা করতে দিয়েছিলেন দাদু। প্রানগোপালদা ছিল তারই ভাগ্নে। সে রোজ রাতে মামার দোকানে শুতে আসত দোকান পাহারা দিতে। আমার সাথে ওর খুব ভাব ছিল।

এর পর নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম এসে যেত। ভাঙত সেই সকালে, ঘুঘুর ডাকে ---- যে ডাকের কথা প্রথমেই বলেছিলাম।
একটা কথা তোমাকে জানিয়ে রাখি। এখানে যেসব ঘটনার কথা বলছি সে সব ঘটেছিল আমার প্রায় ছয় থেকে দশ বছর বয়সের মধ্যে আমার মামার বাড়িতে।
কোনটা আগে আর কোনটা পরে সেটা আর এ বয়সে মনে নেই। থাকার কথাও নয়।
যতটা সম্ভব ক্রমানুসারে বলে যাবার চেষ্টা করছি।

 

 

সন্তোষ কুমার রায়  
রূপনারায়নপুর, বর্ধমান

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।