সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
পেলে

যাদের ফুটবল আর আই এস এল নিয়ে উৎসাহ আছে, বা যাদের নেই, তারা মোটামুটি সবাই এতদিনে জেনে গেছে যে ফুটবলের সম্রাট পেলে কলকাতায় আসছেন। যদ্দিনে এই লেখাটা ইচ্ছামতীতে প্রকাশিত হবে, ততদিনে পেলে সম্ভবতঃ কলকাতায় দ্বিতীয় আইএস এল এর ম্যাচ দেখে ফিরেও চলে গেছেন। তাই পেলের সম্পর্কে যা যা জানা সম্ভব সবই প্রায় সবাই এদ্দিনে জেনে গেছে।

কিন্তু তাও খেলাধুলো নিয়ে আড্ডা তো আর থামানো যায়না। আর পেলেকে নিয়ে আড্ডাও কম জমাটি হবে না। কেননা জগতে অত বড় ফুটবল খেলোয়াড় আর কেউ নেই বলে থাকেন ফুটবল বিশেষজ্ঞেরা। তবে নানা মুনির নানা মত কিনা, কেউ কেউ আবার এটা মানতে চান না। না চাক গে, তাদের কথা তারা ভাবুক! আমরা জগতের সেরা খেলোয়াড় বলেই ধরব।

পেলের জীবনের গল্পও আসলে আরেকটি 'হিরো'স জার্নি' । গরীব ঘরে জন্মে, শুধুমাত্র প্রতিভা, নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের জোরে হয়ে পেলে হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর সেরা ফুটবল্ খেলোয়াড়। ভালবেসে মানুষ নাম দিয়েছিল ' ব্ল্যাক পার্ল'; কেউ কেউ বলত রাজা- 'দ্য কিং'। বিজ্ঞানী টমাস এডিসনের নামে বাবা-মা ছেলের নাম দিয়েছিলে এডসন। সেই নামের বদলে কিভাবে এই মানুষটা 'পেলে' নামে বিখ্যাত হয়ে গেলেন, সে এক মজার গল্প। সে বিষয়ে নিজেই একটু খুঁজে দেখ ইন্টারনেটে। টাইম পত্রিকা তাঁকে 'বিংশ শতাব্দীর প্রথম ২০ জন প্রভাবশালী মানুষদের মধ্যে একজন' বলে সম্মান জানিয়েছে। আর ইউনেস্কো তাঁকে 'বিশ্বনাগরিক' রূপে স্বীকৃতি দিয়েছে।

তিনি নিজের দেশকে ভালবেসে ডাকেন 'ত্রেস কোরাসোইস' ( পর্তুগীজ ভাষায় তিনটি হৃদয় ) । তিনি বলেন- যে দেশ আমার জন্মভূমি, যেখানে আমি বড় হয়েছি, আর যেখানে আমি ফুটবল খেলেছি, সেই দেশ আমাকে তিনটে হৃদয় ও দিয়েছে। এই তিনটে হৃদয়ের তত্বকে মাথায় রেখেই পেলের এই মূহুর্তে পেলে কর্মকান্ডের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে গরীব শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর খেলাধূলার দিকগুলিকে উন্নত করা।

জন্ম হয়ছিল সেই ১৯৪০ সালে, তার মানে এখন বয়স হয়েছে ৭৫ বছর। এই বয়সেও তিনি আসছেন আমাদের দেশে, সেই আমাদের বিপরীত গোলার্দ্ধ থেকে, মানে সেই ব্রাজিল থেকে! বিপরীত গোলার্দ্ধ বললাম কেন জান ত ? সে দেশের সাথে আমাদের দেশের সময়ের তফাৎ একেবারে কমবেশী ১২ ঘন্টার মত!

আই এস এল খেলা দেখতে আমন্ত্রন জানানো হয়েছে তাঁকে। তাই অত দূর থেকেও খেলা পাগল মানুষ খেলা দেখার ডাক অগ্রাহ্য করেন কি করে ? সুতরাং আসতেই হচ্ছে আমাদের দেশে, এ কলকাতাতেও আসছেন তিনি। ইতিমধ্যেই এ্যাটলেটিকো ডি কলকাতা দলের মালিকপক্ষের একজন, আমাদের প্রিয় সৌরভ গাঙ্গুলির পাঠানো দলের জার্সি পেলের কাছে পৌঁছে গেছে।

এর আগে আরও একবার তিনি কলকাতায় এসেছিলেন সেই ১৯৭৭ সালে। তখন তিনি তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন।পেলে সেই সময় এসেছিলেন আমাদের এখানকার নামী দল মোহনবাগান ক্লাবের আমন্ত্রনে।

সেটা ছিল সেপ্টেম্বর মাস। আমাদের এখানে কেমন বৃষ্টি হল বল সেপ্টেম্বরে ? এই অক্টোবরে এসেও মাঝেমধ্যেই হচ্ছে। তা সেপ্টেম্বরে তো মাঠ ভিজে থাকবেই। সেটাও ছিল সেই একই মাস। আর মাঠও ভিজে ছিল। সে সময় উনি নিউ ইয়র্কের কসমস ক্লাবে খেলছিলেন, সেই দলই এখানে এসেছিল মোহনবাগানের সাথে প্রদর্শনী খেলা খেলতে। সেখানকার মাঠ তো আর এখানকার মত ভিজে নয়, খটখটে শুকনো। ভিজে মাঠে পিছলে পড়ে গিয়ে আঘাত লাগলে তখন খুব ঝামেলায় পড়ে যাবেন তিনি। তাই অনেক ভেবে চিন্তে অল্প সময়ের জন্য খেলতে নেমেছিলেন তিনি। তার মধ্যেই নিজের বৈশিষ্ট দেখিয়েছিলেন! তবে এবার খেলোয়াড় হিসেবে নয় দর্শক হিসেবে আসবেন তিনি।

পেলেকে নিয়ে ফুটবল পাগল বাঙালির মাতামাতি কি শুধুই খেলার মাঠে আর খবরের কাগজের খেলার পাতায়, বা টিভির পর্দায়? মোটেও না। ১৯৭১ সালে 'সাউন্ড অফ মিউজিক'- এর আদলে তৈরি হয় একটি বাংলা ছবি - 'জয়জয়ন্তী' ; সেই ছবিতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য একটি গানের মধ্যেও রয়েছে পেলের নাম ! - 'সবচেয়ে নাম কার ফুটবলে?--- ব্রাজিলের পেলে !'

জুলে রিমে কাপের (Jules Rimet Cup) নাম শুনেছ। সে সময়কার ফিফা(বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা) প্রেসিডেন্ট ছিলেন জুলে রিমে। এঁর নাম অনুসারেই এই কাপটার নাম হয়েছিল। এটাই বিশ্বকাপ ছিল একদা, বিজয়ী দলকে এই কাপটাই পুরস্কার দেওয়া হত। এটা ছিল রুপোর ওপর সোনার প্রলেপ দেওয়া,পরীর মত পাখাওয়ালা মুর্তি। এই জন্য একে বলা হত "সোনার পরী", আর এটাই ছিল "ফিফা কাপ" বা "বিশ্বকাপ"। ১৯৩০ সালে যখন বিশ্বকাপ শুরু হয় তখন ঠিক হয় যে দেশ প্রথম তিন বার এই ট্রোফিটা জিততে পারবে এটা সে দেশের নিজস্ব হয়ে যাবে। ব্রাজিল দল প্রথম বার এই কাপটা তিন বার জেতেন আর কাপটা নিজেদের দেশের সম্পত্তি করে নেন! ১৯৫৮, ১৯৬২ আর ১৯৭০- এই তিন বছর ওঁরা চ্যম্পিয়ন হন। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা প্রতি বছরই পেলে খেলেছিলেন! তাহলে কেন বলা হবে না যে কাপটা পেলেই জিতেছিলেন নিজের দেশের জন্য!

