খেলাঘরখেলাঘর

আমার ছোট্টবেলা

                                                                         পর্ব-৮

লিখছি বর্ষার কথা আর খাচ্ছি আম, লিচু, জাম--এই সব।তোমরাও নিশ্চয়ই মজা করে খাচ্ছ! তবে গরমখানা যা পড়েছে ! সাবধানে থেক
সবাই।
দেখ, এখন জৈষ্ঠ্য মাসের শেষের দিক। আজ কালের মধ্যেই বর্ষা আসার কথা। কিন্তু দেখছ'ত, তার আসার নাম গন্ধ পর্য্যন্ত নেই, ভ্যাপসা গরমে প্রাণ আইঢাই! আম পাকা গরম কিনা! অবশ্য এ লেখা যখন পড়বে তখন'ত সে এসে যাবেই, কদ্দিন আর না এসে পারবে!
চল আমার ছোটবেলার গ্রীষ্মবর্ষা দেখে নিই। গ্রীষ্ম দিয়েই শুরু করি,কি বল।
তোমরা যারা শহরে থাক তারা বোধ হয় কোকিলের ডাক শোন নি। কিন্তু গ্রামের ছোটরা চৈত্র-বৈশাখের রাতে এডাক নিশ্চয়ই শুনেছ,কি বল।
কতদিন 'চোখ গেল' বা 'বৌ কথা কও'-- এমন সব ডাক শুনে ঘুম ভেঙে যেত এই সময়!
গ্রীষ্ম নিয়ে কথা, সুতরাং  কালবৈশাখীর কথা ত বলতেই হবে। কবিগুরুর 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটা পড়েছ ত? এ লাইনটা মনে  কর--                'সেই মনে পড়ে জৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিক ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।'
শুধু জৈষ্ঠ্য নয়, চৈত্র- বৈশাখেও ছিল একদম তাই। জৈষ্ঠ্যতে পাকা আম আর চৈত্র-বৈশাখে কাঁচা পাকা মিলিয়ে। সব সময়েই আম কুড়াবার ধুম !         এখন ত ঝড় হতেই চায় না, কিন্তু সে সময় দু'একদিন পর পরই বিকেলের দিকে উত্তর-পশ্চিম আকাশ কালো করে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি ধেয়ে আসত, আর সংগে আসত ভয়ধরানো বজ্র-বিদ্যুত। ভয় পেয়ে দিয়ানির কোলে সেঁধিয়ে যেতাম। বাজ পড়ার সে ভয় আজ বুড়ো হয়েও কাটে নি। দাদুর কথায় বুঝতে পারতাম যে তাঁরও চিন্তা থাকত ঘুর্ণিঝড় নিয়ে, কেন না এটা হলে প্রায়ই শোনা যেত কারও না কারও বাড়ির চালা উড়ে গেছে ঘুর্ণিঝড়ে আর না হয় বজ্রপাতে কারও অপমৃত্যু হয়েছে। সে যে কি ভয়ের কথা, তা বলে বোঝানো যাবে না।   
ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলে মেঘ উড়ে গিয়ে বিকেলের রোদ উঠে পড়ত। আর আমাদের শুরু হয়ে যেত আম কুড়াবার পালা! ধামা ধামা কাঁচা আম
জড়ো হত। কি হত অত আম দিয়ে? দিয়ানি আর মামিমা সব আম কেটে রোদে শুকোতে দিতেন। শুকিয়ে কালো হয়ে কুড়মুড়ে হয়ে যেত আমের টুকরো গুলো,  একে বলা হয় 'আমচুর', তোমরা বোধ হয় আমসি বল, তাই ত ? পরে অবশ্য সেগুলো আর কুড়মুড়ে থাকত না। বর্ষা বা অন্য কোন সময় যখন আম থাকত না তখন আমের স্বাদ পাবার জন্য ঐ আমচুর ব্যবহার হত।
আমাদের পাঠশালার সামনে যে মাঠটা ছিল তাতে এই গরমের সময় খুব জমিয়ে ফুটবল খেলা হত, মানে একটা প্রতিযোগিতা হত । নানা জায়গা থেকে নানা দল খেলতে আসত। হারজিত নিয়ে যেমন হৈ হল্লা হত, তেমনি ঝগড়াঝাঁটিও চলত খুব।
জৈষ্ঠ্যের এই সময় প্রতিদিন বিকেলে জলখাবার কি খেতাম বলত? কাসুন্দি দিয়ে মাখা নানা ধরনের পাকা আম। দিয়ানির আম কেটে মাখা হয়ে গেলে মামারা কেউ হাঁক দিতেন আমার নাম ধরে। রান্নাঘরের পেছনেই ছিল পাঠশালা আর তার পরেই মাঠ। আমি ত কান খাড়া করে ডাকের অপেক্ষাতেই থাকতাম! কোন কোনও দিন কাসুন্দি দিয়ে জাম মাখাও থাকত তার সাথে। কাসুন্দি কাকে বলে জানত ? বাজার থেকে নিশ্চয়ই কিনে আনেন বাবা, তাই না ? কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় ত কাসুন্দি বাজারে কিনতে পাওয়া যেত না কিনা, দিয়ানি বাড়িতেই বানাতেন। যাতে তাড়া তাড়ি সেটা খারাপ হয়ে না যায়,অনেক দিন ধরে খাওয়া যায়, সে জন্য অনেক নিয়ম মেনে শুদ্ধাচারে বানাতে হত। 
আমের কথা বলছিলাম, সেটা বলি। কত রকম স্বাদের আম যে  ছিল ! আর তার কি বিচিত্র সব নাম! শুনবে নাকি কয়েকটা ? ছোট তিল্যা, বড় তিল্যা (যে আমের গায়ে তিলের মত দাগ; তিল থেকে তিল্যা এসেছে), কানাই বাঁশি, পলান্যা(এ নামটা কেন হয়েছিল তা জানি না), গোপাল ভোগ, সিঁদুর‌্যা( পাকলে আমের রঙ সিঁদুরের মত রাঙা হত), চুকারি (এর কথা ত আগে বলেছি),ঝাঁপড়ি (এর আবার ছোট আর বড় দুটো গাছ ছিল)--এমন আরও কত নাম যে ছিল! সব মনে নেই।
আম পাকতে শুরু করলে প্রতিদিন সকালের দিকে ফুলমামা আর সোনামামা হরিশদাকে নিয়ে আম পাড়তে বেরতেন। আমিও যেতাম সংগে। মামারা গাছে উঠতেন হাতে 'কোঁটা' (আঁকশি) নিয়ে আর আমরা নীচে আম কুড়োতাম।
ওঁরা গাছে উঠে  পাড়তে পাড়তেই হাতের নাগালে থাকা আম পেড়ে খেতে শুরু করতেন। প্রতিদিনই বড় এক ঝুরি করে আম হত। রোজ দু'বেলা পেট ভরে খেয়েও অত আম  শেষ করা যেত না, একে ওকে দিয়ে দেওয়া হত, আর না হয় আমসত্ত্ব করতেন দিয়ানি। তোমরা যেরকম আমসত্ত্ব কিনে খাও তেমন মোটা মত নয়, বাড়িতে বানান আমসত্ত্ব পাতলা আর একটু কালচে মত হত, আর স্বাদটাও হত অনেক আলাদা। পাথরের থালা, কুলো বা পরিষ্কার কাপড়ের
ওপর পুরু করে আমের রস ছড়িয়ে রোদে শুকোতে দিতেন দিয়ানি। প্রথম পরত শুকিয়ে গেলে তার ওপরে আর এক পরত ছড়ান হত। এভাবে কয়েকবার করে, একটু পুরু হয়ে একেবারে শুকোনো হয়ে গেলে কাপড়ের মত ভাঁজ করে হাঁড়ির ভেতর রেখে দিতেন দিয়ানি। আমের দিন শেষ হয়ে গেলে আমের স্বাদ পেতে আমসত্ত্বের জুড়ি আর নেই।
কাঁঠালের গাছও ছিল অনেককটা, তাদেরও নানা নাম ছিল। তাদের মধ্যে একটা গাছের কথা বেশ মনে আছে। সেটার নাম ছিল 'মাথাভাঙা'। সেটা যখন ছোট ছিল কোনও কারনে মাথাটা ভেঙে গেছিল, তাতেই ওই নাম। 
