সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
  শিক্ষিকা ভগিনী নিবেদিতা – একটু ফিরে দেখা

একদম ছোট বেলায়, যখন তোমাদের মত ছিলাম,তখন পূর্ববঙ্গে থাকতাম মামার বাড়ি।

সেই ছড়াটা মনে আছে ? সেই যে, 'মামা বাড়ি ভারি মজা কিল-চড় নাই?' আমার ছিল তেমনই। পুজোর কথা তেমন করে মনে নেই,কেননা, নতুন জামা-প্যান্ট,জুতো-মোজা ইত্যাদির  কোন গপ্পো ছিল না তখন!

তাই বলে কি নতুন জামা হত না ? হ'ত সাকুল্যে জোড়া-দুয়েক! একজোড়া দাদু দিদিমা, একজোড়া পাবনার বাড়ি (নিজেদের বাড়ি, পরিবারের বাকি সকলে এখানেই থাকতেন) থেকে আসত,বাবা পাঠাতেন। ব্যস্‌! আর জুতো ? কোথায় পড়ব জুতো ? ঠাকুর দেখতে যাবার কোন 'সিন' ছিল না যে! সে সময় বারোয়ারী পুজো বলে কিছু   দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ধনী মানুষদের কারও বাড়ি ঘরোয়া পুজো হত। প্রতিমা হত একচালার, সাবেকী ধরনের। মামাদের কেউ নিয়ে যেতেন একবার। পূর্ববঙ্গের পুজোর স্মৃতি,  মানে মোটামুটি দশ বছর বয়স অবধি, বলতে এটুকুই!
 
বরং সেখানকার প্রধান পুজো ছিল লক্ষ্মী পুজো ! এদিকে কলকাতায় যেমন ধুম ধাম করে দুর্গাপুজো হয়, ওখানে তেমনি ছিল লক্ষ্মী পুজো!

লক্ষ্মীপুজোর প্রধান উপকরনই মনে হয় ছিল ফুল! সব বাড়িতেই থাকত অন্ততঃ দু ধরনের ফুলগাছ, শিউলি আর স্থলপদ্ম! বর্ষা শেষ হলেই শুরু হত এই দু ধরনের ফুল ফোটা!  সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে  উঠে শিউলি কুড়িয়ে রাখতে হত, না হলে নেতিয়ে যাবে যে ! আর স্থল পদ্ম ? গাছেতেই শুকিয়ে যেত রোদ উঠলে!

পুজোর দিন মামিমা, দিদিমা, মাসিমাদের কাজই ছিল এই সব ফুল কুড়িয়ে নানা কায়দায় সেগুলোকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা! লক্ষ্মী পুজো তো আবার সেই সন্ধ্যায় কিনা!

পুজো শেষ হলে আগে থেকে তৈরি করে রাখা কাপড়ের ব্যাগ (দিদিমা বানিয়ে দিতেন) নিয়ে বন্ধুবান্ধবেরা দল বেঁধে বেড়িয়ে পড়তাম বাড়ি বাড়ি প্রসাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। এত প্রসাদ খাওয়া যেত না যে, তাই সংগ্রহ। কেউ কিছু মনে করতেন না। এটাই রেওয়াজ ছিল তখন!

১৯৫১তে কলকাতায় এসে পড়লাম এখানকার পুজোর খপ্পরে!

বারোয়ারী পুজো দেখা সেই প্রথম ! সব দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পাড়া ক্লাবের পুজো হত সামান্য দুরে, এক মাঠের(বড়সড়, ক্লাবের ফুটবল খেলার মাঠ) এক প্রান্তে, প্যান্ডেল খাটিয়ে!

সেই প্রথম মাইক কাকে বলে দেখলাম। মাঠ থেকে কিছু দুরে একখানা বাড়ী ছিল। তার ছাদে একজোড়া মাইক লাগানো হয়েছিল।

তারের মাধ্যমে গান এসে মাইকের চোঙের ভেতর দিয়ে বেরোত, এটা ভাবতেই আশ্চর্য লাগত। তাতেই তো তর্ক জুড়ে জ্যেঠতুতো ভাইয় খোকনের সাথে মারপিট ! কী বোকাই যে ছিলাম!

তুমি এত বোকা নও নিশ্চয়ই!

বড় বড় প্যান্ডেল বা মন্ডপ খাটিয়ে তাতে কাপড়ের নানা নক্সা করে প্রতিমা রাখা হত। সে সময় ত আর 'থিম' নামের সাজানোর পদ্ধতি ছিল না, তাই ন্য নানারকমের কায়দা করে প্রতিমা রাখা হত! একটা জনপ্রিয় উপায় ছিল কালচে পাথুরে রঙে রাঙানো কাগজ দিয়ে পাহাড় বানানো! পাহাড়ের খাঁজে রাখা হত প্রতিমাদের! এক এক খাঁজে এক এক জন! তাতে অনেক বড় জায়গা (মন্ডপ) লাগত! প্যান্ডেল গুলোর সাইজও হত তাই পেল্লায় পেল্লায়! আগেই বলেছি ফুটবল মাঠের এক প্রান্তে তৈরি হত প্যান্ডেল, তাই জায়গা খুব কম পড়ত না!

