খেলাঘরখেলাঘর

জাপানী রূপকথা

জাপানী রূপকথা

সে অনেক কাল আগের কথা। ছিল এক কাঠুরে আর তার বউ। তাদের অনেক বয়স হয়েছিল। একদিন কাঠুরে-বউ একগাদা জামাকাপড় নিয়ে যাচ্ছিল নদীর দিকে। নদীর জলে যত ময়লা ধুয়ে সাফ করবে বলে।
নদীর জলে চোখ পড়তেই দেখল মস্ত বড় একটা পীচফল জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বুড়ির মনটা আনন্দে নেচে উঠল। মনে মনে বলল আজ রাতে তবে মিষ্টি এই ফল খেয়েই পেট ভরবে।- এই ভেবে সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর সেটা নিয়ে রাখল ডাঙায়।
জামাকাপড় ধুয়ে পীচফলটাকে কাঁধে চাপিয়ে সে এল বাড়িতে।
বুড়ো তো বুড়িকে দেখে অবাক! বলল, এটা আবার কোথা থেকে আনলে?
বুড়ি বুড়োকে বলল, এটা নদীতে ভেসে যাচ্ছিল, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে নিয়ে এসেছি।
বুড়ো বলল, বাঃ আজ রাতে তবে ফল খেয়েই থাকতে পারব।
সন্ধে হল। রাত হল। এবারে খাওয়া দাওয়ার পালা। খাওয়া বলতে আজ সারাদিনে আর কিছুই তো ভাগ্যে জোটেনি, এই ফলটুকু ছাড়া।
একটা ধারালো ছুরি দিয়ে ফলটাকে কাটা হল। ফলটাকে কাটতেই দুজনে অবাক! এ যে বিশ্বাসই করা যায়না। একটা ছোট্ট ছেলে, খুবই ছোট্ট, ফলের মধ্যে কেমন ঘুমিয়ে আছে!
বুড়োর মুখে কথা নেই।বুড়ির মুখে কথা নেই।কিছুক্ষণ পর বুড়ো বলল, ছেলেটাকে ভাবছি ডাকব মোমোতারো বলে।
বুড়ি বলল, বেশ ভালো নাম রেখেছ। আমরা ওকে কোলেপিঠে মানুষ করব। দেখবে ছেলেটা আস্তে আস্তে ঠিক বড়ো হবে।
দিন যায়। মাস যায়। মোমোতারো বড়ো হয়। দেখতে দেখতে মোমোতারো আরও বড়ো হয়ে উঠল।
একদিন গম্ভীর গলায় সে তার বাবা-মাকে বলল, আমি এখন ওগ্‌রু দ্বীপে যাব। আমার জন্য কিছু গরম গরম পিঠে বানিয়ে দেবে কি?
মা বাবা তো ভেবেই অস্থির। বলল, সেখানে গিয়ে তুই কি করবি?
মোমোতারো বলল, শুনেছি সেখানে এক রাজা আছে। একবার রাজার কাছে যেতে দাও।আমি জানি সেখানে গেলেই আমাদের ভাগ্য খুলবে।
মা বাবা আর কি বলেন! শুধু যাবার সময় পই পই করে বললেন, ঠিকমতো রাস্তা দেখে চলবি। রাস্তায় যাকে পাবি মিষ্টি করে কথা বলবি। সে যদি খেতে চায় খেতে দিবি। ভাল ব্যবহার করবি। কাউকে দুঃখ দিবি না। কারো সঙ্গে বেইমানি করবি না। কখনও মিথ্যে বলবি না।
মোমোতারো মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে সব কথা শুনল, তারপর কাঁধে পিঠের ব্যাগ ঝুলিয়ে রাস্তার দিকে পা বাড়াল।
কিছুদূর যেতেই দেখা এক বানরের সঙ্গে। 'কিয়া' 'কিয়া' শব্দ করে বানরটা কাছে এসে বলল, মোমোতারো ভাই আমার, কোথায় যাচ্ছ তুমি?
মোমোতারো যেতে যেতে বলল, আমি ওগরু দ্বীপে যাচ্ছি। শুনেছি সেখানে এক রাজা আছে। একবার রাজার কাছে যেতে দাও। আমি জানি সেখানে গেলেই আমাদের ভাগ্য খুলবে। জান তো, এতদূর যাব বলে আমার মা আমার জন্য গরম গরম পিঠে বানিয়ে দিয়েছে।
বানরটা বলল, যদি তুমি আমাকে একটা পিঠে খেতে দাও, আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি।
মোমোতারো আর কি করে!সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা পিঠে খেতে দিল। পিঠে খেয়ে বানর এবার মোমোতারোর সঙ্গে হেঁটে চলল।
অনেক দূর চলে এসেছে অমনি দেখা এক ময়ূরের সঙ্গে।'কেন' 'কেন' শব্দ করে ময়ূর কাছে এসে বলল, মোমোতারো ভাই আমার, এই অবেলায় যাচ্ছ কোথায়?
মোমোতারো যেতে যেতে বলল, আমি যাচ্ছি ওগরু দ্বীপে।শুনেছি সেখানে এক রাজা আছে। আমি জানি সেখানে গেলেই আমার ভাগ্য খুলবে। জানো তো, আমার মা আমার জন্য গরম গরম পিঠে বানিয়ে দিয়েছে।
ময়ূর বলল, যদি তুমি আমাকে একটা পিঠে খেতে দাও, আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি।
মোমোতারো বলল, এটা আর বলতে! এই নাও পিঠে, এক্ষুনি চলে এসো।
পিঠে খেয়ে ময়ূর এবারে মোমোতারোর সংগে হেঁটে চলল।
এবারে কিছুদূর যেতেই 'ঘেউ' 'ঘেউ' শব্দ করে একটা কুকুর দৌড়ে এল। বলল, মোমোতারো কোথায় যাচ্ছ শুনি?
মোমোতারো যেতে যেতে বলল, আমি যাচ্ছি ওগরু দ্বীপে।জানো তো, আমার মা আমার জন্য গরম গরম পিঠে বানিয়ে দিয়েছে।
কুকুর বলল, যদি তুমি আমাকে একটা পিঠে দাও, তোমার সঙ্গে আমিও যেতে পারি।
মোমোতারো বলল, বেশ তো, এই নাও পিঠে, খেতে খেতে চলো।
অনেক হাঁটাহাঁটির পর মোমোতারো এল ওগ্‌রু দ্বীপে। ওর সঙ্গে সঙ্গে এল বানর, ময়ূর আর সেই কুকুর। হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছোল রাজার বাড়ি।
ওগ্‌রু দ্বীপের রাজা মোমোতারো কে দেখে বলল, তোমার নাম কি বাছা? এখানে কেন এসেছ?
মোমোতারো বলল, আমার নাম মোমোতারো। আমি এসেছি ওগ্‌রু দ্বীপের রাজার কাছে। মানে আপনার কাছে। লড়াই করব বলে।
রাজা মোমোতারোর সঙ্গী বানর, কুকুর আর ময়ূরকে দেখে অবাক হলেন। বললেন, আমি বুড়ো হয়েছি। লড়াই করে আর কাজ নেই বাছা। আমার ছেলেপুলে নেই। তুমি খুব বুদ্ধিমান আর শক্তিধর। তুমি এখানেই থেকে যাও। আমার পরে তুমিই এদেশের রাজা হবে।
মোমোতারো বলল, তা হয় না রাজামশাই। আমার দুঃখী মা-বাবা আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে। সিংহাসনের চেয়ে আমার কাছে অনেক বড়ো আমার মায়ের কোল।
রাজা খুব খুশি হয়ে বললের, তোমাকে কিছু সোনাদানা উপহার দিচ্ছি। এই নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। সবাই খুশি হবে।
তখনই মোমোতারোর কাছে এসে পৌঁছোল এক বস্তা ভর্তি সোনারূপো হিরে আর জহরত। আর এল একখানা কোট, সঙ্গে নীলটুপি।
রাজা বললেন, শোনো, এই অদ্ভূত কোটটুপি পরলে তোমাকে কেঊ দেখতেও পাবে না। বিপদে আপদে শুধু এই কোটটুপি ব্যবহার করবে। কারোর ক্ষতি করবে না।
মোমোতারো এত সব পেয়ে ভীষণ খুশি।
বস্তাভর্তি সোনারূপো কাঁধে ঝুলিয়ে, একহাতে কোটটুপি নিয়ে, সে ছুট দিল বাড়ির দিকে।
বানর, ময়ূর আর সেই কুকুরটাকেও সঙ্গে নিতে ভুলল না সে।


সুনির্মল চক্রবর্তী
জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত শিশু সাহিত্যিক সুনির্মল চক্রবর্তী ইচ্ছামতীকে উপহার দিয়েছেন এই জাপানি রূপকথাটি। এই গল্পটি পূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত হয়েছে।