কাঠের ঘোড়া
--চীনা রূপকথা অবলম্বনে
১
একদিন এক কামার আর এক ছুতোরমিস্ত্রী তর্ক জুড়েছে। দুজনেরই দাবী তার হাতের কাজ সবার সেরা। যে যার নিজের বক্তব্যের স্বপক্ষে নানা যুক্তি দেখায়। কিছুতেই ঝগড়ার নিষ্পত্তি হয়না। শেষে তারা ঠিক করে রাজামশায়ের কাছে যাবে। রাজামশাইকেই এর সমাধান করে দিতে বলবে।
রাজামশাই প্রতাপাদিত্য ওদের দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন - তোমরা কে? এখানে কেন এসেছ?
ছুতোর বলল - মহারাজ, আমি ছুতোরমিস্ত্রী। আমার হাতের কাজ পৃথিবীর অন্য যে কোন ছুতোরমিস্ত্রীর থেকে অনেক বেশি নিখুঁত ও উন্নতমানের। কিন্তু এই কামারটা বলে কিনা তার হাতের কাজ আমার থেকেও ভালো।
কামার বলল - মহারাজ, আমার হাতের কাজ দেখে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যায়। আমি কি করে মেনে নেব যে এই ছুতোরটার হাতের কাজ আমার থেকে ভালো? আমরা চাই আপনি পরীক্ষা করে বলে দিন আমাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ।
রাজামশাই পড়লেন মহা বিপদে। বললেন - আমি তোমাদের হাতের কাজ না দেখে তো কিছু যাচাই করতে পারব না। তোমাদের দশ দিন সময় দিলাম। তার মধ্যে তোমরা কিছু জিনিস তৈরী করে এখানে নিয়ে এসো।
এই শুনে ছুতোর ও কামার যে যার বাড়ী চলে গেল। দশদিন দশরাত ধরে অনেক পরিশ্রম করে যে যার নিজের পছন্দ মতো জিনিষ বানিয়ে রাজামশাই-এর কাছে নিয়ে এলো।
রাজামশাই বললেন - কই কে কি বানিয়েছ দেখাও।
কামার দেখাল সে বানিয়েছে লোহার বিশাল এক মাছ। বলল - এই লোহার মাছটা এক লক্ষ বস্তা শষ্য পেটে নিয়ে নৌকোর মতো জলে ভেসে ভেসে যেতে পারে।
এই শুনে রাজামশাই তো মনে মনে খুব হাসলেন। ভাবলেন –কামার তো হারছেই। এই লোহার ভারী জিনিষটা জলে ফেললে নির্ঘাৎ ডুবে যাবে। তার ওপর যদি এতো শষ্য চাপানো হয় তো আর কথাই নেই। ভেসে থাকা অসম্ভব। কিন্তু কামার যখন এরকম দাবি করেছে তখন তো পরীক্ষা করে দেখতেই হবে।
তিনি লোকজনদের ডেকে বললেন - এই লোহার মাছটার পেটে এক লক্ষ বস্তা শষ্য পুরে এটাকে জলে ভাসিয়ে দাও।
লোকজন রাজার নির্দেশ মতো কাজ করল। আরে কী কান্ড! লোহার মাছটা সত্যিই সেই বিপুল পরিমান শষ্য নিয়ে জলে বেশ সুন্দর ভেসে ভেসে চলল। সব লোকজন যারা দেখছিল তারা সবাই উত্তেজিত হয়ে বলাবলি করতে লাগল যে কামারের হাতের কাজ কী অসাধারন।
রাজাও মুগ্ধ হয়ে গেছেন। বললেন - তোমাকে আমি রাজসভায় একটা ভালো পদে নিযুক্ত করে সম্মানিত করব।
এইবার ছুতোর মিস্ত্রীর পালা। সে নিয়ে এলো একটা কাঠের ঘোড়া।
রাজা সেটা দেখেই বললেন - এটা তো ছোটদের খেলনা ঘোড়া। লোহার মাছের সঙ্গে এটার কোন তুলনাই হয় না।
ছুতোর বলল - না মহারাজ, এই কাঠের ঘোড়া ঐ লোহার মাছের থেকে অনেক গুনে ভালো।
-কী ভাবে সম্ভব তুমি বুঝিয়ে বলো।
-এই ঘোড়াটায় ছাব্বিশটা স্ক্রু আছে। প্রথম স্ক্রু আলগা করে দিলে ঘোড়াটা আকাশে উড়ে যাবে। দ্বিতীয় স্ক্রু আলগা করলে ঘোড়া আসতে আসতে সামনে এগোতে থাকবে। তৃতীয় স্ক্রু আলগা করলে ঘোড়ার গতি বাড়বে। এই ভাবে একটা একটা করে স্ক্রু আলগা করতে থাকলে ঘোড়ার গতি ক্রমশঃ বাড়তে থাকবে। ছাব্বিশটা স্ক্রু-ই আলগা করে দিলে এই ঘোড়া পৃথিবীর যে কোন পাখির থেকে দ্রুত উড়তে পারবে। এই ঘোড়ায় চড়ে নিমেষে আপনি পৃথিবীর যে কোন জায়গায় পৌঁছে যেতে পারবেন।
সেই সময় সেখানে ছোট রাজপুত্র দিগ্বিজয় উপস্থিত ছিল। সে মন দিয়ে সব শুনছিল। তার খুব ইচ্ছে হল একবার ঘোড়াটায় চড়ে আকাশে উড়ে যেতে। সে মহারাজ কে বলল - বাবা, আমাকে একবার এই ঘোড়াতে চড়ার অনুমতি দিন। আমার খুব জানার ইচ্ছে যে আকাশ থেকে পৃথিবীটাকে দেখতে কেমন লাগে।
রাজা সঙ্গে সঙ্গে প্রবল আপত্তি জানালেন। বললেন - এটা আদৌ উড়তে পারে কিনা তাই এখনো প্রমানিত হয় নি। তাছাড়া যদি ধরে নিই যে এটা উড়তে পারে, তাহলেও এটা যে আকাশে উড়তে উড়তে ভেঙ্গে পড়ে যাবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
ছুতোর বলল - চিন্তা করবেন না মহারাজ। এই ঘোড়া খুব মজবুত আর উন্নতমানের। সেরকম কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না।
কিন্তু মহারাজ তাও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। এপাশে ছোট রাজপুত্র বাবার কাছে বারবার ঘোড়ায় চড়ার আবদার করে চলেছে। মহারাজেরও মনটা খারাপ লাগছে। এর আগে কোনদিন এমন হয়নি যে রাজপুত্র কিছু চেয়েছে আর রাজামশাই তা দেননি। শেষে রাজামশাই বললেন-
ঠিক আছে। আমি তোমায় শুধু একবার চড়তে দিতে পারি। কিন্তু তোমায় কথা দিতে হবে যে তুমি কেবল প্রথম স্ক্রুটা আলগা করবে। অন্য কোন স্ক্রুতে তুমি হাত দেবে না।
রাজপুত্র দিগ্বিজয় রাজি হল। চেপে বসল ঘোড়ার পিঠে। আসতে আসতে করে আলগা করল প্রথম স্ক্রুটা। আর সত্যি সত্যিই ঘোড়াটা পালকের মতো হাওয়ায় ভেসে আকাশে উঠে গেল। রাজপুত্র নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল সে তার বাড়ি, শহর, আশে পাশের নদী, পাহাড় সব দেখতে পাচ্ছে। তার এতো ভালো লাগল যে সে দ্বিতীয় স্ক্রুটাও আলগা করে দিল। তখন তার ঘোড়া আসতে আসতে সামনে উড়ে চলল। সে দেখল নীচের চেনা শহর আসতে আসতে পিছনে সরে যাচ্ছে। পাখির মতো উড়ে যাচ্ছে সে। এতো ভালো লাগছিল চারিদিক দেখতে যে সে একের পর এক স্ক্রু আলগা করে চলল। ঘোড়ার গতিও ক্রমশঃ বাড়তে থাকল। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই সে পরিচিত জায়গা ছেড়ে অনেক অনেক দূরে চলে এলো।
২
উড়তে উড়তে একসময় রাজপুত্রের খুব খিদে পেলো। সে দেখলো সে এক অচেনা শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সে একে একে সব স্ক্রু এঁটে ঘোড়ার গতি কমিয়ে আসতে আসতে নেমে পড়ল সেই শহরে। কাছেই ছিল এক সরাইখানা। সেইখানে আশ্রয় নিল। খাওয়া দাওয়া সেরে রাত্রে শুয়ে শুয়ে সে ভাবছিল এমনি করে কাঠের ঘোড়ায় চড়ে উড়ে বেড়ানোর মতো মজাই আলাদা। চোখের পলকে যেখানে খুশি যাও। নতুন নতুন শহর দেখো। এত খুশি জীবনে সে কোনদিন হয়নি।
পরদিন সে হেঁটে হেঁটে শহরে ঘুরতে বেরলো। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখল সামনেই একটা বিশাল মাঠ। সেখানে অনেক লোক এসে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছে। রাজপুত্র ভাবলো আকাশে নিশ্চয় দারুন কিছু একটা দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সে ঐ ভীড়ের মধ্যে ঠেলে ঠুলে ঢুকে আকাশের দিকে তাকালো। কই কিচ্ছু তো নেই।
সে পাশের লোককে জিগ্যেস করল - কি দেখছ ভাই?
লোকটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। বলল - আমাদের দেশের রাজার একটি মাত্র কন্যা। রাজকন্যা অলকানন্দার মতো পরমা সুন্দরী এই দুনিয়ায় আর একটিও নেই। রাজা তাকে খুব ভালোবাসেন। রাজকন্যার যাতে কেউ কোনো ক্ষতি করতে না পারে তাই তিনি আকাশের মধ্যে একটা অট্টালিকা তৈরী করে সেখানে রাজকন্যাকে রেখে দিয়েছেন। প্রতিদিন রাজসভার কাজ শেষ হলে রাজা সেই অট্টালিকায় গিয়ে রাজকন্যাকে দেখে আসেন। আজও উনি গেছেন। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে আসবেন। তাই সবাই ওনার ফেরার অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজপুত্রের এই গল্প খুব অবিশ্বাস্য লাগল। বলল
-আকাশে আবার অট্টালিকা বানানো যায় নাকি? কোন মানুষ এমন অট্টালিকা বানিয়েছে বলে তো কোনদিন শুনিনি।
-মানুষ নয়, এক দেবতা রাজাকে বানিয়ে দিয়েছেন ঐ অট্টালিকা। সেই দেবতার দেওয়া রথে চড়েই রাজা সেই অট্টালিকায় যাতায়াত করেন।
এ খবর শুনে রাজপুত্র খুব উৎসাহিত হয়ে পড়ল। সে তখনই সরাইখানায় ফিরে গিয়ে তার কাঠের ঘোড়ায় চড়ে বসল। তারপর একটা একটা করে স্ক্রু আলগা করে আকাশে উড়ে গেল। আকাশে উড়ে উড়ে খুঁজে বেড়াতে লাগল সেই অট্টালিকা। কিছুক্ষনের মধ্যেই সে দেখতে পেল মেঘের মধ্যে এক অসাধারন সুন্দর অট্টালিকা ‘মেঘ-মঞ্জিল’। রাজপুত্র সোজা গেট দিয়ে উড়ে ঢুকে গেল ভেতরে। তারপর সব স্ক্রু এঁটে ঘোড়া থামিয়ে নেমে পড়ল।
রাজা তখন অট্টালিকা থেকে সবে বিদায় নিয়েছেন। রাজকন্যা অলকানন্দা বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ রাজপুত্র দিগ্বিজয়কে দেখে সে খুব অবাক হয়ে গেল। এত সুপুরুষ কোন মানুষকে সে আগে দেখে নি। ভাবল বুঝি কোন দেবতা এসেছেন। রাজপুত্র ভাবলো এমন সুন্দরী রাজকন্যা সত্যিই দুনিয়ার আর কোথাও মিলবে না। প্রথম দেখাতেই তারা দুজনে দুজনকে ভালোবেসে ফেলল। রাজকন্যা কাছে এসে রাজপুত্রকে অভ্যর্থনা জানালো। রাজপুত্র তার পরিচয় দিতে সে তার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। বসতে দিল, খেতে দিল। তারপর সারা রাত অনেক গল্প করল দুজনে।
পরদিন সকালে রাজপুত্র কাঠের ঘোড়ায় চরে তার সরাইখানায় ফিরে গেল। এপাশে সভা শেষ হলে বিকেলের দিকে রাজা এলেন রাজকন্যাকে দেখতে। অন্য সব দিন রাজকন্যা খুব গম্ভীর হয়ে থাকে। কিন্তু আজ তাকে খুব হাসি খুশি দেখাল। গুন গুন করে গান গাইছে। রাজার কেমন সন্দেহ হল। রোজ রাজা এসে রাজকন্যার ওজন মাপেন। রোজই একই থাকে। কিন্তু আজ ওজন এক কেজি বেশি হল। দেবতার তৈরী এই অট্টালিকায় কারো ওজন বাড়ে না। একমাত্র রাজকন্যা অন্য কোন মানুষকে ছুঁয়ে থাকলে তবেই তার ওজন বাড়বে। রাজা নিশ্চিত হলেন যে কেউ এখানে এসেছিল। রাজার অনুমতি ছাড়া এখানে কেউ কি ভাবে আসতে পারে ভেবে পেলেন না। রাজকন্যার সঙ্গে বেশি কথা না বলে তাড়াতড়ি নিজের প্রাসাদে ফিরে গেলেন।
এত তাড়াতাড়ি রাজাকে ফিরে আসতে দেখে সভাসদরা খুব অবাক হল। এপাশে রাজার মুখও খুব গম্ভীর। নিশ্চয় কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে। রাজাকে জিগ্যেস করতে রাজা সব কথা খুলে বললেন।
-আমি ছাড়া কোনো একজন রাজকন্যার প্রাসাদে গিয়েছিল। তাকে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।
একজন সভাসদ বললেন
-আপনি দেশের সেরা যোদ্ধাদের মধ্যে চারজনকে বেছে নিয়ে রাজকন্যার অট্টালিকার চারকোনে দাঁড় করিয়ে রাখুন। তারাই রাজকন্যাকে পাহারা দেবে। কেউ এলে তাকে তৎক্ষনাৎ গ্রেপ্তার করবে।
রাজার মনে ধরল কথাটা। সে চারজন যোদ্ধাকে নিয়ে গেল অট্টালিকায়। তাদেরকে কি কি করতে সব বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে এলো ।
কিন্তু কোন লাভ হল না। যোদ্ধারা আর কতক্ষন একটানা জেগে থাকবে? এক সময় তার চারজনেই ঘুমিয়ে পড়ল। তখন রাজপুত্র রাজকন্যার অট্টালিকায় গেলো। রোজকার মতো তার সঙ্গে দেখা করে, গল্প করে ভোরের বেলা ফিরে এলো সরাইখানায়।
রাজা পরদিন এসে রাজকন্যাকে আগের দিনের থেকেও বেশি হাসি খুশি দেখলেন। ওজন মেপে দেখলেন আগের দিনের থেকে আরো এক কেজি বেশি। বুঝতে পারলেন সেই আগন্তুক আগের রাত্রেও এসেছিল। রাজা রেগে আগুন হয়ে গেলেন। নিজের প্রাসাদে ফিরে গিয়ে তার সভাসদদের সঙ্গে জরুরী আলোচনায় বসলেন।
এক সভাসদ বললেন - রাজকন্যার বিছানায় আর চেয়ারে নতুন এক পোচ রঙ লাগিয়ে দেওয়া হোক। যে এসে বসবে ওখানে, তারই জামাকাপড়ে রং লেগে যাবে। তারপর আমরা সারা রাজ্য তল্লাশি করে দেখব কার পোশাকে ঐ রং লেগে আছে।
রাজার মনে ধরল কথাটা। সেই মত কাজও হল।
সেদিন রাত্রে রাজপুত্র গিয়ে রাজকন্যার সঙ্গে গল্প করে যখন ফিরিছিল তখন দেখল তার গায়ে বিশ্রী রং লেগে রয়েছে। সে রং লাগা জামাকাপড় খুলে ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল নিচে। এ পাশে হয়েছে কি সেই সময় এক বুড়ো লোক নীচে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সে রোজ ভোরবেলা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকদের ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে প্রার্থনায় বসতে বলে। হঠাৎ আকাশ থেকে জামাকাপড় পড়তে দেখে সে খুব অবাক হয়। খুব ভাল জামাকাপড়, শুধু একটু রং লাগা। ভগবানের-র আশীর্বাদ ভেবে সে খুশি মনে সেই জামাকাপড় নিয়ে গিয়ে বাড়িতে রেখে দিল।
৩
সে দিন রাত্রে, রাজার গুপ্তচর বাহিনী চুপি চুপি সব লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালালো। সেই বুড়ো লোকটির বাড়িতে গিয়ে রঙ লাগা জামাটি খুঁজে পেল। সঙ্গে সঙ্গে লোকটিকে গ্রেপ্তার করে রাজার কাছে এনে হাজির করল তারা।
লোকটিকে রাজা জিগ্যেস করলেন - জামায় রং লাগল কি করে?
লোকটি বলল - রাস্তায় এটা পড়ে থাকতে দেখে আমি তুলে এনেছিলাম। তখন থেকেই এতে রং লেগে ছিল।
রাজা সেসব কথা বিশ্বাস করলেন না। তাকে ফাঁসির আদেশ দিলেন।
সারা শহরে এই খবর রটে গেল। সবাই মিলে ভীড় করল ফাঁসি দেওয়ার জায়গায়। সবার কৌতুহল কি করে ঐ লোকটি আকাশের মধ্যে তৈরী অট্টালিকাতে যাতায়াত করতো। কিন্তু তারা যখন দেখলো এক বুড়ো মানুষকে ফাঁসি দেওয়ার জন্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন খুব অবাক হল। ঐ বুড়ো লোকটা আসল দোষী বলে বিশ্বাস করতে পারল না। সবাই ভাবল কোথাও একটা বড় ভুল হচ্ছে।
এ পাশে রাজপুত্র দিগ্বিজয়ের কানেও একথা পৌঁছলো। সে তার কাঠের ঘোড়া কাঁধে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়ার জায়গায় এসে উপস্থিত হল। চেঁচিয়ে বলল
-ওকে ফাঁসি দিও না। ও আসল দোষী নয়। আমিই রোজ আকাশে তৈরী ঐ অট্টালিকায় যাই রাজকন্যার সঙ্গে দেখা করতে। ফাঁসি দিতে চাইলে আমাকে ফাঁসি দাও। বুড়ো মানুষটাকে ছেড়ে দাও।
রাজা দূরে বসে সব দেখছিলেন। তিনি আদেশ করলেন
-বুড়ো লোকটিকে ছেড়ে দাও। আর যে ছেলেটি তার নিজের দোষ স্বীকার করেছে তাকে ফাঁসি দাও।
সুতরাং তারা বুড়ো লোকটিকে ছেড়ে দিল। সে মনের আনন্দে বাড়ি চলে গেল। তখন সব লোকজন ও জল্লাদ রাজপুত্রকে ফাঁসি দেবে বলে ধরে নিয়ে যেতে এলো। কিন্তু রাজপুত্র কাঠের ঘোড়ায় চড়ে স্ক্রু আলগা করে সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখের সামনে দিয়ে ওখান থেকে উড়ে পালিয়ে গেল। রাজা যখন দেখল তার এত লোকজন এত সেপাই একটা ছেলেকে ধরতে পারল না তখন তিনি রাগে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
রাজপুত্র কাঠের ঘোড়ায় চড়ে সোজা এলো মেঘ-মঞ্জিলে, রাজকন্যার কাছে। বলল
-তোমার বাবা জানতে পেরে গেছেন যে আমি রোজ তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসি। তিনি আমাকে ধরতে পারলে ফাঁসি দিয়ে দেবেন। কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। তুমি আমার সঙ্গে আমাদের রাজ্যে চলো। আমার বাবা তোমাকে নিশ্চয় পছন্দ করবেন। আমাদের বিয়েও দিয়ে দেবেন।
রাজকন্যা বলল – তুমি যেখানে যাবে আমিও তোমার সঙ্গে যাব।
তারা দুজনে কাঠের ঘোড়ায় চেপে উড়ে পালিয়ে গেল সেই অট্টালিকা থেকে।
অনেক অনেকক্ষন উড়ে চলল তারা। হঠাৎ রাজকন্যা অলকানন্দা কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় সে চেঁচিয়ে বলল
-আমি দুটো জিনিষ আনতে ভুলে গেছি। ওগুলো আমার কাছে আমার মায়ের একমাত্র স্মৃতি। ইচ্ছে ছিল আমাদের বিয়ের সময় ঐ পাথর দুটো আমি তোমার বাবা মাকে উপহার দেবো। আমি একবার মেঘ-মঞ্জিলে ফিরে গিয়ে ও গুলো নিয়ে আসতে চাই।
রাজপুত্র দিগ্বিজয় বলল – আমরা মেঘ-মঞ্জিল থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। এখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু রাজকন্যা বার বার অনুরোধ করতে থাকল। তখন রাজপুত্র কাঠের ঘোড়ার স্ক্রুগুলো এঁটে নীচে নেমে পড়ল। বলল – আমি এখানেই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। তুমি এই কাঠের ঘোড়ায় চড়ে মেঘ-মঞ্জিলে যাও আর কাজ সেরে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
রাজকন্যাকে ঘোড়ায় ওড়ার সব নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দিল। রাজকন্যা আবার একটা একটা করে স্ক্রু আলগা করে আকাশে উড়ে চলে গেল।
এপাশে রাজা রাজকন্যাকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। মেঘ-মঞ্জিলে কোন আগন্তুক আসছে রোজ রোজ। সে যদি রাজকন্যার কোন ক্ষতি করে তখন কি হবে এই সব ভেবে আজ সকাল সকাল পাড়ি দিয়েছিলেন। এসে দেখলেন ফাঁকা অট্টালিকা। রাজকন্যা নেই। রাজা তো একদম ভেঙ্গে পড়লেন। কি করবেন, কোথায় রাজকন্যাকে খুঁজতে যাবেন। এমন সময় হঠাৎ রাজকন্যা কাঠের ঘোড়ায় চড়ে ফিরে আসে প্রাসাদে। রাজকন্যাকে দেখেই রাজা তার সৈন্যদের নির্দেশ দেয় রাজকন্যাকে বন্দী করার জন্যে। কাঠের ঘোড়াটাকে কি করে ব্যাবহার করা যায় বুঝতে না পেরে রাজা ওটাকে ফেলে রেখে দিলেন একটা ফাঁকা ঘরে।
৪
অনেক দিন আগে এক ভিনদেশের রাজা রাজকন্যা অলকানন্দার অসামান্য সৌন্দর্যের কথা শুনে রাজার কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন যে তিনি তার পুত্র রাজকুমার সোমদেবের সাথে রাজকন্যার বিয়ে দিতে চান। কিন্তু রাজা তখন সে আবেদন প্রত্যাখান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন রাজা ভাবলেন রাজকন্যাকে এই ভাবে রক্ষা করা অসম্ভব। তার থেকে ভীনদেশের সেই রাজকুমারের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই ভাল।
তিনি ভিনদেশের রাজার কাছে দূত পাঠালেন। সঙ্গে লিখে দিলেন এক চিঠি – আমার কন্যার এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। আমি চাই আপনার পুত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হোক। বিয়েটা সুসম্পন্ন হলে আমরা চির আত্মীয়তা বন্ধনে আবদ্ধ হব ও আমাদের দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হবে। আপনি যদি এই প্রস্তাবে রাজি থাকেন তাহলে দয়া করে রাজপুত্রকে নিয়ে আমাদের দেশে আসুন ও বিবাহ সুসম্পন্ন হলে পুত্রবধূ নিয়ে নিজের দেশে ফিরে যান।
৫
এ পাশে রাজপুত্র দিগ্বিজয় রাজকন্যা অলকানন্দার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পরেও রাজকন্যার দেখা না পেয়ে তার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। এখন সে কি করে! রাজকন্যাও নেই। তার অত শখের কাঠের ঘোড়াটাও নেই। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে সে এক মরুভূমির মধ্যে বসে আছে। যে দিকে যতদূর চোখ যায় ধূ ধূ করছে শুধু বালি আর বালিয়াড়ি। মাথার ওপর প্রখর সূর্য। কাঠ ফাটা রোদ আর ভয়ানক গরম। কোথাও সবুজের কোন চিহ্ন মাত্র নেই।
যত সময় যেতে থাকে তত খিদে আর তেষ্টায় সে কাতর হয়ে পড়ে। শেষে এক সময় সে আর থাকতে না পেরে জলের খোঁজে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু কোথাও কোন জলও নজরে পড়ে না। ভাবল বালির পাহাড়গুলোর ওপর উঠলে কিছুটা দূর পর্যন্ত দেখা যাবে। বুঝতে পারা যাবে জল কোন দিকে আছে। কিন্তু বালির পাহাড়ের ওপর উঠতে গিয়ে তার পা এমন বালির মধ্যে ঢুকে যেতে লাগল যে হাঁটাই কষ্টকর। অনেক পরিশ্রম করে সে যখন ওপরে পৌঁছল তখন মনে হল পায়ের তলার বালিটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা। দেখল বালির পাহাড়ের অন্য দিকে এক সুন্দর সবুজ বাগান। সে গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড় থেকে নেমে পড়ল। বাগান ভরা ফলের গাছ দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেল। লাল, সবুজ আরও নানা রঙ-বেরঙ্গের পাকা পাকা ফল দেখে সে লোভ সম্বরন করতে পারল না। খিদেও পেয়েছিল খুব। সে তাড়াতাড়ি কয়েকটা পাকা পীচ ফল পেড়ে এক গাছের ছায়ায় বসে খেয়ে নিল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল গাছের তলাতেই।
যখন তার ঘুম ভাঙ্গল, তখন তার গাল আর চিবুকে কেমন একটা অদ্ভূত অনুভূতি হল। হাত দিয়ে দেখল গোঁফ দাড়িতে ভর্তি হয়ে গেছে মুখ। খুব অবাক হয়ে গেল সে। কি হতে পারে তার এই ভাবতে ভাবতে সে ফলের বাগানে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল। ভাবল বুঝি পীচ খেয়েই তার এরকম দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে। একটু পরে আবার খিদে পেয়ে গেল তার। কিন্তু এবার ভয়ে সে আর পীচ খেল না। দেখল অনেক গুলো ন্যাসপাতি গাছও আছে। একটা গাছের ডাল সাবধানে নীচু করে কয়েকটা বড় দেখে ন্যাসপাতি পেড়ে খেয়ে নিল। তারপর আবার ঘুম পেয়ে যায়। তাই গাছের তলাতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ঘুম থেকে উঠে বসতে গিয়ে মাথাটা খুব ভারি লাগল। মাথায় হাত দিতেই বুঝতে পারল তার দুটো মোটা মোটা শিং গজিয়েছে। তার দাড়িটাও বেড়ে এক হাত লম্বা হয়ে গেছে। কি ভয়ংকর দেখতে লাগছে তাকে এই ভেবে আঁতকে উঠলো সে। রাজকন্যা যদি এখন কাঠের ঘোড়ায় চড়ে ফেরতও আসে তাহলেও ওকে চিনতে পারবে না, ভালো ও বাসবে না আর।
তাহলে এখন কি করা যায় ভেবে দুঃখে তার চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল।
খুব বুড়ো একটা লোক তার কাছে এসে জিগ্যেস করছে - বাছা, তুমি এতো বিমর্ষ কেন?
ও তখন সব খুলে বলল লোকটিকে। লোকটি বলল
-চিন্তা কোরো না। যাও গিয়ে কয়েকটা শুকনো পীচ আর ন্যাসপাতি গাছের তলা থেকে কুড়িয়ে নাও। সে গুলো খেয়ে ফেললেই তোমার গোঁফ দাড়ি আর শিং সব অদৃশ্য হয়ে যাবে। তুমি আবার আগের মতো সুন্দর হয়ে যাবে। তারপর এই জায়গা ছেড়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও। এখানে অনেক দুষ্ট দানব, দৈত্য, ভূত প্রেতরা থাকে। তারা এখন ঘুমিয়ে আছে। জেগে উঠলেই তোমাকে মেরে খেয়ে ফেলবে।
ঘুম ভেঙ্গে যায় রাজপুত্র দিগ্বিজয়ের। চোখ মুছে উঠে বসে সে। ঠান্ড হাওয়া দিচ্ছে। ও তাড়াতাড়ি উঠে স্বপ্নে দেখা বুড়োটার কথা অনু্যায়ী শুকনো পীচ আর ন্যাসপাতি কুড়িয়ে নেয় গাছের তলা থেকে। সেগুলো মুখে পুরে চিবোতে আরম্ভ করে। দেখতে না দেখতে সত্যিই তার দাড়ি গোঁফ আর শিং সব মিলিয়ে গিয়ে ও আবার আগের মতো হয়ে যায়। সে খুশিতে ডগমগ হয়ে যায়।
তারপর কি যেন ভাবে। তারপর উইলো গাছের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে তাই দিয়ে এক ঝুড়ি বানায়। সেউ ঝুড়ি ভরে অর্ধেক পাকা আর অর্ধেক শুকনো পীচ আর ন্যাসপাতি ভরে নেয়। তারপরেই ঐ বাগান ছেড়ে জলদি পালিয়ে যায়।
যে করেই হোক তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। কিন্তু কোন পথে গেলে বাড়ি পৌঁছবে তা বুঝতে পারে না। তাই শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। খাদ্য হিসেবে শুকনো পীচ আর ন্যাসপাতিই এখন তার একমাত্র ভরসা। ঘুম পেলে ঘুমাতে হবে এই মরুভূমিতেই। সে তাও চলতেই থাকে। এই ভাবে সাত দিন সাত রাত্রি হেঁটে চলে সে। মানুষ তো দূরের কথা কোথাও কোন পাখিও নজরে পড়ে না তার। হতাশ হয়ে মাঝে মাঝে মরুভূমিতেই বসে পড়ে। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার নতুন উদ্যমে সে হাঁটতে থাকে।
শেষ একটা বিশাল চওড়া রাস্তা দেখতে পায়। সে ভাবে রাস্তা যখন আছে, তখন কোন না কোন লোক এখান দিয়ে ঠিক যাবে। এই আশায় সে রাস্তার ধারে বসে বিশ্রাম করে। হঠাৎ দেখে একটা লোক গাধার পিঠে চেপে যাচ্ছে। লোকটার সঙ্গে কথা বলে ও জানতে পারে যে ওর নিজের দেশ পূর্ব দিকে আর রাজকন্যা অলকানন্দার দেশ পশ্চিমে। কিন্তু দুটো দেশই অনেক অনেক দূরে। হেঁটে পৌঁছতে অনেক দিন লাগবে। কাঠের ঘোড়াটা থাকলে এক নিমেষে পৌঁছে যেতে পারত। কিন্তু সেটাও নেই সঙ্গে। ভাবতে থাকে কোন দিকে যাবে। রাজকন্যার কথা মনে পড়তে ঠিক করল রাজকন্যার দেশেই আগে যাবে। রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করল সে।
৬
অনেকক্ষন হাঁটার পর হঠাৎ অনেক লোকজনের গলার আওয়াজ পেল। যেন কেউ জোরে জোরে কিছু আদেশ করছে। তারপর একটু অপেক্ষা করতেই দেখতে পেল একটা বিশাল রাজকীয় শোভাযাত্রা চলেছে। ঘোড়ায় চেপে চলেছে অনেক সৈন্য সামন্ত, ঘোড়ায় টানা গাড়িও আছে অনেক। শোভাযাত্রার মাঝে বড় ও খুব সুন্দর একটা সোনার কাজ করা গাড়ি । তার তিনদিকে কাঁচের জানলা, একদিকে কাঁচের দরজা। যে চারটে ঘোড়া টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই গাড়িটা তাদের গায়ে মাথায়ও সোনার কাজ। চারিদিকে সৈন্যরা নিশ্ছিদ্র পাহারা দিয়ে চলেছে।
রাজপুত্র ওদের পথ করে দেওয়ার জন্যে রাস্তা থেকে একটু সরে দাঁড়ায়। হঠাৎ গাড়িটা এসে ওর সামনে থেমে গেল। একটা প্রহরী জিগ্যেস করল
– তুমি কি বিক্রী করছ?
– কিছু না।
লোকটি ওর ঝুড়ির দিকে দেখিয়ে জিগ্যেস করল – তোমার ঝুড়িতে তো পীচ আর ন্যাসপাতি আছে। আমাদের রাজপুত্র খুব ক্ষুধার্থ। আমরা ঐ ফলগুলো কিনতে চাই। কত দামে বিক্রী করবে ?
-কিন্তু এই ফলগুলো বিক্রীর জন্যে নয়। এগুলো আমি রাস্তায় খিদে পেলে খাবো বলে নিয়ে যাচ্ছি। দেখছ না এখানে কোথাও কিছু পাওয়া যায় না। একটুও সবুজের কোন চিহ্নমাত্র নেই। এগুলো বিক্রি করে দিলে আমি কি খেয়ে বেঁচে থাকব?
ভিনদেশী রাজকুমার গাড়ির ভেতর থেকে একটা মোহর এগিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল
-যা দাম চাইছে তাই দিয়ে ফলগুলো কিনে নাও। রাস্তায় বেশি সময় নষ্ট করো না।
সে জিগ্যেস করল – তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
-আমাদের রাজকুমার পশ্চিমে বিয়ে করতে যাচ্ছেন।
প্রহরীকে আরো কিছু প্রশ্ন করে সে বুঝতে পারল এরা রাজকন্যা অলকানন্দার দেশেই যাচ্ছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বাইরে কিছু প্রকাশ করল না। সে ফল বিক্রি করতে রাজি হল। মোহরটা নিয়ে সে বেছে বেছে সব থেকে ভালো দেখে দুটো পীচ আর দুটো ন্যাসপাতি দিল ।
ভিনদেশের রাজকুমার সোমদেব এমন সুন্দর ফল দেখে খুব খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি গোগ্রাসে খেয়ে ফেলল। শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল। গাড়ির দুলুনিতে তার ঘুমিয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন সে নিজের অবস্থা দেখে হাত পা ছুঁড়ে চীৎকার করে কাঁদতে আরম্ভ করল। প্রহরীরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে। গাড়ির ভেতরে মুখ বাড়িয়ে দেখে রাজকুমার নয় যেন এক দৈত্য বসে আছে। মুখে বিশাল সাদা দাড়ি, মাথায় বিশাল দুটো শিং। তারা আতঙ্কিত হয়ে চেঁচামিচি আরম্ভ করল। গোটা শোভাযাত্রাটাই তখন থেমে গেল। সবাই ভাবল ফলওয়ালার ফল খেয়েই এই অবস্থা হয়েছে। ওরা শোভাযাত্রা থামিয়ে ফলওয়ালার জন্যে অপেক্ষা করে থাকল। কিছুক্ষন পরে ফলওয়ালা বেশি রাজপুত্র দিগ্বিজয় আসতেই ওরা তাকে চেপে ধরে
-কি রকম ফল তুমি আমাদের রাজকুমারকে বিক্রি করছ শুনি?
-কেন? গাছ থেকে টাটকা ফল পেড়ে নিয়ে এসেছি আমি।
-তাহলে ফল খাওয়ার পরই আমাদের রাজকুমারের এমন এক হাত দাড়ি আর দুটো শিং গজালো কেন?
সে গাড়ির জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল ভিনদেশী রাজকুমারের কিম্ভুত কিমাকার রূপ। মনে মনে খুব খুশি হল। মুখে বলল - তা আমি কি জানি! আমি তো এই ফল রোজই খাই। কই আমার তো কিছু হয় নি।
এর উত্তরে তারা কিছুই বলার মতো খুঁজে পেল না। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা আরম্ভ করল। এই রকম চেহারা নিয়ে তো কোন রাজকন্যাকে বিয়ে করতে যাওয়া যায় না। গেলেও রাজকন্যার বাড়ির লোকেরা তাড়িয়ে দেবে ওদের। তার থেকে দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো। কিন্তু রাজকুমার কিছুতেই দেশে ফিরে যেতে রাজি হল না।
শেষে ভিনদেশের রাজার সব থেকে প্রিয় অমাত্য এসে বল
-আমরা আপাততঃ একটা কাজ করতে পারি। একটা সুন্দর দেখতে ছেলেকে খুঁজে নিয়ে তাকেই রাজকুমার বলে কাজ চালিয়ে দিই। বিয়ের পর রাজকন্যা নিয়ে আমরা দেশে চলে যাব। তখন তো সবটা আমাদেরই হাতে থাকবে। রাজকন্যাকে নিয়ে কি করা হবে তা তখন ভিনদেশের রাজাই স্থির করবেন।
সবার এই পরিকল্পনাটি পছন্দ হল। তারা একটা সুন্দর দেখতে ছেলের খোঁজ করতে লাগল। শেষে ফলওয়ালাকে দেখে সবাই একমত হল যে ওখানে যতজন আছে তার মধ্যে সেই সব থেকে সুপুরুষ। সবাই তাকে অনুরোধ করল রাজপুত্র সেজে তাদের কথা মত কাজটা সুসম্পন্ন করে দিতে।
রাজপুত্র দিগ্বিজয় তো মনে মনে খুব খুশি হল। কিন্তু এমন ভাব করল যে সে এরকম কাজ করতে একেবারেই রাজি নয়। বলল সে তার কাজে বেরিয়েছি। তার এখন এসবের জন্যে একেবারেই সময় নেই। তারা অন্য লোক খুঁজে নিক।
রাজপারিষদরা, অমাত্যরা, প্রহরীরা সবাই মিলে ওকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করতে লাগল। বলল
– তোমায় পাঁচটা মোহর দেবো।
রাজপুত্র বলল – মাত্র পাঁচটা মোহরের জন্যে এরকম ছল-চাতুরীর কাজ আমি করতে পারব না
-তাহলে সাতটা দেবো।
তখন রাজপুত্র রাজি হল। তাকে ওরা ভিনদেশী রাজকুমারের মতো রাজার পোশাক সাজিয়ে দিল। বলল – রাজকুমারের মতো সোজা হয়ে গাড়ির মধ্যে বসে থাকতে। আর রাজকুমার সোমদেবকে গাড়ি থেকে বার করে ঘোড়ায় চাপিয়ে দেওয়া হল। তার মাথার শিং আর দাড়ি সব ঢেকে দিল কাপড় দিয়ে। তাকে সব সময় মুখ ঢেকে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হল। আরো বলা হল যে রাজধানীতে পৌঁছলে সে যেন সব সময় ঘরের ভেতরেই থাকে। বাইরে বেরনোর কোন দরকার নেই। বাকি যা ব্যবস্থা করার তা তারাই করবে।
৭
সব কিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর শোভাযাত্রা আবার চলতে শুরু করল। যখন তারা রাজধানীতে পৌঁছালো তখন দেখল শহরের মূল ফটকের বাইরে রাজা নিজে তাদের স্বাগতম জানানোর জন্যে অপেক্ষা করছেন। এমন সুন্দর জামাই দেখে আর এতো রকম বিয়ের উপঢৌকন দেখে রাজা তো আনন্দে আত্মহারা। গত কয়েকদিন ধরে রাজকন্যাকে নিয়ে রাজার দুঃশ্চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না। রাজকন্যার পূর্ব কাহিনী জেনে ফেললে যদি রাজপুত্র বিয়ে করতে বেঁকে বসে তাহলে খুব মুশকিল হবে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হলে উনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন।
রাজার নির্দেশে তড়িঘড়ি চারদিন জুড়ে বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। রাজা সব কমবয়সীদের বললেন বাড়ির ভেতরেই থাকতে। আর বড়দের বলা হল বাড়ির বাইরে এসে অতিথি অভ্যাগতদের আদর-আপ্যায়ন করতে। প্রধান উদ্দেশ্য হল অতিথিদের আমোদ আহ্লাদে ব্যস্ত রাখা যাতে তারা রাজকন্যা সম্বন্ধে বেশি কিছু কৌতুহল দেখানোর অবকাশ না পায়।
প্রথম তিন দিন তো রাজকন্যা শুধু কেঁদেই গেল। মুখ থেকে কাপড় সরালো না। রাজপুত্রর দিকে তাকিয়েও দেখল না। চতুর্থ দিনে রাজা একটা বয়স্কা মহিলাকে পাঠালেন ওদের ওপর নজর রাখার জন্যে। তার ওপরে নির্দেশ ছিল রাজাকে খবর দিতে হবে রাজপুত্র রাজকন্যার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে কিনা।
সেই সন্ধ্যে বেলা রাজপ্রাসাদের বিশাল হলে রাজপুত্র রাজকন্যার পাশে বসেছিল। যখন কেউ তাকাচ্ছিল না তাদের দিকে তখন রাজপুত্র রাজকন্যার কানে ফিস ফিস করে বলল
-দেখো। আমিই ফিরে এসেছি। তোমাকে বিয়ে করার জন্যে।
রাজকন্যা পরিচিত গলা শুনে অবাক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল। দেখেই খুব অবাক হয়ে গেল।
-তুমি কোথা থেকে এলে?
তখন রাজপুত্র গোটা গল্পটা সংক্ষেপে ওকে বলল। বলল এমন ভাব করে থাকতে যেন ও কিছুই জানে না। যখন ওরা একসঙ্গে নাচছিল তখন ওরা কি ভাবে এখান থেকে পালাবে তার পরিকল্পনা করল। রাজপুত্র বলল
-বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর যখন তোমার চলে যাওয়ার সময় হবে তখন তুমি বাবাকে কাঠের ঘোড়াটা চাইবে। বাবা না দিতে চাইলেও বায়না করে যাবে। বলবে ঐ কাঠের ঘোড়া না দিলে তুমি কিছুতেই এখান থেকে যাবে না। তোমার বাবা তোমাকে যতই ভয় দেখাক তাও তুমি তোমার দাবীতে অনড় থাকবে।
এপাশে ওদের কে এক সঙ্গে এমন খুশি মনে নাচতে দেখে রাজার গুপ্তচর গিয়ে রাজাকে খবর দিল যে, রাজকন্যা আর রাজপুত্র একেবারে মানিকজোড়। দুজনে দুজনকে খুব পছন্দ করেছে। একসঙ্গে নাচছে, গান গাইছে। খুব সুখী হবে ওরা দুজনে। এই শুনে রাজা খুব আনন্দিত হলেন।
৮
বিয়ে ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে। পরদিন রাজকন্যা ভিনদেশে শ্বশুরবাড়ি যাবে। রাজকন্যাকে বিদায় জানানোর জন্যে সব লোকজন জড়ো হয়েছে। প্রাসাদের বাইরে ভিনদেশের লোকজন শোভাযাত্রা সাজিয়ে প্রস্তুত। এমনসময় রাজকন্যা অলকানন্দা বায়না জুড়ল। কাঠের ঘোড়াটা তার চাই-ই চাই। না হলে সে এক পাও নড়বে না। রাজা রাজকন্যার এই অদ্ভূত বায়না কিছুতেই প্রশ্রয় দিতে রাজি নন। তিনি তীব্রভাবে তার আপত্তি জানালেন। রাজকন্যা তাও শুনল না, বায়না করেই চলেছে। রাজা শেষে ভয়ানক রেগে গিয়ে রাজকন্যাকে ফাঁসিতে চড়ানোর আদেশ দিলেন। কিন্তু রাজকন্যার তাতেও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। জানিয়ে দিল কাঠের ঘোড়া না পেলে সে ফাঁসিতেই মৃত্যু বরন করবে।
রাজা পড়লেন মহা ফাঁপরে। কি করা উচিত কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না। এপাশে রাজকন্যার বিদায় শোভাযাত্রা দেখবে বলে বাইরে অসংখ্য লোক প্রতীক্ষা করে রয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু গন্যমান্য ব্যক্তি রাজপ্রাসাদের ভেতরে এসে জিগ্যেস করলেন – কিসের জন্যে যাত্রায় এত বিলম্ব হচ্ছে?
রাজা বললেন – রাজকন্যা অলকানন্দা তার পুরানো এক কাঠের ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় বলে আবদার জুড়েছে।
তারা এই শুনে খুব হেসে উঠে বললেন – একটা খেলনার জন্যে এত বায়না করছে তো সেটা দিয়ে দিলেই হয়।
রাজা খুব লজ্জ্বায় পড়ে কাঠের ঘোড়াটাকে বার করে দিতে বাধ্য হলেন। কাঠের ঘোড়া পেয়ে রাজকন্যা খুব খুশি। রাজকন্যা ও রাজপুত্র নিয়ে শোভাযাত্রা ফিরে চলল ভিনদেশের উদ্দেশে।
বেশ কয়েকদিন ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে তারা চলতে থাকল। চলতেই থাকল। প্রহরীরা সারাক্ষন নিশ্ছিদ্র পাহারা দিয়ে ঘিরে রাখত রাজকন্যা অলকনন্দা, রাজপুত্র দিগ্বিজয়কে । ফলে ওরা একটা মিনিটও ফাঁকা পেত না যে কাঠের ঘোড়ার পিঠে চড়ে উড়ে পালিয়ে যাবে। রাজপুত্র আগে থেকেই রাজকন্যাকে শিখিয়ে রাখল
-যখন আমরা ভিনরাজ্যের প্রাসাদে পৌঁছে যাব, তখন তুমি বলবে একমাত্র একটা শর্তেই তুমি গাড়ি থেকে নামবে। সাতটা বড় প্লেটে মোহর ভর্তি করে এনে তোমায় দিতে হবে। মোহর নিয়ে এলে তুমি প্লেট উলটে সব মোহর ফেলে দেবে রাস্তায়।
তারা যখন ভিনরাজ্যে এসে পৌঁছলো, তখন রাজকন্যা সেই পরিকল্পনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। লোকেরা রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে মোহর কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অমনি রাজপুত্র রাজকন্যাকে নিয়ে চেপে বসল কাঠের ঘোড়ায়। আর খুব তাড়াতাড়ি একের পর এক স্ক্রু আলগা করে চোখের নিমেষে উড়ে চলে গেল। সব লোকজন, অতিথি অভ্যাগত, রাজ্যবাসী শুধু তাকিয়ে দেখতেই থাকল। কেউ কিছুই করতে পারলেন না।
৯
রাজপুত্র দিগ্বিজয় রাজকন্যা অলকানন্দাকে নিয়ে নিরাপদে ফিরে এলো নিজের দেশে।
এপাশে রাজপুত্র কাঠের ঘোড়ায় চড়ে অদৃশ্য হওয়ার পর থেকেই রাজা প্রতাপাদিত্য খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। সারা দিন-রাত রাজপুত্রের কথা ভেবে ভেবে অস্থির হচ্ছিলেন। তার সব রাগ গয়ে পড়েছিল ছুতোর মিস্ত্রীটার ওপর। সে কাঠের ঘোড়াটা না বানালে তো এমন কান্ড হতো না। তাই তিনি ছুতোর মিস্ত্রীকে শাস্তি হিসেবে একটা কাঠের সেতুতে আমৃত্যু বেঁধে রাখার আদেশ দিয়েছিলেন।
রাজপুত্রকে সুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরে আসতে দেখে রাজার তো আনন্দ আর ধরে না। রাজপুত্র এসেই ছুতোরের তৈরী কাঠের ঘোড়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বলল
-এই কাঠের ঘোড়াটা এত কাজের যে এই কদিনেই আমি পৃথিবীর অনেকগুলো নতুন দেশ দেখে এসেছি। এমনকি এমন সুন্দর এক রাজকন্যাকে খুঁজে বিয়েও করে এনেছি। তারপর দেশে নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছি। তুমি ছুতোর মিস্ত্রিকে খুব ভাল পুরস্কার দিও।
তখন রাজা তার কৃতকর্মের জন্যে খুব লজ্জিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে লোক পাঠালেন ছুতোর মিস্ত্রীকে আনার জন্যে। রাজার লোকেরা সেতুর কাছে গিয়ে দেখল ছুতোর মিস্ত্রী তখনও বেঁচে আছে। তাকে সব বাঁধন মুক্ত করে নিয়ে এলো রাজপ্রাসাদে। রাজা তাকে অনেক অর্থ ও মনিমুক্ত দিয়ে পুরস্কৃত করলেন এবং রাজসভায় ভালো পদে নিযুক্ত করে সম্মানিত করলেন।
তারপর রাজ্যে বিশাল জাঁকজমক করে রাজপুত্র আর রাজকন্যার আরও একবার বিয়ে দেওয়া হল।
রুচিরা
বেইজিং, চীন
- বিস্তারিত
- লিখেছেন রুচিরা
- ক্যাটfগরি: বড় গল্প