প্রতিমার প্যান্ডেলের সামনে হত আর একখানা প্যান্ডেল, যাতে আড্ডা জমত পাড়ার/ক্লাবের দাদাদের! ঢাকিরা তাদের ঢাক কাঁসর ইত্যাদি নিয়ে আস্তানা গাড়ত এখানে।

এছাড়া ছিল মাইকে গান বাজাবার যন্ত্রপাতি, রেকর্ড ইত্যাদি! আগেকার মত ভারী ভারী রেকর্ড, অ্যামপ্লিফায়ার ইত্যাদি এখন নেই, এখন মাইক চালাতে গেলে ছোট্ট ছোট্ট 'চিপ'এ রাখা গান বাজানো হয়( কী ভাবে হয় জানি না)। খুব অল্প পরিসরে এসব করা যায়, এই সব কারনে এখনকার প্যান্ডেলগুলোতে আশেপাশে বেশী জায়গা না থাকলেও চলে। এখন বেশীর ভাগ প্রতিমার সজ্জাতেই থাকে থিম নামক চমক! সেটা ছোট বা বড়, দুইরকম আয়তনের মন্ডপেই করা যায়। তাই কিছু মন্ডপ  ছোট হলেও দেখতে সুন্দর হয় ।

এখন আলোক সজ্জার নানা রকমফের হয়েছে, যা আগে ছিল না! এমন সজ্জা আমাদের ছোটবেলায় দেখিনি!

এখন তুমি বাবা-মায়ের হাতধরে গিয়ে পছন্দ করে জামা-প্যান্ট, জুতো কিনতে যাও। বাজারে গিয়ে পছন্দমত কয়েক সেট পোষাক কেনো। আমাদের তো সে সব ছিল না! বাড়িতে অনেক মানুষ, আর সমবয়সী ভাইবোনের সংখ্যা নেহাত কম নয়। অন্তত গোটা কুড়ি জন। পূর্ববঙ্গ থেকে উদবাস্তু হয়ে চলে আসা এত বড় পরিবারের ছেলেমেয়েদের সবার অনেকগুলো করে , নানারকমের জানা কেনার প্রশ্নই ছিল না।  বড়রা কেউ একদিন গিয়ে পছন্দসই থান কিনে আনতেন,নিজেদের পছন্দ করার কোন সুযোগই ছিল না! কেউ যদি রাগ করে 'এটা নেব না' বলে গোঁ ধরত তাহলে তার পুজোর পোষাক চলে যেত বিশ বাঁও জলে! তার পোষাক কবে যে হবে কেউ জানত না।

থান কাপড় এসে গেলেই ডাক পড়ত দরজি ভাইদের। দু'ভাই ছিলেন দরজিরা। ওঁরা হলেন বীরুদা আর মহাদেবদা। ছেলেদের জামা বানাতেন ওঁরা, বাড়ির মেয়েদের জামাগুলো পিসিমারা বাড়িতে সেলাই মেশিনে বানিয়ে দিতেন। বীরুদা আর মহাদেবদা মাপ নিয়ে যাবার পর এক এক করে প্রায় রোজই আসত  এক এক জনের পোষাক। ওঁরা এলেই সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম, আজ কার এল সেটা দেখতে! যেদিন নিজেরটা আসত, কী আনন্দই না হত!

প্রতিবার অবশ্য এমন আনন্দ হত না ! একবার অন্ততঃ হয় নি! সে বার সকলের জামা এলেও আমার আর খোকনেরটা এল না।  দরজি মহাদেবদা মুখচুন করে বললেন যে কাপড় কাটার সময় গোলমাল হয়ে গেছে, দুটো জামা হবে না! আমার আর খোকনের !  খোকন হল আমার সমবয়সী, যেমন গলায় গলায়  ভাব, তেমনই সব কিছুতেই আদায় কাঁচকলায় ! এখন আমার মনে হয়, মহাদেবদা অবশ্য প্রকাশ্যে বলার আগে রাঙাকাকার সাথে দেখা করেই এসেছিলেন, নাহলে কিছুতেই বলতে পারতেন না ! একজনের হল, আর একজনের হল না, একথা প্রকাশ করা ভারি মুশকিলের ব্যাপার যে ! প্রবল গোলযোগের সম্ভাবনা কীনা ! শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ কে থামাবে!                                                                    

পুজোতে সকলে নতুন জামা পড়লেও আমাদের দুজনের হয় নি সে বছর! পুজোটা মন খারাপ করে কাটলেও, পরে অবশ্য লাভ হয়েছিল আমাদের কালিপুজোতে আমরা দুজন সকলের চেয়ে ভাল জামা পেয়েছিলাম! এখন তোমাদের এমন হলে তোমরা চুপচাপ মেনে নিতে ?                                                          

 একটাই থান থেকে কাটা বলে, আমাদের বাড়ির সকলের জামা-প্যান্ট একই রকমের হত। পাড়ার কিছু দুষ্টু ছেলে মজা করে বলত -"ঐ যাচ্ছে রায়বাড়ির ব্রিগেড" । একটু মন খারাপ হলেই আমরা সেসবে পাত্তা দিতাম না। পোষাক এক রকম হলেও আনন্দ তো আর সকলের এক রকম হত না! এ বিষয়ে স্বাধীনতা ছিল পুরোমাত্রায়!  সেই একই জামা-প্যান্ট পরে নানা জায়গায় প্রতিমা দেখে বেড়ানো ছিল একটা নেশার মত!

সমস্ত দিন হেঁটে হেঁটে প্রতিমা দর্শন করে আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, কাহিল হয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়তাম, আবার সকাল থেকে উদ্দামতা!

কোথা দিয়ে চার দিন কেটে যেত বুঝতাম না! এটা অবশ্য তোমরাও বোঝ না!

  শিক্ষিকা ভগিনী নিবেদিতা – একটু ফিরে দেখা

 

ছবিঃ মহাশ্বেতা রায়

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা