খেলাঘরখেলাঘর

কাঠের ঘোড়া 


--চীনা রূপকথা অবলম্বনে



একদিন এক কামার আর এক ছুতোরমিস্ত্রী তর্ক জুড়েছে। দুজনেরই দাবী তার হাতের কাজ সবার সেরা। যে যার নিজের বক্তব্যের স্বপক্ষে নানা যুক্তি দেখায়। কিছুতেই ঝগড়ার নিষ্পত্তি হয়না। শেষে তারা ঠিক করে রাজামশায়ের কাছে যাবে। রাজামশাইকেই এর সমাধান করে দিতে বলবে।

রাজামশাই প্রতাপাদিত্য ওদের দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন - তোমরা কে? এখানে কেন এসেছ?

ছুতোর বলল - মহারাজ, আমি ছুতোরমিস্ত্রী। আমার হাতের কাজ পৃথিবীর অন্য যে কোন ছুতোরমিস্ত্রীর থেকে অনেক বেশি নিখুঁত ও উন্নতমানের। কিন্তু এই কামারটা বলে কিনা তার হাতের কাজ আমার থেকেও ভালো।

কামার বলল - মহারাজ, আমার হাতের কাজ দেখে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যায়। আমি কি করে মেনে নেব যে এই ছুতোরটার হাতের কাজ আমার থেকে ভালো? আমরা চাই আপনি পরীক্ষা করে বলে দিন আমাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ।

রাজামশাই পড়লেন মহা বিপদে। বললেন - আমি তোমাদের হাতের কাজ না দেখে তো কিছু যাচাই করতে পারব না। তোমাদের দশ দিন সময় দিলাম। তার মধ্যে তোমরা কিছু জিনিস তৈরী করে এখানে নিয়ে এসো।

এই শুনে ছুতোর ও কামার যে যার বাড়ী চলে গেল। দশদিন দশরাত ধরে অনেক পরিশ্রম করে যে যার নিজের পছন্দ মতো জিনিষ বানিয়ে রাজামশাই-এর কাছে নিয়ে এলো।

রাজামশাই বললেন - কই কে কি বানিয়েছ দেখাও।

কামার দেখাল সে বানিয়েছে লোহার বিশাল এক মাছ। বলল - এই লোহার মাছটা এক লক্ষ বস্তা শষ্য পেটে নিয়ে নৌকোর মতো জলে ভেসে ভেসে যেতে পারে।

এই শুনে রাজামশাই তো মনে মনে খুব হাসলেন। ভাবলেন –কামার তো হারছেই। এই লোহার ভারী জিনিষটা জলে ফেললে নির্ঘাৎ ডুবে যাবে। তার ওপর যদি এতো শষ্য চাপানো হয় তো আর কথাই নেই। ভেসে থাকা অসম্ভব। কিন্তু কামার যখন এরকম দাবি করেছে তখন তো পরীক্ষা করে দেখতেই হবে।

তিনি লোকজনদের ডেকে বললেন - এই লোহার মাছটার পেটে এক লক্ষ বস্তা শষ্য পুরে এটাকে জলে ভাসিয়ে দাও।

লোকজন রাজার নির্দেশ মতো কাজ করল। আরে কী কান্ড! লোহার মাছটা সত্যিই সেই বিপুল পরিমান শষ্য নিয়ে জলে বেশ সুন্দর ভেসে ভেসে চলল। সব লোকজন যারা দেখছিল তারা সবাই উত্তেজিত হয়ে বলাবলি করতে লাগল যে কামারের হাতের কাজ কী অসাধারন।

রাজাও মুগ্ধ হয়ে গেছেন। বললেন - তোমাকে আমি রাজসভায় একটা ভালো পদে নিযুক্ত করে সম্মানিত করব।

এইবার ছুতোর মিস্ত্রীর পালা। সে নিয়ে এলো একটা কাঠের ঘোড়া।

রাজা সেটা দেখেই বললেন - এটা তো ছোটদের খেলনা ঘোড়া। লোহার মাছের সঙ্গে এটার কোন তুলনাই হয় না।

ছুতোর বলল - না মহারাজ, এই কাঠের ঘোড়া ঐ লোহার মাছের থেকে অনেক গুনে ভালো।

-কী ভাবে সম্ভব তুমি বুঝিয়ে বলো।

-এই ঘোড়াটায় ছাব্বিশটা স্ক্রু আছে। প্রথম স্ক্রু আলগা করে দিলে ঘোড়াটা আকাশে উড়ে যাবে। দ্বিতীয় স্ক্রু আলগা করলে ঘোড়া আসতে আসতে সামনে এগোতে থাকবে। তৃতীয় স্ক্রু আলগা করলে ঘোড়ার গতি বাড়বে। এই ভাবে একটা একটা করে স্ক্রু আলগা করতে থাকলে ঘোড়ার গতি ক্রমশঃ বাড়তে থাকবে। ছাব্বিশটা স্ক্রু-ই আলগা করে দিলে এই ঘোড়া পৃথিবীর যে কোন পাখির থেকে দ্রুত উড়তে পারবে। এই ঘোড়ায় চড়ে নিমেষে আপনি পৃথিবীর যে কোন জায়গায় পৌঁছে যেতে পারবেন।

সেই সময় সেখানে ছোট রাজপুত্র দিগ্বিজয় উপস্থিত ছিল। সে মন দিয়ে সব শুনছিল। তার খুব ইচ্ছে হল একবার ঘোড়াটায় চড়ে আকাশে উড়ে যেতে। সে মহারাজ কে বলল - বাবা, আমাকে একবার এই ঘোড়াতে চড়ার অনুমতি দিন। আমার খুব জানার ইচ্ছে যে আকাশ থেকে পৃথিবীটাকে দেখতে কেমন লাগে।

রাজা সঙ্গে সঙ্গে প্রবল আপত্তি জানালেন। বললেন - এটা আদৌ উড়তে পারে কিনা তাই এখনো প্রমানিত হয় নি। তাছাড়া যদি ধরে নিই যে এটা উড়তে পারে, তাহলেও এটা যে আকাশে উড়তে উড়তে ভেঙ্গে পড়ে যাবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।

ছুতোর বলল - চিন্তা করবেন না মহারাজ। এই ঘোড়া খুব মজবুত আর উন্নতমানের। সেরকম কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না।

কিন্তু মহারাজ তাও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। এপাশে ছোট রাজপুত্র বাবার কাছে বারবার ঘোড়ায় চড়ার আবদার করে চলেছে। মহারাজেরও মনটা খারাপ লাগছে। এর আগে কোনদিন এমন হয়নি যে রাজপুত্র কিছু চেয়েছে আর রাজামশাই তা দেননি। শেষে রাজামশাই বললেন-

ঠিক আছে। আমি তোমায় শুধু একবার চড়তে দিতে পারি। কিন্তু তোমায় কথা দিতে হবে যে তুমি কেবল প্রথম স্ক্রুটা আলগা করবে। অন্য কোন স্ক্রুতে তুমি হাত দেবে না।

রাজপুত্র দিগ্বিজয় রাজি হল। চেপে বসল ঘোড়ার পিঠে। আসতে আসতে করে আলগা করল প্রথম স্ক্রুটা। আর সত্যি সত্যিই ঘোড়াটা পালকের মতো হাওয়ায় ভেসে আকাশে উঠে গেল। রাজপুত্র নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল সে তার বাড়ি, শহর, আশে পাশের নদী, পাহাড় সব দেখতে পাচ্ছে। তার এতো ভালো লাগল যে সে দ্বিতীয় স্ক্রুটাও আলগা করে দিল। তখন তার ঘোড়া আসতে আসতে সামনে উড়ে চলল। সে দেখল নীচের চেনা শহর আসতে আসতে পিছনে সরে যাচ্ছে। পাখির মতো উড়ে যাচ্ছে সে। এতো ভালো লাগছিল চারিদিক দেখতে যে সে একের পর এক স্ক্রু আলগা করে চলল। ঘোড়ার গতিও ক্রমশঃ বাড়তে থাকল। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই সে পরিচিত জায়গা ছেড়ে অনেক অনেক দূরে চলে এলো।