খেলাঘরখেলাঘর

পরশমনি   


চলো আবার যাই রান্না ঘরে। দেখি সুলুক সন্ধান করে কিছু পাওয়া যায়  কিনা। তোমাকে তো যেতেই হচ্ছে। মা ডাকছেন দুধ খেতে।

আরে ওকি? মা 'গেলো গেলো' বলে চিতকার করছেন কেনো? চলতো দেখি। ও, দুধ উথলে পড়ে গেছে আর তাতে গ্যাসও নিভে গেছে।এর পর মা যেটা করলেন সেটা বড়ই গোলমেলে একটা কাজ। গরম দুধটা তাড়াতাড়িতে একটা কাচের গ্লাসে ঢেলে ফেললেন। ব্যস সঙ্গে সঙ্গে চড়াত করে একটা শব্দ,গ্লাস ফেটে চৌচির।
কি গেরোরে বাবা!!

তবে এর পর মা যেটা করলেন সেটা কিন্তু একদম সঠিক কাজ। অন্য একটা গ্লাসে দুধ ঢালার আগে একটা চামচ রাখলেন তাতে। এবার কিন্তু গরম দুধ ঢাললেও গ্লাসটা ফাটলো না।
তিন তিনটা কান্ড হল পর পর। কি মনে হচ্ছে, কি কারন থাকতে পারে এর পেছনে ? দেখা যাক এক এক করে।

দুধটা উথলে উঠে পড়ে গেল কেনো ?অথচ জল টগবগ করে ফোটালেও উথলে ওঠেনা বা পড়ে যায় না। দুধ আর জল ফোটে এক রকম করেই, তবে সামান্য একটু তফাত আছে এক জায়গায়। দুধে ফ্যাট বা 'স্নেহপদার্থ' আছে , জলে নেই। দুধ যখন গরম করা হয় তখন নিচের অংশ গরম হলেও ওপরের স্তরটা কিন্তু তুলনায় কিছুটা ঠান্ডা থাকে। আর যার জন্য ওপরের ফ্যাটটা জমে গিয়ে অপেক্ষাকৃত শক্ত একটা সর পড়ে। সরটা দুধটাকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে। তুমি কি সর খেতে ভালোবাসো? আমি তো খুব ভালোবাসি। কি বললে? একদম পছন্দ নয়? তাহলে আর কি করা যাবে...একবার খেয়ে দেখতে পারো চিনি দিয়ে।

যাকগে, যা বলছিলাম - নীচে দুধের বুদ বুদ গুলি ওপরের দিকে উঠে বেরিয়ে যেতে চায় কিন্তু সরের ঢাকনাতে আটকা পড়ে যায়। তখন সবগুলো বুদ বুদ মিলে একত্রে নিচ থেকে ঠেলা মারে। সরটা ঠেলা খেয়ে ক্রমশঃ ওপরের দিকে ওঠে আর দুধ শেষ পর্যন্ত পাত্রের কানা উপচে বাইরে পড়ে যায়।

একটা চামচ দিয়ে যদি ওপরের সরটা ভেঙে দেওয়া যায় তাহলে কিন্তু দুধটা পড়বে না। সেই জন্যই গরম করার সময় চামচ দিয়ে দুধকে অনবরত নাড়া হয়।
তা তো হলো । কিন্তু কাচের গ্লাসটা ফাটলো কেন বলতো ?

তোমরা কি জান যে সব জিনিষকেই গরম করলে লম্বায় চওড়ায় আয়তনে বেড়ে যায়? কাচের গ্লাসে গরম দুধ বা জল ঢাললে তার ভেতরের তলটা আয়তনে বেড়ে যায়। অথচ কাচ ভেদ করে তাপ গ্লাসের বাইরের স্তর পর্যন্ত দ্রুত পৌছতে পারে না। কাচ তাপের কুপরিবাহি কিনা । তাই বাইরের দিকটা বাড়তে পারে না। ভেতরটা বাড়লো অথচ বাইরেটা যেমনকার তেমনি রয়ে গেলো। সে জন্য দুই স্তরে কাচের প্রসারনের তফাতের কারনে চাপের তারতম্য হলো। আর সেটা হতেই কাচের গ্লাসে চড়াত করে চিড় ধরে গেলো !

মা একটা চামচ গ্লাসের মধ্যে দিয়ে যে কাজটা করলেন সেটা একেবারে সঠিক। এতে কি হল বলতো ? ধাতব চামচ তাপের সুপরিবাহী হওয়ায় গরম দুধের তাপটা তাড়াতাড়ি শুষে নিলো। আর তার কিছুটা বাইরে পাঠিয়ে দিলো। ফলে দুধের তাপ যতটা থাকলে কাচের গ্লাস ফেটে যেত ততটা আর থাকছে না। তাই গ্লাসটাও আর ফাটল না।

কুপরিবাহি কথাটার মানেটা কি জান ? একটু বুঝিয়ে বলি । যে সব পদার্থের মধ্য দিয়ে তাপ চলাচল করতে পারে না সেগুলি কুপরিবাহি। যেমন,কাচ কাঠ কাগজ - এই সব আর কি। আর যারা তাপকে বহন করে বা বয়ে এক জায়গা থেকে আর এক যায়গায় নিয়ে যেতে পারে তারা হল সুপরিবাহি। যেমন, কোন  ধাতব পদার্থ। স্টিলের চামচ একটা ধাতব পদার্থ। এটা তাপকে সহজেই অন্যত্র চালান করে দিতে পারে।

চাপের তারতম্য কথাটার মানেটাও তো বলে দিলে ভালো হয়,তাই না ?কাচের গ্লাসের ভেতরটা বেড়ে গিয়ে বড় হতে চাইছে অথচ বাইরেটা যেমনকার তেমনি রইল। একটা টানা- পোড়েনের মতো ব্যাপার হল না ? এটাই চাপের তারতম্য।

মোটা কাচের গ্লাসগুলোই সাধারনত ফেটে যায়। কেননা গ্লাসের দেওয়াল পাতলা হলে কাচ কুপরিবাহী হলেও ভেতরের তাপ একটু তাড়াতাড়ি বাইরে যেতে পারে। ফলে প্রসারনটা মোটামুটি সমান হয়। গ্লাসও ফাটে না।



সন্তোষ কুমার রায়
রূপনারায়ণপুর, বর্ধমান

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।