১৯৬৬ তেই জিততে চেয়েছিলেন ওঁরা, কিন্তু খেলার মাঠে প্রায় প্রতি খেলায় পেলেকে ইচ্ছে করে এমন ভাবে ফাউল করা হত যে উনি নিজের খেলাটা কোন ম্যাচেই খেলতে পারেন নি। শেষ পর্যন্ত তিনি সে বছর খেলা ছেড়ে বসে থাকতে বাধ্য হন! এতে কোন কোন দেশের নামে দোষারোপ করা হলেও সাজা দেওয়া হয় নি।

পরের বার, ১৯৭০-এ অবশ্য তিনি স্বমহিমায় খেলেন এবং কাপটা নিজের দেশের জন্য জিতেও নেন! আর সেই জুলে রিমে কাপটা নিজেদের দেশের করে নেন! তখন ফিফার কর্মকর্তারা চিন্তায় পড়েন পরের বার যে জিতবে তাকে কি দেওয়া হবে ? তখন অনেক ভেবে এখন যে কাপটা দেখতে পাও সেটা বানানো হয়। বিজয়ী দল নিয়ে যায় বটে তবে ফেরত দিতে হয় পরের বার বিজয়ী দলকে দেবার জন্য। এটাও সোনার,কিন্তু ভেতরে কোন রুপো নেই সবটাই সোনার। তবে কাপটা কিন্তু নিরেট নয়, ফাঁপা! সোনা ত খুব ভারি ধাতু, তাই নিরেট হলে এর ওজন প্রায় সত্তর/আশি কেজি হয়ে যেত ! আর চ্যম্পিয়ন হওয়ার পর জয়ী দলের ক্যাপ্টেন কাপটা যে উঁচু করে ধরেন, সেটাও করতে পারতেন না! কি বিপদ হত বল দেখি, জয়ী দলের অধিনায়কের কাপটা উঁচু করে ধরাটাই যে নিয়ম! হ্যাঁ, সত্যি করেই নিয়ম এটা!

ইউটিউবে খুঁজে দেখো, পেলের খেলার পুরনো রেকর্ডিং দেখতে পাবে। কেন সবাই ওঁকে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় বলে মেনে নিয়েছেন সেটা বুঝতে পারবে! ওঁর খেলা ত এখন সরাসরি দেখা সম্ভব নয়, তাই ইন্টারনেটেই দেখে নিতে হবে। এছাড়া আর কিই বা করা যাবে! দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাকে বলে!

পেলে
অ্যাণ্ডি ওয়ারহোলে্র সৃষ্টি পেলে

পেলের ৭৫ তম জন্মদিন পালন করা হচ্ছে বিশ্বের নানা জায়গায়। তার মধ্যে লন্ডনের হ্যালসিওন গ্যালারিতে 'আর্ট, লাইফ, ফুটবল' নামে এক প্রদর্শনী চলছে এক মাস ধরে; গত ২৬শে সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে এই প্রদর্শনী, চলবে ১৮ই অক্টোবর পর্যন্ত। এই প্রদর্শনীতে রয়েছে পেলের গৌরবময় জীবনের নানা অধ্যায়কে মনে রেখে তৈরি করা নানা ভাষ্কর্য এবং ছবি। প্রদর্শনীতে রয়েছে পেলের নিজের হাতে আঁকা ছবিও।

গত শতাব্দীর বিখ্যাত 'পপ আর্ট' শিল্পী অ্যাণ্ডি ওয়ারহোল একবার দশজন বিখ্যাত খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি করেছিলেন তাঁর নিজস্ব ঘরানায় 'অ্যাথলিট্‌স' সিরিজ। সেই সিরিজে ছিল পেলের একটি ছবিও। অ্যান্ডি ওয়ারহোল নাকি বলেছিলেন, অন্যান্য সবাই অন্তত ১৫ মিনিটের জন্য বিখ্যাত হবেন; কিন্তু পেলে বিখ্যাত হয়ে থাকবেন অন্তত ১৫টা শতাব্দী জুড়ে। খুব একটা ভুল হয়ত তিনি বলেন নি।

আর তাঁর পঁচাত্তরতম জন্মদিন পালিন করা নিয়ে পৃথিবীজুড়ে এত হইচই করা দেখে পেলে নিজে কি বলছেন? তিনি জানাচ্ছেন - ত্রিশ বছর আগে খেলা ছেড়েছি ঠিকই, কিন্তু আমার দায়িত্ব তো আরো বেড়ে গেল; নতুন প্রজন্ম আমার কথা জানতে পারছে, এতে আমি গর্বিত বোধ করছি; আমিও তাদের কে সঠিক পরামর্শই দিতে চাই।

পেলেকে আরেকটু কাছাকাছি জানতে চাইলে দেখতে পার তাঁর নিজস্ব ওয়েবসাইট


ছবিঃ বিভিন্ন ওয়েবসাইট

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা