খেলাঘরখেলাঘর

আমার ছোট্টবেলা -৭

লিখতে বসেছি ত গ্রীষ্মসংখ্যার জন্য, অথচ শীত বসন্তের সব কথা ত' বলাই হয়নি। তেমন কথাই কিছু কিছু বলি প্রথমে।
       
পুজোর ছুটির পরপরই বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা আগেই বলেছি। তবে পরীক্ষার সবটাই ভয়ের ছিল না আমার কাছে। পরীক্ষার পর নতুন শ্রেনীতে উঠে নতুন বই হাতে পাওয়ার আনন্দও থাকত মনের মাঝে। নতুন বই হাতে পেতে খুব আনন্দ হয় না ? আমার ত হত।
       
এখনকার মত তখন ডট পেন নিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার কথা ভাবাই যেত না, কেননা ঐ পেন তখন ছিলই না। সে সময় আমাদের দোয়াত কলম নিয়ে যেতে হত পরীক্ষার সময়। বিশেষ কায়দায় তৈরী একরকম দোয়াত পাওয়া যেত যাতে অল্প কালি রাখলে উলটে গেলেও দোয়াত থেকে কালি পড়ে যেত না। আর ছিল কাঠের কলম যার মাথায় থাকত ধাতব নিব।
       
বন্ধুরা একটা কচুর ডাঁটা নিয়ে তাতে কলমের নিবটা খচ খচ করে বারে বারে বেঁধাত। এতে নাকি কলম দ্রুত চলে। ওদের দেখাদেখি আমিও করতাম বটে তবে তেমন কিছুই বুঝিনি।
       
পরীক্ষা হয়ে গেলে আসত মজা করার দিন। একে শীতকাল তায় লম্বা ছুটি, মজা হবে কিনা তোমরাই বল। এরপর  একসময় আসত ফল প্রকাশের দিন। কি কি পরীক্ষা হত বা কত নম্বর পেতাম সেসব এতদিন পরে মনে নেই। তবে নম্বর লেখা কাগজটার সাথে থাকত কতকগুলো নতুন নতুন বই। বড়মাস্টারমশাই দিতেন নতুন শ্রেণীর পাঠ্য হিসেবে।  কি দারুন ব্যাপার বল ত!

বিশেষকরে  বাংলা বইটা যে কি ভাল লাগত তা বলার নয়।কেন বল দেখি ?নতুন নতুন গল্প কবিতা থাকত বইটা ভর্তি। একদিনের মধ্যেই সব পড়া হয়ে যেত সেসব। তবে কবিতা গুলো মুখস্থ হতে চাইত না সহজে। বার বার পড়ে পড়ে যখন কণ্ঠস্থ হয়ে যেত সে সব আর সহজে ভুল হত না।
       
সেই সব কবিতার কিছু কিছু শুনবে ? অল্প সল্প মনে আছে এখনও, যেমন
          'এক যে ছিল দুষ্টু ছেলে নামটি তাহার ননে,
          পাখির ছানা পাড়তে সদা ঘুরত বনে বনে।
          একদিন সে উঠল গাছে পাড়তে ঘুঘুর ছানা,
          শাবক নিয়ে নামছিল সে বলে তাধিন তানা।
           এমন সময় দেখল সে এক কেউটে ভয়ংকর,---'  
এর পর আরও অনেকটা, বেশ বড় কবিতা। এছাড়া ছিল, 'আমাদের ছোট নদী চলে আঁকেবাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে' বা 'মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচিনাচি-' ।আরও কত কি!
      
পৌষপার্বনটা যে কি সেটা আর বলে দিতে হবে না বোধ হয়। এটা যে পিঠে খাবার উতসব সেটা সবাই জানে। পৌষ মাসের শেষ তারিখে বা সংক্রান্তিতে হয়। সেই জন্য পৌষসংক্রান্তিও বলে একে।
      
নানা রকম পিঠে পুলি আর পায়েস খাবার দিন এটা। চালের গুঁড়ো, দুধ, নারকেল,ডাল-- এসব দিয়ে তৈরী হত নানা রকমের সুখাদ্য। শহরের মত এসব জিনিষ বাজার থেকে কেনা হত না।
      
চাল গুঁড়ো করা হত ঢেঁকিতে। দিয়ানি, মামিমা মাসিমারা করতেন। সবার বাড়িতে ঢেঁকি ছিল না, তাই অন্যান্য বাড়ির মহিলারাও আসতেন চাল গুঁড়োতে। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সাহায্য করতেন। ঢেঁকি দেখেছ ? না দেখে থাকলে দেখার
জন্য গ্রামে যেতে হবে। দেখে এস, মজা পাবে।
      
বাড়ির গরু দুইয়ে দুধ পাওয়া যেত। বেশী দরকার হলে বাজার থেকে কেনা হত। একবার মনে আছে-- এক কলসী দুধ বড়মামা ১৪ পয়সায় অর্থাৎ সাড়ে তিন আনায় কিনেছিলেন। তাতে দাদুর কাছে খুব বকুনি খেয়েছিলেন ঠকে আসার জন্য। দাদুর ধারনা ছিল ঐ দুধ অন্ততঃ দশ বা বার পয়সায় পাওয়া যেত। গাছে উঠতে ওস্তাদ সোনামামা আর ফুলমামা গাছে উঠতেন নারকেল পাড়ার জন্য।
       
আর একটা কাজ হত, বেশ মজার। পৌষপার্বনের আগের দিন সকালে দিয়ানি লোক লাগিয়ে সারা উঠোন ঝাঁট দিয়ে গোবরজল দিয়ে লেপেপুঁছে তকতকে করে রাখতেন। সংক্রান্তির দিন সকালে দাদু সেই উঠোনে কাঠ কয়লা দিয়ে হাতি ঘোড়া,গরু- এসব জন্তু জানোয়ারের ছবি এঁকে দিতেন। এর ওপর চালগুঁড়ো জলে গুলে রং-এর মত তৈরী করে বুলিয়ে দেওয়া হত। হয়ে যেত আলপনার জীবজন্তু। জ্যোতস্না রাতে সে সব দারুন সুন্দর দেখাত। যে জন্য এত সব করা,সেটা হত সবার শেষে। অর্থাৎ পেট পুরে পিঠে খাওয়া।
       
পরীক্ষা, পৌষপার্বন-- এসব যেতে যেতেই এসে পড়ত সরস্বতীপূজো। এ সম্পর্কে আগে বলেছি, মনে আছে তো ? তখন অবশ্য একটা কথা বলা হয়নি। একবার ছোটমামারা ঐ সময় নাটক করেছিলেন। এখন নাটকে কত রকমের সেট ইত্যাদি তৈরী হয়। তখন গ্রামে ওসব আর কোথায় পাওয়া যাবে! মঞ্চের পেছন দিকে কয়েক রকমের ছবি আঁকা  স্ক্রীন গোটান অবস্থায় থাকত। নাটকের প্রয়োজন মত সেই পর্দাগুলো দেখাবার ব্যবস্থা করা হত, যেমন, শহর বোঝাবার জন্য শহরের ছবিওয়ালা পর্দা, গ্রাম বোঝাতে সেখানকার ছবি-এই রকম আর কি। নাটকের সময় গ্রীনরুমে উঁকি মারতে গিয়ে বড়দের ধমক আর ছোটমামার কানমলা খেতে হয়েছিল।

ফুলমামাদের দল একবার একটা নাটক করেছিলেন, যার নাম ছিল 'টিপু সুলতান', আর এতে ফুলমামা সেজেছিলেন একজন সাহেব। তাঁর চেহারা ছিল দেখবার মত। দারুন মানিয়েছিল সাহেবের বেশে।
       
সরস্বতী পুজো কাটতে না কাটতেই চারিদিকের আবহাওয়া কেমন যেন বদলে যেত। এই সময় আমের মুকুল, কাঁঠালের মুচি, লেবু আর সজনে ফুলের গন্ধে চারিদিক ম' ম' করত। কি সুন্দর যে লাগত!
       
সাধারনত পুর্ববাংলায় পলাশফুল দেখা যায় না। লালমাটির দেশের গাছ ও দেশে হতে চায় না। কিন্তু কি করে জানি একটা পলাশ গাছ মামাদের বাগানে হয়ে গেছিল আর সেটা ছিলও বেশ উঁচু, অন্য সব গাছের মাথা ছাড়িয়ে গেছিল সেটা। অনেক দূর থেকে দেখা যেত।
       
পাবনার বাড়ি থেকে যখন মামার বাড়ি আসতাম তখন অনেকটা পথ গরুর গাড়ীতে আসতে হত। ঐ সময় লক্ষ্য রাখতাম পলাশ গাছটার দিকে। অনেক দূর থেকে সেটা দেখতে পেলেই মনটা নেচে উঠত মামার বাড়ি আর দিয়ানির
আদরের কথা ভেবে।
        
ভাল কথা, গরুর গাড়ি চড়েছ কখনো ? মোটেই ভাল লাগত না চাপতে। কিন্তু কি আর করা যাবে বল, তখন  ত' এখনকার মত নানা ধরনের যানবাহন ছিল না। অনেকদিন আগেকার কথা কিনা! তাই ভাল না লাগলেও চাপতেই হত। নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা পাবার জন্য সুযোগ পেলে একবার চেপে দেখতে পার।  মজা  পেতেও পার।
        
পলাশ গাছের কথা বলছিলাম। মাঘমাসে সরস্বতী পুজোর সময়েই শুরু হত ফুল ফোটা। গাছে থাকত আরও একদেড় মাস। পলাশফুলের মধু খেতে সমস্ত দিনই পাখীরা কিচির মিচির করত। রাতে বাদুর বা অন্য কোন রাতজাগা পাখী আসত। তাই সকালে গাছের তলায় অনেক ফুল পড়ে থাকত। মাঘের হাড়কাঁপানো শীতের সকালে সেই ফুল কুড়োতাম।

 

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।