খেলাঘরখেলাঘর

ভূতুড়ে উপাখ্যান


ভুতো আর নমি দুই ভাইবোন। ভুতো বড় নমির থেকে, দু মিনিটের। নমি তাই অন্ধের মতো ভুতোর সব কথা বিশ্বাস করে। ভুতো খেলাধুলোর যা যা উপায় বাতলায় নমি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। শুধু সন্ধেবেলা নমিকে দোতলায় যেতে বললে কিছুতেই নমি যেতে পারেনা।

একটা সময় ছিল যখন নমিকে হাত ধরে ভুতো পাড় করে দিত ল্যাণ্ডিংটা। পুরোটাই নমি চোখ বন্ধ করে পার হতো। আর দেখতে পেত গাঢ় অন্ধকারে সাদা সাদা গোল গোল বলের মতো চোখ সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো মুখ নেই চোখের চারপাশে; কিন্তু শনের নুটির মতো সাদা চুল আছে, চোখের পিছনে একটু দূরে।

পরের দিকে আলো জ্বালা থাকলে ল্যাণ্ডিং-এ, নমি পার হতো জায়গাটা একছুটে। তবে সিঁড়ির নিচে আম্মা আর দোতলায় সিঁড়ির মুখে দাদাই দাঁড়িয়ে থাকলে তবেই নমি সাহস করে পার হতো ল্যাণ্ডিংটা। তারপর একদিন লক্ষী পিসি মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে ছিল, “ভুত আমার পুত/ পেত্নি আমার ঝি/ রামলক্ষণ বুকে আছে/ ভয়টা আমার কী?” তারপর থেকে মন্ত্র জপে পার হতো নমি জায়গাটা। কিন্তু তা স্বত্বেও নমি বেশ দেখতে পেত সাদা আঙুলগুলো কাতুকুতুর ভঙ্গিমায় এগিয়ে আসছে ওর দিকে। কিন্তু বোধহয় ও মন্ত্র জপে বলেই ভুতের আঙুল ওর গায়ে আঁচড়টি লাগাতে পারে না। কিন্তু একদিন চোখ বন্ধ করে মন্ত্র জপতে জপতে জায়গাটা পেরোনোর সময় ও শুনেছিল অট্টহাসির শব্দ। তার সঙ্গে দেখতেও পেয়েছিল হাওয়ায় ভাসতে থাকা দাঁতের পাটিজোড়া। বেচারা সেই থেকে সন্ধেবেলা আর দোতলায় যেতেই পারে না।

এদিকে একতলায় মা-বাবা, আম্মার চোখের সামনে যা খুশি তাই পরীক্ষা করা যায় না। কিন্তু পরীক্ষা করুক আর নতুন খেলা খেলুক, ভুতোর একটা শাগরেদ কিংবা খেলার সাথী লাগে। নমি দোতলায় না যাওয়ায় ভুতোর সন্ধেটাই মাঠে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

তবে আজকাল আর ওদের অত অসুবিধে হচ্ছে না। টিভিতে গত তিনমাস ধরে ভুত-ভুতুম অনুষ্ঠান চলছে। রোজ রাত নটায়। এরমধ্যে পৃথিবীর নানাদেশের ভুতুড়ে-অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনা নিয়ে ওরা অনেকগুলো ছোট ছোট নাটক দেখে ফেলেছে। তারপর এলেন বটকৃষ্ট মাইতি নামে একজন বিশিষ্ট ভুতবাদী। সেই অনুষ্ঠানেই তাঁর বিপক্ষে তথ্য-যুক্তি দিয়ে ভুত নেই প্রমাণ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন ভুতবিরোধী আন্দোলনের নেতা যুধাজিৎ দত্ত। এইসব যুক্তি তর্ক শুনে ভুতো নমির সাথে খুব ঝগড়া করল এই নিয়ে যে ভুত বলে আসলে কিছু হয় না। নমি কিন্তু জবাবে কেবলই বলেছে যে ও ভুত দেখেছে তাই বিশ্বাস করে যে ভুত আছে। ভুতোও ছাড়বে না। সে সমানে বলে চলেছে ভুতকে দেখাই যায় না।

দুজনের চেঁচামিচিতে অস্থির হয়ে মা বললেন যে কোন ভুত বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বললেই হবে। তারপর বেশ কয়েকদিন ভুত বিশেষজ্ঞ কে কোথায় থাকেন তার খবর যোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল দুজনে। শেষ অবধি মা-ই উপায় করে দিলেন। ভুত-ভুতুমের ফোন-ইনে প্রশ্ন করে জেনে নিতে যে ভাইবোনের মধ্যে কে ঠিক বলছে।
ফোন-ইন অনুষ্ঠানে এলেন ভুতবাদী ঘন্টেশ্বর ঘড়ুই। আবার তাঁর মোকাবিলা করতে ভুতবিরোধী মন্টু মাকড়। সন্ধে থেকে বেদম চেষ্টার পর যা হোক লাইন পাওয়া গেল। ভুতো হাঁসফাঁস করে জিজ্ঞেস করে বসল, “আচ্ছা কাকু সত্যি কি ভুত আছে?” মন্টু মাকড় আগে উত্তর দিলেন, “না নেই”। শুনেই নমি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “কিন্তু আমি যে দেখেছি!” তখন ঘন্টেশ্বর ঘড়ুই বললেন “কোথায় দেখেছ তুমি ভুত?” উত্তরটা কেড়ে নিয়ে ভুতো তড়বড় করে বলল, “ ও নাকি সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং-এ ভুত দেখে রোজ, কিন্তু ঐ জায়গাটা ও চোখ বন্ধ করে পেরোয় যে, তাহলে ও কী করে ভুত দেখেবে?” এটা শুনে নমির ঠোঁট আরও ফুলে উঠল। কিন্তু ঘড়ুই আর মাকড় দুজনেই খানিক ভেবে নিয়ে বললেন যে ভুতো নমিকে নিয়ে যেন দুপুর বেলা সেই সব জায়গায় যায় যেসব জায়গায় সাধারণতঃ ভুতের বাসা হয়। কারণ কথায় বলে “ঠিক দুক্কুর বেলা/ ভুতে মারে ঢ্যালা”। তাহলে ভুতের বাসায় দুপুরবেলা উঁকি মারতে গেলে ভুত নিশ্চয়ই খুশি হবে না এবং ঢ্যালা মেরে তাড়াবে ভাইবোনকে। সুতরাং ঢ্যালা খেলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে যে ভুত আছে।

কথামতো দুপুরে বনে যাওয়ার জন্য দুভাইবোনই অপেক্ষায় রইল গরমের ছুটির। যেই ছুটি পড়ল অমনি দুজনে গেল পিসিমণির গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে। সেখানে হারাবার ভয় নেই, গাড়ি চাপা পড়ার ভয় কম, ছেলে ধরার ভয় নেই, সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং নেই, তাই ভুতের ভয়ও নেই। তাই সারাদিন যা খুশি করার মানাও নেই।

সেখানে পর পর কয়েকটা দুপুর দুজনে তালতলা, বেলতলা, শ্যাওড়াওতলা, ফলসা বনে এন্তার ঘুরে বেড়াল। খুব হট্টগোল করল। কিন্তু ভুতে কেন কেউই ওদের ঢ্যালা মারল না। ভুতো খুশি হলো। নমিও খুশি হলো। ভুতো খুশি হলো ভুত নেই প্রমাণ হয়ে গেল বলে; নমি খুশি হলো ভয়ানক ভুতের সাথে দেখা হলো না বলে; দেখা হলে তো পিসিমণির বাড়িতে ছুটির আনন্দটাই মাটি হয়ে যেত। কিন্তু ভুতোকে ভুত দেখাতে না পারার একটা মন কেমন ঘিরে রইল নমিকে বাড়ি ফেরা অবধি।

বাড়ি ফিরল ওরা একদিন সন্ধের মুখে মুখে। তখন সবে সিড়িঁর ল্যাণ্ডিং-এ থোপা থোপা ছাই রঙে অন্ধকার জমা হচ্ছে একটু একটু করে। দৌড়ে নমি পৌঁছে গেল সেখানটায়। চোখ বন্ধ করে দেখতে পেল হাওয়ায় ভাসছে গোল বলের মতো চোখেরা, শন নুটির মতো চুলেরা, মাড়িসুদ্ধ দাঁতের পাটিরা আর কিলবিলিয়ে আসছে আঙুলরা। ভয়ে, খুশিতে, চীৎকার করে উঠল নমি, “এই তো আছে সব এখানেই!”

 

 ছাতিম ঢ্যাং