গাছটা ছিল লম্বা শিড়িংগে মত। তাতে অসংখ্য ছোট বড় কাঁঠাল ধরত কান্ড বেয়ে--একেবারে গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত। অনেক সময় গোড়ার দিকের কাঁঠাল পাকলে রাতের আঁধারে শেয়ালে খেয়ে যেত।                   সোনামামা খেতে পারতেন খুব। অনেক সময় ওই গাছে চড়ে কাঁঠাল পাড়তে গিয়ে কোন পাকা কাঁঠাল হাতের কাছে পেলে সেখানে বসেই গোটাটা খেয়ে ফেলতেন। দাদু বা দিয়ানি দেখে বকাবকি করলে হো হো হেসে পাড়া কাঁপাতেন।
পাকা আমের যেমন রং ধরে, পাকা কাঁঠালের কিন্তু রং ধরে না।গন্ধে বোঝা যায় পাকল কিনা। তবে আমের মত পেকে মাটিতে পড়লে সেটা ছেতরে যাবে, খাওয়া যাবে না। তাই আধপাকা কাঁঠাল পেড়ে ঘরে রেখে পাকাতে হয়।
গাছে থাকা অবস্থায় হাত দিয়ে চাপড়ালে শব্দ শুনে বোঝা যায় আধপাকা হয়েছে কিনা আর নামানো যাবে কিনা। কাঁঠাল গাছ থেকে পেড়ে দাদুর ঘরের বারান্দায় সার দিয়ে রাখা হত বোঁটা থেকে আঠা ঝরে যাবার জন্য। এমন ভাবে রাখা হত যাতে আঠা মাটিতে পড়ে, বারান্দায় না পড়ে।
এর পর দেওয়া হত 'কচি'। নামটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে ত! কি আর করা যাবে, যেমন নাম তেমনই ত বলতে হবে। আসলে কচি দেওয়ার অর্থ কাঁঠাল পাকাবার ব্যবস্থা করা।
বাঁশের একটা সরু বাখারিকে ফুটখানেক করে কেটে একটা মুখ ছুঁচল করা হত। ওই সরু মুখটা ঠুকে ঠুকে বোঁটার ভেতর দিয়ে কাঁঠালের ভেতরে অনেকটা ঢুকিয়ে দিয়ে একটা গর্ত করা হত। এবার ওই গর্তের মধ্যে ঠেসে ঠেসে ভরা হত নুন। এই অবস্থায় রেখে দিলে দু'এক দিনের মধ্যেই পেকে যেত কাঁঠাল।
আর পাকলেই চারদিক গন্ধে একেবারে ম ম ! ঘন দুধ আর পাকা আম বা কাঁঠাল দিয়ে ভাত, একবার যে খেয়েছে সে ভুলতে পারবে না।
তোমরা আম দিয়ে দুধভাত নিশ্চয়ই খেয়েছ, কিন্তু কাঁঠাল দিয়ে খেয়েছ কি ? না খেয়ে থাকলে মা'কে বলে দেখ না একবার।
কাঁঠাল খাওয়া মুশকিলই বটে! যা বড়, খেয়ে শেষ করা যায় না। তা ছাড়া আঠার ঝামেলাও কি কম ?
কবিগুরুর আর একটি ছড়ার কথা মনে পড়ল, সেটা হল--
              আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি,
              সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে।
              হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ,
              পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।।
বুঝতেই পারছ কেমন স্বাদ খাবারের!  পিঁপড়ে কাঁদবে, এতে আর আশ্চর্য্য কি!
আমি অবশ্য এতগুলো জিনিষ একসাথে দুধে ফেলে খাইনি, তবে আমসত্ত্ব দুধে ফেলে খেয়েছি। আর আম কাঁঠালের কথা ত বলেইছি।

 

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।