খেলাঘরখেলাঘর

সমুদ্রের জল আর বৃষ্টির জল

 

তুমি কি ঋককে  চেনো ? চেনোনা। কি করে চিনবে ? তোমার সাথে ত আর আলাপ নেই।

আসলে ও আমার এক ছোট্ট এক বন্ধু। তার মনে নানা প্রশ্ন, তার অনেকগুলোই শুনলে চমকে উঠবে তোমরাও। কেমন উদ্ভট উদ্ভট প্রশ্ন তা শোন, যেমন, একটা বাসের সংগে একটা বাঘের লড়াই হলে কে জিতবে, অথবা একটা লরির সাথে যদি শূওরের লড়াই হয় তাহলেই বা কে জিতবে--এমনি সব প্রশ্ন।

তুমিই বল এমন সব কথার কোন উত্তর হয় ?

কিন্তু সেই ঋকই একদিন ধাঁ করে জিজ্ঞেস করে বসলো, সেদিন যে বললে সমুদ্রের জল বাষ্প হয়ে মেঘ হয় আর সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়, তাহলে সমুদ্রের জল নোনতা হলে বৃষ্টির জল নোনতা নয় কেন ?

এ প্রশ্নটা কি  উড়িয়ে দেবার মত ? মোটেই নয়। তাই এড়িয়ে যাওয়া গেল না।

যতই বলি, এখন সময় নেই, পরে বলব ততই চেপে ধরে। এখনই শোনা চাইই চাই তার। অগত্যা কি আর করা।

তোমারও শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে ত ? ঠিক আছে। কিন্তু তাহলে ত আবার সেই রান্না ঘরে গিয়েই ঢুকতে হয়। কি রাজি ? এর আগেও ত অনেকবার গিয়েছি সেখানে, তাই না ? চল আর একবার যাই।

এবার মাকে বলে কয়ে একটা সসপ্যান নিয়ে নাও,আর এর মধ্যে অর্দ্ধেকের মত  জল নাও। বড় এক চামচের মত নুন (লবন) ঐ জলে নিয়ে ভাল করে মেশাও যাতে সবটা মিশে যায়। একটু চেখে দেখ, জলটা নোনতা লাগবে।

এবার মা'কে বল গ্যাসের উনুন জ্বালিয়ে তাতে নুনজলটা চাপিয়ে দিতে। প্রথমে শোঁশোঁ আওয়াজ উঠবে, তারপর জলটা বুরবুর করে, শেষে টগবগ করে  ফুটতে থাকবে। এই সময় দেখবে জল থেকে খুব ধোঁয়া উঠছে। ঠিক বললাম ? উঁহু , ভুল হল। কেন বলত ? নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার যে জল থেকে যে ধোঁয়া ওঠে আসলে তা ধোঁয়া নয়, সেটা জলীয়বাষ্প।  ফুটন্ত জল থেকেই ঐ বাষ্প উঠছে। এ প্রসঙ্গে আগে বলেছি।  তাইত ? না কি ?

এবার একটা কাজ করলে একটা কান্ড দেখতে পাবে। একখানা স্টিলের বড় থালা সাঁড়াশী দিয়ে ধরে সসপ্যানের ওপর এমন ভাবে ধর যাতে থালাটার একদিক একটু কাত হয়ে থাকে আর বাষ্প সরাসরি উঠে থালার গায়ে লাগে। নিজে না করাই ভাল, বরং মা'কেই একটু ধরে থাকতে বল।

কি দেখতে পাবে বলত ? প্রথমে থালার বাষ্প লাগা দিকটা ঘোলাটে হয়ে যাবে, তার পর বিন্দু বিন্দু জল জমতে শুরু করবে। কেননা থালাটা বাষ্পের তুলনায় ঠান্ডা, তাই গরম বাষ্প ঠান্ডার পরশে জলবিন্দুতে পরিণত হবে। এইভাবে বেশ কিছুটা জল জমলে জলবিন্দু গুলো বড় বড় ফোঁটার আকারে থালার গা যেদিকে কাত করা আছে সেদিক বেয়ে নীচে পড়তে থাকবে।

একটা পরিষ্কার বাটিতে এই জল সংগ্রহ কর। এবার একটু জল  চেখে দেখত নোনতা কিনা ! কি ? নোনতা লাগছে ? মোটেই না। একদম সাধারন জলের মত !           সসপ্যানের জলটাও এখন একবার চাখ, দেখবে সেই নোনতাই রয়েছে।

ব্যাপারটা কি হল তাহলে ? একই জল ছিল ত! একবার নোনতা, আর একবার সাধারন জল--এটা কি রকম হল!

কি হল আসলে সেটা বলি। যখন নূনজলে তাপ দেওয়া হল আর সেটা ফুটতে শুরু করল তখন তা থেকে তাপ পেয়ে শুধু জলই বাষ্প হয়ে ওপরে উঠে গেল আর জলবিন্দুর আকারে থালাতে জমতে শুরু করল, তারপর বাটিতে জমল। নূন ত আর বাষ্প হয় নি, তাই সেটা সসপ্যানের জলেই থেকে গেল। সুতরাং বাটির জল সাধারন জলের মত হবে নাতো কি ! এখানে একটা কথা বলে রাখি। জলে নূন না মিশিয়ে চিনি মেশালেও একই ব্যাপার হত। নীল রঙের তুঁতে মিশিয়ে দিলেও একই ফল হবে, বাটিতে সংগ্রহ করা জল কিন্তু নীল না হয়ে সাধারন জলের মতই হবে। এই ধরনের ঘটনাকে বলে 'পাতন' প্রক্রিয়া। দূষিত জলকে এই পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ করা হয়। অসুখ হলে ইঞ্জেকশন দেবার সময় এই
জল ব্যাবহার করা হয়, ইংরাজীতে এর নাম distilled water বা পাতিত জল। এই পাতন করার জন্য অবশ্য আমি যে ভাবে বললাম তেমন করে হয় না, এর জন্য আলাদা যন্ত্র ব্যবহার করা হয় যার নাম 'পাতনযন্ত্র'।

এখন ঋকের প্রশ্নের উত্তর কি হতে পারে বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই।
সূর্যের তাপে সমুদ্রের নোনা জল থেকে জলটা বাষ্পিভুত হয়ে সোজা ওপরে উঠে যায়, আর ওপরের ঠান্ডা আবহাওয়ায় সেই বাষ্প জমে জল হয়ে মেঘের আকারে জমা হয়।

এই জমা জল থেকেই না বৃষ্টি হয়! তাহলে আর বৃষ্টির জল নোনতা হবে কি করে, তোমরাই বল।

বৃষ্টির জল হয়ে গেল সাধারন জলের মত আর নূনটা পড়ে থাকল সমুদ্রের জলে। বৃষ্টির জলকে সাধারন জল বললাম বটে, ও জল কিন্তু একদমই সাধারন নয়, একেবারে বিশুদ্ধতম জল। এই জল নিশ্চিন্তে পান করা চলে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে। বৃষ্টি শুরু হলেই এই জল সংগ্রহ করা চলবে না, একটু পরে করতে হবে, কেননা প্রথমদিকের জলে বাতাসের ধুলোময়লা মিশে যেতে পারে। তাতে জল দূষিত হয়ে পড়বে।

তুমি বড় হয়ে যখন রসায়নের (chemistry) বই পড়বে তখন এ বিষয়ে আরও অনেককিছু জানতে পারবে।

দেখ, ঋকের সাথে সাথে তুমিও অনেক কিছু শিখে গেলে!

তাহলে ঋক যা বলে সবটাই উদ্ভট নয়।
কিছু জানতে হলে তুমিও প্রশ্ন করতে পার, সাধ্যমত উত্তর দেবার চেষ্টা করব, কেমন ?

সন্তোষ কুমার রায়
কোদালিয়া, কলকাতা








সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।